Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কলকাতা, নয়… — ৭ম পর্ব

অশোককুমার মুখোপাধ্যায়

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

সেইসব আত্মজন

পুজোর পরেই যে শালকরের দোকান থেকে গরম জামা, সোয়েটার, আলোয়ান, কোট কাচিয়ে নিতে হবে, এ তো জানা কথা। মনে না থাকলেও চিন্তা নেই— ফ্রি ইন্ডিয়া স্টিম লন্ড্রি কি আজাদ হিন্দ লন্ড্রির বাইরেই দেখা যাবে সারি-সারি ভেজা আলোয়ান, চাদর রোদ্দুরে মেলে দেওয়া হয়েছে, সে ড্রাই ওয়াশই হোক বা ওয়েট ওয়াশই হোক রোদ্দুর লাগাতেই হবে গরম জামাকাপড়ে— এই ছবি দেখেও যদি মনে না পড়ে তাহলেও ভাবনা নেই, বাসুকাকু ঠিক বলবে, যা তো আমার এই কোটটা এফ আহমেদ-এর দোকানে দিয়ে আয়, অর্ডিনারিতে দিবি। অর্ডিনারি আর আর্জেন্ট-এর তফাত কাপড় ফেরত দেওয়ার তারিখে, প্রথমটা সাতদিন পরেরটা তিনদিন, এইজন্য দামও আলাদা। ঠিক তারিখে সূর্য সেন স্ট্রিটের দোকানে পৌঁছে বিল দেখাও, যতক্ষণে তুমি দেওয়ালে টাঙানো নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর ছবি আর তার তলায় লেখা, গিভ মি ব্লাড, আই উইল গিভ ইয়ু ফ্রিডম বানান করে পড়ে উঠছ তার মধ্যেই এফ আহমেদের দোকানদার কাঁচের আলমারি থেকে বের করে আনবে তোমার গরম জামা। চেনবার উপায় নেই; যে জামাটি তুমি প্রায় মণ্ড পাকিয়ে ঘিয়ে ভাজা অবস্থায় দোকানের কাউন্টারে ছেড়ে গিয়েছিলে সাতদিন কি তিনদিন আগে, সে মসৃণ ব্রাউন পেপারের মোড়কে পাটে-পাটে শুয়ে আরামে ঘুম দিচ্ছে! মোড়কের ওপর টোয়াইন সুতোর বাঁধন! তাকে হাতে ধরে প্রায় এক বছরের শিশুকে কোলে নিয়ে চলবার মতো সাবধানে পা ফেলতে হয়, ভাঁজ ঘেঁটে গেলে কেলেঙ্কারি। কানমলা খেতে ভয় নেই, কিন্তু যদি বুদ্ধু কি হাঁদা বলে দেয় কাকু, সে বড় অপমানের!

বাড়িতে পরবার জামাকাপড়, ধুতি-পায়জামা-শাড়ি বাড়িতেই কাচতে হবে— বালতিতে গরম জল ঢেলে সোডা-সাবান দিয়ে তাতেই চুবিয়ে দাও ওইসব কাচবার জিনিস। হাতে ছ্যাঁকা যাতে না লাগে, একটা বেতের লাঠি দিয়ে সারতে হয় কর্মটি। ওই লাঠির আর একটি কাজ— আমাদের ঠ্যাঙানো! যখন নকশালবাড়িতে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ শোনা যাচ্ছে, সে বছর আমিও বিদ্রোহ করে লাঠি ভেঙে ফেলেছিলাম, ভেঙেই অবাক! যে লাঠি এত পিটিয়েছে এতদিন ধরে, চামড়ায় প্রথমে লালদাগ পরে কালশিটে ফেলে দিয়েছে, তাকে, একদিন ঠ্যাঙানি খাবার পর, শুধুমাত্র রাগের ভরে দু হাতে চাপ দিতেই মট করে দু-টুকরো! সেইদিনই নিশ্চয়, কোনও কিছু না জেনেবুঝেই, বিশ্বাস জন্মেছিল, কমরেড, ‘কান্নাকে ঘৃণায়, অপমানকে প্রতিহিংসায় পরিণত করে আমাদের লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।’ এ সবই নিশ্চয় হাওয়ার গুণ অথবা দোষ! অবিশ্যি ততদিনে ডন-বৈঠক করে, আমার জ্যেঠুর ভাষায়, বেশ ষণ্ডা হয়ে গেছি। পাড়ার নামহীন লন্ড্রি (নাম নিশ্চয়ই ছিল কিছু কিন্তু ঝুল কালি লেগে রংছুট হওয়ায় পড়া যেত না) দোকানের মালিক এবং দর্জি  চাদুদার ফিতের মাপ অনুযায়ী— ঠেলা ছাতি… বত্রিশ (যা অচিরেই চৌত্রিশ হবে), কোমর… বাইশ (পরে অনেকদিন চব্বিশ)…

আমাদের তিনতলায় যে পরিবার থাকত সেই দাসবংশের কনিষ্ঠ সন্তান লালটুও এই ঘটনার কিছু পরেই, এক রাউন্ড মারধোর খাবার পর বিদ্রোহ করে আরও বিপ্লবী স্টাইলে। ওর বাবার নাম লেখা লেটার বক্সের মধ্যে চকোলেট বোমা রেখে পলতেয় আগুন ধরায়। আমরা নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে অবলোকন করি, গগনবিদারী আওয়াজের সঙ্গে ওর বাবার সাধের লেটার বক্সের পাল্লা কব্জাছুট হয়ে কান্নিক খাওয়া ঘুড়ির মতো একদিকে হ্যাল-হ্যাল করছে! এমত অবস্থায় আর কেউই মায়া বাড়াতে চাইবে না, লালটুও চায়নি। ওই মৃত্যুপথযাত্রী পাল্লাটিকে বন্ধনছিন্ন করে সামনের জঞ্জালস্তূপে সদম্ভে নিক্ষেপ করে আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে চলে যায়। কেন যে সবাই ‘বাড়িতে আর ফিরব না’ বলে পশ্চিমে আমহার্স্ট স্ট্রিটের দিকে হাঁটতে শুরু করে! গঙ্গা আছে বলে না হাওড়া স্টেশন, বোঝা শক্ত। কাউকেই পূবদিকে বৈঠকখানা কি শিয়ালদা যেতে দেখিনি। লালটু খুব সিনেমা দেখে বেড়াত, রাস্তার আলুকাবলি ফুচকা খাওয়াতেও ওর জুড়ি নেই। ও বোধহয় জুড়ি খুঁজছিল।

একদিন বলল, ‘হলে রাজদ্রোহী এসচে, উত্তম-অঞ্জনা, যাবি?’ হল মানে পূরবী অথবা অরুণা। ‘যাবি?’

–পয়সা নেই রে…
–ও তোরা তো আবার হাতখরচের পয়সা পাস না, আমিও পাই না, লজ্জার কিছু নেই… ঠিক আছে এক কাজ কর, এগারোটা স্টেটসম্যান নিয়ে নে, পুরনো কাগজ নিবি, কাগজের ডাঁইয়ের তলার দিক থেকে… ঠিক এগারোটা, এক কিলো হবে… তারপর চল পুরনো কাগজের দোকানে, বিক্রি করে আড়াই টাকা…

আড়াই টাকা! খরচের হিসেব কল্পনা করে ফেললাম— পঁয়ষট্টি পয়সার সিনেমা দেখা, আলুকাবলি-ঘুগনি-ফুচকা’র পরেও যা থাকবে তা দিয়ে ক্যাডবেরি-কাজুবাদামও হয়ে যাবে। কিন্তু এর আগে যতবার সিনেমা দেখেছি বাবা বা মার থেকে পয়সা নিয়ে টিকিট কেটে দেখেছি। এই সিনেমার নাম শুনলে বাবা কী রাজি হবে? বাবার মুখটাও ভেসে উঠল। অসম্ভব, বিদ্রোহ করতে পারি কিন্তু এ তো চুরি…

‘না রে লালটু, আজ নয়…’, যদিও মনে-মনে জানি আজ-কাল-পরশু কোনওদিনই এইভাবে দেখব না সিনেমা, এইভাবে খাব না কাজুবাদাম। কাজুবাদামের ওপর ভালোবাসাটা জন্মেছিল সেই কাঁচা বয়েসেই…

প্রথম কাজুবাদাম খাওয়ায় বহুরূপীর অরুণকাকু, অরুণ মুখোপাধ্যায়, যিনি সত্যজিৎ রায়ের কাঞ্চনজঙ্ঘা-তে অভিনয় করেছেন। তৃপ্তি মিত্রের সঙ্গে কাঞ্চনরঙ্গ-তেও। রাজা নাটকে কি দারুণ অভিনয় ভণ্ড রাজার ভূমিকায়! একবার সেই কোন বালকবেলায় বাবার হাত ধরে গিয়েছিলাম বহুরূপীর মহলায়, বোধহয় মুক্তধারার রিহার্সাল চলছে। আমি বারান্দায় একা। রাস্তার দিকে তাকিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে ভালোই লাগে, কতরকমের লোক দেখা যায়। হঠাৎ একজন ফর্সা, লম্বা, জামাপ্যান্ট পরা ভদ্রলোক এসে দাঁড়ালেন আমার থেকে তিন-চার ফুট দূরে। উনিও আমার মতো রাস্তা দেখছেন, নিজের মনে কীসব বিড়বিড় করছেন, আর ঠোঙা থেকে বের করে কী একটা মুখে পুরছেন। আড়চোখে দু-একবার দেখলাম। উনিও দেখলেন। হঠাৎ কাছে এলেন…

–কী নাম তোমার?

বললাম।

–কোন ইস্কুলে পড়ো?

এরপরে নিশ্চয় জিজ্ঞেস করবেন কোন ক্লাস। একবারেই দুটো বলে দিলাম।

–হেয়ার স্কুল… ক্লাস ওয়ান…
–ও বাহ্‌… তোমার বাবার নাম কী?

বললাম।

–ও… তুই আমাদের সেজদার ছেলে… এই নে খা…

চারটে কাজুবাদাম দিলেন ভদ্রলোক।

–এইটা কী?
–কাজুবাদাম… খেয়ে দ্যাখ… খুব ভালো

খেয়ে দেখলাম, দারুণ খেতে।

–কী রে ভালো না?

মাথা নাড়লাম। হ্যাঁ খুব ভালো।

–এই নে আরও নে…

এইবার যে মাথা নেড়ে না বলতেই হয়, বলেওছিল বালকটি, কারণ ওই বয়সেই যে তার লজ্জাবোধ প্রখর। এবং তারই হাত ধরাধরি করে কিছু পরিমাণে ভদ্রতাবোধও। এইজন্যই বোধহয় জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কী?

ভদ্রলোক হাসলেন। কী সুন্দর হাসি। আমার নাম অরুণ মুখোপাধ্যায়, তোর অরুণকাকু।

বহুরূপী নাট্যদলে শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্র জেঠু-জেঠিমা, বাকি বাবার বন্ধুদের সবাই আমার কাকু… অমরকাকু, শোভেনকাকু, কুমারকাকু, সমীরকাকু, দেবতোষকাকু, শান্তিকাকু, সুনীলকাকু, বলাইকাকু… সবাই। একবার গড়িয়াহাটে রাঙাকাকিমার বান্ধবী জিজ্ঞেস করেছিল, শম্ভু মিত্র কী তোমার আপন জেঠু? মাথা নাড়ালাম, স্বপন জেঠু। বান্ধবী হেসে উঠলেন। আসলে মা মাঝে-মাঝেই বলত, অত আপন-স্বপন বুঝি না বাপু…। সেই থেকেই স্বপন কথাটা পাওয়া। বাবা মারা যাবার পর ওই ‘স্বপন’ জেঠু বলেছিলেন, সেজদা আমার জীবনে দেখা একজন শ্রেষ্ঠ ভদ্রলোক… তুমি ওই ভদ্রলোকের ছেলে, মনে রেখো।

অরুণকাকু বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলির আত্মীয়, তখন থাকত সার্পেন্টাইন লেনে। স্কট লেনের বাড়িতে বাবার সঙ্গে গল্প করতে আসত মাঝে-মাঝে। যখন ‘আটটা ন’টার সূর্য’ ধারাবাহিক বের হচ্ছে রোববার ম্যাগাজিনে, এই তো সেদিন, ২০১১-১২ বোধহয়, একটি জায়গায় যৌনতা প্রকাশে সোফিয়া লোরেনের নাম ব্যবহার করায় অরুণকাকুর সে কী দুশ্চিন্তা! এই শোন উনি এখনও বেঁচে, যদি তোর নামে কেস ফাইল করে দেয়?… যত বলি আরে দূর এই ম্যাগাজিন কে ওঁর হাতে পৌঁছে দেবে… না-না তুই জানিস না, এদের নানান রকম লোকজন ছড়ানো থাকে…। এই কাকুরা অন্যের জন্য এত দরদ দিয়ে ভাবতে শিখল কী করে!

প্রথম টুকরো-টুকরো মুরগি ভাজা খাওয়াল শোভেনকাকু, শোভেন মজুমদার। যার ডাকনাম বাচ্চা। রক্তকরবীর বিশুপাগল। রান্নাঘরের লাগোয়া খাবার ঘরের লালমেঝের ওপর আসন পেতে বাবু হয়ে বসে আমরা চারজন— বাবা, শোভেনকাকু, আমি আর ছোটভাই খাচ্ছি, মা পরিবেশন করছে… ডাল-ভাত-তরকারি-ঝোল… আর মুরগিভাজা, যার সাহেবি নাম চিলি চিকেন ড্রাই অথবা ফ্রায়েড চিকেন… সেন্ট্রাল অ্যভেনিউ-র চাঙ ওয়া থেকে কেনা, সেই সময়ের সত্যিকারের চিনে দোকান… ডালভাতের সঙ্গে বেগুনভাজা না খেয়ে সেদিন খাওয়া হচ্ছে ওই টুকরো-টুকরো মুরগিভাজা! কী অবলীলায় এই চৈনিক খাদ্যটিকে আমরা ডালভাতের মতোই বাঙালি বানিয়ে আত্মসাৎ করেছি! চাউ-মিয়েন কলকাতার ফুটপাত দখল করবে এর বহু পরে। ভাগ্যিস কোনও চিনা উপস্থিত ছিল না আমাদের খাবার ঘরে— এ দৃশ্য দেখে মাও-সে-তুঙের দেশের যে কোনও চিনের হাসতে-হাসতে বাঁধানো দাঁত খুলে আসবার কথা!

মাঝারি উচ্চতার, গৌরবর্ণ, সৌম্যকান্তি, বাবরি চুল শোভেনকাকুর সর্বাঙ্গে একজন উদাসী বাউল খেলা করত। লম্বা ঝুলের গেরুয়া পাঞ্জাবি, চওড়া ঘের পায়জামা, কোনও চিনের দোকান থেকে কেনা কালো ব্যাক-স্ট্র্যাপ চটিজুতো, মুখে পাইপ আর ডান কাঁধে ঝোলা, এই যদি অকৃতদার মানুষটির বাইরের চেহারা হয়, ভেতরে-ভেতরে হেমকুণ্ডের জল। সেই নির্মলতায় কতবার যে আমরা ডুবেছি। স্কট লেন বাড়ির খাটে বসে যখন গেয়েছে বিশুপাগলের গাওয়া গান, ও চাঁদ চোখের জলে লাগল জোয়ার… মুহূর্তে আমাদের আশপাশের দেওয়াল-কড়িকাঠ-ছাদ সব অদৃশ্য, রাস্তার গাড়িঘোড়ার শব্দ সব জমে একতাল বরফ… শোভেনকাকুর গান আমাদের নিয়ে চলেছে কোনও নক্ষত্রপুঞ্জ ভেদ করে অচেনা গ্রহের দিকে… গান শেষ হলেও চুপ করে বসে থাকি, তখনও জানালার পাল্লায় আলমারির কাঁচে রিনরিন করছে সুরের কণা। আবার যখন গেয়েছে রাজা নাটকের গান, তোরা যে বলিস ভাই… আমাদের চারপাশ নাচতে শুরু করেছে। আমাদের আবদারে গানটা শিখিয়েওছে নাটকের সেই পাগল।

শোভেনকাকুর বাবা সুধীন্দ্রনাথ মজুমদার, আমরা বলতাম দাদু (ঠাকুর্দা), নামকরা ওস্তাদ, যাঁর কাছে তালিম নিতে আসতেন অনেক নামী শিল্পী, আমাদের শেখানোর চেষ্টা করেছিলেন একটি গান… বড় অদ্ভুত তার ভাষা… ঠাকুরদাদা পেয়ারা খাঁউ… আসলে যেমন খুশি বাক্য বসিয়ে শেখাতে চেষ্টা করেছিলেন কোনও একটি রাগ… আমরা শিখিনি… আমাদের ভালো লাগত শোভেনকাকুর সঙ্গ, কত নাটকের গল্প, পুরনো কলকাতার গল্প, চিনেপাড়ার গল্প, ছবি বিশ্বাসের নকল আর যাঁর গান ভালো লাগে সেই দেবব্রত বিশ্বাসের গল্প (যাঁকে শোভেনকাকু জর্জদা বলত। এলআইসি-তে কাকুর সহকর্মী ছিলেন উনি)। শোভেনকাকুর জ্যাঠামশাই নামকরা সাংবাদিক সত্যেন্দ্রনাথ মজুমদার। বড়পিসির মেয়ে, ছোড়দি— তৃপ্তি মিত্র; মেজপিসির ছেলে, দাদা— গোষ্ঠদা, বিজন ভট্টাচার্য।

কী সারল্য এই বিশুপাগলের। মার রান্না আলু-ফুলকপির ঝোল রুটি দিয়ে খাবার সময় একটু ঝোল বাঁচিয়ে রাখবে চুমুক দিয়ে খাবার জন্য। চুমুক দিতে-দিতে বলবে, বৌদি বড় তৃপ্তি এই ঝোল চুমুকে, এতেই তো খাবারের সব গুণ মিশে থাকে, তাই না? মা হাসি-হাসি মুখ করে মাথা নাড়ত। শোভেনকাকুর আকাঙ্ক্ষার দৌড়ও আমাদের মতোই খুব সাধারণ মানের— বৌদি, এখনও বোনাসের টাকাটা দিল না, দিলেই একদিন ভেটকি মাছ-আলু-ফুলকপির ঝোল খাওয়া যায়, হাসতে-হাসতেই বলবে আমাদের কাকু। আগে আমাদের পাড়ার জয়নারায়ণ চন্দ্র লেনে ভাড়া বাড়িতে থাকত শোভেন কাকু-পিণ্টি-শানু-চুম্পা-কুমকুম-বুদি-মুক্তিপিসিরা, পরে নিজেদের বাড়ি হলে চলে যায় সেই যাদবপুর-সন্তোষপুরের বাড়িতে। ওদের চলে যাবার দিন কী কান্না স্কট লেনের বালক দুটির। সেই বাড়িতে গিয়ে তিন-চারদিন করে থেকেওছে দুজন। তখন ওই বাড়ির চারপাশ তেপান্তরের মাঠ, জনমানব নেই, একটু এগোলেই মাছের ভেড়ি, যাদবপুর স্টেশনে নেমে কুড়ি মিনিট-আধ ঘন্টা পা চালাতে হয়। বিদ্যুৎ নেই, রাত্তিরে লন্ঠন। বাড়ির চাতালে বসে দেখা যায় দূরে ট্রেনের ঝিকিমিকি। রক্তে নাটক ছিল বহুরূপীর কাকুদের। যখন শেষপ্রহর উপস্থিত, শোভেনকাকু বলছে, এইবার শোভেন মজুমদার মারা যাচ্ছে।

অমরকাকু, রক্তকরবীর সর্দার অমর গাঙ্গুলি, শুভবিবাহ সিনেমার ছোটভাই, সহজ-সরল না হলেও ওর মধ্যে নাটকের পরিমাণ ষোলো আনা। গলার আওয়াজটিও বেশ নাটুকে। মনস্তত্ব বুঝত খুব ভাল। একবার যখন আমাদের বাড়িতে চার-পাঁচদিন ছিল, বলল, ‘শোন এখন এই কুড়ি বছর বয়সে বুঝছিস না, এটা-সেটা করে সময় নষ্ট করছিস, পরে একদিন বুঝবি… আমিও এমন করেছি, এখন আফশোস করি… কত বই পড়বার ছিল, পড়া হয়নি…’ এইসব বলে অঙ্ক কষে বোঝাল যে, আমি যদি দু-মাসেও একটি করে ভালো বই, যাকে ক্ল্যাসিক বলে, মন দিয়ে পড়ে শেষ করি তাহলে বছরে ছটি বই পড়া হয়, পাঁচ বছর পরে তিরিশটি হয়ে যায়, আর যদি মাসে একটি করে পড়ে ফেলতে পারি, যা করা খুবই সম্ভব, তাহলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ষাট। বলল, ‘ষাট ছেড়ে দে, তিরিশই ধর… তোর পঁচিশ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে দেখবি আশপাশে তিরিশটি ওই মাপের বই পড়া লোক নেই… তোর আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাবে…’ চেষ্টা যে করিনি তা নয়, ওর কথা শুনে কিছু বই তো পড়া হয়ে গেছে।

সেই ১৯৭৬ সালে বহুরূপীর সংসর্গ ছেড়ে চলে যেতে হবে হলদিয়া, চাকরি করতে। মন খারাপ। খুব ঘ্যানঘ্যান করছি— দেখো অমরকাকু, ভাবলাম নাটকটা করব এখন চাকরি করতে যেতে হবে হলদিয়া… একদম ভাল্লাগে না…

প্রথমে অমরকাকু খুব একটা পাত্তা দেয়নি। ঘ্যানঘ্যানের প্রাবল্য বাড়াতে বলল, তুই অভিনয় করতে সত্যি ভালোবাসিস? বললাম হ্যাঁ সত্যিই…

না-না সত্যি নয়, যদি সত্যিই ভালোবাসতিস তাহলে চাকরি করতে যেতে পারতিস না। হাসল অমরকাকু। ভেবে দেখলাম চাকরি না করে নাটক নিয়ে থাকবার মতো মনের জোর তো নেই আমার। আসলে সব কিছুই যে পেতে যাই, চাকরিও করব, নাটকও, লিখবও, নামও হবে, সব কী হয়! সেই থেকে নিজেকে একটু-আধটু চিনতে শিখি। অমরকাকুর কাছে আত্মকরুণার কোনও জায়গা ছিল না। ওর অনেক বলা গল্পের একটা এইরকম— কাকু শম্ভু মিত্রকে বলেছে, শম্ভুদা, আমাদের সত্তর বয়েস অবধি যথেষ্ট, শিশির ভাদুড়ি এবং আপনার একশো বছর বাঁচা উচিত…

তারপর? শম্ভুদা কোনও উত্তর দিলেন না, হাসলেন। অন্য কথা-বার্তা হল, বেলা হয়ে গেছে উঠছি, শম্ভুদাও বাইরে যাবার পাঞ্জাবি পরে নিলেন… এখন এই দুপুরে আবার কোথায় যাবেন শম্ভুদা? খাবেন না?

কোনও উত্তর না দিয়ে আমার সঙ্গে বেরুলেন। সিঁড়ি দিয়ে নামতে-নামতে বললেন, একশো বছর বাঁচবে যে লোকটা সে আপাতত বাঁচবার জন্য কিছু ধার করতে বেরুচ্ছে!

 

(চলবে)