Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বাংলার রাইস মিল সংক্রান্ত কিছু কথা

তন্ময় হক

 

দেশ এখন ঘটনাবহুল, এবং কাজেকাজেই খবরবহুল। সকালের খবর বিকেলে মনে রাখা দায় হয়ে যাচ্ছে। তাই মোটের ওপর ধরে নিতেই পারি কিছুদিন আগে খবরের কাগজে রাইস মিল নিয়ে যে খবরটা বেরিয়েছিল, সেটা বিস্মৃতির আড়ালে চাপা পড়েছে। তাতে দোষের কিছু নেই।

খবরটা ছিল, রাইস মিল সংগঠনগুলি সরকারি ধান ভাঙাবে না বলেছে।

হোক একটু আলোচনা। দেখা যাক একটু খতিয়ে। যেহেতু খাওয়াদাওয়া, অর্থাৎ খাদ্যাভ্যাসটা এখন বেশ হট টপিক, বাঙালিত্বও, এবং বাঙালির ভেতো বলে একটা বদনামও রয়েছে, তাই সব মিলিয়ে নেহাত অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলেই বোধ হয়।

শুরুতেই সবার আগে রাইস মিলগুলোর ইতিহাসটা একটু জানা প্রয়োজন।

৭০-৮০-র দশকে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় সর্বত্রই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা হাস্কিং মিল বা পাড়ন রাইস মিলগুলো মূলত তারাই করেছিলেন যারা মফঃস্বলের ‘বড়লোক’, বাড়িতে একটা গাদা বন্দুক আছে, বাবা কাকা মিলিয়ে বেশ কিছু পরিমাণ জমিজমা আছে, তারাই। আর হাতে কিছু নগদ টাকারও জোগান ছিল তাদের। ব্যাঙ্ক লোন তখনও এই পৃথিবীতে প্রবেশ করেনি। তখন আজকের এই উচ্চফলনশীল লালস্বর্ণ বা IR-64, বা নিদেনপক্ষে গুটকা GS ক্যাটেগরির ধান ছিল না। তাই নামে রাইস মিল হলেও আসলে একটু উন্নত ধানকলই ছিল সেগুলো।

এর পরে কৃষিতে আমুল পরিবর্তন ঘটে। সেচে, বীজে, ট্রাক্টরে, কৃষি ঋণ সংস্কারের ফলে গ্রাম্য কৃষিতে বিপ্লব আসে, ৯০-এর দশকের শুরু থেকেই। উপরন্তু সরকারি মিনিকিট (ধানবীজ) পেয়ে উচ্চফলনশীল ফসল ফলাতে শুরু করে চাষীরা। তখন শহরাঞ্চল ব্যতীত চাল কেউই কিনে খেত না তেমন। গ্রামের সম্পন্ন মানুষেরা বাড়ীতেই সিদ্ধ-ভাপাই করে চাল বানাতেন। মজুরেরা গৃহস্হের থেকে মজুরী বাবদ চাল পেতেন। তাতেই চলে যেত। এইসময় নিজের প্রয়োজন মিটিয়েও অতিরিক্ত ধান বেচতে গিয়ে চাষীরা দেখল ধান কেনার খরিদ্দার নেই। যদিও বা কেউ নিতে রাজি হলেন, পয়সা কবে দেবেন তার কোনও গ্যারান্টি ছিল না।

ঠিক এইমতো পরিস্থিতিতে বাজারে অবতীর্ণ হলেন মাড়োয়ারী সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীরা। সাথে নিয়ে এলেন সামান্য পুঁজি, তৎকালীন উন্নত প্রযুক্তি আর প্রখর ব্যবসাবোধ। ব্যাস প্রতিযোগিতাতে টিকে থাকতে না পেরে অচিরেই সেই পুরাতন বাঙালী রাইস মিলগুলির অবলুপ্তি ঘটল। তখনও সরকার ধানকল সম্বন্ধে চরম উদাসীনতাই দেখিয়েছিল যেন চালচুলোটা তো ঘরোয়া বিষয়, ওখানে আর সরকার কী করবে?

৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যেই, মানে ৫-৭ বছরের মধ্যেই ‘রাইস মিল’ বাজারের ৯৫%-এর বেশি মালিকানা অবাঙালিদের হাতে চলে গেল। চাষীদের কাছে তখন অতিরিক্ত ফলনের ধান মজুত। সুতরাং বাজারে ধানের ফড়ে বা দালাল গোষ্ঠীর জন্ম হল। মানে এনারা চাষীর থেকে, বস্তা-লেবার–গাড়ি করে ধানটা মেপে নিয়ে মিল পর্যন্ত পৌঁছে দেবে, তার জন্য মিল আর চাষী উভয়ের থেকেই একটা পার্সেন্টেজ পাবে। আর চাষীকে টাকা দ্রুত পেতে সাহায্য করবে। দাম দরের তেমন সুযোগ ছিল না, মিলারের খুশিতে দাম নির্ধারিত হত।

আমি নিজে সাক্ষী, কালনার এক মাড়োয়ারী রাইস মিলে আমার দাদু ধান বেচে এসে ১১ মাস পর টাকা ফেরত পেয়ে ধন্য হয়েছিলেন। এটাই ছিল খুব স্বাভাবিক ঘটনা। ফলে সেই আমলের রাইস মিলারগুলো রাতারাতি ফুলে কোলাব্যাঙ হয়ে যায়। অগাধ পুঁজির রমরমাতে একটা থেকে পাঁচটা রাইস মিল তৈরি হতে সময় লাগল না। সাথে অন্যান্য ব্যাবসাতেও সেই বিনা সুদের চাষীদের টাকা খাটতে লাগল। সরকার সেই সময় একটাই কাজ করেছিল। প্রতিটি রাইসমিলের গেটে লাল ঝাণ্ডা লাগিয়ে একটা করে সিটু ইউনিউন বানিয়েছিল, যাতে প্রতিটি মিছিলে প্রতি রাইস মিল থেকে কমপক্ষে ২০০ লোকের যোগান নিশ্চিত করা যায়।

এর পর নতুন শতাব্দীর দোরগোড়ায়। যখন খোলা বাজারে নানান অর্থলগ্নী সংস্থাগুলো নতুন মেশিনারির উপরে লগ্নি করার জন্য গায়ের চামড়া খুবলে নিচ্ছে। রাইস মিলগুলিতে আবার গণ-আধুনিকিকরণ ঘটল। অটোমেটিক সিস্টেম চালু হল। ১০ বিঘা মেঝেতে ধান শুকানোর রেওয়াজ উঠে গিয়ে ছয় ফুট বাই ছয় ফুট জমিতে ৭০ ফুট উঁচুতে মাথা তুলে দাড়াল ড্রায়ার। এক লপ্তে প্রোডাকশন ডবল থেকে পাঁচ গুণ পর্যন্ত বেড়ে গেল।

এত অতিরিক্ত চালের হবেটা কি? সুতরাং বহির্বিশ্বে নন-বাসমতি চাল রপ্তানির জন্য একটা দিগন্ত খুলে গেল। কেন্দ্রীয় সরকার বিদেশী মুদ্রা আয়ের গন্ধ পেয়ে EC Act amendment করে, নতুন রূপে Rice miller & Wholesaler, Levy Act প্রণয়ন করল। এর আগে রাজ্য সরকারের Food & Supplier দপ্তর ছিল ঠিকই। কিন্তু তারা মূলত কেন্দ্রীয় সংস্থা Food Corporation of India (FCI)-র শাখা হিসবেই কাজ করত। আর এই FCI সম্বৎসর কাল ধরে চালের প্রোকিওরমেন্টটা করত। সেখান থেকে তারাই তাদের গোডাউনে মজুত চাল থেকে রাজ্যের সংস্থা দ্বারা বিলিবণ্টন করত। এই সময় রাজ্য খড়গপুর IIT-এর বিশেষজ্ঞ দ্বারা ধান চালের Ratio পরীক্ষা করায় বাংলার ধান নিয়ে। পাশাপাশি কেন্দ্রও পাঞ্জাবের ধান দিয়ে রুরকি থেকে একই পরীক্ষা করায়। তাতে দু’স্থানে দু’রকম ফলাফল আসে। সেটাই স্বাভাবিক। বাংলা আর পাঞ্জাবের পরিবেশ আলাদা, চাষের পদ্ধতি আলাদা। তাই পাঞ্জাবের ধান থেকে ৬৮% চাল নিষ্কাশন সম্ভব হলেও বাংলার ধানে টেনেটুনে ৬৪% এর বেশি দাঁড়ায়নি। অতএব দুই স্থানে দুই রকম চালের হিসাব চালু হয়ে গেল। মিলাররা তখনও লেভি দিলে সেই টাকা পেতে নিদেনপক্ষে মাস চারেক লাগতই। FCI টাকাটা তাড়াতাড়িই পেমেন্ট করত।

এই সময়েই সরকার খাদ্য সুরক্ষা প্রকল্পের অন্তর্গত নানান জনমুখী প্রকল্পের জন্য প্রচুর পরিমাণে চাল মজুত করার সিদ্ধান্ত নিল। এবং আইন বানিয়ে 50% of total yearly production লেভি হিসাবে দেওয়াটা বাধ্যতামূলক হল। সেই লেভি না দিলে বাকি অর্ধেক চাল বাজারে বিক্রির অনুমতি মিলবে না। ওই লেভির ৫০% রাজ্যসরকারের খাতায় আর ৫০% সেই FCI-কে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হল। আইনটা খাতায় কলমেই রয়ে গেল। কারন রাইস মিল ব্যাবসাটা বর্ধমানকেন্দ্রিক, আর তৎকালীন শাসকদলের একটা অলিন্দ সেই বর্ধমানেই। তাই মিলাররা পার্টির নেতাদের নাকের ডগাতে বসে দিব্যি থাবামুঠো লেভি দিয়ে পার পেয়ে গেল। সরকারি প্রকল্পের জাল মালগাড়ি করে ভিনরাজ্য থেকে FCI চাল আদায় করতে লাগল। প্রসঙ্গত, যেখানে একটা রাইসমিলের ৯৯% লেনদেনই কাঁচা টাকাতে হত, সুতরাং আইন শিকেয় না উঠলে এটা সম্ভব ছিল না। সরকার যথারীতি ধৃতরাষ্টের ভুমিকায়। DM, SP, Income Tax, Sale Tax, থানা পুলিস সবই সামনে ২০০ মিটারের মধ্যে যখন, এবং রোজ এই কোটি কোটি টাকার নগদ কারবার আজও রমরমিয়ে চলে, তখন বুঝতে হয় সরকার আসলে কয়েকজন মানুষ, বাকি সবটাই তাদের মর্জিমাত্র, আমরা বোকারা ভাবি গণতন্ত্র।

রাইস মিলগুলো তখনও অধিকাংশই বর্ধমান, মেদিনীপুর বা রায়গঞ্জ শহরকেন্দ্রিক বা মফঃস্বলের ছোট পুরসভার ভিতরে বা তার আশেপাশে। সুতরাং এই রাইস মিলার অ্যাসোসিয়েশনগুলোর মাথাগুলোও শহুরে কোন মিলারই হতেন স্বাভাবিক নিয়মেই। যিনি মন্ত্রী না হয়েও চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী হতেন। এক, বিপুল পরিমাণে চাঁদা, আর দুই, মিটিং মিছিলে লোকের যোগান। ভাবুন ৪০০ রাইস মিল হলে ১০০০০ টাকা করে চাঁদা আর ২০০ করে লেবার শ্রমিক হলে সংখ্যাটা চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। অতএব নেতারাও আইনি কারচুপির মাধ্যমে রিটার্ন কৃতজ্ঞতা জানাতে কসুর করতেন না। এভাবেই চলছিল লেনদেন।

যিনি ভাগ্যগুণে একবার এই অ্যাসোসিয়েশনের পদাধিকারী হয়েছেন, তার স্টেটাস যে কোন লেভেলে পৌঁছেছে, সে শুধু মিলারেরাই জানেন। অ্যাসোসিয়েশনের বাৎসরিক চাঁদা ন্যূনতম ২০০০০ টাকা বছরে, অন্যান্য আয় বা অনুদান বাদ দিন। শুধু বর্ধমানেই নথিভুক্ত রাইস মিলের সংখ্যা ৫৮০+। যদিও চালু ছোট বড় মিলিয়ে আড়াইশোর কাছাকাছি। বছরে ৫০০টি মিল নিয়মিত সদস্যপদ রিনিউ করে। তাহলে টাকার সংখ্যাটা কত দাঁড়াচ্ছে? আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, আপনি কোথাও এমন কোনও বদনাম বা অপপ্রচার শোনেননি, যে রাইস মিল অ্যাসোসিয়েশন কোনও সমাজসেবার সাথে যুক্ত। তাহলে এই বিপুল অর্থ কি হয়? জানার চেষ্টা করলেই মামলার খাঁড়া ঝুলবে, স্থানীয় নেতাদের উৎপাত শুরু হবে, নানা অশান্তি। তাই জানতে চেয়ে কে যেচে ঝামেলা নেবে?

এর পর রাজ্যে ২০০৯ থেকেই রাজনৈতিক পালাবদল ঘটতে থাকে। তার প্রভাব এই চাল শিল্পে প্রচুর। কেন্দ্রীয় সরকার চালের উপর থেকে সেলট্যাক্স তুলে নেয়। এমনকি রাইস ব্রানের উপর থেকেও যাবতীয় কর উঠিয়ে নেয়, আর সেই ৬৮% চালের নিয়মটা সারা দেশব্যাপী চালু করে দেয়। এছাড়া অনেক ছোটখাট সংস্কার হয়। কিন্তু শাসক দল ঘর বাঁচানোর তাগিদে সেসব দিকে নজর দেওয়ার ফুরসতই পায়নি।

নতুন সরকার ক্ষমতায় আসতে না আসতেই, গুয়ের মাছির মতো এই অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা রঙ পাল্টাতে সবুর করেননি। তাই হাকিম বদলালেও হুকুম বদলায়নি।

শেষ পাঁচ-ছয় বছর বাজার অর্থনীতির পাশাপাশি যোগাযোগ প্রযুক্তির সুবর্ণযুগ। শহরের রাইস মিলগুলোর এক লপ্তে বিপুল জমি আবাসন শিল্পের জমি হিসাবে বিকিয়ে গেল। সেই টাকাতে তারা গ্রাম সাইডে রাইস মিল খুলে বসল। কাঁচামাল আরও সহজলভ্য এখানে। তবে এখন চাষী শুধু ধান বিক্রির টাকার উপরে সংসার চালানোর জন্য নির্ভরশীল নয়। প্রয়োজনে সুদূর উড়িষ্যাতে ধান বেচছে আবার মিলারেরাও বিহার ছত্তিশগড় থেকে ধান আমদানি করছে। ২০০৮ সালের আশপাশ থেকে চাষীরা মিলারদের কাছে টাকা রাখার চেয়ে ব্যাঙ্কে টাকা রাখতে বেশি পছন্দ করার দরুণ, আর বাজারে চিটফান্ডের রমরমাতে মিলারদের হাতে নগদ টাকার যোগান কমতে শুরু করে। আগের মতো ধান আর স্টক করা যাচ্ছিল না। কিন্তু খরচা তো সেই আগের মতোই ছিল সব। আবাসন শিল্পে রাইসমিলের অনেক টাকা বেনামে খাটত, সেগুলোতে টাকার যোগান বন্ধ করলে আম ছালা সব যাওয়ার সম্ভাবনা। তাই রাইস মিলগুলোতে টাকার অভাব শুরু হল।

এবার গণহারে ব্যাঙ্কের মূল ঋণখাতা NPA হওয়া শুরু হল। যেটা এই অ্যাসোসিয়েশনেরই হিসাব অনুযায়ী, ৬০% রাইস মিলই ২০১৪ সালে এই NPA ক্লাবের সদস্য হয়েছে। ঋণখেলাপিটা যার জন্য লজ্জার কারণ হয়নি।

নতুন সরকার ক্ষমতাতে আসার পরেই বিচিত্র সব বুদ্ধির আমদানি করল। আসলে সবটাই তো গায়ক নায়কদের মত এন্টারটেনার বুদ্ধিজীবী দিয়ে তৈরি খসড়া। তাই এগুলো দেখে সকলেই হাসত বেশি। তবুও কর্ত্রীর ইচ্ছাই হুকুম। ফড়ে বন্ধের নামে কালোবাজারির দিগন্ত খুলে গেল। সম্ভবত সর্বোচ্চ স্তরের নির্দেশেই লোকাল নেতারা সরকারি দরে ধান বিক্রির জন্য কুইন্টাল পিছু স্থায়ী বখরার ননডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট চালু করল। যেটা আজও চাষীমহলে ওপেন সিক্রেট।

স্বয়ম্ভর গোষ্ঠী, বিভিন্ন সমবায়, আর চিনি বা লোহা চুরির দায়ে অভিযুক্ত মির্জাগালিব স্ট্রীটের অত্যাবশকীয় খাদ্য নিগমকে (WBECSC) মুখ্য করে নানান সরকারি আধাসরকারি সংস্থাকে দিয়ে ধান কেনাতে লাগল সরকার। টাকা অবশ্য মিলারকেই লাগাতে হয়েছিল, কারণ আগের সরকার রাজ্যকে দেনায় ডুবিয়ে গেছে (তেনার কথাতে), অতএব টাকা নেই। যাদের ধান কেনার দায়িত্ব, সেই সংস্থাগুলোর না আছে ঢাল না তলোয়ার, তাই হওয়া থেকে মরা সবটাই মিলাররা করত, আজও করে। বামদলগুলির তবুও একটা কৃষক শাখা ছিল, বর্তমান দলের সেই বালাইও নেই। এখানে সবটাই তেনার ইচ্ছাতে হয়। তাই এই ‘তানাসাহি’তে, চাল মজুতের নিজস্ব পরিকাঠামো না তৈরি করেই ধান মিলিং করে ফেলার ফলশ্রুতিতে এই ‘সরকারি চাল’ মিলারের ঘরেই রয়ে গেছিল মাসের পর মাস।

কিছু মিলার সেই বিপুল চাল টাকাতে রূপান্তরিত করে ফেলতে বাধ্য হল ব্যবসায়িক প্রয়োজনে। অনেকের চাল মিলের গোডাউনেই ছত্রাক ধরে গন্ধ হয়ে গেল। এমতাবস্থায় একটা বিশাল অঙ্কের চাল মিলারদের কাছ থেকে অনাদায়ি রয়ে যায়। এর পর মামলা, গ্রেফতার, জরিমানা, মিলগেটে তালা ঝোলানো নানান পন্থা ঘটতে থাকে। শুধুমাত্র আইনের ফাঁদে আটকা পড়ে নিজের ধনেই নিজেরা চোর বনে যায় মিলাররা।

এর এফেক্টটা পরের সিজনেই মোক্ষম টের পেল সরকার। পকেটের পয়সা লাগিয়ে চাষীর ধান কেনার জন্য মিলার নেই। দিকে দিকে চাষী বিদ্রোহে রাজ্য পয়সার বরাদ্দ করল ECSC-কে। কিন্তু সেই পরিকাঠামো নেই, এবারেও সব চাল নিতে পারল না সরকার, অতএব আবার কিছু মিলারের জেল জরিমানা ঘটল। লেভিটা কেমন যেন বিনা আইনেই অবলুপ্তির পথে হাঁটতে লাগল। গত শস্য বছরেও প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ECSC আদায় করতে পারেনি। কারণ যাদের ধান দিয়েছিল তারা অধিকাংশেই কাগজে কলমে রাইস মিল। বাকিটা রাজনীতির পাঁক আর ফ্যাক্টরিতে আগাছা। সুতরাং টাকা নিয়ে চম্পট। ফলস্বরূপ গোটা ৫০ মিলারের নামে অ্যারেস্ট অর্ডার জারি হয়েছে। কোর্ট ব্যাপারটা বুঝেছে, তাই এ বছর জোর করে লেভি নেওয়ার উপরে স্থগিতাদেশ দিয়েছে মহামান্য বিচারপতি রঞ্জিত কুমার বাগ সাহেবের এজলাস।

এখন প্রশ্ন এতদিন এইসব প্রশ্ন ওঠেনি কেন?

এই সরকারি আর চাষীর অত্যাচার(!) বা চাপ কেবলমাত্র গ্রাম সাইডের মিলগুলোর উপরে। চাষীদের এক্সট্রা চাপ দিলেও তারা দিন নষ্ট করে শহরে যেতে নারাজ। যত দোষ নন্দ ঘোষ গ্রামের মিলারগুলো। তাই ওই শহুরে মিলারদের তেমন অসুবিধা হয়নি গত পাঁচ-ছয় বছরে। এরা আবার অ্যাসোসিয়েশনের নেতাও বটে। বর্তমানে গ্রামের মিলগুলোর অধিকাংশই কোমায়। যারা বেঁচে আছে তারাও মরে যাবার ভান করে আছে বেঁচে থাকার তাগিদে।

সরকারি এজেন্সির ধান নিলে সরকার ধানের কুইন্টাল পিছু ৬৮ কেজি হারে ফেরত নেবে, যে আইনটা কেন্দ্রীয় সরকার গত সিজনে তুলে নিলেও রাজ্যে বহাল আছে।

ধান ওঠার মরশুমে ধানের বাজারদর কম থাকে, কিন্তু সরকারের দর ফিক্সড, যেটা বাজার থেকে দুই তিনশো টাকা বেশি। তাই মিলাররা ব্যাবসায়িক কারণেই সরকারি ধান কিনতে অনীহা দেখায়। বিগত দশ বছরে ধান চালের দাম চার থেকে পাঁচ গুণ বেড়েছে। লেবারের মজুরী, চাল মজুতের জন্য নতুন চটের বস্তা, ডিজেলের ও বিদ্যুতের খরচা লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছে। সেখানে মিলারের ভাঙানি মজুরী দ্বিগুণ বৃদ্ধিটুকুও হয়নি। ২০০৩-০৪ সালে এক বস্তা লালস্বর্ণ ধানের দাম ছিল (৬০ কেজি) ২৩০ টাকা। সেটা এখন ৯০০ টাকার আশেপাশে (পুরাতন ধান, অক্টোবরে ছিল)। প্রতি বছরেই একটু একটু করে এটা বেড়েছে। শস্য বছরের শেষে সেপ্টেম্বরে সরকার যখন চাল ফেরত নেবার তাগাদা দেয়, তখন সেই চালের দাম অনেকটাই বেড়ে যায় সিজনের শুরুর থেকে। তাই সরকারি ধান ভাঙা মানেই লোকসান অনিবার্য।

তাহলে এখন সরকারি প্রকল্পের কী হবে? APL, BPL, অন্নপূর্ণা যোজনা, অন্ত্যোদয় যোজনা, ICDS Project, ইত্যাদি ছাড়াও মিড ডে মিল আর সিঙ্গুর-জঙ্গলমহলের চাল রয়েছে। সেগুলো চালু রাখতে বিপুল চাল প্রয়োজন। বাইরের রাজ্যে সাধারণত আতপ চাল খায়, তাই সেই চাল রাজ্যে এনে চলবে না, এখানেই চাল বানাতে হবে। এখন মিল চাই ধান ভাঙাবার জন্য। কিন্তু সুস্থ শরীরে বেঁচে আছে শহরের মিলগুলোই। সুতরাং সরকারের এবারের নজর তাদের উপর। বিগত ৬ বছরের পরিকল্পনাহীন খামখেয়ালিপনা আর সরকারি ফরমান তথা অত্যাচারে রাইস মিলগুলো বর্তমানে রক্তশূন্য, তাই অগত্যা সরকার আবার সেই সমবায়দের নাকি টাকা দেবে নতুন রাইসমিল স্থাপনের জন্য। আজ পর্যন্ত বঙ্গদেশে এই সমবায় পদ্ধতিতে একটাও সফল মিল নেই, তারপরেও এই লোকদেখানো উৎসব আসলে সেই কিছু পাবলিককে বা হাতে গোনা নির্দিষ্ট মানুষকে টাকা পাইয়ে দেবার নিকৃষ্ট প্রচেষ্টা। তাতে করে কিছু লোক ধনী হবে, শিল্পটা সেই তলিয়েই যাবে।

সরকারকে ধার দেওয়ার রেওয়াজ আগেও ছিল, আজও আছে, আগামীতেও থাকবে। যে কেউ তথ্য জানার অধিকার আইনে জেনে নিতে পারেন। টাকার অঙ্কটা হয়তো কম থাকত, কিন্তু টাকার দামও তো আগের থেকে কমেছে। আসলে পার্থক্যটা হল, আগে যাদের টাকা সরকারের কাছে থাকত তারা কেউ নেতা ছিল না, তারা ব্যবসাদার ছিল। এই ধারটাকে ব্যবসার অঙ্গ হিসাবেই দেখত। আজ তারা হয় আমলাশোলের অপুষ্ট রিকেট শরীর নিয়ে বাঁচার লড়াই করছে, বা রাইস মিলার হিসাবে মৃত। শুধু বর্ধমানেই ৩০০-র বেশি মিল বন্ধ, কারণ ঘোড়ারোগ। এখন নেতাদের মিল আর তাদের তহবিলে নজর পড়েছে। অ্যাসোসিয়েশনের অর্ধেকের বেশি সদস্য নিজেরা রাইস মিল চালায় না। অন্যকে লিজে দিয়ে নিশ্চিন্তে ইউনিয়নবাজি করে। এখন কাকে কাকের মাংসে নজর দিতেই চতুর্দিক কা কা রবে মুখরিত।

আগের সরকারের আমলেও রাইস মিল ছিল, লেভি ছিল, চাষী ছিল, সহায়ক মূল্যে ধান ক্রয় ছিল। আইনও ছিল আর দুর্নীতিও ছিল। কিন্তু তারা কোর্টে থানা পুলিশের বাইরে একটা মীমাংসা ঠিক করেই নিত। যার জন্য কোনও রাইস মিল বন্ধ হয়নি সরকারি অত্যাচারে, সরকারও লোকসানে পড়েনি। বর্তমানে খিস্তিপ্রিয় বেল্লিকের দল ক্ষমতার দম্ভে, শিল্পের জন্য হাহাকার করা এই কৃষিজাত ক্ষুদ্রশিল্পের ভবিষ্যতকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। আঁতেলের মতো রাজনীতি নিয়ম বদলাচ্ছে।

এছাড়াও নোট বাতিলের কারণে মূলত কাঁচাতে লেনদেন হওয়া কারখানাগুলোতে স্যালাইন ঝুলছে। রাইস মিলগুলো তার অন্যতম। সরকার আগেও রাইসমিলকে দেখেনি, এখনও দেখে না। সেই অসংগঠিতই রয়ে গেল। চীন বাদ দিন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স বা ন্যূনতম পাঞ্জাব সরকারের ৫০% রাইসমিল নীতি এই রাজ্য যদি গ্রহণ করত তাহলে গোটা দেশটাই আরও অনেকটা বেশি এগিয়ে যেতে পারত। ভালো শাড়ি না পরলেও চলবে, বেড়াতে না গেলেও হবে, রাস্তাতেও ৫ দিন কাটিয়েই দেওয়া যায়, কিন্তু পেটের ভাত ছাড়া? সব কিছুই ফাঁকা।

এদিকে আবার আজকাল খুব ইতিহাসের ডাক শোনা যাচ্ছে। যে সব সময়, তার দুর্লক্ষণগুলি আমরা পার করে এসেছি ভাবতাম, সেগুলিই আবার বেয়াড়ার মতো দরজায় কড়াঘাত করছে। বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশক অনেকেরই মনে পড়ে যাচ্ছে। এখন চল্লিশের দশকে বাঙালি তো কেবল দাঙ্গাতেই রক্তাক্ত হয়নি, না খেতে পেয়েও মরেছে দলে দলে। তাই আমরা ঘরপোড়া, স্বজনহারানো ভেতোরা সিঁদুরে মেঘ দেখলে স্বাভাবিকভাবেই ডরাই।