Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নির্বাচন এখন এক প্রহেলিকারই নাম

সত্যব্রত ঘোষ

 




প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, চলচ্চিত্রবেত্তা

 

 

কোভিড পরিস্থিতিকে অগ্রাহ্য করে গত বছর বিহারের বিধানসভার নির্বাচন হয়। এই বছরেও সংক্রমণের হার নতুন করে আবার বাড়তে শুরু করেছে। অথচ দেশের পাঁচটি রাজ্যে যুযুধান দলগুলির প্রচার এবং পাল্টা প্রচারের ঝালাপালায় কেউই ক্ষান্তি দেয়নি। বস্তুত, নির্বাচন প্রক্রিয়ায় আজব কিছু না কিছু ঘটতেই থাকে। সেইসব দেখে বা শুনে ধন্দ জাগা স্বাভাবিক। মানবকল্যাণের তাগিদেই কি নির্বাচনের এই বিশাল যজ্ঞ, নাকি অন্য কিছু?

অসমের রতনবাড়িতে বিজেপি প্রার্থী কৃষ্ণেন্দু পালের গাড়ি থেকে সম্প্রতি ভোটযন্ত্র উদ্ধার হল। নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে ভোটদান পর্ব শেষ হওয়ার পর যে সরকারি গাড়িতে ইভিএমগুলিকে করিমগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তা ৮ নম্বর জাতীয় সড়কে রাত ৯টা নাগাদ বিকল হয়ে যায়। তখন ভোটকর্মীরা সেক্টর অফিসারকে ফোন করে বিকল্প গাড়ির ব্যবস্থা করবার দাবি জানান। কিন্তু তারপরে কেন যে ভোটকর্মীরা বিজেপি প্রার্থীর গাড়িতে ইভিএমগুলি নিয়ে উঠে বাকি রাস্তা পাড়ি দেন, তার কোনও স্পষ্ট ব্যাখা নেই। নির্বাচন কমিশনের হাতে আপৎকালীন পরিস্থিতিতে বিকল্প ব্যবস্থা থাকবে না, তা ভেবে নেওয়াটা কঠিন। অবশ্য এই ঘটনাকে ব্যতিক্রম হিসেবে চিহ্নিত করবার প্রচেষ্টা চলবে। তবে ভোটপ্রক্রিয়ার সামগ্রিক ব্যবস্থায় ফাঁকফোকরগুলিকেই স্পষ্ট করে এমন অনেক ঘটনা।

পশ্চিমবঙ্গেও সম্প্রতি দেখা গেল প্রশাসনিক শিথিলতার আরেক নিদর্শন। নির্বাচনের আগের রাত থেকে নন্দীগ্রামে ১৪৪ ধারা জারি হল। কিন্তু পরের দিন সকাল থেকেই বিভিন্ন ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে যে জটলার ছবি বারবার আমাদের দেখানো হয়েছে, তা স্পষ্টতই নিরপেক্ষ একটি প্রশাসনের ভূমিকাকে নস্যাৎ করে। আইন-শৃঙ্খলার দ্রুত অবনতির নেপথ্যে থাকে বিভিন্ন পরিকল্পনা এবং হিসাব। জনসাধারণের কৌতূহল মেটাতে তাই টেলিভিশনের বিতর্কসভায় ক্ষমতাসীন এবং বিরোধী দলগুলির প্রতিনিধিরা পরস্পরের দিকে অবাধ কাদা ছোঁড়াছুড়ি করেন। তা দেখে সাধারণ মানুষের আশঙ্কা আর রাজনৈতিক বোধ মিলেমিশে একাকার হয়ে বিপন্নতাকেই তীব্র করে তোলে। নিরবচ্ছিন্ন এই দ্বন্দ্ব আর হানাহানিতে সাধারণ রাজ্যবাসীর কোনও উপকার হয় কি?

নন্দীগ্রাম বিধানসভা আসনটিকে কেন্দ্র করে পশ্চিমবঙ্গের বহুস্তরীয় সমাজে মেরুকরণের যে উদগ্র রূপ দেখা গেল, তাও অভূতপূর্ব। বিজেপি-র বিভেদমূলক প্রচারের জবাবে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও এবার নিজেকে অধিক পরিমাণে হিন্দু সাব্যস্ত করতে চেয়েছেন। আজ যারা মূল দুই প্রতিপক্ষ হয়ে পরস্পরের সম্মুখীন, গত দশ বছর ধরে দুজনে এক হয়ে এখানে আধিপত্য উপভোগে ব্যস্ত ছিলেন। ২০২১-এর ভোটের প্রচারে তাই একে অপরকে দোষারোপ করবার মাধ্যম হিসেবে অবশ্যম্ভাবীভাবে ধর্মকেই করেছেন হাতিয়ার। ভোট চাইতে গিয়ে দুই পক্ষই নিজেদের ব্যক্তিপরিচিতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এতটাই, যে শেষবেলায় একজন বিভিন্ন ভোটকেন্দ্রে দাপাদাপি করে এবং অন্যজন একখানে মৌন অবস্থান করে সংবাদমাধ্যম এবং ভোটদাতাদের বার্তা দিয়েছেন প্রকৃত অর্থে এখানে ভোট হল এই দুজনের দাবাখেলা— মোক্ষম শেষ চালেই যার জিত বা হার নির্ধারিত হবে। ভোটপ্রার্থীদের এই ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিশ্রুতি পাওয়াটাকেই ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছেন কি সাধারণ মানুষ? বিকল্প হিসেবে তাঁদের কাছে অবশ্য যোগ্য একজন বাম প্রার্থী ছিলেন। ধর্মভিত্তিক বিভেদ নয়, সমন্বিত এক উন্নয়নের পথকে তাঁরা শ্রেয় ভেবে সেই তরুণীকেই এবার বিধানসভার আঙিনায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ দিলেন কিনা, তা জানা যাবে ফলপ্রকাশের দিন। আপাতত, নন্দীগ্রামের ভোটদানের শতকরা হিসাবটি (৮০.৭৯ শতাংশ) অন্তত এটুকু বুঝিয়ে দেয় যে মতপ্রকাশে ভয় পায়নি জনসাধারণ।

মতবিরোধিতার স্বাধীনতা নিয়ে মতবিভেদগুলির মধ্যে দিয়েই ভারতের মানুষরা বুঝে নিতে চান: আমরা কে? আমরা কোথায় যেতে চাই? কেমনভাবে যাব? সঙ্গে চান শান্তিতে দিনযাপনের অবকাশ এবং দৈনন্দিন জীবনে কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য। অনিশ্চয়তা আর দারিদ্রের কবলে জেরবার মানুষগুলির সমস্যার সুরাহা করবার ইচ্ছা হয়তো নির্বাচনে অবতীর্ণ অধিকাংশ প্রার্থীদের থাকে। কিন্তু দশচক্রে ভগবান যেমন ভূত হয়, তেমনই এই ‘সমাজসেবক’-রা ভোটের জটিল অঙ্কে পাক খেতে খেতে বিরোধী হয়ে ওঠেন সেই সমাজেরই, যার অবিচ্ছেদ্য অংশ তাঁরা নিজেরাও। তখন তাঁদের চোখে ভোটদাতা নেহাতই এক সংখ্যা।

২০০৭-৮ সালের বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দার পরে থেমে যায় ভারতের প্রগতি। সেই স্তব্ধতায় সুচতুর বিপণন ছকে গুজরাটের বিতর্কিত মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর বিশ্বস্ত এক সহচরকে বানানো হয় নবযুগের কাণ্ডারীদ্বয়। পুর্বতন ইউপিএ সরকারের ঘাড়ে যাবতীয় দায় চাপিয়ে বলা হয় দেশ নামক টগবগে ঘোড়াটির রাশ এতকাল ছিল অযোগ্য মানুষদের হাতে। মানুষের জীবনযাত্রার উন্নতি তাই হয়নি। আশ্চর্য দৈত্য এবার ‘বিকাশ’-এর ফুলে সবার বাগান ভরিয়ে দেবে। দৈত্যের ফুল ফোটানো দেখার পুলক অবশ্য মিটতে থাকে যখন দেখা যায় গোরক্ষকদের সজাগ তৎপরতায় দেশের মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। গত সাত বছরে একের পর এক প্রচারের ঢেউ এসে পাথুরে বাস্তবে আছড়ে পড়লেও ‘বিকাশ’ নামক ফুলটি তাই আর ফোটেনি।

মাঝখানে নাকি গভীর তদন্ত হয় জানতে যে রাতদিনের লাগাতার প্রয়াসেও বিকাশের ফুল কেন ফুটছে না। তদন্তে জানা গেল দেশ জুড়ে কালো টাকার দাপট। সমান্তরাল সেই অর্থনীতির বিরুদ্ধে হাতিয়ার হল নোটবন্দি। ২০১৬ সালের শেষদিকে হঠাৎ নোটবন্দির পর থেকেই শুরু হয় গভীর অর্থনৈতিক সঙ্কট। অথচ, ২০১৯ সালে দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে ভারতবাসী সেই দৈত্যকেই আবার ফিরিয়ে আনেন। সাত বছর আগের মতো মানুষ এখনও উৎসুক। তাঁরা এখন জানতে চান: আমরা কেমনভাবে এগিয়ে যাব।

বহুত্ববাদী, বহুধর্মীয় একটি সমাজের অংশ হিসেবে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর অতিবাহিত করবার ফলে ভারতবাসীরা নিজেদের জন্যে একটি সার্বজনীন পরিচিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। সেই পরিচিতিকেই উপড়ে দিয়ে ইদানিং ব্যক্তিগত পরিচিতির উপর যাবতীয় গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। ‘ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া’ স্লোগানের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া সেই আরএসএস কর্মী এখন হাস্যময় প্রধানমন্ত্রী রূপে দেশের সর্বত্র শোভিত। সাংবাদিক সম্মেলনে নয়, রেডিও ও টেলিভিশনে প্রসারিত ‘মন কি বাত’-এ তিনি মানুষকে আশার ছলনায় ভুলিয়েছেন।

আশাভঙ্গের যাবতীয় তিক্ততার মধ্যেই করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হল। দীর্ঘ লকডাউনের সূত্রে অধিকাংশ ভারতবাসীর অর্থনৈতিক নিরাপত্তাটুকুও কেড়ে নিয়ে শোনানো হল ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর কথা। ‘আত্মনির্ভরতা’-র সেই পর্বটি যে দেশপ্রেমের মিষ্টত্বে অবসৃত হয় না তা সবাই জেনেছিলেন। তবে যারা মেনে নিতে পারেননি, তাঁরাও বুঝেছেন কৃষকদের স্বার্থের পরিপন্থী আইনগুলি ঘোষণার পর লাগাতার কৃষক বিক্ষোভ চলা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকারের অনমনীয় অবস্থান দেখে। অধিকাংশ ভারতবাসীই এখন মনে করেন যে রাজনীতি আসলে ক্ষমতা এবং আধিপত্য বিস্তারের অমোঘ এক প্রক্রিয়া।

সেই ক্ষমতানীতির পরিচয় এখন পশ্চিমবঙ্গ এবং অন্যান্য রাজ্যের মানুষ আবার নতুন করে পাচ্ছেন। ইভিএমের কারসাজি করে এবং দেশের আধা-সামরিক বাহিনিকেও ক্রীড়নক বানিয়ে সামগ্রিক ভোটপ্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতাকেই সন্দেহ করা তাই এখন একটি স্বাভাবিক প্রবণতায় পর্যবসিত হয়েছে। গৃহস্থরা ৮৩৫ টাকায় কিনছেন একটি গ্যাস সিলিন্ডার। পেট্রলের এক লিটার এখন ১০০ টাকা, ডিজেল বিকোচ্ছে ৯০-তে। তবুও বিজেপি-র দাবি ভোটের হাওয়া তাদেরই অনুকূলে। তা প্রমাণ করতে তারা এতটাই মরিয়া যে এক রাতের মধ্যে প্রত্যাহার করে নেওয়া হল পিপিএফ, সুকন্যা সমৃদ্ধি এবং সিনিয়র সিটিজেন সেভিংস-এর সুদ কমানোর সরকারি ঘোষণা। অথচ, অর্থমন্ত্রী অন্তত দিন পনেরো ধরে প্রটোকল মেনে নিজের অধীনে থাকা বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে আলোচনার পর সুদের নতুন হার নির্ধারণ করেই সরকারি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন।

‘সুনার বাংলা’ গড়ার প্রতি ‘মোদি-শাহ’র আগ্রহ কতটা তা সন্দেহাতীত নয়। ওনাদের অনেক বেশি আশঙ্কা ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন নিয়ে। চটকসর্বস্ব প্রচারের জোরে তো বারবার জেতা যায় না। প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য অন্য কোনও উপায় ওনাদের জানা নেই। তাই, দেশের এমন সঙ্কটাপন্ন অবস্থাতেও নিজেদের সরকারি দায়িত্বগুলি আমলাদের হাতে দিয়ে বারবার এই রাজ্যে আসতে হচ্ছে তাঁদের। পশ্চিমবঙ্গের ভোট এখন বড় বালাই। বাংলার জনগণকে প্রলুব্ধ করতে নিয়োগ করা হচ্ছে বিভিন্ন ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট সংস্থা। বিলি করা হচ্ছে গেঞ্জি, পাঞ্জাবি আর শাড়ি। পাগড়ি পরাতে আনা হচ্ছে লোক। বস্তা বস্তা গোলাপের পাপড়ি দিয়ে কুসুমাস্তীর্ণ করা হচ্ছে রাস্তা। এমনকি, টেলিভিশনের ক্যামেরায় ‘স্বতঃস্ফূর্ততা’ ফুটিয়ে তুলতে নেতাদের দিকে ফুল ছোড়ার দায়িত্ব দিয়ে বাড়িগুলির ছাদেও তুলে দেওয়া হচ্ছে ভাড়াটে মানুষদের।

বাংলা তথা অসমের মানুষের নেওয়া ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তগুলি আগামী দিনে রাজ্য এবং সমগ্র দেশের সমাজ ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সেই উপলব্ধি তাঁদের আছে। তবে তাঁরা নিশ্চিত নন যে তাঁদের সিদ্ধান্তগুলি শেষ অবধি ইভিএমের মাধ্যমে নিশ্চিত এক জনাদেশে রূপায়িত হবে কিনা। নির্বাচন তাই এখন এক প্রহেলিকারই নাম।