Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রশ্নের মুখে সুপ্রিম কোর্টের নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা

জয়দীপ মিত্র

 


লেখক রাজনৈতিক কর্মী ও প্রবন্ধকার

 

 

 

 

দিল্লি হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি এ পি শাহ (যিনি ভারতের আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসাবেও কাজ করেছিলেন) গত ১৮ সেপ্টেম্বর তাঁর বিচারপতি সুরেশ স্মৃতি বক্তৃতায় মোদি সরকারের জমানায় সুপ্রিম কোর্টের বিচ্যুতির ধারার এক বিশ্লেষণ রাখেন। তাঁর বক্তৃতার শিরোনাম ছিল “সুপ্রিম কোর্টের বিপথগামিতার ধারা: ভুলে যাওয়া স্বাধীনতা ও ক্ষয়প্রাপ্ত অধিকার”। তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তু ছিল এই যে— দেশের গণতন্ত্র আজ এক সঙ্কটের মধ্যে, জনগণের বুনিয়াদি অধিকারের বঞ্চনা প্রবল আকার নিয়েছে, সংবিধানের বিপর্যয়কর অবমাননা প্রকট হয়ে সামনে এসেছে, প্রশাসনিক দাপট প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের স্বায়ত্ততাকে ধ্বস্ত করে তাদের প্রশাসনের বশ্য করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্টই হল একমাত্র প্রতিষ্ঠান যা প্রশাসনের স্বৈর প্রবণতায় রাশ টেনে গণতন্ত্রের রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারত। কিন্তু নিজের মাহাত্ম্য বিস্মৃত হয়ে সুপ্রিম কোর্ট বর্তমান সরকারের দুরভিসন্ধিমূলক অভিপ্রায়েই ইন্ধন যুগিয়ে চলেছে। বিচারপতি শাহর কথায়, “সুপ্রিম কোর্টের অবনতি হঠাৎই হয়নি বা তা কোনও সমাপতনও নয়, তা ছিল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার প্রশাসনের বৃহত্তর, সুচতুরভাবে রচিত কৌশলের অংশ, এবং তা এমন ধারায় যা তার রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডারই সহায়ক হবে।”

ক্ষমতায় এসে বিচারবিভাগ সহ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কব্জা করাটা যে মোদি সরকারের গৈরিক সংখ্যাগুরুবাদী অ্যাজেন্ডা রূপায়ণের নীল নকশার একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ছিল তা নিয়ে আজ আর কোন সংশয় থাকতে পারে না। বিচারবিভাগের স্বায়ত্ততার মর্যাদা যে তাঁদের কাছে গুরুত্ব পাবে না, মোদি সরকার তাদের জমানার গোড়াতেই তা স্পষ্ট করে দেয়। বিচারপতিদের নিয়োগ ও বদলির ওপর সুপ্রিম কোর্টের নির্ধারক অধিকার খর্ব করতে এবং নিজেদের পছন্দের বিচারপতিদের নির্দিষ্ট আদালতে বসাতে তারা সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে সংঘাতে লিপ্ত হয়। মোদি সরকারের প্রয়াত মন্ত্রী অরুণ জেটলি সে সময় কলেজিয়ামের মধ্যে দিয়ে বিচারপতি নিয়োগের সুপ্রিম কোর্টের অধিকারকে “অনির্বাচিতদের স্বৈরাচার” বলে কটাক্ষ করেন। বিচারবিভাগের ওপর প্রভাব খাটিয়ে পছন্দমত রায় বার করার মোদি জমানার প্রথম বড় ধরনের ঘটনাটা ঘটে সোহরাবুদ্দিন শেখ সংঘর্ষ হত্যা মামলায় অমিত শাহর অব্যাহতি লাভ এবং বিচারপতি লোয়ার রহস্যজনক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে। তাঁর পরিবারের সদস্যদের বক্তব্য অনুযায়ী অমিত শাহকে সোহরাবুদ্দিন সংঘর্ষ হত্যার দায় থেকে অব্যাহতি দেওয়ার জন্য বিচারপতি লোয়ার ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করা হয়েছিল, এর সঙ্গে ভালো পরিমাণ অর্থপ্রাপ্তির প্রস্তাব করেছিলেন বোম্বে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি স্বয়ং। কিন্তু নিজের সততার প্রতি অবিচল থেকে তিনি মামলাটির শুনানি গ্ৰহণ করতে থাকেন এবং অমিত শাহকে সশরীরে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। এরপর ২০১৪-র ৩০ নভেম্বর গভীর রাতে রহস্যজনক পরিস্থিতিতে নাগপুরে বিচারপতি লোয়ার মৃত্যু হয় এবং তাঁর স্থানে নিয়োজিত হন বিচারপতি এম ভি গোসাভি। দায়িত্ব নেওয়ার পর এক মাসেরও কম সময়ে কোনও বিচার ছাড়াই বিচারপতি গোসাভি অমিত শাহকে বেকসুর খালাস দেন। এই কুনাট্য বোম্বে হাইকোর্টে মঞ্চস্থ হলেও এর সঙ্গে যুক্ত বড় নাটকটা অভিনীত হয় সুপ্রিম কোর্টে। বিচারপতি লোয়ার রহস্যজনক মৃত্যুর তদন্তের আবেদনটিকে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্র নিজের ক্ষমতা প্রয়োগ করে মোদি-অনুরাগী বলে সুবিদিত বিতর্কিত বিচারপতি অরুণ মিশ্রর বেঞ্চে নির্দিষ্ট করার প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্টের চার বরিষ্ঠ বিচারপতি ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারি ঐতিহাসিক সাংবাদিক সম্মেলন করেন এবং সুপ্রিম কোর্টে যে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে না, তার ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ কায়েমের প্রচেষ্টা যে প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে তা তাঁদের সাংবাদিক সম্মেলন থেকে উন্মোচিত হয়ে যায়।

একের পর এক মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এমন সমস্ত রায় দিতে থাকে যাতে সরকারি ভাষ্যের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ পায় এবং সরকারের বিরুদ্ধে জোরালো তথ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অপরাধী সাব্যস্ত হওয়া থেকে সরকার রেহাই পেয়ে যায়। সাহারা-বিড়লা মামলায় আয়কর দপ্তরের বাজেয়াপ্ত করা নথিতে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি নেতাদের বহু কোটি টাকা নেওয়ার উল্লেখ থাকলেও অরুণ মিশ্র ও অমিতাভ রায়ের বেঞ্চ সেটাকে তথ্যপ্রমাণ বলে মানতে অস্বীকার করে মোদির বিরুদ্ধে তদন্ত চালানোর অনুমতি না দিয়ে তাঁকে রেহাই দেন। ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় গ্ৰেপ্তার হওয়া অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তারা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে হত্যার ষড়যন্ত্রে যুক্ত। কিন্তু এই মামলায় সংখ্যালঘিষ্ঠ মত পোষণকারী বিচারপতি চন্দ্রচূড় তাঁর লিখিত মতামতে জানান, এএসজি নিজেই আদালতের কাছে জানিয়েছেন যে, “প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার তথাকথিত চক্রান্তের সঙ্গে গ্ৰেপ্তার হওয়া পাঁচজনকে যুক্ত করার কোনও ভিত্তি নেই।” তিনি আরও বলেন, মহারাষ্ট্র পুলিশ পক্ষপাতিত্ব দেখাচ্ছে এবং তাদের কথা বিশ্বাস করা যাবে না। তাঁর সুচিন্তিত অভিমত ছিল— “বিরোধীদের অবস্থান সরকার-বিরোধী বলেই তাদের কণ্ঠরোধ করা যাবে না।” এই মামলা প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ভীমা-কোরেগাঁওতে যারা প্রকৃতই দলিত-বিরোধী হিংসা সংঘটিত করেছিল, সেই সম্ভাজি ভিদে ও মিলিন্দ একবোটের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা সে সময়ের বিজেপি নেতৃত্বাধীন মহারাষ্ট্র সরকার তুলে নিয়েছিল। প্রসঙ্গত, ভীমা-কোরেগাঁও মামলায় গ্ৰেপ্তারের ধারা আজও অব্যাহত রয়েছে এবং জামিন পাওয়া যে অসম্ভব হয়ে পড়েছে তারও উৎস রয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মধ্যে। এনআইএ বনাম জহুর ওয়াতালি মামলায় বিচারপতি খান উইলকার ও বিচারপতি রাস্তোগির বেঞ্চ বলে, ইউএপিএ-র অধীনে এফআইআর হলে আদালতকে ধরে নিতে হবে যে, এফআইআরে করা সমস্ত অভিযোগই সঠিক। সরকারের আনা অভিযোগ খণ্ডন করতে পারলে তবেই জামিন পাওয়া যাবে, আর সেটা যে একরকম অসম্ভব তা বোঝার জন্য বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না।

রাফাল যুদ্ধবিমান ক্রয় জনস্বার্থ মামলায় গোটা ক্রয়প্রক্রিয়ায় সরকারের পক্ষে সন্দেহজনক লেনদেন ও স্বজনপোষণের জোরালো তথ্য প্রকাশ পেলেও প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ এই যুক্তিতে সিট বা সিবিআই তদন্তের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন যে, দাম নিয়ে তদন্ত চালানোটা সাংবিধানিক এক্তিয়ারের বাইরে। বিমুদ্রাকরণ, ইলেক্টোরাল বন্ডের মত মামলাগুলোর শুনানিকে ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে বিষয়গুলোকে একরকম তামাদি-ই করে তোলা হয়। আর, সাম্প্রতিক কালের সবচেয়ে বিতর্কিত মামলা, অযোধ্যার জমি মালিকানা মামলায় জমি হিন্দুদের দিয়ে রামমন্দির নির্মাণের পথকে নিষ্কন্টক করা হয়। রায়ে ১৯৪৯ ও ১৯৯২ সালে হিন্দুদের পক্ষে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার কথা উল্লেখের পরও জমি হিন্দুদের হাতে তুলে দিয়ে অপরাধকেই পুরস্কৃত করা হয়। প্রশান্তভূষণ টুইট মামলায় আইনজীবী প্রশান্তভূষণ তাঁর টুইটের মধ্যে দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের শেষ চার প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছিলেন যে, তাঁরা অঘোষিত জরুরি অবস্থার পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র ধ্বংসে মদত জুগিয়েছেন। তাঁরা “স্বৈরাচার, সংখ্যাগুরুবাদের প্রসার ঘটতে দিয়েছেন, বিরোধী কণ্ঠস্বরের দমন, ব্যাপক হারে রাজনৈতিক কর্মীদের ধরপাকড় ঘটতে দিয়েছেন।” সুপ্রিম কোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে প্রশান্তভূষণের বিরুদ্ধে মামলা শুরু করে, প্রশান্তভূষণকে মার্জনা ভিক্ষায় নত করাতে অসমর্থ হয়ে অরুণ মিশ্রর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ তাঁর আচরণকে নিন্দনীয় বলে সাব্যস্ত করে তাঁকে এক টাকা জরিমানা করে। এরপর এল বাবরি মসজিদ ধ্বংসে বিশেষ সিবিআই আলালতের রায়, যাতে বলা হল বিজেপির কোনও নেতাই মসজিদ ধ্বংসকাণ্ডে ইন্ধন জোগায়নি, ফলে সমস্ত অভিযুক্তই বেকসুর খালাস পেল। গোট দেশের জনগণ স্বচক্ষে যা দেখেছিল, রায় তাদের দেখাকে ভুল বলে প্রতিপন্ন করল। প্রশান্তভূষণের মত এক টাকা জরিমানাও আদবানি, মুরলি মনোহর যোশীদের দিতে হল না। তাদের বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ যত গুরুতরই হোক, মামলার রায় নিজেদের পক্ষে নিয়ে আসার ব্যাপারে বিজেপি নেতৃত্বের আত্মপ্রত্যয় সীমাহীন হয়েই দেখা দিচ্ছে।

অতি সম্প্রতি বেরিয়েছে শাহিনবাগে সিএএ-বিরোধী আন্দোলন সম্পর্কে সুপ্রিম কোর্টের রায়। প্রসঙ্গত, সিএএ বা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে এই আন্দোলন ছিল স্বাধীন ভারতে মহিলাদের নেতৃত্বে চালিত বৃহত্তম ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। তাঁরা এবং তার সঙ্গে ভারতীয় জনগণের এক বড় অংশই বলে ছিলেন যে, সিএএ এমন একটা আইন যা সংবিধানস্বীকৃত হতে পারে না। নাগরিকত্বের ভিত্তি সমস্ত সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই সমান হতে হবে। নাগরিকত্বের আওতা থেকে মুসলিমদের বাদ রাখলে সেই আইন কখনই সমদর্শী হতে পারে না। সুপ্রিম কোর্ট তাদের রায়ে বলল, আন্দোলনকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া স্থানেই চালাতে হবে। জনগণের চলাচলের রাস্তা আটকে আন্দোলন চালানোয় তা পথচারীদের প্রভূত অসুবিধার সৃষ্টি করেছে। “গণতন্ত্র ও বিরোধী মতপ্রকাশ হাত ধরাধরি করে চলে” বলার পরও বিচারপতিরা “অনির্দিষ্টকাল ধরে” রাস্তায় আন্দোলন চালানোটাকে অনভিপ্রেত বলেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এই আন্দোলনকে অবাঞ্ছিত বললেও বিচারপতিরা কিন্তু আন্দোলন চালিত হওয়ার পিছনে যে কারণ, সেই একদেশদর্শী, একটা নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে নিশানা বানানো অসমদর্শী আইন নিয়ে কোনও কথা বললেন না। এই রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই যে প্রশ্নটা উঠছে তা হল: নির্দিষ্ট স্থানে দিনের পর দিন আন্দোলন চালানোর পরও সরকার যদি জনগণের সুরাহা করতে অস্বীকার করে, সে ক্ষেত্রে কী হবে? শাহিনবাগের আন্দোলন ১০০ দিনেরও বেশি চলার পরও তো সরকার একটুও নমনীয়তা দেখাল না। শাহিনবাগ আন্দোলনের অন্যতম উদ্যোক্তা শাহিন কওসর যেমন বলেছেন, “সাধারণ মানুষের অসুবিধা হোক, তা আমরা চাইনি। কিন্তু আমরা এদেশে আর থাকতে পারব না— সেই আতঙ্কের কোনও মূল্য নেই?” বিচারপতিদের জ্ঞানগর্ভ অভিমত হল— “আগে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে যে পদ্ধতি ও পথে বিরোধিতা চলত, স্ব-শাসিত গণতন্ত্রে বিরোধিতাকে তার সমতুল্য বলে গণ্য করলে চলবে না।” এ ক্ষেত্রেও প্রশ্ন জাগে, স্বাধীন দেশের সরকার যদি ঔপনিবেশিক সরকারের মত আচরণ করতে থাকে? দিল্লির তখতে বসে শ্বেত সাহেবদের বদলে যদি বাদামি সাহেবরা শাসন চালায়? যদি ঔপনিবেশিক যুগের দেশদ্রোহ আইনের নির্বিচার প্রয়োগ চলতেই থাকে? যদি ইউএপিএ-র মত দানবীয় আইনের প্রয়োগকে সরকার নিয়ম করে তোলে? যদি অঘোষিত জরুরি অবস্থা নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকে? এই বিষয়গুলো সুপ্রিম কোর্টের বিবেচনার বাইরে থেকে গেছে এবং রাস্তা আটকানোর জন্য যাত্রীদের অসুবিধা তার বিবেচনায় স্থান পেলেও বৃহত্তর অসুবিধা, বলা ভালো অস্তিত্বের সঙ্কটকে সে উপেক্ষণীয় বলেই জ্ঞান করেছে।

সুপ্রিম কোর্টের কাছ থেকে দু-একটা ভালো রায় পাওয়া যায় না এমন নয়। কে এস পুটুস্বামী বনাম কেন্দ্রীয় সরকার মামলায় ব্যক্তিগত পরিসরের গোপনীয়তাকে বুনিয়াদি অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে; তিন তালাক মামলায় তিন তালাককে অসাংবিধানিক অভিহিত করে বিবাহকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান বলে গণ্য করা হয়েছে; শবরীমালা মন্দিরে রজঃস্বলা নারীদের প্রবেশাধিকারের স্বীকৃতি দিয়ে প্রথমে যে রায় দেওয়া হয় তা অবশ্যই প্রগতিশীল ছিল; কিন্তু পরে আবার ওই রায়ের পুনর্বিবেচনার আবেদনে সায় দিয়ে প্রথম রায়ের প্রগতিশীলতাকে খারিজ করা হয়। কিন্তু যখনই কেন্দ্রীয় সরকারের কোন কর্মসূচি বা প্রকল্প চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, সুপ্রিম কোর্ট যেন নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে সরকারের সুরে সুর মেলানোর পথেই গেছে। এর পিছনে প্রশাসনিক চাপ এবং বিচারপতিদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শ উভয়েরই অবদান থাকে বলেই মনে হয়। আজকের পরিস্থিতির দিকে তাকালে দেখা যাচ্ছে সমস্ত প্রতিষ্ঠান চুরমার হয়ে যাচ্ছে, প্রশাসনিক বাড়াবাড়িকে নিয়ন্ত্রিত করার কোনও মাধ্যমই আর কাজ করছে না। স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রের তৎকালীন পরিচালকরা সংবিধানের ওপর ভিত্তি করে একটা মডেল হাজির করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের ধারণায় এটাও ছিল যে, দেশের অনেক বিভেদ, অসমতার ওপর, বলা যায়, এক অগণতান্ত্রিক ভিত্তির ওপরই ওই মডেল স্থাপিত হল (এই প্রসঙ্গে বিশেষ উল্লেখ্য ড. আম্বেদকরের নাম)। সেই বিভেদ ও অসমতাগুলোকে দূর করতে না পারলে এই মডেল বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। কিন্তু বিভেদ ঘোচানো দূরে থাক, সেগুলো আজ আরও বেড়ে চলেছে, তীব্রতর হচ্ছে। ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্য অনেক বেশি উগ্ৰ রূপ নিচ্ছে, সাম্প্রদায়িক বিভাজন স্বাধীনতার পর সবচয়ে গভীরতর হয়ে উঠেছে, জাতপাতবাদী উৎপীড়নের দাপট বেড়ে চলেছে, আর্থিক বৈষম্য ক্রমবর্ধমান, স্যাঙাতি পুঁজিতন্ত্রের আস্ফালন কুণ্ঠাহীনভাবে জাহির হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রীয়তা, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্রের বিপন্নতা এক প্রশ্নহীন বাস্তবতা। সংবিধানের ওপর আক্রমণের এই পরিস্থিতিতে সংবিধানের অভিভাবকত্বের, তাকে সুরক্ষিত করার ভূমিকা পালনে সুপ্রিম কোর্ট চূড়ান্ত রূপে ব্যর্থ। সুপ্রিম কোর্টের হৃত মর্যাদা ফেরাতে হলে, তার অভিপ্রেত ভূমিকা পুনরুদ্ধার করতে হলে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তনই সবচেয়ে জরুরি হয়ে দেখা দিচ্ছে। আর বর্তমানের দুর্বল সংসদের মাধ্যমে তা সম্ভব নয়, রাস্তায় নেমে জনগণকেই তা সম্পাদনে অগ্ৰণী ভূমিকা নিতে হবে।