Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বুরুজে নিশান: হজম করতে ‘সিভিল সোসাইটি’-র এত সমস্যা হচ্ছে কেন

স্যমন্তক ঘোষ

 



সাংবাদিক ও সমাজকর্মী

 

 

 

 

সত্য সেলুকাস, এমন দেখিনি! সাংবাদিকতা করছি, তাও প্রায় ১৫ বছর হল। এমন মিছিল কখনও দেখিনি। নন্দীগ্রামের পরে নাগরিক মিছিলের সামনে বিশিষ্ট মানুষদের জমায়েত এখনও মাথায় ফোটোকপি হয়ে আছে। সেই নন্দীগ্রামেই জানুয়ারির গোড়ায় লালপতাকার দম্ভের বিরুদ্ধে লালপতাকার গর্জন নিজের কানে শুনেছি। ইতিহাসের সাক্ষী থেকেছি।

ইতিহাস?

কতটা পথ পেরোলে তবে ইতিহাস বলা যায়? প্রশ্নগুলো সহজ। সত্যিই সহজ। ২৬ জানুয়ারির দিল্লি সেই ইতিহাসের পাঠ দিল।

না। এটা মিছিল নয়। না। এটা কেবলই একটা আন্দোলন নয়। না। এটা কোনও রাজনৈতিক পালাবদলের সঙ্কেত নয়। ছাব্বিশের রাজপথ যা দেখাল, সাংবাদিকতার পাঠ তার বিশ্লেষণ করতে পারে না।

বাস্তিলের পতনের সময় অর্ণব গোস্বামীদের লাইভ কভারেজ থাকলে বুরবোঁ-বুড়বকের দল কি সত্যি কি খুব নিশ্চিন্ত থাকত? জানা নেই। ইমোশনাল ইতিহাসবেত্তারা নিশ্চয় এর ছানবিন করতে পারবেন। ২৬ জানুয়ারির রাজধানীতে বাস্তিলের পতন হয়নি। কিন্তু চাইলে যে হতে পারে, তার ট্রেলার দেখা গিয়েছে। অধমের ইতিহাসজ্ঞান কম। কিন্তু সেই ইতিহাসেই পড়েছিলাম, মেরঠে বিদ্রোহের পর সিপাই, প্রতিবেশী, তাঁদের পরিবার রানির ব্যারিকেড উপেক্ষা করে লালকেল্লার লালফটকে পৌঁছে গিয়েছিলেন দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের কাছে তাঁদের নিবেদনটুকু পৌঁছে দিতে। ১৮৫৭ সালের কথা বলছি। রানি বাধ্য হয়েছিলেন, কোম্পানির শাসন মুলতুবি করে সরাসরি ব্রিটিশ ঝান্ডা পুঁততে এই পোড়া দেশে।

ফ্ল্যাশব্যাক

“স্যরজি, গরম পানি হ্যায়। পাওঁ মে লাগা লো।” কৃষকদের লড়াই তখন সবেমাত্র দিনকয়েকের। সিংঘু সীমানায় টেন্ট টাঙিয়ে বসে থাকা কৃষক যুবক রাত বারোটায় এক বালতি গরম জল নিয়ে হাজির হয়েছে সাংবাদিকের কাছে। সাংবাদিক এক রাত থেকে দেখতে চায়, সীমানায় শূন্য ডিগ্রিতে কৃষকরা ঠিক কতটা কষ্টে আছেন?

কষ্ট? সর্ষের শাক আর ভুট্টার রুটি গরম-গরম নামছে তাওয়া থেকে। ঝকঝকে থালায় ঘি মাখিয়ে রুটি ঘুরছে হাতে-হাতে। ট্র্যাক্টরের ব্যাটারিতে চলছে ওয়াশিং মেশিন। তাতে একবারে ২০ লিটার লস্যি গোলা হচ্ছে। হাইওয়ের ডিভাইডারের উপর আগুন জ্বেলে ড্রাম ড্রাম গরম জল। সাংবাদিকের কষ্ট হবে, তাই খাওয়ার গরম জল বালতি করে এসেছে পা ধোয়ার জন্য। রাতে শোয়ার ব্যবস্থা টেন্ট অথবা খড়-বিছনো ট্র্যাক্টরের ট্রলি। পাশে তেলের টিনে আগুন। নতুন কম্বল। মাথার বালিশ। প্রতিদিন গ্রাম থেকে ফেরি হচ্ছে জিনিস। ভোরের আলো ফোটার আগে শয়ে শয়ে ট্র্যাক্টরে পৌঁছে যাচ্ছে দুধ, সারাদিনের খাবার মজুত। যৌথ খামার? সিংঘু সীমানায় যৌথ খামার দেখেছি।

জাম্পকাট

২৬ জানুয়ারির ট্র্যাক্টর মিছিলে কৌমে বাঁচা ভারতবর্ষকে দেখেছি। না, নাগরিক মিছিলের নিয়ম নেই তাতে। গান বাজছে। রাস্তা জুড়ে মানুষ নাচছেন। যেন বিয়ে করতে যাচ্ছে গ্রামের ছেলে। যে কোনও ট্র্যাক্টরে যে কোনও সাংবাদিকের অবাধ আসন। দিনের পর দিন ধরে গালি দেওয়া বুম দেখলে খানিক রসিকতা। ট্র্যাক্টরের ইঞ্জিনের উপর বসে লাইভ দিতে চাইলে, চালক হাত বাড়িয়ে ক্যামেরা ধরে দিচ্ছেন। না-বলতেই সেই ক্যামেরা নিজের মুখে ঘুরিয়ে “জো বোলে সো নিহাল”। পাশ দিয়ে ঘোড়া ছুটছে। জাতীয় পতাকা হাতে অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের প্রজাতন্ত্রের কুচকাওয়াজ। আকাশ থেকে ফুল ঝরছে।  আকাশ নয়, ওভারব্রিজে দাঁড়িয়ে কাতারে কাতারে মানুষ। তাঁরা মিছিল নন, দর্শক। কার্নিভাল। বিপ্লবের কার্নিভাল। এটা কেবল একটি মিছিল, কেবলই এক বিক্ষোভ হতে পারে না।

দিল্লির প্রান্তরেখায় এসে সুর কাটল। বিশাল কংক্রিটের ব্যারিকেড হাতে-হাতে সরিয়ে দিচ্ছেন সত্যি-সত্যি ৫৬ ইঞ্চি ছাতিওয়ালা কিছু মানুষ। পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ছুড়ছে, পাশের খালে। বেশ অনেক পরে এক আইপিএস ব্যাজ লাগানো পুলিশকে আন-অফিশিয়ালি প্রশ্ন করা গিয়েছিল, কাঁদানে গ্যাস জলে ছুড়লেন কেন? সহাস্য উত্তর, “উপর থেকে অর্ডার ছিল, তাই জলে মেরেছি। দু’একটা রাস্তাতেও ফাটিয়েছি। বাপ-কাকা-ভাইদের গায়ে তো আর হাত দিতে পারি না!”

মিছিলের মুখ যখন আইটিওতে, তখনও পানিপথ থেকে ট্র্যাক্টর বেরচ্ছে। লাখে ক’টা শূন্য হয়, এখনও হাতে গুনতে হয়। এ দিন লাখের বেশি ট্র্যাক্টর দেখেছি, কেবল সিংঘুর বিপ্লবে।

সন্দেহ নেই, আইটিও-তে তাণ্ডব হয়েছে। পুলিশ নয়, প্রতিবাদী কৃষকরাই তা থামিয়েছেন। লালকেল্লায় যাঁরা পৌঁছেছেন, ইতিহাস তাঁদের মনে রাখবে। যিনি তেরঙার নীচে ঝান্ডা লাগিয়েছেন, শুনছি মোদির সঙ্গে এক বছর আগেই নাকি তিনি ছবি তুলেছিলেন। বড় আন্দোলনে ঘুরপথে তাল কাটানোর এমন নানা ব্যবস্থা যে থাকে, তা জানার জন্য ইতিহাসের ছাত্র হতে হয় না। প্রশ্ন করতে নেই, যে দিল্লিতে মাস্ক না-পরে রাস্তায় ঘুরলে পিঁপড়েরও জরিমানা হয়, যে দিল্লিতে পুলিশ চাইলে অন্ধ প্রতিবাদীকেও রাস্তায় ফেলে পেটাতে পারে, যে দিল্লিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পুলিশ তাণ্ডব, (হ্যাঁ, তাণ্ডবই) চালাতে পারে, সেই দিল্লির পুলিশ কিছু কৃষককে ব্যারিকেড দিয়ে আটকাতে পারে না?

পারে না। লাখো মানুষ যখন বাস্তিলের দখল নিতে যায়, তখন পেয়াদাদের দম থাকে না তা আটকানোর। বাস্তিল দখল হয়নি। একটি দাগও লাগেনি লালকেল্লায়। মানুষ কেবল বুঝিয়ে দিয়েছেন, পারলে হয় না, এমন কিছু নেই। তাঁরা ব্যারিকেড ভেঙে আসতেও যেমন পারেন, ব্যারিকেড ভেঙে ফিরতেও পারেন।

তথাকথিত ‘সিভিল সোসাইটি’-র একটু সমস্যা হচ্ছে বোধহয় এসব মেনে নিতে! নিয়ম ভাঙলে যেমন কষ্ট হয়। যেমন কষ্ট হয় নাগরিক রুচিবোধে ধাক্কা লাগলে।

হওয়ারই কথা। ‘সর্বাঙ্গীন সুন্দর’ বলে একটা কথা আছে আমাদের মধ্যবিত্ত ডিকশনারি-তে। তবে ভরসা একটাই। সে সব সাজানো কথা ইতিহাস সচরাচর মনে রাখে না। ইতিহাস মনে রাখে সে কথাই, পরবর্তী সময়ের সিভিল সোসাইটি যা নিয়ে নাগরিক চর্চা করবে। চর্চা করবে, করতে বাধ্য হবে বলেই। কেবল সেটুকুই। ২০২১-এর ২৬ জানুয়ারিকে ইতিহাস মনে রাখবে। বর্তমান শাসকের ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরের মতো করে নয়, বাস্তিলের ইতিহাসের মতো করে।