Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মন্দির-হিন্দু-মুসলমান নাকি শিক্ষা-কাজ-মর্যাদা: বিহার পক্ষ বেছে নিচ্ছে

নীলাশিস বসু

 


লেখক রাজনৈতিক কর্মী

 

 

 

একই কুমির ছানা বারবার দেখিয়ে শেয়াল পণ্ডিত নিজেকে বিশাল চালাক মনে করে। কিন্তু কারসাজি যখন চোখের সামনে চলে আসে তখন সেই চতুর বাবাজি পালানোর পথ পায় না।

নির্বাচনের আগে বিভিন্ন মিডিয়া হাউসগুলোর ওপিনিয়ন পোল ইত্যাদি টুকটাক নজরে আসছিল। নিজেদের কার্যত গোয়েবলসের যোগ্য উত্তরসূরি প্রমাণ করার জন্য তাদের যে প্রাণপণ প্রচেষ্টা, তাতে ফাঁক নেই একটুও। এবার বিহার নির্বাচনের ধারা এবং মিডিয়ার ওপিনিয়ন পোল কার্যত দুই মেরুতে বসবাস করছে। বেশিরভাগ মিডিয়া হাউসগুলো এনডিএ জোটকেই ফের ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে, যেভাবে তারা ২০১৫ সালেও একই কাজ করে পরে ক্ষমা চেয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতাটা কী? একটু মাটিতে তাকান, একটু জনমানসের চেতনার সঙ্গে একাত্ম হোন, দেখতে পাবেন মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ! এনডিএ জোটের সভাগুলো কার্যত ফাঁকা, অপরদিকে মহাজোটের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ উল্টো ছবি। বিজেপি-জেডিইউ প্রার্থীরা বিভিন্ন গ্রামে-মহল্লায়-এলাকায় বিতাড়িত হচ্ছে সাধারণ মানুষের দ্বারা। মানুষ এই নির্বাচনকে এড়িয়ে যাচ্ছে না, উল্টে যথেষ্ট সোচ্চার এবং সবাক তারা। ক্ষোভের অনর্গল বর্ষণ আবালবৃদ্ধবণিতার মুখে। নিউজ এইট্টিন এবং এবিপি হাওয়া বুঝে তাদের অবস্থান বদলেছে। শেষ দফার ভোট শেষ হওয়ার পরে প্রায় সমস্ত মিডিয়া হাউস, যারা এতদিন দেখাচ্ছিল এনডিএ অপ্রতিরোধ্য, তারাই উল্লফন দিয়ে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। ৭ নভেম্বরের এক্সিট পোলগুলি মহাগঠবন্ধনের পক্ষেই রায় দিচ্ছে।

খেলাটাই আর এনডিএ-র মাঠে নেই। এই মহাজোটে CPI-ML লিবারেশনসহ বামেদের যোগদান পুরো ন্যারেটিভটাকে এনে দাঁড় করিয়েছে মানুষের বুনিয়াদি প্রশ্নে। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়েছেন খোদ জে পি নাড্ডা থেকে যোগী বা মনোজ তিওয়ারিরা। তাদের মূল আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘মালে’ বা CPI-ML লিবারেশন। কখনও বলা হচ্ছে ‘মালে আরজেডিকে কব্জা করে ফেলেছে!’ কখনও বলা হচ্ছে ‘মালে টেররিস্ট!’ বামপন্থীরা যে বিজেপির মাথাব্যাথা হয়ে দাঁড়িয়েছে মহাজোটে যোগ দিয়ে সেটা নিশ্চিত।

পাটনা শহরকে স্মার্ট সিটি করার নামে, কয়েক হাজার মানুষকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কোনও ক্ষতিপূরণ বা পুনর্বাসন ব্যতিরেকেই এই কাণ্ডটি করেছেন ‘সুশাসনবাবু’। মানুষের ক্ষোভের আঁচ তাই ধ্বনিত হচ্ছে পাটনা শহর জুড়েই। এখানেরই দীঘা বিধানসভায় দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে রয়েছেন বিজেপির বিধায়ক। বিজেপি এখানে দম্ভের সঙ্গে বলে রাজ্যে ক্ষমতায় যেই থাকুক, পাটনা কেন্দ্র বিজেপির। এবার সেই সুরও কেটে কেটে যাচ্ছে। শহরকেন্দ্রিক এই বিধানসভার একমাত্র পঞ্চায়েত নাট্টা-দিয়ারা। নৌকো করে গঙ্গা পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে। সেখানে প্রায় ১৮,০০০ হাজার মানুষের বাস। দীর্ঘদিনের দাবি নদীর ওপর একটা পুল হোক। তা এতদিনেও হয়ে ওঠেনি। চিকিৎসাকেন্দ্র বলে কিছু নেই, একটা ছোট গুমটি দোকান, মানুষ সেখানেই তাদের চিকিৎসা করান, গুরুতর কিছু হলে নদী পেরিয়ে শহরে আসতে আসতেই ঘটে যায় দুর্ঘটনা! স্কুল নেই, জলের একটা ট্যাঙ্ক বানানো আছে বটে কিন্তু তাতে জল নেই। এই অবস্থায় ওখানকার মানুষ ফুঁসছেন। বিজেপির বর্তমান বিধায়ক সন্দীপ চৌরাসিয়া প্রচারে গিয়ে বিতাড়িত হন এখান থেকে। এখানে মহাজোটের প্রার্থী শশী যাদব। তিনি আশা-অঙ্গনওয়ারী-রন্ধনকর্মী আন্দোলনেরও নেত্রী। শশী যাদব প্রাথমিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আগে এখানে হাসপাতাল-স্কুল আর জলের ব্যবস্থা হবে। চেষ্টা চলবে নদীর ওপর পুল তৈরি করারও।

গরিবগুর্বো মানুষ একটা প্রশ্ন তুলছেন। আমরা ভোট তো দিই, কিন্তু মেশিনের গণ্ডগোলে আমাদের ভোটগুলো কোথায় যায় কে জানে! পালিগঞ্জের গ্রাম থেকে দীঘার বস্তি পর্যন্ত একই কথা শুনেছি মানুষের থেকে। এই আশঙ্কার ভিত্তি আছে কী নেই সেটা তর্কের বিষয়। কিন্তু মানুষ আশঙ্কিত এই বিষয়ে, সেটা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।

পালিগঞ্জ বিধানসভা এলাকা। এখান থেকে মহাজোটের পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন CPI-ML লিবারেশন প্রার্থী আইসার সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ সৌরভ। CPI-ML-এর দীর্ঘদিনের লড়াকু ইতিহাসের সাক্ষী বহু শহীদের রক্তরাঙা গ্রামীণ পাটনার এই বিধানসভা ক্ষেত্র। পালিগঞ্জ এবং দুলহনবাজার এই দুটি ব্লক মিলিয়ে ৩৯টি পঞ্চায়েত এবং প্রায় ৪০০-র ওপর গ্রামের সমাবেশে এই বিধানসভা এলাকা। বর্তমান বিধায়ক এবং এইবারের JDU প্রার্থী জয়বর্ধন যাদবের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ তুঙ্গে। এই ভদ্রলোক ২০১৫-র নির্বাচনে RJD-র টিকিটে নির্বাচনে জেতেন এবং জেতার পর পাল্টি খেয়ে JDU-তে যোগ দেন। বিগত পাঁচ বছরে এঁর নির্লজ্জ অনুপস্থিতি প্রত্যেক ক্ষণে ক্ষোভ জাগাচ্ছে যথারীতি। ‘সুশাসনবাবু’-র এই চ্যালাটি ন্যূনতম একটা ইট পেতেও এই এলাকার মানুষের জন্য কিচ্ছু করেননি বিগত পাঁচ বছরে। পালিগঞ্জের মানুষের ক্ষোভ স্বাভাবিক।

বিহারের গ্রামগুলো আর ঘুমিয়ে পড়ছে না তাড়াতাড়ি, কারণ মানুষ সজাগ হচ্ছেন, মানুষ জেগে থাকছেন তাদের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে। রাত ৯-৩০টায় যখন বলবন গ্রামে ঢুকছি তখনও গোটা গ্রাম ভেঙে পড়েছে, সেখান থেকে রাত ১০-৩০ টায় বাহাদুরগঞ্জ, ছবিটা একই। মানুষের এই প্রনোদনা কিসের কারণে! বিরোধীরা এটা এখানে প্রতিস্থাপন করতে পেরেছেন যে এবারের নির্বাচন হবে মানুষের দাবি নিয়ে। পালিগঞ্জের কথাই বলি। এখানে লাইব্রেরি তৈরি, সরকারি স্কুল-কলেজ তৈরি, কর্মসংস্থানের দাবিতে লড়াই। এই দাবিগুলোর ভিত্তিতেই মানুষ এককাট্টা হচ্ছেন। জানান দিচ্ছেন ‘ডবল ইঞ্জিন’এর নাম করে এই ডবল বুলডোজারের সরকারকে তার এবার জবাব দেবেন।

পালিগঞ্জের সবথেকে বড় সমস্যা যা পালিগঞ্জের মানুষের ভাষায় ‘নালি অউর গলি কি সমস্যা’! সঙ্গে একটা ছবি দিয়েছি দেখলেই বুঝতে পারবেন যাতায়াত করার ন্যূনতম অবস্থা এখানের গ্রামগুলোতে অমিল।

পালিগঞ্জের এই ছবি বদলাক এটা মানুষের চাহিদা, আর সেই চাহিদারই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে সন্দীপের প্রচারে এবং তার প্রতি মানুষের সমর্থনে। চিত্রটা স্পষ্ট, এবারের নির্বাচনে কোনও নির্দিষ্ট প্রার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে না এখানে। মানুষ লড়ছেন ডবল বুলডোজারের সরকারের বিরুদ্ধে। এই লড়াই বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে, জয়বর্ধন যাদবের মতো মানুষের রায়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে, নীতিশের বিশ্বাসঘাতকতার বিরুদ্ধে, বিজেপির সাম্প্রদায়িক প্রোপাগান্ডা এবং দেশ বেচে দেওয়ার ফ্যাসিস্ট নীতির বিরুদ্ধে।

এবারে বিহার নির্বাচনের ফলাফল কী হবে সেটা তো বোঝা যাবে আগামী ১০ নভেম্বর। কিন্তু ইতিমধ্যেই এনডিএ জোট মূল জায়গায় হেরে গেছে বিহারে। এবারের বিহার নির্বাচন বিজেপির সেট করে দেওয়া অ্যাজেন্ডার ভিত্তিতে হচ্ছে না। মহাজোটের প্রার্থীরা এবারের বিহার ভোটের বয়ানটাই বদলে দিতে পেরেছে। এবারের বিহার ভোটে জনজীবনের প্রকৃত সমস্যাই প্রতিফলিত হচ্ছে। বেসরকারিকরণ, কর্মহীনতা, লকডাউনে প্রবাসী মজুরদের হয়রানি, কৃষি বিল, মনুবাদের বিরুদ্ধে এবারের বিহার ভোট। সবার জন্য শিক্ষার দাবিতে এবারের বিহার ভোট। তার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে মহাজোটের ঘোষণাপত্রও। আর এর ফলেই ধাক্কা খেয়েছে নীতিশের ‘সুশাসন’-এর ফাঁপা মডেল। ‘নালি-গলির সমস্যা’র সঙ্গে মিশে গেছে কৃষকের কৃষি থেকে উচ্ছেদের প্রশ্ন, বেরোজগারের হাহাকার, প্রবাসী মজুরদের কান্না। এই কারণেই মহাজোটের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে বিজেপি। বিরোধীরা এখানে বিজেপির মাঠ থেকে খেলাটা জনগণের বৃহত্তর ময়দানে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। দিকে দিকে সন্দীপ সৌরভ, মনোজ মঞ্জিল, অজিত কুশওয়া, আফতাব আলম, রঞ্জিত রামের মতো ছাত্র-যুব আন্দোলনের কন্ঠস্বররা। মহাজোটের প্রার্থীরা এই লড়াইটা এখানেই জিতে গেছেন। নির্বাচনের জয়-পরাজয়টা সময় আসলে বোঝা যাবে, কিন্তু বিজেপি বিহারের এই উত্তাপ টের পেয়েছে। নাড্ডা এসে এক দুবার ধর্মের উস্কানি দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু বিফল মনোরথে ফিরতে হয়েছে তাঁকে। সুশীল মোদি বলেছেন লিবারেশন বা ‘মালে’ জিতলে সব জমি ছিনিয়ে নেবে। পিছন থেকে মানুষ উঠে সেই সভাতেই জবাব দিয়েছেন, ‘মালে’ সামন। তদের থেকে জমি কেড়ে গরিবের মধ্যে জমি বিলি করে, গরিবের জমি কেড়ে নেয়নি। আর এই উত্তাপের আঁচ পেয়েই ঘোষণা হওয়ার পরেও পালিগঞ্জ বিধানসভা কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদির জনসভা করার কথা থাকলেও, সেটা বাতিল করা হয়েছে। যোগী বলেছেন বিহারে জিতলে ফ্রি-তে রামমন্দির দেখতে পারবেন, টেনে আনছেন ৩৭০-এর প্রসঙ্গ। সেই সভাতেই মানুষ হাথরস নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, যুবকরা চিৎকার করে উঠেছে আগে কাজ দাও, তারপর যার ইচ্ছা সে নিজের খরচে গিয়ে মন্দির দেখতে যাবে। দিনকরের বিহার, বাবা নাগার্জুনের বিহার, গোরখ পাণ্ড্যের বিহার, রাম নরেশ রামের বিহার পথ দেখাচ্ছে, আমাদেরও সেই পথের পথিক হতে হবে। ফ্যাসিবাদ এবং তার দোসরদের হারাতেই হবে।

বিহারের এতদিনের প্রথাগত ভোট কাঠামোটাও কোথাও যেন বদলে যাওয়ার বাঁকে এসে দাঁড়িয়েছে এই নির্বাচনে। জাত-পাতের দীর্ঘদিনের নিগড়ে যেন এবারের নির্বাচন টান দিয়েছে। এখনও বলার সময় আসেনি যে জাতপাতের সমীকরণ একদমই নিশেঃষিত হয়ে গেছে; কিন্তু এবার সমস্ত কিছু উর্ধ্বে জায়গা করে নিয়েছে মানুষের বুনিয়াদি দাবিগুলো। এম-ওয়াই সমীকরণকে বর্তমান প্রজন্ম বলছে ‘মজদুর-যুবা’ সমীকরণ।

যতটুকু বিহারের মানুষের কাছে পৌঁছানো গেছে এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে, তাতেই প্রতিটি মুহূর্তে টের পাওয়া যাচ্ছিল বিহার একটা জলবিভাজিকার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এটা বদলে যাওয়া বিহার; নবীন প্রজন্ম ভাবতে শুরু করেছে নতুনভাবে। এই বিহার কখনওই এককভাবে বিজেপিকে ক্ষমতায় আসতে দেয়নি। তাই বিজেপি নাছোড়! কিন্তু সেই গুড়ে বালি পড়বে হয়তো ১০ তারিখ। একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, মূল লড়াই মহাজোট বনাম এনডিএ জোটের মধ্যেই। অন্যদিকে বিজেপির দাবার বোড়ে এলজেপি হোক অথবা উপেন্দ্র কুশওয়াহা কিংবা পাপ্পু যাদবের জোট; তাদের প্রভাব এই ভোটে পড়ার তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই।

সামগ্রিকতার প্রেক্ষিতে বিহার এবার পক্ষ বেছে নিচ্ছে; ৩৭০, রাম মন্দির, হিন্দু-মুসলিম নাকি শিক্ষা-কাজ-মর্যাদা-খাদ্য-বাসস্থান! বিহার পক্ষ বাছবে; গোটা দেশ অপেক্ষমান।