Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নতুন আমেরিকা: অথ বাইডেন কথা

অরূপ ঘোষ

 


প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, প্রাক্তন অধ্যাপক

 

 

 

জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই সারা বিশ্বের চোখ এখন আমেরিকার দিকে। নতুন আমেরিকা কাদের স্বার্থকে বেশি গুরুত্ব দেবে, দেশীয় ও বৈদেশিক নীতিতে কী রদবদল ঘটবে, কী সুযোগসুবিধা পাবেন জনগণ ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস শপথ বাক্য পাঠ করার পর যে বিষয়গুলি ঘোষণা করেছেন সেগুলি কী।

(১) মার্কিন ঐতিহ্যকে অবিলম্বে ফিরিয়ে আনা, অর্থাৎ ‘ক্যাপিটল হিল’-এর ওপর ট্রাম্পের সমর্থকদের আক্রমণের পর এতদিনের ঐতিহ্যশালী মার্কিন গণতন্ত্রে যে ঘা লেগেছে তাকে মেরামত করা, বর্ণবাদকে ঘিরে যে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাকে নিয়ন্ত্রণে আনা।

(২) কোভিড ১৯-এর জোয়াল থেকে মার্কিন দেশকে মুক্ত করার উদ্দেশে ভ্যাকসিন ব্যবস্থাকে আরও জোরদার করা, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি চালু করা এবং স্বমহিমায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা ব্যবসাবাণিজ্যকে যা ট্রাম্প অধ্যুষিত কারবারে মুখ থুবড়ে পড়েছে।

(৩) সাদা-কালো বিভেদের ভেতর দিয়ে কোভিড পরিস্থিতিতে যে বৈষম্য মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে তাতে সমতা ফেরানো এবং সকলকেই সমান চিকিৎসাব্যবস্থার সুযোগ করে দেওয়া। কোভিড ১৯ পরিস্থিতি থেকে দেশকে উদ্ধারের জন্য মার্কিন কংগ্রেসের সামনে ১৯ ট্রিলিয়ান ডলারের একটি প্যাকেজ অনুমোদনের জন্য প্রস্তাবও রাখা হয়েছে।

(৪) বাইডেনের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক ‘ডক্টর অ্যান্থনিও ফাউচি’ ঘোষণা করেছেন, ‘ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন’-কে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে আমেরিকা যাতে ধনী-দরিদ্র দেশ সমান সুযোগ পায়। আগে ট্রাম্প অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনকে সমালোচনা করে মার্কিন দায়ভারকে অস্বীকার করেছিল, তারই উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে এই ঘোষণা।

ইতিমধ্যে চিন বাইডেনকে স্বাগত জানিয়ে ঘোষণা করেছে, “Kind Angels can triumph over evil forces.” ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শয়তান হিসাবে চিহ্নিত করে এই বক্তব্য রেখেছেন চিনের বিদেশমন্ত্রী। বাইডেন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ট্রাম্পের সময় মার্কিন বাণিজ্যের ওপর  চিনের রাষ্ট্রীয় একাধিপত্য চাপিয়ে দেওয়ার সমালোচনা করেছেন। পাশাপাশি তাইওয়ানের রাষ্ট্রদূত বাইডেনের শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে মার্কিন সরকারকে অনুরোধ করেছেন, তাইওয়ানের সার্বভৌমত্বের ওপর চিনের চাপানো নীতিকে ট্রাম্প যেভাবে বিরুদ্ধাচারণ করেছেন তা যেন বজায় থাকে। চিন এই প্রসঙ্গে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে এই বলে যে চিনের সার্বভৌমত্ব নষ্ট হলে তারাও ছেড়ে কথা বলবে না।

এই ধরনের আন্তর্জাতিক আবহাওয়ায় বাইডেন ক্ষমতা হাতে পেয়েই বারবার কোভিড পরিস্থিতির থেকে মার্কিন দেশ ও গোটা বিশ্বকে বাঁচানোর কথা বলছেন ভ্যাকসিনের মাধ্যমে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প গ্লোবাল ব্রড ভ্যালু চেইন ভেঙে তার দোসরদের নিয়ে যে শর্ট ভ্যালু চেইন বানিয়ে একরকম যুদ্ধের অর্থনীতি গড়তে চেয়েছিলেন তার থেকে সরে এসেছেন বাইডেন। ট্রাম্পের তাঁবেদারি করা এই দোসর দেশগুলি মূলত ছিল ভারত, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইজরায়েল, ব্রাজিল ইত্যাদি। লক্ষণীয় বিষয় হল, এইসকল দেশেই চরম প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উদ্ভব হয়েছে। এখন প্রশ্ন হল, বাইডেনের আসল উদ্দেশ্য কী?

কৃষি থেকে শুরু করে চিকিৎসা জগতে জিনপ্রযুক্তি ও মাইক্রোবায়োলজির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ ঘটিয়ে মূলত ডলারের আধিপত্যকে মজবুত করতে চাইছেন বাইডেন ব্রড ভ্যালু চেইনকে ফিরিয়ে এনে। সম্প্রতি জিনতত্ত্ববিদ এরিক ল্যান্ডারকে (Eric Lander) হোয়াইট হাউসের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিভাগের মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ করেছেন বাইডেন। একজন জীবতাত্ত্বিক হিসেবে এই পদ পাওয়া আমেরিকার ইতিহাসে অভূতপূর্ব। বহুল-চর্চিত বিতর্কিত হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের সঙ্গে গভীর যোগাযোগ ছিল এরিক ল্যান্ডারের। উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হল, মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসের আকাঙ্ক্ষাও ঠিক এটাই কারণ বরাবরই বিল গেটসের বিনিয়োগ ও পাহাড়প্রমাণ মুনাফার উৎস এই ক্ষেত্রেই। পরিসংখ্যান বলছে, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে মাইক্রোবায়োলজি বাজারে বিনিয়োগের গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী। এছাড়াও সম্প্রতি বাইডেনের ইমিগ্রেশন সংস্কার আমেরিকার বাঘা বাঘা পুঁজিপতিদের কাছে সুখের বার্তা এনেছে। অ্যাপল, গুগল উচ্চকণ্ঠে বাইডেনের নতুন বিলের প্রশংসা করেছেন। এতদিনের আটকে থাকা বিশ্বব্যাপী সস্তা শ্রমের বাজার আবার মুক্ত হল। অ্যাপল সিইও টিম কুক বাইডেনের “commitment to pursuing comprehensive immigration reform that reflects the American values of justice, fairness and dignity”-কে স্বাগত জানিয়েছেন। সুন্দর পিচাই বলেছেন, “Google has supported action on these important issues & we look forward to working with the new administration to help the US recover from the pandemic + grow our economy”। এই বক্তব্যের রেশ টেনে বলা যায় যে এই সকল কাজের হাতেখড়ি হবে ভ্যাকসিন বাজারকে আঁটোসাটো করার মধ্যে দিয়ে। ঠিক এই কারণেই ভ্যাকসিন, প্যারিস চুক্তি ও পরিবেশ সংক্রান্ত কথাগুলি বাইডেনের মুখে শোনা যাচ্ছে। একই সুরে তাল মিলিয়ে এলন মাস্ক বলেছেন, শ্রেষ্ঠ কার্বন শোষণ প্রযুক্তির উদ্ভাবককে তিনি ১০০ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার দেবেন। বোঝাই যায় যে, সবুজ প্রযুক্তিতে বিরাট বিনিয়োগ করে sustainable capitalism-কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সমস্ত রকম প্রস্তুতি চলছে।

ট্রাম্প ডলার আধিপত্যের বদলে মার্কিন রাষ্ট্রের আধিপত্য কায়েম করতে চেয়েছিলেন এবং সেই মর্মে শ্বেত জাতীয়তাবাদের জন্ম। ডলার আধিপত্যের সুযোগ নিয়ে অন্যদিকে চিন তার রাষ্ট্রীয় আধিপত্যকে বাড়িয়ে চলেছে। আগে সরকারি আমলাদের একটা অংশ, অস্ত্রব্যবসায়ী, পরিবেশ অমান্যকারী, ওয়েলথ্ স্ট্রিপার ও হেজফান্ড মালিকদের একটি বড় অংশের সাহায্য নিয়ে বর্ণবাদকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চেয়েছিলেন ট্রাম্প।

ভারতের দিকে চোখ ফেরানো যাক। নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে দ্বিতীয়বার এনডিএ সরকার ক্ষমতায় এসে বৈদেশিক নীতিতে বিরাট পরিবর্তন আনে। বিশেষ করে ইজরায়েলের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন, নিশ্চুপ থেকে ট্রাম্পের বর্ণবাদকে সমর্থন ও চিনকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করার মধ্যে দিয়ে। মূল কারণ কেন্দ্রের শাসক পার্টির ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী আদর্শের সঙ্গে ট্রাম্পীয় বর্ণবাদের মিল। দুজনেই এক ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল অনুশাসন গড়ে তুলতে চেয়েছেন, যা মূলত সরকারি সাহায্যে কিছু মুষ্টিমেয় কর্পোরেটের ফুলে-ফেঁপে ওঠার পথ মসৃণ করবে। একে কায়েম রাখতে এক ধরনের ফ্যাসিস্ট অনুশাসন তাদের কাছে অপরিহার্য। তাই নরেন্দ্র মোদিকেও বলতে শোনা গিয়েছিল ‘আব কি বার ট্রাম্প সরকার’। আর বাইডেন আসার সঙ্গে সঙ্গেই এই একই কারণে কেন্দ্রীয় সরকার একতরফা এক কর্পোরেট কৃষিনীতি চাপিয়ে দিতে চাইছেন কৃষকদের ওপর, যাতে বাইডেনের মদতপুষ্ট কর্পোরেটরা চিনে ঘাঁটি না গেড়ে ভারতের কৃষিব্যবস্থায় জিনপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে। ট্রাম্পের নীতি যেমন ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছিল বাইডেনের নীতিও সে অর্থে মোটেও কম ক্ষতিকর নয়। প্যারিস চুক্তিতে প্রত্যাবর্তন করলেও বাইডেনের নতুন নীতির প্রয়োগে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যেকার বাস্তুতান্ত্রিক সম্পর্কের অপূরণীয় ক্ষতি হবে, ফলত এক দুর্বিষহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে ভারত। মূলত যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রাকৃতিক জিন কোডিং-এর যে শৃঙ্খলা সেটাই বিপর্যস্ত হতে চলেছে।

শেষের কথা হিসেবে বলা যেতে পারে, ট্রাম্প ও বাইডেনের  নীতির মধ্যের তফাতকে তুলনা করলে, দেশের ভেতরে বা পড়শি দেশের সঙ্গে যুদ্ধ মেতে উঠে অথবা যে প্রাকৃতিক পরিবেশে মানুষ এখনও পর্যন্ত বেঁচেবর্তে আছে তাকে সম্পূর্ণ  ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়ে কর্পোরেট আঁতাতবদ্ধ হয়ে মুমূর্ষু পুঁজিবাদকে বাঁচিয়ে রাখাই হল দুয়েরই সারকথা।