Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ওরা আমাদের ধর্ষণ করে কেন

ওরা আমাদের ধর্ষণ করে কেন -- রুমেলা সাহা

রুমেলা সাহা

 

নির্ভয়া গণধর্ষণ কাণ্ডের কয়েক বছর পর, একজন সাংবাদিক অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, নির্ভয়া কাণ্ডের ধৃত অপরাধীদের ইন্টারভিউ নেওয়ার অনুমতি পেলেন। তাদের মধ্যে বয়সে সব থেকে ছোট ছেলেটিকে যখন প্রশ্ন করা হল, এই কাজ আপনি কেন করেছেন, তখন সে উত্তর দিয়েছিল “সবক শিখানা থা”। সঙ্গে আরও বলেছিল, যে মেয়ে এত রাত্রে পরপুরুষের সঙ্গে বাইরে থাকে, সে কখনও ভালো মেয়ে হতে পারে না। কাজেই….

সবক…. এই মনোভাবই ধর্ষণ সংস্কৃতির মূল আধার।

মধুমিতা পাণ্ডে অপরাধবিজ্ঞান‌‌ নিয়ে অধ্যাপনা করেন ইংল্যান্ডের অ্যাংলিয়া রাস্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার পিএইচডির রিসার্চ পেপারটা এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দলিল। মধুমিতা দিল্লির তিহার জেলে শাস্তিপ্রাপ্ত প্রায় শতাধিক ধর্ষকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তিনি এটা বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন কোন পরিস্থিতি এক বা একাধিক ধর্ষকের জন্ম দেয়। এবং মধুমিতা শেষ পর্যন্ত যে উপসংহারে এসেছেন সেটা মারাত্মক। মধুমিতা দেখেছেন, ধর্ষকরা কিন্তু রাক্ষস নয়, তারাও আমার আপনার মত সাধারণ মানুষই। এরা ধর্ষণ করেছে তাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশের কারণে, চিন্তার জগতে পারিবারিক আর সামাজিক পরিবেশের প্রভাবে।

মধুমিতা লিখেছেন, একজন ৪৯ বছর বয়সের পুরুষ একটি ৫ বছরের শিশুকন্যাকে ধর্ষণ করে। মধুমিতা তাকে প্রশ্ন করে এই বিষয় নিয়ে, তখন সে নিজের অপরাধ স্বীকার করে বলে, “আমার খুব খারাপ লাগছে। মেয়েটি তো আর কুমারী রইল না। ওকে কে বিয়ে করবে? ওকে আমি বিয়ে করব জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর।” অর্থাৎ অপরাধীর থেকে তিনি একজন উদ্ধারকর্তা, বিয়ে করে তিনি মেয়েটিকে উদ্ধার করবেন এই ইমেজটি বারবার বোঝাতে চেয়েছেন।

একজন পিতা তার সাত বছরের সৎমেয়েকে ধর্ষণ করে। তাকে প্রশ্ন করা হলে সে বলে, “যখন ঘটনাটি ঘটে তখন আমি আর মেয়ে পাশাপাশি শুয়ে ছিলাম। মেয়ে কোনও পোশাক পরেনি। আমি সামলাতে পারিনি।”…. সাত বছরের শিশুকে নগ্ন অবস্থায় দেখে একজন পুরুষ— যে কিনা তার সৎপিতাও— তিনি নিজেকে সামলাতে পারেন না।

মধুমিতা লক্ষ করেন, এই অপরাধীদের মধ্যে বেশিরভাগেরই শিক্ষা প্রাথমিক পর্যন্ত। এদের মধ্যে সামান্যতমই কখনও স্কুলের পড়াশোনা সম্পূর্ণ শেষ করেছে, বা স্নাতক হয়েছে। এবং আশ্চর্যজনকভাবে আরও একটি জায়গায় এদের অসম্ভব মিল। এদের প্রত্যেকের কাছে তাদের মায়েরা আদর্শ মহিলা। এরা যখন তাদের মায়েদের, স্ত্রী বা বোনেদের নিয়ে কথা বলেছে তারা বলেছে, ভারতীয় আদর্শ নারীর যা হওয়া উচিত এরাও তাই। অর্থাৎ, ঘরের কাজ, সংসার সামলানো, বাচ্চা মানুষ করা, রান্না করা, বাড়ির সবার সেবা করা, নীরবে আত্মত্যাগ করা, বাড়ির পুরুষটি মারলে চুপচাপ সহ্য করা, কখনও কোনও প্রতিবাদ না করা, পুত্রসন্তানকে অগ্রাধিকার দেওয়া— এগুলোই হল আদর্শ ভারতীয় নারী। এবং প্রায় প্রত্যেক ধর্ষক তাদের মা, স্ত্রী, বোন সবাইকে আদর্শ ভারতীয় নারী, কয়েকজন আবার দেবীর সঙ্গেও তুলনা করেছেন।

মনুবাদী সমাজব্যবস্থায় তথাকথিত ভারতীয় হিন্দু সমাজে, নারী এবং পুরুষের মধ্যের বৈষম্যকে যুগ যুগ ধরে রক্তের মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়েরা সেখানে যোনিনির্ভর সন্তান উৎপাদনের মেশিন ছাড়া আর কিছু নয়। আর এই বৈষম্যের ফলেই ধর্ষকের জন্ম হয়। কারণ যৌন সম্পর্কে মেয়েদের সম্মতি লাগে, এটা মনু-শিক্ষিত পিতৃতান্ত্রিক সমাজ কখনও স্বীকার করেনি। মধুমিতা যত জন ধর্ষকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ অপরাধীদেরই ধর্ষণ যে একটা অপরাধ সেই বোধটাই নেই। এরা জানেই না মেয়েদের সম্মতি “খায় না কি মাথায় দেয়”। অর্থাৎ নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা যে একটি অপরাধ, এটাই এরা জানে না। মেয়েদেরও যে ব্যক্তিগত ইচ্ছে বা মতামত রয়েছে, মনুবাদী সমাজব্যবস্থায় এই সত্যটাকে কখনও স্বীকার করা হয়নি। মেয়েরা সেখানে শুধুমাত্র পুরুষদের ভোগের বস্তু। মেয়েরা কুহকিনী। মেয়েরা নরকের দ্বার অথচ এই দরজা দিয়েই পুরুষদের অবাধ যাতায়াতের জন্য যুগের পর যুগ ধরে মেয়েদের অবদমন চলছে। পিতৃত্বের পরিচয় সুরক্ষিত রাখার জন্য মেয়েদের ন্যূনতম মানুষের মর্যাদাও দেওয়া হয়নি। তাই, নিজের ভালোবাসা প্রকাশ করলে, শূর্পনখার নাক কেটে দেওয়া হয়। অহল্যা কোনও অপরাধ না করা সত্ত্বেও অভিশাপে পাথর হয়ে যায়। দ্রৌপদীকে পাশা খেলায় বাজি হিসেবে রাখা হয়। গালবের চাহিদামত ভিক্ষা না দিতে পারায়, মহান রাজা যযাতি ঘোড়ার পরিবর্তে তার কন্যাকে ভিক্ষা দেন। মাধবী রাজকন্যা থেকে, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্রে পরিণত হন। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে ভাইয়ের সাহায্যে জঙ্গলে একাকী নির্বাসন দিতেও বাধে না যে পুরুষের তাকে নাকি মর্যাদা দিয়ে পুরুষোত্তম বলা হয়। ঠিক যেরকম, যে পুরুষটি তার স্ত্রীকে কখনও স্ত্রীর মর্যাদাই দিলেন না, তিনি যে বিয়ে করেছেন সেটাই স্বীকার করেননি প্রথমে, তারপর বহু চাপে সেটা স্বীকার করতে বাধ্য হন— ভারতের মতন একটা বিশাল দেশের  মা-বোনের সম্মান রক্ষার দায়িত্ব নাকি বর্তায় তাঁর ওপর। অথচ সবাই তো মা, বোন হয় না। স্ত্রী হয়, প্রেমিকা হয়, বান্ধবী হয়, কিংবা শুধুমাত্র পরিচিত নারী হয়, তাদের দায়িত্ব কে নেবে?

মনোবিদরা বলেন, ধর্ষণে আর যাই হোক যৌন পরিতৃপ্তি ঘটে না। অর্থাৎ sexual pleasure ধর্ষণে পাওয়া যায় না। তাহলে ধর্ষণ কেন হয়।

মার্কিন লেখক সুজান ব্রাউনমিলার বলেছিলেন, “rape is motivated not by lust, but by the urge to control and dominate.” ধর্ষণ যৌন আনন্দ উপভোগের জন্য নয়, বরঞ্চ ক্ষমতা এবং আধিপত্য বিস্তারের জন্য করা হয়।

মধুমিতা পান্ডে তিহার জেলে যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সমাজের নিম্ন আয়ভুক্ত মানুষ। কিন্তু এর বাইরে, সারাদেশে বিশাল সংখ্যক ধর্ষক রয়েছে যারা কোনদিনও শাস্তি পায় না। কারণ সেই অপরাধগুলো অপরাধ হিসেবে নথিভুক্ত করাই হয় না। স্কুলে, কলেজে, অফিসে, রাস্তাঘাটে, বাজারে, বাড়ির ভেতর, মেয়েরা যে ঠিক কোথায় সুরক্ষিত সেটা হয়তো মেয়েরা নিজেরাও জানেন না। এমনকি মাতৃগর্ভও তাদের জন্য সুরক্ষিত স্থান নয়। আর ভারতে তো বৈবাহিক ধর্ষণ অপরাধ হিসেবে গণ্যই হয় না।

ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী, স্বামী স্ত্রীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে সেটি ধর্ষণের আওতায় পড়বে না যদি না স্ত্রীর বয়স ১৫ বছরের কম হয়। “Sexual intercourse by a man with his own wife, the wife not being under fifteen years of age, is not rape.” অর্থাৎ ভারতে, বৈবাহিক ধর্ষণ আইনত বৈধ।

সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি দীপক মিশ্র বলেছিলেন, “That marital rape should not be made a crime in India, because it will create absolute anarchy in families and our country is sustaining itself because of the family platform which upholds family values”.

একটি মেয়ের বিবাহিত পুরুষটির অধিকার আছে, সেই মেয়েটিকে ইচ্ছামত ধর্ষণ করার। যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিবাহিত মহিলাদের ইচ্ছেঅনিচ্ছের কোনও মূল্য এদেশের আইনও দেয়নি। অর্থাৎ গোড়ায় গলদ। একটি পুত্রসন্তান, ছোটবেলা থেকে চোখের সামনে দেখে আসছে, তার বাবা যাই করুক না কেন, মাকে সেটাই মেনে নিতে হবে। এটাই আদর্শ ভারতীয় মহিলার দায়িত্ব এবং কর্তব্য। এবং একটি কন্যাসন্তানকে ছোট থেকে এইভাবে বড় করা হয় যাতে সে সবকিছু মুখ বুজে মেনে নেয়। এই ছোট ছেলেটি বা মেয়েটি  সমাজের যেকোনও বর্গের, যেকোনও বিত্তের ছেলে/মেয়ে হোক না কেন, সে ছোটবেলা থেকে যা দেখছে সেটাই শিখছে, এবং বড় হওয়ার পর তার শিক্ষা অনুযায়ী কাজ করছে।

গত মে মাসে দিল্লিতে একটি ইনস্টাগ্রাম চ্যাট ভাইরাল হয়েছিল। মূলত দিল্লির ১৫ থেকে ১৮ বছর বয়সের স্কুলছাত্ররা এই চ্যাট গ্রুপ তৈরি করেছিল যার নাম ছিল “বয়েস লকার রুম”। ভাইরাল হওয়া চ্যাটটির মূল বিষয় ছিল, একটি স্কুলছাত্রীকে গণধর্ষণ করতে চাওয়া যে কিনা ওই গ্রুপের ছাত্রদের সহপাঠিনী। এবং কীভাবে গণধর্ষণ করা হবে সেই সংক্রান্ত আলোচনা। পরে পুলিশ যখন এই ছাত্রদের গ্রেপ্তার করে তখন দেখা যায় তারা প্রত্যেকে বিত্তশালী পরিবারের সন্তান। কাজেই ধর্ষণ করার পেছনে আর্থসামাজিক অবস্থা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়, গুরুত্বপূর্ণ হল মানসিকতা এবং দৃষ্টিভঙ্গি।

হাথরস ধর্ষণ কাণ্ডের পর মিডিয়া বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষদের মধ্যে একটি সমীক্ষা চালায়। সেখানে বিভিন্ন মানুষকে জিজ্ঞেস করা হয় মেয়েরা কেন ধর্ষিত হয়? এবং অদ্ভুতভাবে, যে দেশে কোনও ব্যাপারে কখনও ঐকমত্য হয় না, সে দেশে সিংহভাগ পুরুষ নির্দ্বিধায় জানালেন যারা ধর্ষিত হয় সেই সব মেয়েদের চালচলন ঠিক নয়। মেয়েরা এমন পোশাক পরে যাতে পুরুষরা প্রলুব্ধ হয়। মেয়েরা ঘর ছেড়ে বাইরে কেন বেরোয়। মেয়েরা কেন রাস্তাঘাটে একা একা চলাফেরা করে। মেয়েরা কেন রাতে বাড়ির বাইরে থাকে। মেয়েরা কেন ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা করে। তালিবানি সমাজ নয়, ভারতের আধুনিক সমাজের প্রায় ৮০ শতাংশ নাগরিক পুরুষ বলছে, ধর্ষণের জন্য দায়ী মেয়েরা, পুরুষ তো পরিস্থিতির শিকার। না এই সমীক্ষা কোনও অজপাড়াগাঁয়ে নয়, দিল্লি, হায়দ্রাবাদ, ভুপালের মত শহরে করা হয়েছিল। এবং যাদের প্রশ্ন করা হয়েছিল তারা কিন্তু সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ।

পর্ন ইন্ডাস্ট্রি সারা পৃথিবীতে অন্যতম লাভজনক ব্যবসা। হলিউডের সারা বছর ৬০০ সিনেমা তৈরি হয়, যেখানে পর্ন ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি হওয়া সিনেমার সংখ্যা ১৩,০০০। পর্ন ইন্ডাস্ট্রির আয় ৯৭ বিলিয়ন ডলার, যা সারা বিশ্বের ৪.৮ বিলিয়ন বা ৪৮০ কোটি মানুষের এক দিনের খাদ্যের যোগান দিতে পারবে। সারা বিশ্বে ইন্টারনেটে যা কিছু ডাউনলোড হয় তার মধ্যে ৩৫ শতাংশ পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত। পর্নসাইটে দর্শকদের সংখ্যা, নেটফ্লিক্স, টুইটার এবং আমাজনের মিলিত ব্যবহারকারীদের থেকেও অনেক বেশি। এবং “পর্ন হাব” সাইটের একটি আভ্যন্তরীণ সমীক্ষা অনুযায়ী, child sexual exploitation বা চাইল্ড পর্ন, is one of the fastest-growing online businesses. ভয়ানক দুশ্চিন্তার শুরু কিন্তু এখান থেকেই। ২০১৮ সালে কাঠুয়ায় একটি আট বছরের মেয়েকে গণধর্ষণ ও খুন করা হয়। ঘটনাটার পর পর্নসাইটগুলোতে “চাইল্ড রেপ” ভিডিওর সার্চ হঠাৎ বেড়ে যায়। এছাড়া “রেপ ডে”-র মতো অনেক অনলাইন গেম আছে যেগুলো ধর্ষণকে মহিমান্বিত করে। এরপরও আমরা আশা করি, শুধুমাত্র শাস্তির মাত্রা কঠোর হলেই ধর্ষণের সংখ্যা কমবে!!!

আসলে ধর্ষণ কোনও বিছিন্ন ঘটনা নয়। এটি একটি প্রথা। এমন একটি প্রথা বা হাতিয়ার যেটা দিয়ে মেয়েদের শরীরের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মন, আত্মা দুমড়েমুচড়ে শেষ করে দেওয়া যায়। সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, পণপ্রথা, এই সমস্ত প্রথার মতোই ধর্ষণ আসলে একটি কুৎসিত সামাজিক প্রথা। পিতৃতান্ত্রিক যে সমাজ মেয়েদের শুধুমাত্র যোনিসর্বস্ব দ্বিতীয় শ্রেণির প্রাণী বলে মনে করে, তারা যখন আঘাত করবে, তখন যোনি যে তাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু হবে সেটা তো স্বাভাবিক। আমাদের দেশে ধর্ষণ হলে সেটা ধর্ষিতার অপরাধ, ধর্ষক তো কেবলমাত্র নিজের ইন্দ্রিয়গুলোকে বশে রাখতে পারে না— তাদের আর কী দোষ। নির্ভয়া তার বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখে রাত সাড়ে নটায় বাসে করে বাড়ি ফিরছিল, এত রাতে পরপুরুষের সঙ্গে বাড়ির বাইরে, কাজেই মেয়েটি মোটেই ভালো নয়। সবক শিখানা জরুরি থা…।

হাথরসের মেয়েটির অপরাধ তো আরও বেশি। একে সে সদ্যযৌবনা, তারপর দলিত সমাজভুক্ত। মনুর মতে, শূদ্রনারী সমাজের অন্য সব শ্রেণির ভোগ্যা। কাজেই এটা একটা সামান্য ঘটনা। এতে এত বাড়াবাড়ি করার কী আছে। ভাগ্যিস ধর্ষিতা হয়েছিল, তাই তো পরিবার ক্ষতিপূরণের এত টাকা পাচ্ছে। করোনায় মরে গেলে কি কোনও টাকা পেত। স্বয়ং প্রশাসনকর্তা এইভাবে সন্তোষ প্রকাশ করেছে ধর্ষিতার বাবা মায়ের কাছে। শুধু তাই নয়, এরপর থেকে প্রশাসন বিভিন্নভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এটি প্রচার করতে যে হাথরসে কোনও গণধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। এটা একটা সাংঘাতিক প্রবণতা। এই প্রবণতার ফলও মিলতে শুরু করেছে হাতেনাতে। মহেন্দ্র সিং ধোনির ৫ বছরের মেয়েকে খোলাখুলিভাবে ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। আইপিএলের একটি ম্যাচে ধোনির টিমের খারাপ ফলাফলের জন্য তার পাঁচ বছরের মেয়েকে সরাসরি ধর্ষণের হুমকি দেওয়া হয়েছে।

একটি বাচ্চা মেয়েকে এভাবে প্রকাশ্যে (সোশ্যাল মিডিয়ায়) ধর্ষণের হুমকি দেওয়ার মতো ঘটনা কিন্তু আগে ঘটেনি। অবশ্য এক্ষেত্রে এক কিশোরকে গুজরাট পুলিশ গ্রেফতার করেছে। কিন্তু বিষয়টা অত্যন্ত চিন্তাজনক অন্য কারণে। এই ১৬ বছর বয়সে ছেলেটির কাছে ধর্ষণ কোনও গর্হিত অপরাধ হিসেবে গণ্য হচ্ছে না। বরঞ্চ ধর্ষণটা এখানে শাস্তি, যেটা চাইলেই যে কেউ যে কাউকে দিতে পারে। অর্থাৎ বাবার জন্য মেয়ে শাস্তি পাবে। এখানেও কিন্তু সেই “সবক”।

প্রশাসন ধর্ষিতার লাশ রাতারাতি জ্বালিয়ে দিচ্ছে প্রমাণ লোপাটের জন্য। সম্পূর্ণ ঘটনাটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে অনবরত। চেষ্টা চলছে অপরাধীদের আড়াল করার। এই পরিস্থিতিতে ধর্ষকরা অনুপ্রাণিত হবে না তো কে হবে! রাষ্ট্র যখন অনুপ্রাণিত করে, তখন তথাকথিত দেশভক্তদের মহান কর্তব্যই হল অনুপ্রাণিত হওয়া। কিন্তু এক্ষেত্রে আমাদের যে মূল্য দিতে হবে তার জন্য আমরা প্রস্তুত তো? ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর মতে, ২০১৯ সালে গড়ে রোজ ৮৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ভারতের। ২০১৮ সালের নিরিখে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে ৭ শতাংশের বেশি। যদিও ধর্ষণের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনও অভিযোগ দায়ের করা হয় না।

আসলে হাথরসের মেয়েটির গণধর্ষক কিন্তু শুধুমাত্র উচ্চবর্ণের ওই চারটে ছেলে নয়। তার ধর্ষক মনুবাদী, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা। মনুবাদ আর পুঁজিবাদ— নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে তাদের যুগলবন্দি অনবদ্য। মনুবাদ মেয়েদের পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে ব্যবহার করতে শিখিয়েছে আর পুঁজিবাদ মেয়েদের মানুষ থেকে পণ্যে পরিণত করেছে। যে সমাজ আজও মেয়েদের শুধুমাত্র মাংসপিণ্ড হিসেবে দেখে, যেখানে নারী-পুরুষের বিভেদ প্রথম আর দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের মত, যেখানে আজও কন্যাভ্রূণহত্যা ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত, যে সমাজে মেয়েরা একটা বয়সের‌ পর বাবা-মার কাছে অবাঞ্ছিত, বোঝা, যে সমাজে শিক্ষার অধিকার, খাদ্যের অধিকার, সাম্যের অধিকার সবকিছুতেই চূড়ান্ত বৈষম্য, সেই সমাজে শুধুমাত্র গুটিকয়েক ধর্ষকদের ফাঁসিকাঠে ঝোলালে, ধর্ষণ সমস্যার কোনও সমাধান হবে না।

রামরাজ্যে সীতাকে প্রথমে বনবাসে তারপর পাতালে প্রবেশ করতে হয়েছিল। যেসব মহিলারা ভাবছেন আগামী দিনে তারা সুরক্ষিত থাকবেন; যেসব পুরুষেরা ভাবছেন আগামীতে তার প্রেমিকা, স্ত্রী, মেয়ে, মা, বোন, বান্ধবী অথবা পরিচিতারা সুরক্ষিত নিরাপদ থাকবে… তাদের আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, রামরাজ্য কিন্তু সীতার রাজ্য নয়। সেখানে সীতার কোনও স্থান ছিল না।

মেয়েদের প্রতি সমাজের পণ্যসর্বস্ব দৃষ্টিভঙ্গি যতক্ষণ বদলাবে না, লিঙ্গভেদের আকাশপাতাল পার্থক্য যতক্ষণ না কমবে, মা বাবারা যতক্ষণ না তাদের পুত্রসন্তানদের মেয়েদের সম্মান করতে শেখাবেন, সমান অধিকার শেখাবেন, এবং মেয়েরাও যতক্ষণ নিজেদের ইচ্ছেঅনিচ্ছের মূল্য আছে, এইটা না শিখবেন ততক্ষণ ধর্ষণ নামক অপসংস্কৃতি চলছে, চলবে। আমরা শুধু অপেক্ষা করতে পারি কেবল। কখন আমাদের নম্বর আসবে।