Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘আমরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’: বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ ও আকাশবাণী

সৈয়দ কওসর জামাল

 

লেখক কবি ও প্রাবন্ধিক। দীর্ঘদিন প্রসারভারতীতে রেডিও ব্রডকাস্টারের দায়িত্ব সামলেছেন। বর্তমানে টেকনো ইন্ডিয়ার মিডিয়া স্টাডিজের আমন্ত্রিত অধ্যাপক।

 

 

 

 

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য লাভ করেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লিগ দল। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টির নেতা প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টো চাননি শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসুন। তাঁর প্রস্তাব ছিল আওয়ামী লিগ তাঁর দলের সঙ্গে মিলিতভাবে শাসনক্ষমতায় আসুক। শেখ মুজিবের পক্ষে এই প্রস্তাব স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করা সম্ভব ছিল না। তিন মাসের মধ্যেই, অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ১ মার্চ প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে ৩ মার্চ জাতীয় সংসদের যে অধিবেশন হওয়ার কথা তা অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে। নির্বাচিত জন-প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ জন্মে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের প্রতি এই আচরণকে তাঁরা তাঁদের প্রতি পাকিস্তানিদের অবিচার অত্যাচার ও ঔপনিবেশিক মনোভাবের প্রকাশ বলে মনে করেন।

১ মার্চ থেকেই শেখ মুজিবের নেতৃত্বে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন, যা ক্রমশ সার্বিক ধর্মঘট ও গণঅভ্যুত্থানের আকার নেয়। যা মোকাবিলার ক্ষমতা ছিল না শাসকের। তারা যা করতে পারে তাই করেছিল—নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা। ১৯৭১-এর ৭ মার্চ একটি ঐতিহাসিক দিন হয়ে আছে মুক্তিকামী মানুষের ইতিহাসে। এই দিন শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষের উদ্দেশে ডাক দেন মুক্তিসংগ্রামের। তাঁর ভাষণের একটি বাক্য এখন প্রবাদের মতো আমাদের স্মৃতিতে থেকে গেছে। বাক্যটি হল— “এবারে সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” তাঁর আহ্বানে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি তুলে লক্ষ লক্ষ মানুষ, বিশেষ করে তরুণ ও ছাত্র, গণ-অভ্যুত্থানে যোগ দেয়, যত ভাবে সম্ভব প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। তবু সশস্ত্র পাক সেনাবাহিনীর সামনে কোনও প্রতিরোধই তখন যথেষ্ট ছিল না। ১৫ মার্চের গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক নির্মম হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ হয়ে আছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে চলে এসেছেন কলকাতা ও অন্যান্য জায়গায়। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে বাঙালির আবেগ জড়িয়ে ছিল বলেই এপারে তাদের আশ্রয় পেতে অসুবিধে হয়নি।

১৯৭১ সালে আমরা, যারা তরুণ, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মুক্তিযুদ্ধের এই ঘটনাক্রম অত্যন্ত বেদনার সঙ্গে অনুসরণ করেছি। পূর্ব পাকিস্তান নয়, আমাদের সবার কাছে ওপারের বাঙালিদের বাসস্থান পূর্ব বাংলা। এই পূর্ব বাংলার সঙ্গে পশ্চিম বাংলার কয়েক কোটি মানুষের নাড়ির যোগ। তাই মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ে এপারে আমরা যেমন উল্লসিত হয়েছি তেমনি তাঁদের সাময়িক পরাজয় ও ক্ষয়ক্ষতিতে ব্যথিত হয়েছি। তখন আমাদের যে কোনও খবরের সূত্র ছিল প্রধানত রেডিও, আর রেডিও মানেই অল ইন্ডিয়া রেডিও, অন্য নাম আকাশবাণী। কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালিত গণমাধ্যম আকাশবাণী মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থন জুগিয়েছে। শুধুমাত্র বাঙালি ভাবাবেগ দ্বারা চালিত হলে তা সম্ভব হত না। হয়েছিল স্পষ্টতই রাজনৈতিক কারণে। পূর্ব বাংলার মানুষের লড়াই ও লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন। বিরুদ্ধভাবাপন্ন পাকিস্তানের সঙ্গে ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ ভারত ভোলেনি। আর কে না জানে শত্রু দেশ দুর্বল ও বিভক্ত হলে যে কোনও দেশেরই আনন্দ পাওয়ার কথা। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অতখানি সরল ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের ভৌগোলিক দূরত্ব কয়েক হাজার কিলোমিটারের। স্ট্রাটেজিক দিক থেকেও ভারতের অবস্থান সুবিধাজনক স্থানে। আর এক রাষ্ট্রের অন্তর্গত হওয়া ছাড়া পশ্চিমিদের সঙ্গে পূবের বাঙালিদের কোনও মিল ছিল না। ধর্মের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রব্যবস্থা যে চলতে পারে না তা প্রমাণিত হয়েছে পূর্ববঙ্গের মুসলমান অধ্যুষিত মানুষের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র দাবি করার মধ্যে দিয়ে। প্রমাণিত হয়েছে রাষ্ট্র গঠনে ভাষা ও সংস্কৃতির একটা বড় ভূমিকা থাকে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সঙ্গে পূর্ববাংলার মানুষের নাড়ির যোগ অগ্রাহ্য করা ভারত সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাছাড়া আলাদা রাষ্ট্র হলে যে কোনও সীমান্ত সংঘর্ষে ভারতকে আর পূর্ব সীমান্তে সৈন্যসমাবেশ করতে হবে না। কিন্তু সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য ছিল— ভারত পূর্ববাংলার স্বাধীনতা লাভে যদি সহায়তা করে তবে নতুন রাষ্ট্রকে সে বন্ধু হিসেবে পাবে— বন্ধু প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাওয়ার সাফল্য কম নয়। এই সব কারণে ভারত চেয়েছিল মুক্তযোদ্ধাদের জয় ও নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠন। এই পটভূমিতেই শেখ মুজিবুর রহমান, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতা-আকাঙ্ক্ষার প্রতি ভারত সরকারের  অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতার বিষয়টিকে দেখতে হবে।

১৯৭১ সালে গণমাধ্যম হিসেবে আকাশবাণীর গুরুত্ব এখনকার প্রেক্ষিতে অনুধাবন করা সত্যিই খুব কঠিন। তবু, একটি দেশে মুক্তিযুদ্ধ বা স্বাধীনতার লড়াই চলছে আর পার্শ্ববর্তী দেশের রেডিও সেই যুদ্ধের পুঙ্খানুপুঙ্খ সংবাদ দিয়ে যাচ্ছে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল বাড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে এমন একটা সময়ে যখন আর কোনও সংবাদসূত্র তাঁদের কাছে নেই। শুধু সংবাদ নয়, গান, ফিচার, কথিকা ইত্যাদি নানা বাংলা অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে তাঁদের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করছে ও উদ্দীপ্ত করছে আকাশবাণী কলকাতা। যতই রাজনৈতিক কারণ থাক, আকাশবাণী কলকাতার প্রযোজক, অনুষ্ঠান পরিবেশক, সঞ্চালক, সংবাদপাঠক যদি ওপার বাংলার সঙ্গে তাঁদের নাড়ির টান অনুভব না করতেন তবে শুধু সরকারি আদেশ পালনের জন্য এই আবেগ সঞ্চারিত হত না। অনেকের অভিজ্ঞতায় আছে সেদিনের আকাশবাণীর অনুষ্ঠান শোনার স্মৃতি। আকাশবাণীর এই ভূমিকাকে অকুণ্ঠচিত্তে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন বাংলাদেশের মানুষ।

এইসব অনুষ্ঠান শ্রোতা হিসেবে আমাকে যতই আবেগাপ্লুত করে থাকুক, ১৯৭৮ সালে আকাশবাণীতে যোগ দেওয়ার আগে পর্যন্ত আমার পক্ষে অনেক ঘটনার পশ্চাৎপটের দিকটি জানা ছিল না। ১৯৭১ সালে আকাশবাণীতে কাজ করেছেন এমন মানুষের সাক্ষাৎ কিছুদিন আগে পর্যন্ত পেয়েছি। তাঁদের সঙ্গে কাজ করার সৌভাগ্যসূত্রে অনেক অজানা তথ্য জানার সুযোগ আমার হয়েছিল। তাঁদের কাছ থেকে পাওয়া কথাগুলো জোড়া দিয়ে কাহিনির অনেকখানি পেয়েছিলাম আমি। সেই সময়ের সাড়াজাগানো অনুষ্ঠান ছিল ‘সংবাদ বিচিত্রা’, প্রযোজক ছিলেন উপেন তরফদার যিনি কয়েক মাস আগে পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে ছিলেন এবং আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ ও প্রামাণ্য রেকর্ডিং সহযোগে নিউজরিল তৈরি করতেন তিনি।

১৯৭১-এর ৭ মার্চ রেস কোর্সে শেখ মুজিবের আবেগদীপ্ত ভাষণ— “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”— রেকর্ড করতে ঢাকায় উপস্থিত হয়েছিলেন উপেন তরফদার। ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের সময় উপস্থিত থেকে রেকর্ডিং করে এনে ‘সংবাদ বিচিত্রা’ তৈরি করেছিলেন। এই শপথ অনুষ্ঠান হয়েছিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায়। যার নাম দেওয়া হয়েছিল মুজিবনগর। শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দিন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করা হয়। শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে তিনি ছাড়া অন্যরা অস্থায়ী সরকারের শপথগ্রহণ করেন। অধ্যাপক ইউসুফ আলি তাঁদের শপথবাক্য পাঠ করান। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেন— “পূর্ব পাকিস্তান আজ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশ।” এই অনুষ্ঠানে গাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত— “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।” আকাশবাণীর পক্ষ থেকে এই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রণবেশ সেন ও উপেন তরফদার। পরদিন আকাশবাণী থেকে এই অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং শোনানো হয়। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের পাবলিক রিলেশন অফিসার সমর সেনের তত্ত্বাবধানে তাঁরা মেহেরপুরে পৌঁছেছিলেন। এই অস্থায়ী সরকার গঠনের পরই সেই সরকারের অফিস হয়েছিল কলকাতার থিয়েটার রোডের ৬ নম্বর বাড়িতে এবং ঘোষণা করা হত মুজিবনগরের পক্ষ থেকে।

মেহেরপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন আব্দুল মান্নান, যিনি পরে আকাশবাণীর সহযোগিতায় স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র তৈরি করতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আব্দুল গফফর চৌধুরীও। এই বেতারকেন্দ্র নির্মিত হয়েছিল কলকাতার ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে। অনুষ্ঠান নির্মাণ ও সম্প্রচারের সমস্ত কারিগরি সহায়তা দিয়েছেন আকাশবাণীর কর্মীরা। সম্প্রচারের জন্য আকাশবাণীর দুটি ট্রান্সমিটার কাজ আলাদা করে রাখা হয়েছিল। এই বেতারকেন্দ্র বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরও বেশ কিছুদিন চালু ছিল। এই বেতারকেন্দ্রে দুই বাংলার বিখ্যাত শিল্পীরা ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের বেতারকেন্দ্রগুলোতে কাজ করা কয়েকজন কর্মীও ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের মাসগুলোতে আকাশবাণী কলকাতার বেশিরভাগ অনুষ্ঠানের ফোকাস ছিল দুই বাংলা ও বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐক্য। প্রতিদিন রাত দশটায় বাংলা সংবাদের ঠিক আগে প্রচারিত ‘সংবাদ পরিক্রমা’র প্রায় প্রতিদিনের বিষয় হত মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা ও পুব বাংলার মানুষের কথা। আর এই সংবাদ পরিক্রমার স্ক্রিপ্ট লিখতেন প্রণবেশ সেন আর আবেগমথিত কণ্ঠে সেগুলো পাঠ করতেন দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তরুণ চক্রবর্তীও পড়তেন পরিক্রমার স্ক্রিপ্ট। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহপাঠী তরুণ তখন সদ্য ক্যাজুয়াল সংবাদপাঠক হিসেবে কাজ করতে শুরু করেছেন, পরে রেগুলার নিউজ-রিডার হন। এই পরিক্রমা পূর্ববাংলার মানুষ ও মুক্তিযোদ্ধাদের লড়াইয়ে উৎসাহ ও প্রেরণা জুগিয়েছে।

প্রতিদিনই আকাশবাণী কলকাতা থেকে প্রচারিত হত উদ্দীপক বাংলা গান। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা, দীনেন গুপ্তের সুরে অংশুমান রায়ের গাওয়া গান ‘একটি মুজিবুরের থেকে লক্ষ মুজিবুর’, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবীদের কাছে মন্ত্রের মতো ছিল। আর যখন এই গানের সঙ্গে মুজিবুরের বক্তৃতার অংশ যোগ করে   সম্প্রচার করা হয়েছিল তখন সেই গান হয়ে ওঠে স্বাধীনতা যোদ্ধাদের জীবন-আলেখ্য। এমন আরও উদ্দীপক গান আকাশবাণী থেকে সম্প্রচারের ব্যবস্থা করা হত নিয়মিতভাবেই। যেমন, শ্যামল গুপ্তের লেখা ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের একটি নাম মুজিবর’ গানটি পূর্ববাংলার শিল্পী মোহম্মদ আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে প্রচারিত হত। এই গানটি স্বাধীন বাংলা বেতার থেকেও নিয়মিত বাজানো হত।

পাশাপাশি ছিল নানা ধরনের কথিকা ও বেতার আলেখ্য। কথিকার বিষয় হত বাংলা ও বাঙালির ঐক্য। ১৯৭১ সালে বাংলা সাহিত্য ও কথিকার দায়িত্বে ছিলেন সরল গুহ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জানি, সরল গুহ-র অনুরোধে প্রতি সপ্তাহে পূর্ববাংলার লেখকদের বই রিভিউ করতেন সাহিত্যিক সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। কলকাতার অন্য কবি ও লেখকেরাও নানাভাবে যুক্ত থেকেছেন আকাশবাণীর অনুষ্ঠানের সঙ্গে। ওইসময় কবিতা সিংহ ছিলেন আকাশবাণী কলকাতার যুববাণী বিভাগের প্রযোজক। সম্ভবত আগের বছর প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে আকাশবাণীতে যোগ দেন জগন্নাথ বসু ও পঙ্কজ সাহা। ১৯৭১ সালে এঁদের কাজ করতে দেখেছি যুববাণী বিভাগে। ব্যক্তিগতভাবে আমিও ওইসময় থেকে যুববাণীতে কবিতাপাঠ ও আলোচনায় অংশ নিয়েছি। যুববাণীর জন্য কবিতা সিংহ যে সব অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা গ্রহণ করতেন, সেগুলোকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব নিতে হত তাঁদের। মনে আছে বাইরে থেকে রেকর্ড করে এনে যুববাণীর অনুষ্ঠান সাজাতেন পঙ্কজ সাহা। যুববাণীতে যুক্ত থাকার সময় এঁদেরও নিশ্চয়  মুক্তিযুদ্ধের ওপরে যুবাদের উপযোগী অনুষ্ঠান করতে হয়েছিল। অনেক পরে জগন্নাথ বসু নাটক বিভাগের প্রযোজক ও পঙ্কজ সাহা দূরদর্শনের প্রযোজক হয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে আকাশবাণীর একটি উল্লেখ করার মতো অনুষ্ঠান ছিল রেডিও কার্টুন। পৃথিবীর সম্প্রচার ইতিহাসে কার্টুন এক অভিনব অনুষ্ঠান। খবরের কাগজে যে কার্টুন আমরা দেশি, সেই শাণিত ব্যঙ্গ দিয়ে নির্মিত হত আকাশবাণীর কার্টুন। এক মিনিটের অনুষ্ঠান। এটি ছিল তদানীন্তন কেন্দ্র অধিকর্তা দিলীপ সেনগুপ্তের উদ্ভাবনা। একটি উদাহরণ দিই। “ঢাকার পল্টন ময়দানে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজির ভাষণ”… নিস্তব্ধতা… শ্রোতার আস্বস্তি তৈরি করে বলা হল মাঠে একজন শ্রোতাও নেই দেখে লে-জেনারেল মুখ খোলেননি… এইরকম ছিল রেডিও কার্টুন। খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল অনুষ্ঠানটি।

এবার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলে শেষ করব। ১৯৯৬ সালে আমি আকাশবাণী কলকাতায় কর্মরত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে দুটি আলোচনা প্রযোজনা করার সময় সংবাদপত্রের সাংবাদিক, যেমন সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত, বেতার সাংবাদিক উপেন তরফদার প্রমুখ যাঁদের মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ছিল এমন মানুষদের ডেকেছিলাম। তাঁদের আলোচনা আমাকে অনেক তথ্য জানার সুযোগ দিয়েছিল। আর একবার আমাদের হেডকোয়ার্টার্স, দিল্লির আকাশবাণী ভবন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় আকাশবাণী কলকাতার ভূমিকা সে সময় কেমন ছিল এই বিষয়ে রিপোর্ট চাওয়া হলে আমি পুরনো ফাইলপত্র খুঁজে দেখার চেষ্টা করি। আশ্চর্যের সঙ্গে লক্ষ করেছি সে সময়ের কোনও ‘কনফিডেন্সিয়াল’ ফাইল সংরক্ষণ করা হয়নি, অর্থাৎ বাংলাদেশ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরপরই সেসব নষ্ট করে ফেলা হয়েছিল। আমার আর জানার সুযোগ হয়নি স্বাধীন বেতারকেন্দ্রের সম্প্রচারের জন্য আকাশবাণীর কোন কোন ট্রান্সমিটার ব্যবহার করা হয়েছিল বা কেমন ছিল সেই সব আদেশের বয়ান।