Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সিএএ-র পর ‘লাভ জিহাদ’— নুরেনবার্গ আইনের আধুনিক রূপ

তানিয়া লস্কর

 


লেখক গদ্যকার, প্রাবন্ধিক, পেশায় আইনজীবী

 

 

 

আজগুবি নয়, আজগুবি নয়, সত্যিকারের কথা—
ছায়ার সঙ্গে কুস্তি করে গাত্রে হল ব্যথা!
ছায়া ধরার ব্যবসা করি তাও জান না বুঝি?
রোদের ছায়া, চাঁদের ছায়া, হরেকরকম পুঁজি!

সুকুমার রায় ঠিক কোন বিষয় মাথায় রেখে এই ছায়াযুদ্ধ রূপকটি ব্যাবহার করেছিলেন সেটা বলা না গেলেও ‘লাভ জিহাদ’ নিয়ে আইন পাশ করাটা যে এরকমই একটি ব্যাপার সেটা হলফ করে বলা যায়। বিজেপি এবং তাদেরর পিতৃসংগঠন আরএসএস এই লাভ জিহাদ নামক বিরাট মিথ্যা (হিটলারের ভাষায় বললে ‘বিগ লাই’)-কে প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। তাদের ভাবাদর্শী গোলওয়ালকর এবং ইউএন ব্যানার্জি তাঁদের বই “আমরা এবং আমাদের জাতীয়তাবাদের পুনর্গঠন” এবং “হিন্দু— একটি মৃতপ্রায় জাতি” ইত্যাদিতে এই বিষয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন। যার সারমর্ম করলে দেখা যায় যে ঘুরিফিরিয়ে যেনতেনপ্রকারেন সকল হিন্দুকে নিজেদের রক্তের বা জাতিগত বিশুদ্ধতা বাঁচানোর জন্য আহ্বান করা হয়েছে। ব্যক্তিগত স্বাধীনতার বিরুদ্ধে তাদের এই অবস্থান ভারতীয় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২১-এ স্বীকৃত জীবন এবং ব্যক্তিগত স্বাধীনতার পুরোপুরি বিপরীতে। এটা ইসলাফোবিক তো বটেই নারীস্বাধীনতারও সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে। অথচ গত দু-তিন সপ্তাহ ধরে পাঁচটি বিজেপিশাসিত রাজ্যে গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের এই ধারণাকেই আইনি স্বীকৃত দেওয়া হল।

নুরেনবার্গ আইনের আধুনিক রূপ

১৯৩৫ সালে জার্মানিতে দুটি আইন একসঙ্গে পাশ করা হয় ‘নুরেনবার্গ আইন’ নামে। প্রথমটি ছিল রাইখ নাগরিকত্ব। সোজা ভাষায় বললে জার্মানির নাগরিকত্ব শুধু রক্ত-সম্পর্কের ভিত্তিতে জার্মান বংশোদ্ভূতদের দেওয়া হবে। দ্বিতীয় আইনকে বলা হয় “জার্মান রক্ত এবং জার্মানদের সম্ভ্রম রক্ষার আইন”। আজ্ঞে হ্যাঁ, ঠিক এই নামেই একটি আইন পাশ করা হয়। এর প্রথম অনুচ্ছেদেই জাতিগত বিশুদ্ধতা সুনিশ্চিত করতে জার্মান মহিলাদের ইহুদিদের সঙ্গে বিবাহ হওয়াকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও তাদের ইহুদিদের বাড়িতে কাজ করা সহ আরও নানা কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বলাই বাহুল্য যে এসব আইন পাশ করার আগে হিটলার এবং গোয়েবেলস ঠিক আজকের আইটি সেলের মতোই নানারকম লেখালেখি করে ইহুদি পুরুষদের জার্মান মহিলাদের ফুসলিয়ে বিয়ে করার কাল্পনিক গল্প ফেঁদে একচেটিয়া প্রপাগাণ্ডা ছড়িয়েছিল। সুতরাং দুইয়ে দুইয়ে চার করে নিন। যাকে বলে ‘টেক্সটবুক ফ্যাসিজম’।

ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করতে ফ্যাসিবাদের এত মাথাব্যথা কেন?

দুটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে দৃঢ় করে। তাদের মধ্যে সামাজিক মেলবন্ধন শক্তিশালী করে। এতে ধর্মীয় পৃথকীকরণের মাধ্যমে একমাত্রিক সমাজ স্থাপনের ডানপন্থী চিন্তাধারাকে সরাসরিভাবে প্রত্যাখ্যান করা হয়। দ্বিতীয়ত মানুষের ব্যাক্তিস্বাধীনতাকে যথাসম্ভব সঙ্কুচিত করে একান্ত ব্যাক্তিগত ব্যাপারস্যাপারে নজরদারি চালানো তথা এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা ফ্যাসিবাদের একটি অন্যতম লক্ষ্য। তৃতীয়ত নারীদেহের উপর কর্তৃত্ব এবং এর মাধ্যমে তাদের মতামত প্রকাশের অধিকারকে যথাসম্ভব নিয়ন্ত্রণ করে পুনরায় সম্পত্তি আহরণ এবং সঞ্চয়কে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এতে সামন্ততান্ত্রিক পুঁজিবাদেরও পুনঃ.প্রতিষ্ঠা হয়। সুতরাং কোনো নির্দিষ্ট ধরনের ভালোবাসা বা কোনও বিশেষ দুজন ব্যাক্তির মধ্যে ভালোবাসাকে নিয়ন্ত্রণ করা এই আইনের উদ্দেশ্য নয়। আসলে সার্বিকভাবে সকল নাগরিকদের ব্যাক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করাই এর একমাত্র উদ্দেশ্য।

“মিছিলেও প্রেম হোক, ভেঙে যাক মোহ/ তুমি সাজো ব্যারিকেড আমি বিদ্রোহ”

যুগ-যুগ ধরে প্রেম-ভালোবাসা মানুষের প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ আন্দোলনের একটি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে। নারিবাদী আন্দোলন, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন থেকে শুরু করে হালের এলজিবিটি আন্দোলন সবখানেই ভালোবাসা শুধু ভাষা নয় বরং পথনির্দেশক হিসেবে কাজ করেছে। আলেকজান্দ্রা কলনতাই তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রেড লাভ’-এ বলেছেন ভালোবাসা আসলে দুজন মানুষের মধ্যে সম্পর্কের যোগসূত্র স্থাপন করে তাদের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করে। সুতরাং এর উপর রাষ্ট্রীয় নজরদারি কখনওই কাম্য নয়। যে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি  ব্যক্তিস্বাধীনতা এবং সাংবিধানিক মর্যাদা কোনওটারই তোয়ক্কা না করে এমন আইন পাশ করার দুঃসাহস দেখায় তাদের অচিরেই ক্ষমতা থেকে উৎখাত না করলে শেষের সেদিন খুবই ভয়ঙ্কর হবে।