Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘তাণ্ডব’ ঘিরে যে তাণ্ডব

সত্যব্রত ঘোষ

 




প্রাবন্ধিক, চলচ্চিত্রবেত্তা

 

 

 

উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তি ভোগে বাধাবিপত্তি নিয়ে রহস্যোপন্যাসের যে জনপ্রিয়তা গত শতাব্দীতে ছিল, এখনও তার রেশ রয়ে গেছে। চরিত্র হিসেবে এদের ক্রুরতা এবং ন্যায়হীনতার শীতল উত্তেজনা নিয়ে এখনও পাতার পর পাতা লেখা যায়। অ্যামাজন প্রাইম ভিডিও-তে ১৫ই জানুয়ারি থেকে স্ট্রিমিং হওয়া ‘তাণ্ডব’-এর লেখক গৌরব সোলাঙ্কি যা লিখেছেন। ‘আর্টিকেল ১৫’-এর বলিষ্ঠ চিত্রনাট্যটি রচনার সুবাদে তিনি এখন প্রতিষ্ঠিত। তবু তিনি ও তাঁর মতো প্রথিতযশা চিত্রনাট্যকারেরাও সমকালীন রাজনীতির ব্যক্তিত্বদের অনুষঙ্গটুকু রেখে কাহিনীর ‘কাল্পনিক’ বিন্যাস করতে পারেন। তাতে বাস্তবের প্রলেপ থাকলেও সেগুলিতে জড়িত ব্যক্তিদের নাম চিত্রনাট্যে থাকবে না (‘দ্য অ্যাকসিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ সম্ভবত ব্যতিক্রম, যাতে সরকারের প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপোষকতা ছিল)। গণতন্ত্র নামে যে ব্যবস্থা ভারতে প্রচলিত, তার মহিমা এমনই অপার।

গৌরব সোলাঙ্কির ‘তাণ্ডব’ তাই হয়ে উঠেছে জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে সংবাদের শিরোনামে আসা এক যুবনেতা (পড়ুন কানহাইয়া কুমার)-এর উত্থানের কাল্পনিক আখ্যান এবং উত্তরাধিকারে রাজনৈতিক ক্ষমতা না পাওয়া এক রাজনীতিবিদের প্রতিশোধের এক রগরগে কাহিনী। নয়টি পর্বে বিস্তৃত এই ধারাবাহিকটি বানিয়েছেন আলি আব্বাস জাফর, হিন্দি অ্যাকশন ফিল্মের পরিচালক হিসেবে যিনি ইতিমধ্যেই যথেষ্ট জনপ্রিয়। দুয়ের মিলিত প্রয়াসে যে ‘তাণ্ডব’, তার মূল বিষয় উত্তাল ছাত্র রাজনীতি এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রাজনৈতিক অধিকারের প্রতিষ্ঠা। ‘তাণ্ডব’ সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসুত নয় বটে। তবে সরলরৈখিক গল্পটিতে নাটকীয় মোচড় আনতে কাহিনীকার এবং পরিচালক যে হিংসা, লোভ, লালসার উপাদানগুলি ব্যবহার করেছেন, সস্তা রোমাঞ্চকর কাহিনীতে তেমন ঘটনার ঘনঘটা ঢের ব্যবহৃত হয়েছে।

আমোদপ্রিয় দর্শকরা ‘তাণ্ডব’-এ যে মশগুল হবেন, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ, নাটকীয় দৃশ্যগুলি পরপর উন্মোচিত করবার জন্যে যে পেশাদারি কুশলতা প্রয়োজন, তা এতে আছে। তবে চিত্রনাট্যকার এবং পরিচালকের আদৌ যদি কোনও রাজনৈতিক দর্শন থাকে তা এখানে বানিজ্যিক স্বার্থরক্ষার তাগিদে ঢাকা পড়েছে। বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের প্রতি সমবেদনা বা রাজনৈতিক শঠতার বিকল্প সন্ধানের চেয়েও মনোরঞ্জনের সামগ্রীগুলিকে একত্রিত করবার প্রতিই তাঁরা তাই যত্নশীল। তবে ‘তাণ্ডব’ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহলে সম্প্রতি যে তাণ্ডব চলছে, তা দেশের প্রতীয়মান রাজনৈতিক সংস্কৃতির এক নতুন পরিচয় দেয়। কেন তাঁরা অসন্তুষ্ট, তা বোঝা যাক:

‘তাণ্ডব’-এ ক্ষমতাসীন একটি দলের কথা বলা হচ্ছে যারা পরপর তিনবার নির্বাচন জিতছে। এমন এক মা আছে যিনি তার অপদার্থ, উদ্ধত, নেশাসক্ত ছেলেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বানাতে বদ্ধপরিকর। রাজনৈতিক নেতাদের একাধিক নারী আসক্তির কথা বলা হয়েছে। ক্ষমতার অলিন্দে সেই নারীরা যে ওই অবৈধ সম্পর্কগুলিকে ব্যবহারে ইতস্তত করে না, তাও এখানে স্পষ্ট। আত্মীয় হত্যা (fratricide) আছে এতে। বলা হচ্ছে রাজনৈতিক জোট কেনা ও বেচার লাগামহীন কথা। এর সমান্তরালে চলেছে রাজধানীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা রাজনীতির কথা, যা জন্ম নিচ্ছে এক নেতার। রাজনীতিবিদরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষোভ ও রাজনীতিকে কীভাবে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করছে, তারও বিবরণ আছে এখানে।

তবে, প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিবিদ এবং তাঁদের অনুগামীরা কি এই মোটা দাগের ধূর্ততা, শঠতা এবং নিষ্ঠুরতার প্রতিরূপ দেখে সত্যিই এতটা অসন্তুষ্ট হয়েছেন? কারণ, তাঁদের ঘোষিত আপত্তি তো মিনিট তিনেকের একটি অংশ নিয়ে। রেগে তাঁরা প্রশ্ন তুলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কেন শিবের তাণ্ডবনৃত্যের সঙ্গে ‘আজাদি’-র স্লোগান শোনানো হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অভিনেতাটি (মহম্মদ জিশান আয়ুব) কেন ‘শিবা’ নাম নিয়ে শিব সেজে নেচেছেন? বলা বাহুল্য, মূল ধারাবাহিকের সঙ্গে উক্ত এই নাচটির সম্পর্ক এতই ক্ষীণ যে ইতিমধ্যে অ্যামাজন প্রাইম ভিডিয়ো তাঁদের স্ট্রিমিং থেকে অংশটি ছেঁটেও দিয়েছে। অনেক চিত্রনির্মাতা অ্যামাজনের এই তৎপরতায় ক্ষুব্ধ।

তাহলে কি ভারতীয় রাজনীতির বিবরণ হিসেবে যে তঞ্চকতার ছবি ফুটে ওঠে, তা পর্দায় ফুটে উঠছে দেখেই কি রাজনীতিবিদেরা অসন্তুষ্ট? এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তিন শিল্পী তা ফুটিয়ে তুলছেন বলেই কি তাঁদের গাত্রদাহ? ‘তাণ্ডব’ নির্মাণ কি তাঁদের চোখে কি ধর্মনিন্দার সমান?

এঁদের অনেকেই বলছেন ওটিটি স্ত্রিমিং হওয়ার আগে সব অনুষ্ঠানকে সিনেমার মতো সেনসর করা প্রয়োজন। অনেকে এমনও বলছেন যে এমন ‘নোংরামি’ দেখাটা ‘পাপ’। ‘তাণ্ডব’ ব্যান করবার জন্যে বিজেপি নেতা মনোজ কোটাক কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রীকে চিঠিতে আবেদন জানিয়েছেন। কনফেডারেশন অফ অল ইণ্ডিয়া ট্রেডারস (CAT)-ও প্রকাশ জাভরেকরকে চীঠি লিকে অনুরোধ করেছেন অবিলম্বে ‘তাণ্ডব’-এর স্ট্রিমিং বন্ধ হোক। জব্বলপুরে হিন্দু সেবা পরিষদও কতৃপক্ষকে একই অনুরধ জানিয়েছেন। মুম্বাইয়ের ঘাটকোপর থানায় অভিযোগ লিখে বিজেপি-র আরেক নেতা রাম কদম পুলিসকে বলেছেন ‘অভিনেতা, নির্দেশক এবং প্রযোজকদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হোক’। গ্রেটার নয়ডায় রাবুপুরা থানায় বলবীর আজাদ নামে এক ব্যক্তি অভিযোগ লিখিয়েছেন যে ‘পুলিশের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করেছে ‘তাণ্ডব’। লখনঊ-তে হজরতগঞ্জ থানায় অ্যামাজন প্রাইম-এর ভারতীয় বিভাগের প্রধান অপর্ণা পুরোহিত সহ গৌরব সোলাঙ্কি এবং আলি আব্বাস জাফরের বিরুদ্ধেও অভিযোগ দায়ের হয়েছে। তার ভিত্তিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্যে উত্তর প্রদেশ পুলিশ ইতিমধ্যেই পৌঁছে গেছে মুম্বাইতে। কর্ণাটকেও পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এছাড়া সাম্প্রদায়িক বিবাদ এবং হিন্দুদের আবেগকে আহত করবার জন্যে দিল্লীর আদালতে একটি মামলা এখন বিচারাধীন।

না, এর আগেও ভারতীয় চলচ্চিত্রকারদের উপর দেশের আইনব্যবস্থা খড়্গহস্ত হয়েছে। কিন্তু দমন করবার যে বর্তমান গতিপ্রকৃতি, তা অন্যরকম। আগে লেখক এবং নির্দেশকদের আইনের ভয় দেখিয়ে এমন স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি যে চলচ্চিত্র মাধ্যমটিতে সমালোচনামূলক কোনও রাজনৈতিক বা সামাজিক বক্তব্য উপস্থাপন করা যাবে না। প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত সিনেমার ক্ষেত্রে যে নিষেধ ইতিমধ্যেই লাগু। ওটিটি স্ট্রিমিং-এর ক্ষেত্রে যতটুকু স্বাধীন পরিসর এতদিন চলচ্চিত্রকারেরা পেয়েছিলেন, তা দখল করতে এখন মরিয়া কেন্দ্রীয় সরকার। ‘তাণ্ডব’ নিয়ে যে তাণ্ডবের মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে সরাসরি বার্তা পাঠানো হচ্ছে। ‘ভারতীয় সংস্কৃতি’র জন্যে যেটুকু পরিসর সরকারিভাবে দেওয়া আছে, শিল্পীরা যেন সেই গণ্ডিকে কোনোভাবে না অতিক্রম করে।

চলচ্চিত্রকারদের অনেকের মত যে এত তাড়াতাড়ি অ্যামাজন প্রাইমের মাথা নোয়ানোটা উচিৎ হয়নি। ক্ষমাপ্রার্থনা করে নাচের অংশটি বাদ দেওয়ার ফলে অন্য স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মগুলির পক্ষে ভবিষ্যতে এই ধরণের অযৌক্তিক আপত্তির বিরুদ্ধে লড়াই করাটা কঠিন হবে। বিভিন্ন প্রযোজনা সংস্থা তাদের বেশ কয়েকটি ধারবাহিকগুলিকে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে মুক্তি দিতে চাইছেন না এই ভয়ে যে বাধা আসবে। কোনও সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে নতুন প্রযোজনায় সংস্থাগুলি এই মুহূর্তে আগ্রহী নয়। তাহলে সাংসদ, বিধায়ক এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের পছন্দমাফিক কাজ করাটাই কি চলচিত্রকারদের নিয়তি? অনেকে বলছেন, ‘তাণ্ডব’ নিয়ে যে তাণ্ডব চলছে, সেই ভয়ই এতদিন পাচ্ছিলেন তাঁরা। অন্তর্জালেও সেনসর প্রযোজ্য করবার জন্যেই সম্ভবত সরকারের কতৃত্ব ক্রমশ এমন একটি অসহ্য অবস্থায় পৌঁছাচ্ছে, যে আগামী দিনে সেনসররের তাণ্ডবকেও ‘নিউ নর্মাল’-এর অংশ বলে ধরে নেওয়া হবে।

ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৮০টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ৮০ থেকে নেমে এখন হয়েছে ৮৬। যে সমাজে এত কাঁচা টাকা ওড়ে, সেই সমাজের হর্তা-কর্তা-বিধাতা সেই রাজনীতির কারবারিদের থেকে স্বচ্ছতা আশা করাটাই কঠিন। নির্বাচনে জিতে জনপ্রতিনিধিরা যখন সরকারের অংশ হন, তখন তাঁরা নিজেদের মনে করেন বাজিকর। তাই প্রতিদিন অসংখ্য অসাম্য, অবিচার এবং অন্যায় ঘটলেও তা নিয়ে চলচ্চিত্রকার যদি ছবি বানান, তাহলে প্রতি পদে আসবে বাধা। ধর্মের নামে যে বজ্জাতিগুলি নিয়ে চলচ্চিত্রের ভাষায় প্রতিবাদ করলে জুটবে লাঞ্ছনা আর হয়রানি। তবুও কেউ না কেউ এই দমনমূলক শাসনব্যবস্থাকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রশ্ন করবেনই।

গণ্ডি অতিক্রম করতে হলে তাঁদের গল্প বলবার কৌশলকে আরও উন্নত করতে হবে। নিছক মনোরঞ্জনের নামে তাৎক্ষনিক উত্তেজনার উপাদানগুলিতে গুরুত্ব না দিয়ে তাঁদের চিত্রনাট্যকে প্রবেশ করতে হবে আরও গভীরে। ইংরেজিতে যাকে nuances বলা হয়, তাঁদের রচিত চরিত্রবিন্যাস ও ঘটনার বৃত্তান্তে সেই সূক্ষ্ম তারতম্যগুলিকে তুলে আনতে হবে। চিত্রনাট্যকার এবং চলচ্চিত্রকারদের হতে হবে আরও তীক্ষ্ণ এবং বুদ্ধিমান। যদি তাঁরা বিতর্কিত সামাজিক ও ধার্মিক বিষয়গুলিকে এড়াতে না চান, তাহলে মোটা দাগের অতিব্যাখার পথে হাঁটলে চলবে না। নিজেদের বক্তব্যকে এমনভাবে উপস্থাপন করবেন তাঁরা, যা প্রতিপক্ষের আক্রমণের জবাব দিতে সমর্থ হয়। সুতরাং আক্রমণগুলি কোন কোন দিক থেকে আসতে পারে, সেই বিষয়ে সজাগ থাকাটাও তাঁদের ক্ষেত্রে জরুরি। দায়বোধ নিয়ে চলচ্চিত্রকে সমকালীন করে তোলবার প্রয়াসীরা হবেন সংবেদনশীল। এবং তাঁদের প্রকাশভঙ্গীর গভীরতা হবে এতটাই যেন তাতে সস্তা সমালোচনার অবকাশ না থাকে।