Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ছায়াতরণী

ছায়াতরণী -- মধুময় পাল

মধুময় পাল

 

সানে বান্ধা পুষ্করিণী গলায় গলায় জল৷
পাইক্যা আইছে শাইলের ধান সোনার ফসল৷
তা দিয়া কুটিয়া খাইয়াম শালি ধানের চিড়া৷
এই দেশ ছাইড়ো না ভাই রোমার মাথার কিরা৷

–মহুয়া, ময়মনসিংহ গীতিকা

সোনার তরীতে এসেছি আমরা৷ যে তরী দেখা যাচ্ছে না. ছোঁয়া যাচ্ছে মনে৷ অনুভবে আসছে তার গলুই, পাটাতন, ছই, এমনকী নাভিমূলে লেগে থাকা জলের মাতৃআদর৷ আমরা এই মুহূর্তে একজন আর-একজন থেকে ভৌগোলিক দূরে৷ ফিজিকাল ডিসটান্স৷ কিন্তু আছি খুব কাছাকাছি, একটি তরীর করতলে৷ সামাজিক দূরত্ব নেই৷ আজ তিরিশে বৈশাখ৷ রবীন্দ্র জন্মদিন পেরিয়ে এসেছি চারদিন আগে৷ কেন এই দেরি? ভয়ঙ্কর ভাইরাস দূরে দূরে করে দিচ্ছে আমাদের৷ ইতালি থেকে আরও দূরে সরে গেছে স্পেন৷ স্পেন থেকে রাশিয়া৷ ইয়োরোপ থেকে এশিয়া৷ আপনি থেকে আমি৷ আমি থেকে আমি৷ আপনি থেকে আপনি৷ আমরা আর কখনও এভাবে পরস্পর থেকে দূরে সরে গেছি কিনা জানা নেই৷ এভাবে পরস্পরকে সন্দেহ করেছি কিনা জানা মেই৷ এই পরিস্থিতিতে সোনার তরীর ভাব-পাটাতনে উদযাপন করতে এসেছি পঁচিশে৷ এই সোনার তরী নেট-এর নির্মাণ৷ যখন তখন ভেঙে য়েতে পারে সংযোগ৷ হারিয়ে যেতে পারে কারও মুখ, কারও কথা, কারও গান৷ একজনের ডাকে অন্য কারও সাড়া নাও মিলতে পারে৷ এই সব সমস্যা মেনে নিয়ে নৌকোতেই থাকব৷ আমি রণধীর৷ এবার বলবেন সুগতদা৷

সুগত নমস্কার করে৷ রণধীর যা বললেন, এরপর আমার বিশেষ বলার নেই৷ রবীন্দ্রনাথ আমাদের শেষ আলোকবন্দর৷ তাঁকে নিয়ে জলসা নয়, ফাংশন নয়৷ তাঁর গানের সুরে র‍্যাম্পে হাঁটা নয়৷ উলাল্লা উলাল্লা জুড়ে বর্বর নাচ নয়৷ একগাদা মিউজিকের মধ্যে ঠোঁট নাড়া নয়৷ পূজা পর্যায়ের গানে যৌন আবেদন ঢুকিয়ে দেওয়া নয়৷ য়েমন এখন নামী শিল্পীরা কর থাকেন৷ পাবলিক খায় বলে৷ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বটতলায় হাঁটা নয়৷ রবীন্দ্রনাথের নামে কচুরির দোকান খোলা নয়৷ সবই ভাইরাস৷ ক্রোনার চেয়ে ভয়ঙ্কর৷ আমরা ছ-জন এখানে আছি তাঁর গান, কথা নিয়ে ভাইরাস-আক্রান্ত এই সময়ে আমাদের মতো চর্চা করব বলে৷ পাবলিককে খুশি করার দায় নেই৷ একটা কথা বলি, রণধীর আজকের অনুষ্ঠানকে বলেছেন ‘সোনার তরী’৷ খুব সুন্দর৷ যথার্থ৷ তবু বিকল্প একটা বলি৷ ‘ছায়াতরণী’৷ হঠাৎ মনে এল৷ আমরা তো ছায়াতরণীতেই আছি৷ তাই না? রবীন্দ্রনাথের ছায়া৷ তাঁর গানের, কথার৷ আমাদের বোধের অনুভবের ছায়াও৷ যদি আপত্তি না থাকে আপনাদের৷

রণধীর বলে, আরও সুন্দর।

সবাই সম্মতি জানায়৷

সুগত বলে, সোনার তরী ঠিক করেছিলাম আমরা৷ আমি আর রণধীর যৌথভাবে৷ শুরুতেই স্প্লিট হয়ে গেল৷ তরী আমার হঠাৎ ভেঙে যায়৷ আমারই চক্রান্ত৷

সবাই হেসে ওঠে৷

কনকদি প্রণাম নেবেন৷ আপনি শুরু করুন আমাদের তরী বাওয়া৷

তানপুরা বাজে৷ কনক বলেন, এরকম আয়োজনে গান গাইতে হবে কখনও ভাবিনি৷ শান্তিনিকেতনে সবাই মিলে গেয়েছি৷ এখন সবাই না-মিলে গাওয়া৷ কী দিন এল! সুগত আর রণধীর যেদিন প্রস্তাব দিল, সরাসরি না বলে দিয়েছিলাম৷ ওসব আমার দ্বারা হবে না৷ গান গাইতে হলে সামনে দু-চারজন মানুষ তো লাগে৷ আমি কাউকে দেখতে পাব না অথচ লোকজন শুনছে বলে গেয়ে যাব এটা কী করে হয়? নাতনি বিশাখা বলল, হয়৷ ওঁদের জানিয়ে দাও তুমি গাইবে৷ ওকে আপনারা দেখতে পাচ্ছেন না৷ আমাকে দেখাবে বলে ও আড়ালে৷ টেবিলে ক্যামেরাওলা ফোন বসিয়ে নিজে তানপুরায়৷ গোটাদেশ আজ ঘরবন্দি৷ মানুষের কাজকর্ম নেই৷ খাবে কী? বাঁচবে কীভাবে? এটা রাজনীতির খেলা মনে হয়৷ মানুষকে শেষ করে দেওয়ার রাজনীতি৷ এদেশের নেতারা যদি দেশটাকে একটু ভালোবাসত, দেশের মানুষকে একটু ভালোবাসত, এত খারাপ হাল হত না৷ এরা দেশের জন্য ভাবে না৷ খালি নিজের কথা আর নিজের লোকের কথা আর পার্টির কথা৷ যখন ভাবি, একটা মানুষ আমাদের মধ্যে জন্মেছিলেন, মহামানব, সারাজীবন দেশের কথা ভেবে গেলেন, এখন তাঁকে নিয়ে রসিকতা করি, এ লজ্জা কোথায় রাখি! এসব বললে পুলিশে ধরবে, এমন দিন দূরে নেই৷ রণধীর, সুগত জলসার গান গাইতে বারণ করেছে৷ মানে চিনি গো চিনি তোমারে, সখী ভালোবাসা কারে কয় এ ধরনের গান৷ সত্যিই, অনেক হয়েছে৷ তো আমি গাইছি, আবার যদি ইচ্ছা করো আবার আসি ফিরে৷

সবাই খুশি৷ তারা নির্বাচনের প্রশংসা করে৷

–দিশা, আমাকে দেখা যাচ্ছে?

–খুব। খুব৷ তুমি নিশ্চিন্তে গাও৷ এক তরুণীর কণ্ঠস্বর শোনা যায়৷

কনক গান শুরু করেন৷ আবার যদি ইচ্ছা করো আবার আসি ফিরে/ দুঃখসুখের ঢেউ-খেলানো এই সাগরের তীরে৷ পদদুটো দু-বার গেয়ে থামলেন৷ বললেন, রবীন্দ্রনাথ যখন এই গান লেখেন, তাঁর বয়স ৫৩৷ বিশ্বযুদ্ধ চলছে৷ শুরু হয়েছে দু-মাস আগে৷ মন্দিরে ভাষণ দিয়েছেন কবি৷ মা মা হিসীঃ৷ হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি বিশ্বসেরা হতে বেপরোয়া৷ রবীন্দ্রনাথ গয়া, বুদ্ধগয়া, বরাকর পাহাড়ে গেলেনে৷ অশান্ত মনকে শান্ত করতে৷ বুদ্ধগয়ায় লিখলেন, আবার যদি ইচ্ছা করো আবার আসি ফিরে৷ কেউ এই গানে পেয়েছেন আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া. কেউ বলেছেন, সুখ-দুঃখের ধরণীকে দেখে কবির পুরনো প্রেম নতুন করে জাগল৷

কনক গানে ফেরেন৷ আবার জলে ভাসাই ভেলা ধুলার পরে করি খেলা গো/ হাসির মায়ামৃগীর পিছে ভাসি নয়ননীরে৷ কথাগুলো বারবার কান পেতে শুনতে হয়৷ কবি কাঁদছেন৷

কিছুক্ষণ নির্বাক কনক। তানপুরা বেজে যায়৷ কনক আবার ধরেন৷ এবার টানা গেয়ে শেষ করেন৷ নূতন প্রেমে ভালোবাসি আবার ধরণীরে৷

কনক থামেন৷

সবাই মুগ্ধ৷

–রণধীর, আরও দু-একটা কথা বলতে পারি কি? এই গান নিয়ে৷ কনক বলেন৷

রণধীর বলে, নিশ্চয়৷ বলুন৷

কনক বলেন, শান্তিদেব ঘোষের স্মৃতিচারণ মনে পড়ছে৷ কবির বয়স তখন ৬০৷ শান্তিনিকেতনে পঁচিশে বৈশাখ হবে৷ শান্তিদেব কবির কাছে গিয়েছেন গান ঠিক করতে৷ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবার যদি ইচ্ছে করো আবার আসি ফিরে’ গাইব কি? রবীন্দ্রনাথ উত্তরে বলেন, আমার জন্মদিনের গান আমি বেছে দেব কেন? তুই বেছে নে৷ এরপর অভিমান-মেশানো গলায় বললেন, আমি যখন চলে যাব, তখন বুঝবে দেশের জন্য কী করেছি৷ খানিকক্ষণ নীরব থেকে কবি গেয়ে উঠেছিলেন, সার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে৷ এই গানটা পরে গাইব৷ দম নিয়ে নিই৷ বয়স তো অনেক হল৷

সুগত বলে, কনকদি, বিশ্রাম নিন৷ য়ে উচ্চতায় বেঁধে দিলেন আজকের অনুষ্ঠান, চেষ্টা করব সেটা ধরে রাখতে৷ ’ছায়াতরণী’তে আছেন করবী মালিয়া৷ পড়তে ভালোবাসেন৷ তর্ক করতে ভালোবাসেন৷ গান শুনতে ভালোবাসেন৷ হয়তো গাইতেও৷ গাইবেন কি, করবী?

–আমি গাইবার চেষ্টা করলে সরকারি বাসের ইঞ্জিন বসে যায়৷ রেললাইনে সিগনাল নিভে যায়৷ কেবল লাইনে অন্ধকার নেমে আসে৷ সেব টেস্টেড৷ গসিপ নয়৷ বরমহাশয় বলে দিয়েছেন, যা-ই করো বা না-করো, গাইতে যেও না৷ নেট উড়ে যাবে৷

সবাই হাসে৷

সুগত বলে, দেখাই যাক, নেট কতটা ওড়ে৷

করবী বলে, না৷ কো-মর্বিডিটির গ্যাঁড়াকলে আমি নেই৷

আবার হাসি৷

রণধীর বলে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইমউিনিটি হয়তো বেড়েছে৷ পরীক্ষা প্রার্থনীয়৷।

করবী মালিয়ার ব্লক থেকে পুরুষকণ্ঠের জোরালো হাসি ভেসে আসে৷ শোনা যায়, ম্যাডাম আজ সারা দুপুর প্রবন্ধের ক্লাস করেছেন৷ সাবজেক্ট নিশানা রবীন্দ্রনাথ৷

ছবিতে না-থাকা ব্যক্তির দিকে তাকিয়ে করবী বলে, তোমাকে সুগতদারা ডাকেনি বলে রাগ হচ্ছে? বলো, তুমি বলো৷ এখানে এসো৷ নাকি মোবাইল ঘুরিয়ে দেবে? পালাচ্ছ কেন? পালিয়ে গেল৷ আমার বর৷ ভূতের রাজার এক বর৷ যাই হোক, যে-কথাটা বলতে চাই, নতুন কিছু নয়৷ তবু আবার বলা৷ মনে হয়, বলবার প্রয়োজন আছে৷ যে দূরত্বের সাধনা, যে বিচ্ছিন্নতার সাধনা আমরা করেছি, করে চলেছি, তারই হাত ধরে এসেছে আজকের ভাইরাস ও সোশাল ডিসটান্সিং৷ আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ জীবিতকালে বারবার আক্রান্ত হয়েছেন৷ আজও হন৷ কখনও পূজার ছলে, কখনও তুচ্ছতাচ্ছিল্যে৷ যারা আক্রমণ করে, তাদের মধ্যে আছে ভক্ত-পূজারী-পাণ্ডা, মুনাফাখোর-সিন্ডিকেট, আছে বিকারগ্রস্ত-কামুক-দালাল৷ এবং আরও যত মহাজন৷ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি রবীন্দ্রনাথের রচনাকে প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরের শক্তি বলে চিহ্নিত করেছিল৷ বলা হয়েছিল, প্রগতি শিবিরকে এগোতে হবে রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করে৷ তাঁর শেষ জীবনের নজিরটুকু তুলে ধরে তাঁকে গ্রহণ করলে সেটা হবে সুবিধাবাদ৷ একথা বলা হচ্ছে ১৯৪৯ সালে৷ আট বছর আগে প্রয়াত হয়েচেন রবীন্দ্রনাথ৷ ষাট বছর বয়সে অভিমানী গলায় শান্তিদেব ঘোষকে বলেছেন, আমি চলে গেলে বুঝবে দেশের জন্য কী করেছি৷ এর প্রায় তিন দশক পরেও বোঝা তো দূরের কথা, তাঁর কাজকে অস্বীকার করা হচ্ছে৷

করবী ডায়েরির পাতায় চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে বলে, রবীন্দ্রনাথ নাকি হিন্দু মহাসভা-আরএসএসের মতবাদের সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন৷ সাভারকারের দীক্ষাগুরু হয়ে উঠেছিলেন৷ রবীন্দ্রনাথের যে মন্তব্যের প্রেক্ষিতে কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিক নেতা এই সিদ্ধান্তে আসেন, সেটা একবার পড়ে নেওয়া যাক৷ ‘কালান্তর’ গ্রন্থের ‘সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, এক জায়গায় এই দুই পক্ষ অর্থাৎ হিন্দু ও মুসলমান, ক্ষণে ক্ষণে মেলবার চেষ্টা করে, সে হচ্ছে তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে৷ শিবঠাকুরের ছড়াটা যদি আজ সম্পূর্ণ পাওয়া যেত, তাহলে দেখা য়েত, ওই য়ে প্রথমা কন্যাটি রাঁধেন বাড়েন অথচ খেতে পান না, আর সেই যে তৃতীয়া কন্যাটি না খেয়ে বাপের বাড়ি যান, এদের উভয়ের মধ্যে একটা সন্ধি ছিল— সেটা হচ্ছে ওই মধ্যমা কন্যাটির বিরুদ্ধে৷ কিন্তু যেদিন মধ্যমা কন্যা বাপের বাড়ি চলে যেত সেদিন অবশিষ্ট দুই সতিন, এই দুই পোলিটিকাল অ্যালি-দের মধ্যে চুলোচুলি বেধে উঠত৷ রবী্ন্দ্রনাথ অবশিষ্ট দুই সতিন বলতে হিন্দু ও মুসলমানের কথা বলেছেন৷ মধ্যমা কন্যা হল ইংরেজ৷ ইংরেজের অনুপস্থিতিতে এই দুই সম্প্রদায় চুলোচুলি বাধায়৷ কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক নেতার সিদ্ধান্ত, রবীন্দ্রনাথরে এই মতটা তাঁকে গান্ধির চেয়েও প্রতিক্রিয়াশীল করে তুলেছে৷ একেবারে তাঁকে সাভারকারের দীক্ষাগুরুতে পৰিণত করেছে৷ কমিউনিস্ট নেতার এই সিদ্ধান্ত একটা ভাইরাস৷ রবীন্দ্রনাথকে ধ্বংস করার পোলিটিকাল ভাইরাস৷ জীবাণু অস্ত্রের চেয়ে যা অনেক বেশি সর্বনাশা৷

আমার বিনম্র প্রশ্ন, ইংরেজ চলে গেছে তিয়াত্তর বছর হল৷ দুই সতিনের চুলোচুলি বন্ধ হল কি? দেশভাগ করেও ঐক্যে আসা গেল কি? হাজার হাজার অসাম্প্রদায়িক নিবন্ধ ছেপে ও সেমিনার করে একটা, অন্তত একটা সেতু গড়া সম্ভব হল কি?

সত্যকে অস্বীকার করে, বাস্তবকে অস্বীকার করে রবীন্দ্র-বিরোধিতার এই ভাইরাস সেদিন পোলিটিকাল ল্যাবোরেটরিতে তৈরি হয়েছিল৷

‘সমস্যা’ নিবন্ধটি লেখা হয় ১৯২৩-এ৷ রবীন্দ্রনাথ তখন ৬২৷ হিন্দু-মুসলমানের অনৈক্যের সমস্যা দেখেছেন নিকট থেকে, মাটিতে পা রেখে, সমস্যার আগুনে বসে৷ তিনি লেখেন, হিন্দু নিজেকে ধর্মপ্রাণ বলে পরিচয় দেয়, মুসলমানও তাই দেয়৷ অর্থাৎ ধর্মের বাইরে উভয়েরই জীবনের অতি অল্প অংশই অবশিষ্ট থাকে৷ এই কারণেই এরা নিজ নিজ ধর্ম দ্বারাই পরস্পরকে ও জগতের অন্য সকলকে যথাসম্ভব দূরে ঠেকিয়ে রাখে৷ এতে করে সকল মানুষের সঙ্গে সত্যযোগে মনুষ্যত্বের যে প্রসার হয় তা এদের মধ্যে বাধাগ্রস্ত হয়েছে৷

পোলিটিকাল ভাইরাস মনুষ্যত্বের প্রসারকে সেদিন সংক্রমিত করেছে৷

১৮৯৪ সালে, রবীন্দ্রনাথ তখন ৩৩ বছরের যুবক, লিখেছিলেন ‘নতুন হিন্দুয়ানির দাপট’৷ এই দাপট কীভাবে দুই সম্প্রদায়কে আরও বিচ্ছিন্ন ও বিদ্বেষপ্রবণ করে তোলে, তিনি ব্যাখ্যা করেছেন। তবু তাঁকে বলা হবে সাভারকারের দীক্ষাগুরু!

এই ভাইরাস ক্রমে মিউটেট করে আজ সংক্রামিত করেছে রবীন্দ্র সংস্কৃতিকে৷ তাঁর ভাবনা চিন্তা এখন স্কুল কলেজের প্রশ্নোত্তরের মেড-ইজি কিংবা রুখাশুখা পিএইচডি পেপার৷ তাঁর গানে ঢুকে পড়ে উৎকট মিউজিক ও যৌন শিরশিরানি৷ রবীন্দ্রনাথ বনাম রবীন্দ্রনাথের লড়াইয়ের আয়োজন করে পোলিটিকাল দাদারা৷ আরও কত নষ্টামি৷ তাঁর জীবনের ব্যক্তিগত ও গৌণ দিককে আদিরসে চুবিয়ে মুখ্য করে তোলা হয়৷ আর, আমরা যারা একটু ভালো রোজগারপাতি করি, ভঙ্গি করে কথা বলি, তারা রবীন্দ্রনাথকে এলিটের পাষাণঠাকুর বানাই৷ বিরাটঠাকুর, বেঁটেঠাকুর, হাঁদাঠাকুর, মোটাঠাকুর ইত্যাদি৷

করবী একটু থামে৷ আঁচলে কপালের ঘাম মোছে৷ বলে, বিরক্ত করছি না তো? বলবেন৷ থেমে যাব৷

কনক বলেন, তুমি বলো৷ আমরা শুনব৷

–এসব কথা বলতে চাইনি৷ একটা ভাইরাসের কথা বলব ভেবেছেলিাম৷ অনেক ভাইরাস এসে গেল৷ যা বলেছি যন্ত্রণা থেকে৷ কাউকে আঘাত করতে নয়৷ রবীন্দ্রভাবনাকে যিনি প্রতিক্রিয়াসীল শিবিরের অস্ত্র বলেছিলেন, সেই কমিউনিস্ট নেতা কয়েক দশক পরে বলেন, মৃত্যু পর্য়ন্ত তিনি বিশ্বপ্রগতির সঙ্গে যে এগিয়ে চলেছিলেন— এইখানেই তাঁর মহত্ত্ব৷ তাঁর জীবনচরিত অধ্যয়ন করলে সমগ্র যুগের ইতিহাস অধ্যয়ন করা হয়৷ বিলম্বিত হলেও এই ভুলস্বীকার থেকে বুঝতে পারি, সেদিনের সেই ভাইরাস আর তত তেজি নয় এখন৷

করবী বলা শেষ করে৷

হাত তুলে বলবে বলে সঙ্কেত দেয় অরিজিৎ৷

রণধীর জানায়, এবার অরিজিৎ বলবেন৷ আমরা অনেকদিনের বন্ধু৷ ওঁকে পেয়ে ভালো লাগছে৷

–প্রসঙ্গটা যখন উঠলই একটা ঘটনা বলবার তাগিদ বোধ করছি৷ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আমরা উৎসব করেছি৷ তাঁকে উৎসবের আইটেম বানিয়েছি৷ তাঁকে পড়েছি কি? থিসিস লিখেছি৷ পড়েছি কি? গান গেয়েছি, নাটক করেছি৷ বুঝেছি কি? তাঁর নাম ভাঙিয়েছি৷ অনুসরণ করেছি কি? তাহলে বাংলার এই পচাগলা হাল হত না৷ নৈরাজ্যের শীৰ্ষে যেত না বাংলা৷ রবীন্দ্রনাথ ব্যর্থ৷ শুনতে খারাপ লাগলেও, এটা ঘটনা, তিনি ব্যর্থ৷ আমাদের দ্বিচারিতা তাঁকে ব্যর্থ করেছে৷ রবীন্দ্ররচনাবলি সুমুদ্রিত৷ বহুল বিক্রিত৷ ঘরে ঘরে সুরক্ষিত৷ পঠিত নয়৷ চর্চিত নয়৷ আমাদের হিপোক্রেসির সবচেয়ে বড় প্রমাণ এই আহামরি ঘটনা৷ এই হিপোক্রেসি দিয়েই আমরা রবীন্দ্রনাথের পরম প্রার্থনা ব্যর্থ করে দিয়েছি৷ ১৯৩২ সালে পারস্যে গেলেন কবি৷ বয়স তখন ৭১৷ দেশজুড়ে ক্রমেই ছড়িয়ে পড়তে থাকা হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় মন অবসন্ন৷ পারস্যে গিয়ে দেখলেন মোল্লাতন্ত্র থেকে মুক্তির হাওয়া৷ সেখানে ধর্ম মনের সৌন্দর্য৷ “আমি বললুম, দুর্ভাগা ভারতবর্ষ, জটিল ধর্মের পাকে আপাদমস্তক জড়ীভূত ভারতবর্ষ৷ অন্ধ আচারের বোঝার তলে পঙ্গু আমাদের দেশ, বিধিনিষেধের নিরর্থকতায় শতধাবিভক্ত আমাদের সমাজ।” চতুর্দশ শতকের ইরানি কবি হাফেজের সমাধিস্থলে গেলেন ভারতের কবি৷ খাজা শামস-উদ্-দিন মুহম্মদ হাফেজ শিরাজি৷ যিনি ধর্মীয় ভণ্ডামিকে আক্রমণ করেছেন৷ সমাধিরক্ষক একখানা বড় চৌকো আকারের বই নিয়ে এলেন৷ হাফেজের কাব্যগ্রন্থ৷ সাধারণের বিশ্বাস, কোনও বিশেষ ইচ্ছা মনে নিয়ে চোখ বুজে এই গ্রন্থ খুলে যে কবিতাটি বেরোবে তার থেকে ইচ্ছার সফলতা নির্ণয় হবে৷ রবীন্দ্রনাথ সেই ইচ্ছেটাই মনে মনে উচ্চারণ করলেন, যা তিনি বছর বছর ধরে প্রতিনিয়ত ভাবেন, ভেবে ক্রমে বিষণ্ণ হন৷ তিনি মনে মনে বললেন, ধর্মনামধারী অন্ধতার প্রাণান্তিক ফাঁস থেকে ভারতবর্ষ যেন মুক্তি পায়৷ যে পৃষ্ঠাটি বেরোল সেখানে একটি কবিতার দুটি ভাগ৷ দ্বিতীয় ভাগে বলা আছে, স্বর্গদ্বার যাবে খুলে, আর সেই সঙ্গে খুলবে আমাদের সমস্ত জটিল ব্যাপারের গ্রন্থি, এও কি হবে সম্ভব৷ অহঙ্কৃত ধর্মনামধারীদের জন্যে যদি তা বন্ধই থাকে, তবে ভরসা রেখো মনে, ঈশ্বরের নিমিত্তে তা যাবে খুলে৷ এই বিশ্লেষণে ঈশ্বর আর ধর্ম শুধু পৃথকই হচ্ছে না, প্রতিশক্তি হয়ে যাচ্ছে৷ ধর্মাচারে রুদ্ধ মনের দরজা ঈশ্বরের হাতের ছোঁয়ায় খুলে যাবে৷ রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, সেই রৌদ্রোজ্জ্বল বসন্ত প্রভাতে মনে হল তিনি আর হাফেজ একই পানশালার বন্ধু৷ নানা রসের অনেক পেয়ালা তাঁরা ভরতি করেছেন৷

অরিজিতের ব্লক হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যায়৷ নেটবিভ্রাট৷ কথা ভেসে আসে অন্ধকার থেকে৷

সুগত বলে, অরিজিৎ, আপনি বলে যান৷ আমরা শুনতে পাচ্ছি৷

ভেসে আসে, রবীন্দ্রনাথ বলছেন, কত শত বৎসর পরে জীবনমৃত্যুর ব্যবধান পেরিয়ে এই কবরের পাশে এমন এক মুসাফির এসেছে যে মানুষ হাফেজের চিরকালের জানা লোক৷

অরিজিতের অন্ধকার ব্লক থেকে ভেসে আসে, ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ও মা, তোমার রাখাল আমার চাষি/ আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি/ চিরদিন তোমার আকাশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি৷

অরিজিৎ বলে, অনুরাধা গাইছে৷

–চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি৷ ফিরে ফিরে গায় অনুরাধা৷

আলো জ্বলে৷ নেট যুক্ত হয়৷ অনুরাধাকে দেখা যায় না৷ গান শোনা যায়৷
সবাই খুব খুশি৷

রণধীর বলে, অরিজিৎ এত চমৎকার বলে, জানা ছিল না৷ করোনার দিনগুলোতে আমরা অনেক খারাপ খবর শুনছি, খারাপ দিক দেখছি, প্রিয়জনদের হারাচ্ছি৷ পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা জুড়ে মনখারাপ৷ কিন্তু সেটাই শেষ কথা নয়৷ আরও একটা ছবি আছে৷ স্বপ্নের ছবি, লড়াইয়ের ছবি৷ এই অনুষ্ঠানে যাঁরা বলছেন, গাইছেন, তাঁরা আমাদের জানিয়ে দিচ্ছেন যে, সংক্রমণের দিনেও স্বপ্ন কাজ করে যায়৷ হয়তো আরও বেশি কাজ করে৷ হেরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত লড়াই চলে৷ এবার বিপুলকে বলতে অনুরোধ করছি৷ আমরা অনেকদিনের বন্ধু৷ অনুষ্ঠানের প্রস্তাব শুনে দু হাত নেড়ে ‘না’ বলেছিল৷ কী হবে এসব করে? ভাবের ঘরে চুরি? কিছু একটা করলাম বলে হোটেলবাজির ঢেকুর তোলা? যাই হোক, বন্ধুবর শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে৷

–আমরা এখন এমন সময়ে আছি, আগে কখনও ছিলাম বলে ইতিহাস জানায় না৷ যুদ্ধ নেই, বিদ্রোহ নেই, অস্ত্রের হুঙ্কার নেই৷ তবু লাশ গুম হয়ে যাচ্ছে৷ বাবা ছেলের থোঁজ পাচ্ছে না৷ ছেলে বাবার খোঁজ পাচ্ছে না৷ হাসপাতাল থেকে লাশ লোপাট হয়ে যাচ্ছে৷ লোপাট হয়ে কোথায় যাচ্ছে? কেউ জানে না৷ কোথায় কত লাশ পুড়ছে বা পুঁতে দেওয়া হচ্ছে কেউ জানে না৷ লাশগুমের অডিট কমিটি হয়েছে৷ কখনও শুনেছে কি কেউ? সব হিসেব পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে৷ মৃতের জন্য শোক নেই৷ যাঃ, একটা আপদ গেল৷ রোগাক্রান্তের জন্য সহানুভূতি নেই৷ ঘর থেকে বের করে দাও৷ পাড়া থেকে বের করে দাও৷ এক তরুণের আর্তনাদ কানে আসে৷ মা, আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা করছে৷ টিপে দেবে একটু! মা, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে৷ তোমার কোলে মাথা রেখে একটু ঘুমোব৷ সেই ছোটবেলার মতো গায়ে হাত বুলিয়ে দেবে? মা, আমাকে ছোঁবে না? বাবা আমাকে ছোঁবে না? কেউ ছোঁবে না? দূরে কোনও আগুনে ছুঁড়ে ফেলে দেবে? মা, এ শরীর যে তোমারই দান!

বিপুল থামে৷ মাথা নামিয়ে চুপ করে থাকে৷ কেউ কথা বলে না৷

আবার শুরু করে৷ আমাকে ক্ষমা করবেন৷ পরিবেশটা ভেঙে দিলাম৷ রোজ শুনি, লাশ দড়ি দিয়ে বেঁধে টেনে টেনে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ আঁকশি দিয়ে চিতায় বা চুল্লিতে ফেলা হচ্ছে৷ পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে৷ এখানে ওখানে৷ উত্তরে দক্ষিণে৷ দশটা বিশটা৷ হাসপাতালে পড়ে থাকে লাশ৷ গাদা গাদা৷ আমার স্বজনদের মৃতদেহ৷ সরকারের অপদার্থতায় নিহত৷ দিন দুই আগে, প্রতিবেশী এক তরুণ বন্ধ ঘরে মারা গেছে৷ ডাক্তার আসেনি৷ অ্যাম্বুলেন্স আসেনি৷ কেউ তার কাছে যায়নি৷ পাড়ায় যেন জানাজানি না হয় তাই গোপন রাখা হয়েছিল অসুখের খবর৷ তিন ঘণ্টা পড়ে ছিল দেহ৷ ভাবা হয়েছিল রাতের অন্ধকারে পাচার করে দেওয়া হবে৷ শেষরক্ষা হয়নি৷ পাড়ার রকফেলা গোয়েন্দারা ধরে ফেলে৷ পুরসভার গাড়ি আসে৷ পলিথিনে মুড়ে বডি নিয়ে যায়৷ যারা এসেছিল, তারা বলে গেল, বাড়িতে মরল তাই শেষ দেখা হল৷ হাসপাতালে গেলে নোবডি৷ অডিট কমিটি রিপোর্ট দিল, কো-মর্বিডিটি৷ পরিবার হতবাক৷ তাজা ছেলে৷ কোনও অসুখ নেই৷ কিন্তু কে কার কথা শোনে৷ আটতলার মাচানে বসে প্রত্যহ কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে বাক্য উদ্গীরণ করা হচ্ছে, উহাই পরম সত্য৷ কোন আহাম্মক তার বিরোধিতা করে? মনীষীর সতর্কবাণী আছে, ইট ইজ ডেঞ্জারাস টু বি কারেক্ট হোয়েন দা গভর্নমেন্ট ইজ রং৷ এসব ঘটনা আপানারাও জানেন৷ সোশাল মিডিয়া অহরহ বলছে৷ তবু বললাম যন্ত্রণা ভাগ করে নিতে৷ যদি বারণ করেন, আর বলব না৷

সুগত বলে, আপনি বলুন৷ আমরা আজ ফাংশানে আসিনি, জলসায় নয়৷ প্রমোদে ঢলাঢলি থাক না দুদিন দূরে৷ বলুন৷

–অদ্ভুত একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম৷ ছেলেটিকে যখন গাড়িতে তোলা হল, গোটা পাড়ার দরজা জানালা বন্ধ৷ কারও শোক নেই। কোথাও ব্যথা নেই৷ হৃদয় বলে কিছু নেই৷ সবারই কি একটাই বিদায়বচন? বাঁচা গেল! এ কোন সভ্যতায় এসে পৌঁছোলাম? বাইরের ব্যবহারিক স্বার্থপরতা কি অন্তরের সত্য হয়ে উঠেছে? বহু মানুষের সত্যযোগে মনুষ্যত্বের প্রসারের সাধনা ব্যর্থ? হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ আমরা জানি৷ দেখেছি সন্দেহ থেকে বিদ্বেষ থেকে বৈরিতার চেহারা৷ কিন্তু এই বিচ্ছিন্নতা আমাদের অভিজ্ঞতায় নেই৷ কয়েকটা স্বঘোষিত দারোয়ান ‘সাওধান সাওধান’ বলে চেঁচাল, আর আমরা সামাজিক মানুষেরা পরস্পরের শত্রু হয়ে গেলাম! কী চেতনাহীন আকাট বানিয়ে দেওয়া হল আমাদের৷ এই সময়ই তো সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল সেই বহু মানুষের সত্যযোগে মনুষ্যত্বের প্রসার৷ হেরে গেলাম৷ রবীন্দ্রনাথকে আবার হারিয়ে দিলাম৷

আমাদের বাড়ির কোণাকুণি উলটোদিকের বাড়ির বারান্দা থেকে একটি ছোট্ট মেয়ের জিজ্ঞাসা ভেসে আসছে, টিলুদাকে ওরা প্লাস্টিকে পুড়িয়ে দেবে, দিদিভাই? ‘উন্নয়ন উন্নয়ন’ করে আমরা দেশটাকে যমের দুয়ার বানিয়ে ছাড়লাম! সোশাল মিডিয়ায় এই গানটা আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন৷ ‘ভাত পায়নি বুকের ধন/ মুখে লাথি তোর উন্নয়ন৷ ওষুধ পায়নি বুকের ধন/ মুখে লাথি তোর উন্নয়ন’৷

বিপুল কথা বন্ধ করে ডানদিকে তাকায়৷ সেখানে হয়ত কেউ আছে, কিছু বলল৷ কথায় ফেরে বিপুল৷ “টিলুদাকে প্লাস্টিকে পুড়িয়ে দেবে, দিদিভাই”— ছোট্ট মেয়েটির এই জিজ্ঞাসা শেষ কথা নয় বলে বিশ্বাস করতে চাই৷ ফরাক্কা থেকে যে মধ্যবয়সী বাবা ইরফান আলি তার কিশোর ছেলের হাত ধরে সাড়ে তিনশো মাইল হেঁটেছে ঘরে ফেরার জন্য, তাদের খাবার ছিল না, থাকার জায়গা ছিল না, তাদের রাষ্ট্র ছিল না, সরকার ছিল না, ছিল অসংখ্য মানুষ, বেঁচে থাকার জন্য যা লাগে সেসব জুগিয়ে বাপ-ছেলেকে ঘরে ফিরিয়েছে তারা. দরজা-জানালা বন্ধ করে শুধু নিজেদের কথা ভাবেনি৷ সন্দেহবশত অ্যাসিড ছুঁড়ে দেয়নি বিপন্ন বাপ-ছেলের গায়ে৷ প্লাস্টিকে পোড়াবার ব্যবস্থা করেনি৷ অর্থাৎ মনুষ্যত্ব আছে৷ কিছুটা হলেও আছে৷

–বড় ভালো একটা জায়গায় পৌঁছে দিলেন বিপুল৷ অনেক নেই-এর মধ্যে কিছু আছে৷ ভাইরাস আছে৷ সংক্রমণ বাড়ছে৷ জীবন লড়ে যাচ্ছে৷ এবার বলতে অনুরোধ করব তরুণ বন্ধু ঋতবানকে৷ ও একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলেছিল৷ সেটা এখানে আরেকরকমভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারে৷ অন্যকিছুও বলতে পারে ঋতবান৷ রণধীর ছোট্ট এই ভূমিকা সেরে জানায়, অনুষ্ঠান হয়তো নেট সার্ভিস প্রোভাইডারের মনে ধরেছে৷ ব্যাঘাত এখন পর্যন্ত মাত্র একবার৷

সবার মুখে হাসি৷

–নার্ভাস লাগছে, রণধীরদা৷ কনকদি থেকে বিপুলদা পর্যন্ত যে পথরেখা, আমি তার দূর বাইরে৷ একটা হাটুরে কতদূর যেতে পারে? হাট আর ঘর এই তো তার চলাচল৷

–ঋত, তুমি আম্রকুঞ্জের যে ঘটনার মুখে পড়েছ, সেটাও ভাইরাস৷

–তার আগে অন্য একটা কথা বলতে চাই যদি সম্মতি পাই৷

–বলো৷

সুজনকাকু কাজ খুইয়েছেন৷ আমাদের পাড়ার প্রবীণ মানুষ৷ বইপাড়ায় কাজ করতেন৷ চাকরি বলতে যে সম্মান, স্বাচ্ছন্দ্য, নিরাপত্তা বোঝায়, বইপাড়া সেসব দেয় না৷ যত গালগল্প করুক, বইমেলা নিয়ে যতই গাবাক, কর্মীদের পেট ভরে খেতে দিতেও পারে না৷ তবু বইয়ের দোকানে কাজ করেন বলে একটা গর্ব ছিল সুজনকাকুর৷ আশ্চর্য ভালোবাসা৷ হয়তো বোকামি, কিন্তু তিনি খুশি ছিলেন৷ এবার খুশিটা তো গেলই, অবধারিত অনাহারে পড়লেন৷ মালিক জানিয়ে দিয়েছে আর আসতে হবে না৷ কবে দোকান খুলবে ঠিক নেই৷ বসিয়ে বসিয়ে মাইনে দেওয়া সম্ভব নয়৷ কাজ খুইয়েছে সুতীর্থ৷ আমাদের বন্ধু৷ আইটি কর্মী৷ কোম্পানি জানিয়ে দিয়েছে, বিশ্ববাজারে তীব্র মন্দা৷ কী করবে সুতীর্থ? ফ্ল্যাটের ইএমআই৷ নামী স্কুলে ছেলের লেখাপড়া৷ জীবন তো বড়লোকির মুখ দেখেছে৷ সরবে কী করে? কী করবেন সুজনকাকু? দুই ছেলের একজন ড্রাইভার, অন্যজন জুটমিলে৷ তাদেরও কাজ নেই৷ কী হবে? জানা নেই৷ ভয় হয়৷ লক্ষ লক্ষ মানুষ বেকার হয়ে যাবেন৷ ক্ষুধার্ত মানুষের শক্তি সম্পর্কে আমাদের পুঁথিগত ধারণা ফের পুঁথিতে ঢুকে যাবে?

হাত দিয়ে মুখে জমা ঘাম মুছে নেয় ঋতবান৷ এই ফাঁকে ভেতরে ভেতরে জোরালো হয়ে ওঠা উত্তেজনাও খানিকটা ঠান্ডা করতে চায় হয়তো৷ বলে, এরপর যা বলব, সেটা বছর পনেরো আগেকার ঘটনা৷ একটা সংগঠন ছিল আমাদের৷ নাম ‘ভুবনধারা’৷ নাম যতটা ভারি, সংগঠন ততটাই হালকা৷ পাঁচ-সাতজন বন্ধু মিলে একটা ক্লাব আর কী! নাম দিয়েছিলেন তারাপ্রসন্নবাবু৷ স্থানীয় স্কুলের ইংরেজির শিক্ষক৷ বিনে পয়সায় ছাত্র পড়াতেন৷ সেই সূত্রে সবার ‘স্যার’৷ তখন আমরা সবে কলেজে ঢুকেছি৷ ইচ্ছে হল অন্যরকম রবীন্দ্রজয়ন্তী করব৷ খোলা মাঠে৷ পাওয়া গেল মাঠ৷ তেমন যে খোলা তা নয়৷ যাই হোক খানিকটা৷ চার-পাঁচটা আমগাছ, দুটো লিচুগাছ, একটা জামগাছ আর ঘাসবিছানো জমি৷ আমরা নাম দিয়েছি আম্রকুঞ্জ৷ অন্যরকম রবীন্দ্রজয়ন্তী মানে গানবাজনানাচনার বাইরে, রবীন্দ্রনাথের গল্প থেকে, উপন্যাস থেকে নির্বাচিত অংশ পাঠ৷ রবীন্দ্রনাথের নাটকের একটি বা দুটি দৃশ্য অভিনয়৷ এমনকি প্রবন্ধ থেকে পাঠ৷ বেছে দিতেন টিপি স্যার৷ রবীন্দ্রনাথের সমাজভাবনা, পল্লীভাবনা, স্বদেশভাবনা ইত্যাদির ওপর জোর দিতেন৷ চিঠিপত্র থেকেও পড়েছি৷ যাঁরা শুনতে আসতেন, তাঁদের সংখ্যা অল্পই৷ তাঁরা অনুষ্ঠানের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে নিতেন৷ শেষ পর্যন্ত থাকতেন৷ তখন এরকম শ্রোতা ছিলেন, পাঠক ছিলেন৷ মাঠ ছিল, গাছ ছিল৷ উন্নয়নের ভাইরাস সব খেতে পারেনি তখনও৷

তো, একবার একটা একাঙ্ক করা হল৷ নাম ‘অন্ধকারের এবেলা ওবেলা’৷ স্যারের লেখা৷ রবীন্দ্রনাথের ‘ছোট ও বড়’ অবলম্বনে৷ মনে আছে, একটা সংলাপ ছিল এরকম: বাংলার যুবসমাজ ক্ষুদ্র বিষয়বুদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিয়ে প্রবল নিষ্ঠার সঙ্গে দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে নিজেদের প্রস্তুত করেছে৷ স্বাধীনতার আগের ও পরের ছবিটা একইরকম৷ আর পুলিশ এই দেশভক্তদের ওপর খড়্গহস্ত৷ স্বাধীনতার আগে যা, পরেও তা-ই৷ ওদের নিশ্বাস লাগলেই কাঁচা প্রাণের অঙ্কুর শুকোতে শুরু করে৷ আমি সূত্রধরের পার্ট করেছিলাম৷ কিছু সংলাপ মনে আছে৷ নাটকের শুরুতে এই দৃশ্যটা ছিল: নদীর জল থেকে এক এক করে উঠে আসে কয়েকজন তরুণ৷ তাদের হত্যা করে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল৷ অপরাধ, তারা অপশাসন ও শোষণমুক্ত স্বদেশ চেয়েছিল৷ সময়টা সত্তর দশক৷ স্বাধীনতার কমবেশি তিরিশ বছর পর৷ তরুণরা জানতে চায় কেন তাদের হত্যা করা হল? জানতে চায় নতুন সরকার এল বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে৷ কিন্তু বিচার হল না৷ কেন? কেন খুনিদের শাস্তি হল না?

নাটক মাঝপথে বন্ধ করে দেয় সেদিনের শাসকদলের গুন্ডারা৷ ওরা রটায় যে, টিপি একটা নকশাল৷ নকশালরা সবসময়ই দেশের শত্রু৷ নাটকে সদর্থক কথা নাকি নেই। রাজনৈতিক দলকে পোলিটিকাল পঙ্গু বলা হয়েছে। মূর্খরা জানে না, পোলিটিকাল পঙ্গু বলছেন খোদ রবীন্দ্রনাথ৷ মঞ্চ দখল করে ওরা জানাল, মার্কসবাদী অনুশীলন ছাড়া এখন কোনও উৎসব অর্থহীন। এক দাদা বলল, যা, তোরা দর্শকদের চা-বিস্কুট খাইয়ে দে৷ হাতে কেটলি ধরিয়ে বলেছিল, আমাদের না জানিয়ে কিছু করবি না৷ মনে থাকে যেন৷ ঋতবান হাসে৷ এটা আরেকরকম ভাইরাস৷ ভালো চিন্তাভাবনাকে শেষ করেছে, নিজেরাও শেষ হয়েছে৷ অন্ধতার আরেক চর্চা৷ নমস্কার৷

–আমরা অনেকরকম ভাইরাসের মধ্য দিয়ে এলাম৷ ভ্যারিয়েশন দেখলাম৷ ভারসান পেলাম৷ হয়তো আরও আছে৷ মিউটেট করে আমাদের সহবাসী হয়ে গিয়েছে, যাদের আর আলাদা করে শনাক্ত করা কঠিন৷ এই কথাটা বলতে ইচ্ছে করে, ভাইরাস তোমার শেষ যে না পাই৷ কিন্তু বলব না৷ বলব, ভাইরাস শেষ কথা নয়৷ কনকদি দীর্ঘ সময় ধরে আলোচনা শুনেছেন৷ শুধু শোনা নয়, মাথা নেড়ে সায় দিয়েছেনে, লক্ষ করেছি৷ এই বয়সেও তিনি সজাগ, সক্রিয়৷ তিনি বলেছেন, ‘সার্থক জনম মাগো’ গাইবেন৷ সেই গানের তীরে দাঁড়াক ছায়াতরণী৷

তানপুরা বাজে৷

কনকদি বলেন, দুটো কথা বলি৷ অনেকেরই হয়তো জানা৷ তবু বলি৷ এই গানটি লেখা হয় ১৯০৫ সালে৷ বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের পটভূমিকায়৷ ১৯০৮ সালে মুরারিপুকুর বোমা মামলায় আরও কয়েকজনের সঙ্গে গ্রেপ্তার হন উল্লাসকর দত্ত৷ ১৯০৯ সালের ২৬ মার্চ মামলা চলার সময় কোর্টের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গানটি গেয়ে ওঠেন বিপ্লবী উল্লাসকর৷ কোর্ট স্তব্ধ৷ বিচারক নীরব৷ আমি যেন দেখতে পাই, অগ্নিযুগের এক নায়ক তাঁর প্রাণের স্বদেশের গৌরব গাইছেন চরম শাস্তির মুখে দাঁড়িয়ে৷ নিজেকে প্রশ্ন করি, ব্যর্থ হল কি সেই গাওয়া? সেই প্রাণ দেওয়া? ১৯২১ সালে রবীন্দ্রনাথ নিজে গানটি গেয়ে ওঠেন শান্তিদেব ঘোষের সামনে৷ হয়তো ইচ্ছে ছিল এটি গাওয়া হোক তাঁর ষাটতম জন্মদিনে৷ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিচারণ থেকে জানতে পারি, আবার তিনি গাইছেন এই গান৷ সাল ১৯৩৮৷ বয়স ৭৭৷ বলছেন, আমার গান শুনবে? আমি এখনও গাইতে পারি৷ তবে আস্তে আস্তে গুনগুন করে গাই৷ দেশকে ভালোবেসেই বারবার তিনি গেয়ে ওঠেন ‘সার্থক জনম মাগো’৷ আমরা তাঁকে বুঝি না৷

গাইতে গিয়ে কনকদি নিজেকে ধরে রাখতে পারেন না৷ আঁখি মেলে তোমার আলো প্রথম আমার চোখ জুড়াল/ এই আলোকেই নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে৷ কনকদির দু চোখ বেয়ে জলধারা নেমে আসে৷ বেদনার বাষ্পে ভেঙে ভেঙে যায় স্বর৷ সবাই মাথা নিচু করে সেই দেশপ্রেমকে প্রণতি জানায়৷

সুগত বলে, অনুষ্ঠান শুরুর আগে আমরা যে জায়গায় ছিলাম, এখন সেখানে আর নেই৷ এটা কি আমার একার অনুভব? সম্ভবত না৷ দেশে ও বিদেশে আমাদের কয়েকজন বন্ধু অনুষ্ঠান দেখেছেন, শুনেছেন৷ তাঁরা আপ্লুত৷ এই সময়ের দেশের কথা রবীন্দ্রভাবনায় এভাবে মিলিয়ে দেখার চেষ্টাকে তাঁরা অভিনন্দন জানিয়েছেন৷ সেসব পড়ছি না৷ বেছে বেছে চারটে মন্তব্য পড়ব৷ এক, কিছু বুড়ো কবর-খননকারীর কাণ্ড দেখে বেশ মজা পাওয়া গেল৷ ধন্যবাদ৷ দুই, ফালতু ব্যাপার৷ নিজেদের কী ভাবে! তিন, ঘাড়ে পাউডার দেখিনি৷ পারফিউমের গন্ধ পাইনি৷ হা হা৷ চার, বকবকম অফ ওল্ড হ্যাগার্ডস৷ রাবিশ৷ সুগত হাসে৷ শেষ করছি এই বলে, সবাই ভালো থাকুন৷ মজবুত থাকুন৷