Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কবিতার সিঁড়ি বেয়ে কৈশোরের চিলেকোঠায়

সুচেতনা দত্ত

কবিতা আমার আজন্মের শত্তুর।

জ্ঞান হওয়া ইস্তক দেখে আসছি, বাড়িতে দুর্বোধ্য নানারকম কবিতার বই, আর এক মহিলা যখন তখন মুখ গুঁজে আছেন সে সব বইয়ে। ওনার আমার সাথে খেলনাবাটি খেলার সময় নেই, আমাকে নিয়ে শিশু উদ্যান যাওয়ার সময় নেই, অথচ ওই বইগুলো ওনার নিয়ম করে পড়া চাই। আবার শুধু পড়েও ওনার হয় না, কারণে-অকারণে নানারকম কবিতার লাইন বলতেও উনি ভালোবাসেন। সন্ধে হলে সবার বাড়িতে শাঁখ বাজে, আমাদের বাড়িতে বাজে না, তার বদলে শুনতে হয় অদ্ভুত একেকটা লাইন, বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাঠের ধারের ঝুপসি বাবলাগাছটার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠেন “শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা নামে, ডানায় রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল।” এবার এই কথার কী মানে? এত তাড়াতাড়ি শিশির পড়ে? তাও নাকি শব্দ করে? কখনও হয়? হতে পারে? এরকম অদ্ভুত অদ্ভুত সব লাইন যখন তখন শুনতে শুনতে জীবনানন্দ নামের লোকটার উপর এক অদ্ভুত আক্রোশ নিয়ে বড় হতে থাকি। লোকটার লেখা কবিতার বইগুলোয় চোখ বুলিয়ে দেখেছি আমি, কোনও কবিতার কোনও মানে বোঝা যায় না, এদিকে মন খারাপ করিয়ে দেয় এমন অদ্ভুত সব লাইন। এমনই মন খারাপ করিয়ে দেয় যে মন খারাপটা সহজে মুছে যায় না, বরং কুরে কুরে খেতে থাকে।

রেগে গিয়ে বলি “ওর নামের মানে তো জীবনের আনন্দ, তাহলে এত মন খারাপের কবিতা লিখেছে কেন? সকালবেলাতেও মন খারাপ, দুপুরবেলাতেও মন খারাপ, বিকেলবেলাতেও মন খারাপ, সন্ধ্যাবেলাতেও মন খারাপ, এত মন খারাপ কেন?”

উত্তরে শুনতে পাই “জীবনে নানারকমের আনন্দ আছে, বিষণ্ণতারও আনন্দ আছে…….।” আরও কী কী সব কঠিন কঠিন কথা। শুনতেও ইচ্ছে করে না। এর থেকে আনন্দমেলার কবিতাগুলো ঢের ভালো। নিজে পড়েও না, জানেও না।

আর শুধু কি জীবনানন্দ? আরও আছে। কবিদের নামও ভালো হয় না। বুড়ো বুড়ো সব নাম। বিষ্ণু, সুধীন্দ্রনাথ, অরুণ, বিনয়, তুষার, সুভাষ এইসব। শুধু একটা দুটো নাম ভালো লাগে– শঙ্খ, পূর্ণেন্দু। আর আরেকজনের নামও আমি জানি, সব আনন্দমেলায় তার নাম থাকে, নীরেন্দ্রনাথ। সে আমাকে একটা চিঠিও লিখেছিল একবার। তার কবিতার বইয়ের কবিতাগুলো আমার অত কঠিনও লাগে না। ব্যাস্। এই তিনজন বাদে আর কোনও কবিকে আমি পছন্দ করি না। রবীন্দ্রনাথকে আর নজরুলকে অবশ্য ভালো লাগে। আর সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকেও। কী সুন্দর ছন্দ মেলাতে পারে এরা। আর মানেগুলোও দিব্যি বোঝা যায়।

জীবনানন্দকে আমার এত খারাপ লাগে যে কী বলব! সারাক্ষণ ইদুঁর, প্যাঁচা এইসব অন্ধকারের জীব নিয়ে কবিতা লেখা! আবার আমার নাম নিয়েও কবিতা লেখা হয়েছে! তাতে আবার রক্ত-মক্ত কীসব! লোকটাকে আমি শিক্ষা দেব। কী করি? এই তো পেয়েছি বুদ্ধি। ধূসর পাণ্ডুলিপির মলাটের কোণাটা চিবিয়ে চিবিয়ে খাই আমি। যেমন মলাটের রঙ, তেমনই শক্ত! মলাটের খানিকটা চিবিয়ে খেয়ে নিয়ে শান্তি হয় আমার।

কিছুক্ষণ বাদেই ধরা পড়ে যাই অবিশ্যি। অপকম্মের শাস্তি হিসেবে দাঁতে নোড়া ঘষে দাঁত ভোঁতা করে দেওয়ার ভয় দেখানো হয় আমাকে। বাবা অফিস থেকে এসে যাওয়ায় আর সেটা সত্যি সত্যি করতে পারে না। আমাকে কষ্ট দেওয়া বাবা পছন্দ করে না। বাবাকে দেখানো হয় ধূসর পাণ্ডুলিপির কী অবস্থা করেছি আমি। তখন আবার জানতে পারি, ওই বইগুলো নাকি বাবা নিজেই কিনে এনে উপহার দিয়েছিল ওনাকে। বাবার এরকম কাজে আমার কান্না পেয়ে যায়। সহজে আবার আমার কান্না থামে না। ফোঁপাতে ফোঁপাতে প্রায় ঘুমিয়ে পড়ি। আধো ঘুমের মধ্যেই শুনতে পাই, বাবা আমার কপালের চুলগুলো সরিয়ে দিতে দিতে বলছে, “ঝুকাইবুড়ি, তুমি বইয়ের মলাটটা খেতে গেলে কেন মা?”

ঘুমের মধ্যেই জড়ানো গলায় উত্তর দিই, “সব খেয়ে নেব। কাল খাব সাতটি তারার তিমির। পরশু খাব বিষ্ণু দে।” তরশু কাকে খাওয়া যায় ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি।

পরের দিন সকালে উঠে দেখি সমস্ত কবিতার বইয়ের উপরে লন্ড্রির দোকানের কাগজের প্যাকেটগুলোর উল্টোদিকগুলো দিয়ে মলাট দেওয়া হয়ে গেছে।

মন্দ

শঙ্খ ঘোষ

ভিতর থেকেই ভালোবাসব ভেবে
গিয়েছিলাম সেদিন তোমার কাছে
কিন্তু এ কী আরেক রকম মুখ
জেগে উঠল দহনবেলার আঁচে।
শরীরমনকে জরিপ করে নিয়ে
চাইছিলে সব সন্দেহভঞ্জন
আলতো টানে চোখের সীমানাতে
হিংস্রতাকে করেছিলে অঞ্জন
দিন বা রাতে গলিতে রাজপথে
ঝুলিয়ে দিয়ে রক্তঝরা ঝালর
দেখছিলে ঠিক কাদের হিসেবমত

তফাত করি মন্দ এবং ভালোর
বাঁধছিলে খুব শক্ত আলিঙ্গনে
না হই যাতে পিছলপথগামী
সবটা যদি তোমার মত না হই
অবশ্যই মন্দ তবে আমি–
মন্দ তবে অবশ্যই আমি

ইস্কুলে যেমন যেমন নতুন ক্লাসে উঠতে থাকলাম, কবিদের প্রতি আমার হিংস্র মনোভাবটা একটু একটু করে কমতে লাগল, স্কুলের বাংলা বইয়ের পাতায় অন্য কবিদের দেখা পেয়ে। এখন আমি আরও অনেক কবিদের নাম জানি, তাদের কবিতাগুলো মোটেই অমন দুর্বোধ্য, জটিল নয়। এই সব কবিদের নামগুলোও বেশ ভালো, সুরেলা; যেন রূপকথার পাতা থেকে কিছু নাম উঠে এসেছে। কুসুমকুমারী, সুকুমার, বন্দে আলি মিঞা, সুকান্ত, সুনির্মল, জসিমুদ্দিন, সুখলতা– এইসব নাম দিয়ে আমি দিব্যি একটা গল্প লিখতে পারতাম। টিচার-টিচার খেলায় আমার একটা রোলকল করার খাতা ছিল, আর সেই খাতায় যেসব ছাত্র-ছাত্রীদের নাম ছিল, তার মধ্যে এনারাও ছিলেন। জসিমুদ্দিন তো আমার খুবই প্রিয় ছাত্র ছিল, আর কুসুমকুমারী? শুধু তার নামের জন্যই আমি বিশেষ পক্ষপাতিত্ব করে তাকে আমার পুতুল-ইস্কুলের ক্লাসের মনিটর করে দিয়েছিলাম।

এরপরেই একদিন ঝামেলাটা হল। কুসুমকুমারীর লেখা কবিতা পড়াতে গিয়ে, কবিপরিচিতির সময়ে বাংলার দিদিমণি বলে বসলেন, “এনারই সুযোগ্য পুত্র জীবনানন্দ দাশ।” এই পরিচয়টি পেয়ে আমার মনের কীরকমের অবস্থা হল, এতদিন পরেও তার বিবরণ দেওয়া খুবই কষ্টকর। শুধু এটুকুই বলা যেতে পারে যে “কুসুমে কীট” বলতে কী বোঝানো হয়, তা আমি মর্মে মর্মে এবং অক্ষরে অক্ষরে উপলব্ধি করলাম। সেই দিন বিকেলেই আমার ঘরের ইস্কুলের ব্ল্যাকবোর্ডে (বাইরের ঘরের সাদা দেওয়ালে) নতুন মনিটরের নাম উঠল– সুনির্মল। জসিমুদ্দিন আর কুসুমকুমারী আর জয়েন্ট ফার্স্ট বয়, ফার্স্ট গার্ল থাকল না, কুসুমকুমারীর জায়গায় নতুন জয়েন্ট ফার্স্ট বয় হয়ে উঠে এল বন্দে আলি। যদিও মন কেমন করতে থাকল কুসুমকুমারীর জন্য, ছেলে ওরকম বিদঘুটে কবিতা লিখলে মা আর কী করবে, এসব ভেবেটেবে কুসুমকুমারীকে সেকেন্ড র‍্যাঙ্কটা দিয়েই দিলাম। নিজেকে বললাম– ওই যে প্রথমেই শুধুমাত্র কুসুমকুমারী নামটা অত ভালো লেগে গিয়েছিল বলেই অতটা পক্ষপাতিত্ব করেছিলাম সেটা উচিত হয় নি। তা বাদে বন্দে আলি আর জসিমুদ্দিনের কবিতাগুলো যেমন চোখ বন্ধ করলেই চোখের সামনে ছবির মতো দেখতে পাই, কুসুমকুমারীর কবিতা মোটেই ওরকম সিনেমার মতো দেখতে পাই না। এইভাবে আমার ন্যায়বিচারের দাঁড়িপাল্লায় দুইদিকই সমান করে দিলাম। মানে দাঁড়াল এই যে বন্দে আলি তার নিজের যোগ্যতাতেই নিজের জায়গা করে নিয়েছে, শুধুমাত্র ভালো নামের জন্য পক্ষপাতিত্ব করে তাকে ফার্স্ট বয় করে দেওয়া হয়নি।

এবারে নিজের সাথেই নিজের দ্বন্দ্ব। বন্দে আলির আরও কবিতা পড়তে হবে, কবিকেও আরও ভালো করে জানতে হবে। পরে যেন জানতে না হয় এনার ভাই বা ছেলেও আমার মায়ের কোনও প্রিয় কবি। কিন্তু কী করে জানা যায়? বাড়িতে জসিমুদ্দিনের কবিতার বই দেখেছি, কিন্তু বন্দে আলির বই দেখিনি। মালামাসির বাড়িতেও দেখিনি, কৃষ্ণামাসির বাড়িতেও না। ছোটমাসিকে বললে হয়তো সিউড়ির ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরি থেকে এনে দেবে, কিন্তু গরমের ছুটিতে সিউড়ি যাওয়া অব্দি অপেক্ষা করা আমার মতো অধৈর্য্য মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। সামনের বাড়ির সোমাদিকে বললাম। সোমাদি খুব একচোট হেসে আমাকে শিশু উদ্যানে নিয়ে গিয়ে দাদুর কাছে হানা দিল, বলল আমার সমস্যার কথা। সমস্যার সমাধানও হল। দাদু ক’দিন বাদে সোমাদি মারফত আমাকে ডেকে পাঠালেন, তারপর দিলেন এক আশ্চর্য বই– ময়নামতীর চর। একটু দ্বিধা নিয়ে বললাম “বড়দের বই নয় তো?” (কদিন আগেই ম্যাপ বইয়ের মধ্যে “স্বপ্নের পুরুষ ও একটি জীপগাড়ি” নামের একটা বই রেখে পড়তে গিয়ে, প্রথম পাতা শেষ হওয়ার আগেই ধরা পড়ে গিয়ে মায়ের হাতে গোটা কতক চড় খেয়েছিলাম কিনা। স্মৃতিটা একটু দগদগে ছিল।) দাদু একটু হেসে নিয়ে বললেন যে ময়নামতীর চর বইটা পুরো পড়ে আমি নিজেই যেন এসে বলি বইটা বড়দের না ছোটদের। বাড়ি এসে মাকে বইটা দেখিয়ে বেশ বাঁকা গর্বের সুরে বললাম “এই বইটা দাদু পড়তে দিয়েছে।” আসলে বলতে চেয়েছিলাম “বড়দের বই-ই হোক অথবা ছোটদের বই, কিছু বলতে এসো না।” মা সত্যিই কিছু বলল না।

বললাম তো। কিন্তু তারপর? ঘোর লেগে গেল। সে ঘোর আজও কাটেনি। অনেক শব্দর মানেই বুঝলাম না, অনেক ছবিও স্পষ্ট হল না। কিন্তু একটুও অসুবিধা হল না, বড় হওয়ার পথে দু-কদম এগিয়ে যেতে।

ময়নামতীর চর

বন্দে আলি মিঞা

এ-পারের এই বুনো ঝাউ আর ও পারের বুড়ো বট
মাঝখানে তার আগাছায় ভরা শুকনো গাঙের তট;
এরই উঁচু পারে নিত্য বিহানে লাঙল দিয়েছে চাষী,
কুমীরেরা সেথা পোহাইছে রোদ শুয়ে শুয়ে পাশাপাশি।
কূলে কূলে চলে খরমূলা মাছ, দাঁড়িকানা পালে পালে
ছোঁ দিয়ে তার একটারে ধরি’ গাঙচিল বসে ডালে
ঠোঁটে চেপে ধরি’ আছাড়ি আছাড়ি নিস্তেজ করি তায়
মুড়ো পেটি লেজ ছিঁড়ি একে একে গিলিয়া গিলিয়া খায়।
এরি কিছু দূরে একপাল গোরু বিচরিছে হেথা সেথা
শিঙে মাটি মাখা দড়ি ছিঁড়ি ষাঁড় চলে সে স্বাধীনচেতা।
মাথা নিচু করি কেহ বা ঝিমায় কেহ বা খেতেছে ঘাস,

শুয়ে শুয়ে কেহ জাবর কাটিয়া ছাড়িতেছে নিঃশ্বাস;
গোচর পাখিরা ইহাদের গায়ে নির্ভয়ে চলে ফেরে
উকুন আঠালু ঠোকরিয়া খায় লেজের পালক নেড়ে;
বক পাখিগুলো গোচরকীয়ার হয়েছে অংশীদার
শালিক কেবলই করিছে ঝগড়া কাজ কিছু নাই তার।
নতুন চরের পলি জমিটাতে কলাই বুনেছে যারা
আখের খামারে দিতেছে তারাই রাতভর পাহারা;
খেতের কোণায় বাঁশ পুঁতে পুঁতে শূন্যে বেঁধেছে ঘর
বিচালী বিছায়ে রচেছে শয্যা বাঁশের বাখারি ‘পর।
এমন শীতেও মাঝ মাঠে তারা খড়ের মশাল জ্বালি
ঠকঠকি নেড়ে করিছে শব্দ হাতে বাজাইছে তালি।
ওপার হইতে পদ্মা সাঁতারি বন্য বরাহ পাল
এ-পারে আসিয়া আখ খায় রোজ ভেঙে করে পয়মাল।
তাই বেচারিরা দারুণ শীতেও এসেছে নতুন চরে
টোঙে বসি বসি জাগিতেছে রাত পাহারা দেবার তরে;
কুয়াশা যেন কে বুলায়ে দিয়েছে মশারির মত করি
মাঠের ওপারে ডাকিতেছে “ফেউ” কাঁপাইয়া বিভাবরী।
ঘুমেল শিশুরা এই ডাক শুনি জড়ায়ে ধরিছে মায়,
কৃষাণ যুবতী ঝাপটি তাহারে মনে মনে ভয় পায়;
“ফেউ” নাকি চলে বাঘের পেছনে গাঁয়ের লোকেরা বলে
টোঙের মানুষ ভাবিতেছে ঘর, ঘর ভেজে আঁখি জলে।
এই চরে ওই হালটার কোণে বিঘে দুই ক্ষেত ভরি
বট ও পাকুড়ে দোঁহে ঘিরে ঘিরে করি আছে জড়াজড়ি।
গাঁয়ের লোকেরা নতুন কাপড় তেল ও সিঁদুর দিয়া
ঢাক ঢোল পিটি গাছ দুইটির দিয়ে গেছে নাকি বিয়া।
নতুন চালুনি ভেঙে গেছে তার, মুছি আর কড়িগুলা
রাখাল ছেলেরা নিয়ে গেছে সব ভরি গামছায় ঝুলা।
চড়কের মেলা এই গাছতলে হয় বছরের শেষে

সে দিন যেন গো সারা চরখানি উৎসবে ওঠে হেসে।
বটের পাতায় নৌকা গড়িয়া ছেড়ে দেয় জলে কেউ,
এই চর হতে ওই গাঁ’র পানে নিয়ে যায় তারে ঢেউ।
ছোট ছেলেপুলে বাঁশি কিনে কিনে বেদম বাজায়ে চলে,
বুড়োদের হাতে ঠোঙায় খাবার, কাশে আর কথা বলে।
ছেঁড়া কলাপাতা টুকরো বাতাসা চারিদিকে পড়ে রয়
পরদিনে তার রাখাল ছেলেরা সবে মিলে খুঁটে লয়;
উৎসব শেষে খাঁ খাঁ করে হায় শূন্য বালির চর–
এ পারের পানে চাহিয়া ও পার কাঁদে শুধু রাত ভর।

ময়নামতীর চর নামের একটা কবিতার বইয়ের কয়েকটা ছত্র আমাকে বড় হওয়ার পথে দুই কদম এগিয়ে দিয়েছিল। লাইনগুলো বড় অদ্ভুত ছিল। জমকালো রোদ্দুরে খোলা রাস্তার দিকে তাকালে সব কিছু যেমন তিরতির করে কাঁপতে থাকে, সামনে যা কিছুই দেখি, যেন অল্প ঘষা কাঁচের মধ্যে দিয়ে দেখা। সবই দেখতে পাচ্ছি, তবু যেন তিরতিরে কাঁপতে থাকা রোদ্দুরে ভেজা জলছবি। হাতছানি দেয় আরও স্পষ্ট করে দেখেবুঝে নিতে, কিন্তু মাঝের ঘষা কাঁচটা কিছুতেই স্পষ্ট হতে দেয় না। কবিতার কয়েকটা লাইনও তেমনই ছিল– কোনও দুর্বোধ্য শব্দ নেই, পড়ছি, আন্দাজও পাচ্ছি, তবু আবছায়া। বড় হওয়ার রাস্তাটায় সেই বোধহয় পা ফেলার শুরু। তবে তাই বলে কি আর মিঠুদির বাড়ি থেকে মায়ের ধার করে আনা সুনীল গাঙ্গুলির প্রেমের উপন্যাস লুকিয়েচুরিয়ে পড়ার চেষ্টা করিনি এর আগে? নাকি অ্যাসেম্বলিতে ‘বিশ্ব সাথে যোগে যেথায়’ গাইতে গিয়ে ‘গোপনে প্রেম রয় না ঘরে আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ে’ লাইনটা গাওয়ার সময় হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়িনি? কিন্তু এই বইটার কয়েকটা লাইনে যেন অন্য কোনও রহস্যের হাতছানি! বুঝি না ঠিক, কিন্তু রহস্যের ভিতরে ঢুকতেও সাহস হয় না। কেমন একটা কালো পোঁচ যেন, খাঁ খাঁ করা ভাঙা বাড়ির আনাচেকানাচে।

এখন আর আমার শুধু বই পড়তেই ভালো লাগে না, টিভিতে সিনেমা দেখতেও বড় ভালো লাগে। বাইরের ঘরে বসে বইয়ে মুখ ঢেকে সব সিনেমা আর সিরিয়াল গিলে নিই। শনিবারের বিকেলগুলোতে তো উৎসব আমাদের বাড়িতে, বাংলা সিনেমা দেখতে সবাই আসে– মায়ামাসিমণি, মিঠুদি, সোনালীদি, তুলিপিসি, বন্দনাপিসি আরও কত লোক। এরকমই এক শনিবারে এত লোকের মধ্যে মা খেয়ালই করে না, আমিও সবটুকু দিয়ে শুষে নিচ্ছি কেদার রাজা।

সরোজ নামের মেয়েটা যে কেন এত সরল, কেন এত সহজেই বিশ্বাস করছে খারাপ লোকটাকে? আর ওর বাবাই বা কেমন? আমি প্রভাস নামের লোকটার চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝে যাচ্ছি লোকটা খারাপ, আর পাহাড়ি সান্যাল এত বয়স্ক একজন মানুষ হয়েও বুঝছে না! রাগের চোটে বড় অসহায় বোধ করি। সিনেমার শেষের দিকে গণেশের চোখের তীব্র দৃষ্টিতে কী যেন ছিল? শুধুই কি সরোজকে বাঁচাতে চেয়েছিল, আর কিছুই কি চায়নি গণেশ? এর উত্তর না তো পরিচালক আর নাই বা লেখক খোলসা করে গেছেন। শুধু গণেশের সেই অদ্ভুত চাউনিটা দেখেই বুঝে যাই– সেই যে সেই অন্য জগতটা, যাকে বড়দের জগত বলে, সেখানে আজ থেকে পা ফেললাম। রাত্তিরে যখন ঘুমোতে যাই, কানের কাছে মায়ের গলায় সেই বহুবার শোনা লাইনগুলোই আবার শুনি— “আলো— অন্ধকারে যাই— মাথার ভিতরে স্বপ্ন নয়, কোনও এক বোধ কাজ করে! স্বপ্ন নয়— শান্তি নয়— ভালোবাসা নয়, হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!”

ভারী হয়ে আসা চোখের পাতা জোর করে খুলে দেখি– কই না তো! মা তো জানলায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আবৃত্তি করছে না! রান্নাঘর থেকে জলের আওয়াজ আসছে, মায়ের আজ রাতের বাসন মাজাই শেষ হয়নি এখনও। তাহলে?
ঘুমে তলিয়ে যেতে যেতে স্বপ্ন দেখি– প্রায় অন্ধকার হয়ে আসা এক বিকেলে একটা লোক ধুতিপাঞ্জাবী পরে একটা পুকুড়পাড়ে বসে আছে, ঘাটের পাশে ঝুরি-নামানো ঝুপসি সব গাছ। লোকটাকে বড় সাধারণ দেখতে, মাথায় ইষৎ ঢেউখেলানো চুল, শুধু চোখদুটো বড় বড়। কী যেন ভাবছে লোকটা! এমন সময়ে শার্ট আর ধুতি পরে একটু ভারীমতো চেহারার আরেকটা লোক এসে বসে পড়ল আগের লোকটার পাশে। দুজনে গুনগুন করে কী যেন গল্প করে, দুজনে বুঝি দুজনকে গাছ চেনাচ্ছে। আমি দুটো লোককেই চিনি, ওদের ছবি আমি অনেকবার দেখেছি। কিন্তু স্বপ্নের মধ্যে কি কারুর নাম মনে করা যায়!

শুধু মা আজও বলে, আমি নাকি যেদিন টিভিতে কেদার রাজা দিয়েছিল, সেদিন রাতে ঘুমের মধ্যে বিড়বিড় করে কেদাররাজা কে লিখেছিল জিজ্ঞেস করেছিলাম। কী জানি, আজও সেই আবছায়া অন্ধকারে পুকুরের ঘাটে বসে জীবনানন্দ আর বিভূতিভূষণ গাছের নাম চেনার খেলা খেলেন কিনা!

বোধ

জীবনানন্দ দাশ

আলো-অন্ধকারে যাই– মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়– কোনও এক বোধ কাজ করে!
স্বপ্ন নয়– শান্তি নয়– ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়!
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে;
সব কাজ তুচ্ছ হয়– পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা–- প্রার্থনায় সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়!
সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে!

কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো!
তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর!
কোনও নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর?
শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর?
প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার!
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই! ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?
স্বপ্ন নয়– শান্তি নয়– কোনও এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে!

পথে চ’লে পারে– পারাপারে
উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
মড়ার খুলির মতো ধ’রে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারিপাশে!
তবু সে চোখের চারিপাশে!
তবু সে বুকের চারিপাশে!
আমি চলি, সাথে সাথে সেও চলে আসে!
আমি থামি,
সে-ও থেমে যায়;

সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধাঁ?
আমার পথেই শুধু বাধা?
জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের মতো হয়ে,–
সন্তানের জন্ম দিতে দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজক্ষেতে আসিতেছে চ’লে
জন্ম দেবে-জন্ম দেবে ব’লে
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় না কি? তাহাদের মন
আমার মনের মতো না কি?
তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী!
হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?
বালটিতে টানিনি কি জল?
কাস্তে হাতে কতবার যাইনি কি মাঠে?
মেছোদের মতো আমি কত নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি;
পুকুরের পানা শ্যালা– আঁশটে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
গিয়েছে জড়ায়ে;
–এইসব স্বাদ;
–এসব পেয়েছি আমি; বাতাসের মতন অবাধ
বয়েছে জীবন,
নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন

একদিন;
এইসব সাধ
জানিয়াছি একদিন, অবাধ-অগাধ;
চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে;
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;
আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে– যখন ডেকেছি বারে-বারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিল একদিন– এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা ক’রে গেছি; যে নক্ষত্র-– নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা
আমি তা ভুলিয়া গেছি;
তবু এই ভালোবাসা-– ধুলো আর কাদা।
মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়-– প্রেম নয়-– কোনও এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে:
সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয়!
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনওদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ

মানুষের মুখ দেখে কোনওদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনওদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনওদিন!
এই বোধ-– শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ-– অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
চায় না সে?-– করেছে শপথ
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
চোখে কালোশিরার অসুখ,
কানে যেঁই বধিরতা আছে,
যে কুঁজ-– গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা-– পচা চালকুমড়ার ছাঁচে,
যে সব হৃদয় ফলিয়াছে
–সেই সব।

গল্পের খিদে ছিল আমার বড্ড বেশি। গল্পের খোঁজে লক্ষ্মীর পাঁচালি পড়তেও দ্বিধা করতাম না। আবার ইন্দ্রজাল কমিক্সের মধ্যেখানে বিএসএ সাইকেলের বিজ্ঞাপনে কপিলদেবের প্লেন ধরতে যাওয়ার গল্প হাজারবার পড়েও আশ মিটত না। আনন্দমেলার পিছনের মলাটে পপিন্সের কমিক্সের পাতাও সমান টানত। কিছু বিজ্ঞাপন থাকত আনন্দমেলার পাতায় পাতায়– সিএমডিএ, সিইএসসি, কোয়ালিটি আইসক্রিম, বাটা, ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক। এদের বিজ্ঞাপনগুলোয় নানারকম চরিত্র দিয়ে দিব্যি নানা স্বাদের গল্প বলা থাকত। আর আমার আগ্রাসী খিদে মেটাতে এরা সব্বাই দিব্যি হজম হয়ে যেত। এরই পাশে পাশে সমান্তরালভাবে আরেকজনও এগিয়ে চলছিলেন; গল্পের বই, ম্যাগাজিনের ফাঁকফোকর দিয়ে কখন যেন ঢুকে পড়ে জমিয়ে মৌরসিপাট্টা গেড়ে ফেলেছিলেন টেলিভিশনসাহেব।

টিভির পর্দাতেও দিব্যি কবিতা তৈরি হত তখন। কখনও বাংলাদেশ টিভিতে– এই সব দিনরাত্রি, কখনও বা রাতের দিল্লি টিভিতে– মালগুডি ডেজ বা কথাসাগর। অথবা রোব্বারের দুপুরে কন্নড় সিনেমা– সংস্কারা। ইংরেজি সাবটাইটেল পড়ে ওঠার আগেই মিলিয়ে যাওয়া। তবুও হুমড়ি খেয়ে গিলতে বসা। শনিবারের সন্ধের বাংলা সিনেমা ঘিরে উৎসব সন্ধ্যাগুলোও কবে যেন কবিতার খাতায় নাম লেখাল। যদিও এগুলোকে গল্প বলেই জানতাম তখন, কিন্তু (এই জীবনেই আমি দুইহাজার সালের পরেও টিভি সিরিয়াল দেখেছি যেহেতু) এখন পিছন ফিরে তাকালে আশির দশকের টিভিকে কবিতা বলে মনে হয়। আমার গল্পের খিদে মেটানোর জন্য দূরদর্শন, কোলকাতা ক-য়ের নাটক, বইয়ের আলমারি সব্বাই আপ্রাণ চেষ্টা করে যেত। শুধুই কি খিদে মেটাত তারা? বয়সটাকেও টেনে বাড়িয়ে দিত, আবার কখনও বা বয়সের কোনও একটা পুরনো পাথর তুলে এনে তার উপরে কিছুদিনের জন্য ঝিম ধরিয়ে বসিয়ে দিত। পুজোর সময়ে ঠাকুর দেখতে গেলে প্যান্ডেলের পাশে লাল শালু মোড়া আরেকটা ছোট প্যান্ডেলে সাজিয়ে রাখা বইগুলোর মধ্যে তোলিয়া ক্লুকভিনের অ্যাডভেঞ্চার খুঁজে পেলে মা বাবা কাকু কাকিমাকে বলতাম, “তোমরা ঠাকুরটা দেখে এসো। আমি ততক্ষণে একটু পরের গল্পটা পড়ে নিই।” কী বোকাটাই না ছিলাম তখন! যদি জিদ ধরতাম, যদি বলতাম, “আমাকে এই বইটা কিনে না দিলে আমি যাবই না” তাহলে কি কিনে দিত না আমাকে বইটা? নিশ্চয়ই দিত কি? অথবা হয়তো দিত! কী জানি! কিন্তু আমার ওই লালশালু মোড়া বাঁশে ঠেস দিয়ে রাশিয়ান বইয়ের খানিকটা গোগ্রাসে গিলে নিতেই আনন্দ। হলই বা ক্লাস এইট। তাই বলে ছোটবেলার বইগুলো হাতের কাছে পেলে
ছেড়ে দেব নাকি? ওদিকে বড়বেলাটাকে ভরিয়ে রাখতে আরও কত বই, কত সিনেমা, কত গল্প, কত কবিতা, কত হাসি, কত কান্না যে আমার জন্য ডালা সাজিয়ে বসেছিল তখন।

স্কুল লাইব্রেরি থেকে যেদিন ‘শিলাপটে লেখা’ নিয়ে এলাম, মা দিব্যি মুচকি হাসি হাসল। ক্লাস এইটের জন্মদিনে মা উপহার দিল– খড়কুটো। দিদার বাগানের ঝুপসি তিনটে আমগাছের পাতার ফাঁকফোকরের মধ্যে দিয়ে আসা মিঠে হলদে রঙের আলোয় পড়তে বসলাম। বই শেষ হলে গলার কাছে পাকানো দলাটাকে সামলাতে গিয়ে টের পেলাম আলোটা কখন যেন রঙ বদলে হলুদ থেকে কমলা হয়ে গেছে, দেখতেই পাইনি। ক্লাস এইটের গরমের ছুটি শুরু হওয়ার আগেই প্রথম প্রতিশ্রুতি শেষ। টিভিতে জতুগৃহ দেখে ডুকরে কেঁদে উঠলাম। মা কিনে দিল– সুবোধ ঘোষের শিউলিবাড়ি। রেডিওতে বনফুলের শাজাহান নাটকটা শুনে দুইদিন ধরে থম মেরে রইলাম। ছোটমাসি ডিস্ট্রিক্ট লাইব্রেরি থেকে এনে দিল– নিশিকুটুম্ব। মালামাসি পয়লা বৈশাখে উপহার দিল– দরবারী। শুভদাদা ভাইফোঁটায় দিল– বকুলবাসর। টিভিতে দিল– হাটেবাজারে।

কিশোরীবেলাকে বোধহয় এমনি করেই আবাহন করে নিতে হয়। আমি তখনও জানি এরা সব গল্পের বই, সিনেমা, নাটক। কবিতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নেই বললেই চলে।

কবিতা কেমন করে আঁকে, টের পেলাম এক শনিবারের সন্ধেয়। টিভিতে দেখলাম– আঁধার পেরিয়ে। বাংলা সিনেমা। সিনেমা বুঝি? সিনেমা বুঝি এমনি করে চুলের মুঠি ধরে তুলে কবিতার বই খুঁজতে লাগিয়ে দেয়? এমন হতে হয় বুঝি সিনেমাকে? আঁধার পেরিয়ে দেখে মনটা কুয়াশায় ভরে থাকল বহুদিন। সেই যে মা কোন ছোটবেলায় বলেছিল, “বিষণ্ণতারও আনন্দ আছে!” এই বুঝি তা! একটা অসম্ভব বিষণ্ণ, ধূসর (তখনও নেগেটিভ কথাটা শিখিনি) মায়ায় বাঁধা পড়ে রইলাম কয়েকদিন। বলছি যদিও ধূসর, অথচ সিনেমাটার আনাচেকানাচে যে কত মণিমুক্তো ছড়িয়ে ছিল!

এই সিনেমাটা দেখতে গিয়ে জানলাম– আজন্ম যাকে ছ্যাবলামির অভিনয় করতে দেখেছি, সেই চিন্ময়ের অদ্ভুত সুরেলা গলা। সেই সুরেলা খালি গলায় তিনি দিব্যি স্কট ম্যাকেঞ্জির সুরে সুর মিলিয়ে গেয়ে ফেলতে পারেন— “হোয়েন ইউ আর গোইং টু সানফ্রানসিসকো”! অথবা বৌভাতে দিব্যি কনেচন্দন আর বেনারসি পরে কনে নিজেই মাংসের বালতি ধরে পরিবেশন করতে পারে সবাইকে। কনেকে মোটেই পুতুল সেজে সিংহাসনে বসে সবাইকে জোড়হাতে নমস্কার করতে হয় না। বলিউডের বিখ্যাত বাঙালি নায়িকা নির্দ্বিধায় খবরের কাগজের সাংবাদিক আর ফ্রিল্যান্স লেখিকার বিয়ের ভোজ খেতে চলে যেতে পারেন। এইরকম দ্বিধাহীন এবং স্বচ্ছন্দই ছিল সত্তর-আশির দশকের কুড়ি-তিরিশেরা।

এই সিনেমাটা দেখতে গিয়ে মাধবীর গলায় এক ছবির মতো কবিতার আবৃত্তি শুনে চমকে উঠি– কবিতার মধ্যে দিয়ে ছন্দ মিলিয়ে এমন আশ্চর্য গল্প বলাও সম্ভব! কে সেই কবি? কবিতা বলা হলে মাধবী নিজেই বলে দেয়— “পড়োনি? যতীন্দ্রমোহন বাগচির কবিতা। ক্লাস নাইনে আবৃত্তি করে প্রাইজ পেয়েছিলাম।” আর আমি মাকে জ্বালিয়ে মারতে থাকি রামমোহন লাইব্রেরি থেকে যতীন্দ্রমোহন বাগচির কবিতার বই এনে দেওয়ার জন্য।

অন্ধ বধূ

যতীন্দ্রমোহন বাগচি

পায়ের তলায় নরম ঠেকল কী!
আস্তে একটু চলনা ঠাকুর-ঝি—
ওমা, এ যে ঝরা-বকুল! নয়?
তাইত বলি, বসে দোরের পাশে,
রাত্তিরে কাল— মধুমদির বাসে
আকাশ-পাতাল— কতই মনে হয়।
জ্যৈষ্ঠ আসতে কদিন দেরি ভাই—
আমের গায়ে বরণ দেখা যায়?
— অনেক দেরি? কেমন করে হবে!
কোকিল-ডাকা শুনেছি সেই কবে,
দখিন হাওয়া—বন্ধ কবে ভাই;
দীঘির ঘাটে নতুন সিঁড়ি জাগে—

শেওলা-পিছল— এমনি শঙ্কা লাগে,
পা-পিছলিয়ে তলিয়ে যদি যাই!
মন্দ নেহাৎ হয় না কিন্তু তায়—
অন্ধ চোখের দ্বন্দ্ব চুকে যায়!
দুঃখ নাইক সত্যি কথা শোন্,
অন্ধ গেলে কী আর হবে বোন?
বাঁচবি তোরা— দাদা তো তার আগে?
এই আষাঢ়েই আবার বিয়ে হবে,
বাড়ি আসার পথ খুঁজে না পাবে—
দেখবি তখন— প্রবাস কেমন লাগে?
— কী বল্লি ভাই, কাঁদবে সন্ধ্যা-সকাল?
হা অদৃষ্ট, হায়রে আমার কপাল!
কত লোকেই যায় তো পরবাসে—
কাল-বোশেখে কে না বাড়ি আসে?
চৈতালি কাজ, কবে যে সেই ল!
পাড়ার মানুষ ফিরল সবাই ঘর,
তোমার ভায়ের সবই স্বতন্তর—
ফিরে আসার নাই কোনও উদ্দেশ!
—ঐ যে হেথায় ঘরের কাঁটা আছে —
ফিরে আসতে হবে তো তার কাছে!
এই খানেতে একটু ধরিস ভাই,
পিছল-ভারি— ফসকে যদি যাই—
এ অক্ষমার রক্ষা কী আর আছে!
আসুন ফিরে— অনেক দিনের আশা,
থাকুন ঘরে, না থাক্ ভালবাসা—
তবু দুদিন অভাগিনীর কাছে!
জন্ম শোধের বিদায় নিয়ে ফিরে’—
সেদিন তখন আসব দীঘির তীরে।
চোখ গেল ঐই চেঁচিয়ে হল সারা।

আচ্ছা দিদি, কি করবে ভাই তারা—
জন্ম লাগি গিয়েছে যার চোখ!
কাঁদার সুখ যে বারণ তাহার— ছাই!
কাঁদতে গেলে বাঁচত সে যে ভাই,
কতক তবু কমত যে তার শোক!
চোখ গেল– তার ভরসা তবু আছে —
চক্ষুহীনার কী কথা কার কাছে!
টানিস কেন? কিসের তাড়াতাড়ি—
সেই তো ফিরে যাব আবার বাড়ি,
একলা-থাকা-সেই তো গৃহকোণ—
তার চেয়ে এই স্নিগ্ধ শীতল জলে
দুটো যেন প্রাণের কথা বলে—
দরদ-ভরা দুখের আলাপন
পরশ তাহার মায়ের স্নেহের মতো
ভুলায় খানিক মনের ব্যথা যত!
এবার এলে, হাতটি দিয়ে গায়ে
অন্ধ আঁখি বুলিয়ে বারেক পায়ে—
বন্ধ চোখের অশ্রু রুধি পাতায়,
জন্ম-দুখীর দীর্ঘ আয়ু দিয়ে
চির-বিদায় ভিক্ষা যাব নিয়ে—
সকল বালাই বহি আপন মাথায়!—
দেখিস তখন, কানার জন্য আর
কষ্ট কিছু হয় না যেন তাঁর।
তারপরে– এই শেওলা-দীঘির ধার—
সঙ্গে আসতে বলব না’কো আর,
শেষের পথে কিসের বল ভয়—
এইখানে এই বেতের বনের ধারে,
ডাহুক-ডাকা সন্ধ্যা-অন্ধকারে—
সবার সঙ্গে সাঙ্গ পরিচয়।

শেওলা দীঘির শীতল অতল নীরে—
মায়ের কোলটি পাই যেন ভাই ফিরে!

৮০র দশকে বালিকাবেলা থেকে কিশোরীবেলায় এমন করেই পা রাখতে হত।