Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দুটি গান ও বঙ্গের বুদ্ধিজীবী

চার্বাক মিত্র

 

রাজনৈতিক নিবন্ধকার

একটি গানে বলা হয়েছে ‘তুমি কাউকেই ভালোবাসো না’। অন্য ‘গান’, যদি তাকে গান বলে ধরে নিই, তাহলে সেই গান বলছে, ‘তুমি আমাদের ভালোবাসো না’। এই প্রথম বোধহয় বাংলার নির্বাচনী আবহে রাজনৈতিক তরজায় ‘ভালোবাসা’ শব্দটা উঠে আসছে। ভালোবাসা কেন এত অসহায়, সেই কবে বাংলা গানে এই গূঢ় প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। আজ যেন আবার সেই প্রশ্ন এসে দাঁড়াচ্ছে ভোটের দামামায়। তা হঠাৎ করে বাং‌লার ভোটরাজনীতিতে ভালোবাসা-টালবাসা নিয়ে এত কথা কেন?

প্রথম যে গানটি, যেটি ইতিমধ্যেই দেশজুড়ে আলোড়ন ফেলেছে, ফেলাই উচিত, সেই গানটির দৌলতেই কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টির মতো একটি আদ্যন্ত কাঠখোট্টা রাষ্ট্রবাদী দল গানের মধ্যে ‘আমাদের ভালোবাসো না’ জাতীয় অভিমানী শব্দচয়ন আমদানি করেছে। বিজেপি-র গানের প্রতিটি ছত্র শুনলে বুঝবেন এই গানটি প্রথম গানটির কাউন্টার। ব্যর্থ, বেসুরো কাউন্টার। বিজেপি-তে নাকি গন্ডা গন্ডা সেলিব্রিটি ঢুকেছে, ঢুকেই তারা প্রার্থী হয়ে জেঁকে বসেছে! অথচ মজার ব্যাপার, এই ভিডিওতে সেই ফাটা রেকর্ডের বাবুল সুপ্রিয় আর প্রকাশ্যে স‌ং সাজা রুদ্রনীল ঘোষ‌। আর দু-একজন সিরিয়ালের তামাদি অভিনেতা আছেন, বাকিটা যাঁরা ভরাট করেছেন, বাবুল সুপ্রিয় দেখলাম দাবি দিয়েছেন, তাঁরা টালিগঞ্জের ‘নিপীড়িত’ টেকনিশিয়ান। খুব ভালো কথা, এমনটাই তো হওয়া উচিত। অর্থাৎ সেলিব্রিটির চমকে জোর দেয়নি বিজেপি। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে, কারণ একা রুদ্রনীল ঘোষ পারফরমেন্সের যা নমুনা রেখেছেন ভিডিওজুড়ে, তাতে অন্য সেলিব্রিটি যোগ হলে আরও বিপজ্জনক হত! তবে রুদ্রনীলের এলএসডি খাওয়া অভিনয়, ভিডিওতে ‘সংগ্রাম’ ‘সংগ্যাম’ হয়ে যাওয়ার মতো গোলমাল, গানের লিরিকের নামে গাঁজাখোরের প্রলাপের মতো চচ্চড়ি পাকানো, সুরের নামে বেড়ালের কান্না, গায়নশৈলীর ফাঁকফোকর— এসব মাথায় রেখেও একটা কথা বলতেই হয়, এই গানের উদ্দেশ্য এবং বক্তব্য যথেষ্ট লোডেড, এবং সেটা বিশেষ উপেক্ষণীয় নয়। কেন? একটু পেছনে হাঁটা যাক।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নন্দীগ্রাম সম্পর্কে মন্তব্যের পর ফেসবুক আবার সরগরম হল বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে। আবার চোদ্দ বছর আগের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। এই ‘বুদ্ধিজীবী’ লব্জটা তখনই বাংলা বাজারে লঞ্চ করেছিল। অনেকে এমন ডিসকোর্স রেখেছিলেন, ‘রিক্সাওলা কি বুদ্ধিজীবী নন?’ এই ছদ্ম শ্রেণিচেতনা আদতে কতজন রিক্সাওলা বা শ্রমিকশ্রেণিকে এমপাওয়ার করল কেউ জানে না, তবে বুদ্ধিজীবীরা সমাজের বিবেক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেলেন। প্রাথমিকভাবে আরেকটা সন্দর্ভ উঠে এল তখন। বুদ্ধিজীবী মানেই নিরপেক্ষ। আরও পরিস্কার করে বললে, তিনি পার্টিজান নন। তারপর কোথা থেকে কী হয়ে গেল… নতুন সরকার আসতেই বুদ্ধিজীবীদের একাংশ টপাটপ পার্টিজান হতে শুরু করলেন। কয়েকজন নন-পার্টিজান রয়ে গেলেন। সেই শুরু, এখন দেখা যাচ্ছে, শুধু বুদ্ধিজীবীরা, অর্থাৎ যাঁরা সমাজের মেধাজগৎ অধিকার করে থাকেন, তাঁরা নন, তথাকথিত জনপ্রিয় তারকা ইত্যাদিরা, বা বলা ভালো ‘সেলেব’রা দুমাদ্দুম পার্টিজান হয়ে গেলেন। যাঁরা নন-পার্টিজান হওয়ার পক্ষে সওয়াল করছিলেন, তাঁরা কেউ অরাজনৈতিক ছিলেন না। আর আজ যাঁরা পার্টিজান হচ্ছেন তাঁরা সচেতনভাবে পলিটিসাইজড্ই হননি। এবং আশ্চর্যভাবে মিডিয়ার তৈরি করা ‘দো ফুল’-এর বাইনারিতে এঁরা সকলেই দুটো পক্ষে ভাগ হয়ে গেলেন আড়াআড়ি‌। ‘ওরা থাকে ওধারে’-মার্কা রাজনীতি নন্দীগ্রাম-লালগড়-নেতাই পরবর্তী রাজনীতিতেও তো হয়েছে। তখন তো খবরের কাগজের উত্তর সম্পাদকীয় পাতায় সবচেয়ে আলোচিত এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সান্ধ্য প্যানেলে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত শব্দবন্ধগুলোর মধ্যে একটা ছিল ‘আমরা-ওরা’। কিন্তু সেই আমরা-ওরার বিভাজন ছিল খুব পরিষ্কার রাজনৈতিক মতের ওপর নির্ভর করে, ইস্যুভিত্তিক মতামতের ওপর নির্ভর করে। সেই আমরা-ওরার একপাশে যেমন ছিলেন তরুণ মজুমদার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনিন্দিতা সর্বাধিকারী, বাদশা মৈত্র, সুবোধ সরকার, অরিন্দম শীল (শেষোক্ত দুজন ড্যাংড্যাং করে তৃণমূলের ছাতার তলায় গেলেন পরে, সেকথা আলাদা), অন্যদিকে অপর্ণা সেন, জয় গোস্বামী, কৌশিক সেন, ব্রাত্য বসু, সুনন্দ সান্যাল, মহাশ্বেতা দেবী, কবীর সুমনরা। এঁদের কে ঠিক কে ভুল, কে কতটা ধান্দাবাজ, কে কতটা সুবিধেবাদী, সেসব অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু এঁরা সকলেই বিভিন্ন জায়গায় যা যা কথা বলছিলেন, তাতে রাজনৈতিক সারবত্তা ছিল, সত্যি-মিথ্যে পরের কথা। আর কমবেশি এঁরা সকলেই বুদ্ধিবৃত্তের লোক। কিন্তু এই যে কাল অবধি একটিও রাজনৈতিক কথা না বলা তারকা আজ হঠাৎ দলীয় পতাকা হাতে তুলছেন, কালকে প্রার্থী হয়ে যাচ্ছেন, কাল অবধি নন-পার্টিজান থাকা, বা বামঘেঁষা লিবারাল বলে পরিচিত হওয়া অভিনেত্রী দুম করে তৃণমূল হয়ে দেশের মাটিতে মাথা ঠেকাতে বলছেন, কাল অবধি সাতেপাঁচে না থাকার মতো গুরুতর সামাজিক সমস্যা নিয়ে সস্তার ছড়া কেটে তা ভাঁড়ামো করে পারফর্ম করে ভাইরাল হওয়া অভিনেতা বিজেপি হয়ে শীতল ভিলেনের মতো লোকজনকে প্রচ্ছন্ন হুমকি-টুমকি দিচ্ছেন, এসব বাংলায় নেহাতই আচমকা ঘটছে।

কিন্তু এর মধ্যে দেশজুড়ে এব‌ং আমাদের রাজ্যেও একটা বিষয় ঘটে গেছে। সেটা হল, জনমানসে বুদ্ধিজীবী নামক শ্রেণিটির প্রতি তুমুল শ্রেণিঘৃণা জন্ম নিয়েছে। দেশে হঠাৎ এমন হল কেন? এনকাউন্টার মুভিতে মানবাধিকার কর্মীকে লাতারে গাল পাড়ার মধ্যেই আসলে এর বীজ নিহিত ছিল। সমান্তরাল সংস্কৃতির মানুষ, পাশাপাশি সমান্তরাল রাজনীতির অ্যাক্টিভিস্ট, অর্থাৎ ভারভারা রাওয়ের মতো মানুষদের নিয়ে একটা সমষ্টিগত ভুরু কুঁচকোনো ছিলই, বিজেপি এসেই সেটাকে আপাদমস্তক ঘৃণায় পরিণত করল। এর ফলে, বিজেপি যখনই কোনও জাতীয় ন্যারেটিভ তৈরি করছে, এবং দেশজুড়ে আমজনতা সেটাকে পাখিপড়ার মতো আওড়াচ্ছে, তথাকথিত অরাজনৈতিক বা রাজনীতির খোঁজখবর না রাখা ইয়ুথ সেই ন্যারেটিভে রক্ত গরম করছে, তখন সেই ন্যারেটিভের বিরুদ্ধে গিয়ে কথা বললেই এইসব বুদ্ধিজীবীরা সরাসরি টার্গেট হয়ে উঠছেন। সোশ্যাল মিডিয়া এই প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করল। তাই ওম পুরী মারা গেলে উল্লাস হয় সোচ্চারে। এখন দেশের এই বুদ্ধিজীবী-বিরোধী ন্যারেটিভে ইরফান হাবিব বা রোমিলা থাপারের মতো সারস্বত জগতের মানুষ রয়েছেন। বিবেক অগ্নিহোত্রীর মতো বি গ্রেড ডিরেক্টরও বলেছেন, লেফট লিবারালরা অ্যাকাডেমিয়া এবং কালচারাল এরিয়া দখল করে রেখেছেন, সেটা দখলমুক্ত হওয়া প্রয়োজন। কংগ্রেসের কখনও দরকার হয়নি এই পুনর্দখলের। বরং রাজীব গান্ধির আমলে রোমিলা থাপাররা যথেষ্ট সম্মান পেয়েছেন। কিন্তু আরএসএস-এর রেজিমেন্টেশন আছে। নির্দিষ্ট মতাদর্শগত কাঠামো আছে। লেফট লিবারালদের অ্যাকাডেমিয়া এবং সংস্কৃতির জমি ছেড়ে রাখার বিলাসিতা তাদের করলে চলবে না। তাই এই সর্বাত্মক বিরোধিতা এবং ঘৃণা ছড়ানোর দরকার ছিল। রাজ্যে আবার সারস্বত জগতের মানুষরা একটু পেছনের সারিতে। শিল্পসংস্কৃতির জগতের মানুষ, যাঁদের অসাধারণ বাগ্মিতা, শিক্ষার আভিজাত্যের নমুনা পেয়ে একসময় বাঙালি মুগ্ধ হতে শুরু করেছিল, অর্থাৎ বাম আমলের শেষ দিকে, তাঁদের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ছাতার তলায় যাওয়া দেখে রাজ্যের মানুষের মোহভঙ্গ হতে শুরু করল। এর মধ্যে আবার একাংশ তৃণমূলে গিয়ে বলেছিলেন তাঁরা এখনও বামপন্থী। এর মধ্যে সুবোধ সরকার ও অরিন্দম শীলের কথা বিশেষ মনে পড়ে, নন্দীগ্রাম পর্বে টিভি পর্দায় এরাই গলা ফাটিয়েছেন সিপিএমের হয়ে। মনে পড়ে, এরা যখন দলবদল করছেন, তখন সুমন মুখোপাধ্যায় বাংলা মঞ্চে আবার ফিরিয়ে এনেছেন ‘মেফিস্টো’। সেই নাটকে এক গেস্টাপো অফিসারের চরিত্র, যেটা একদম প্রথমদিকে বিমল চক্রবর্তী করতেন, তার এরকম একটি সংলাপ ছিল, “দুদিন ফুটানি মারলেই কেউ কমিউনিস্ট হয়ে যায় না।” হলজোড়া হাততালি পড়ত। যাই হোক, কয়েকদিন আগে দেখলাম, কৌশিক কর নামক এক বৈপ্লবিক নাট্যব্যক্তিত্ব বিজেপিতে গিয়েই বললেন, এখনও আমি বামপন্থী‌। সহি বামপন্থীরা কি তাহলে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাচ্ছেন? কে জানে! মোদ্দা কথা, ওই সুললিত বাগ্মিতাকে চতুরতা ভাবল রাজ্যবাসী। ‘বুদ্ধিমান লোক যখন নিজের বুদ্ধিকে চতুরতায় পালটে ফেলে, তখন শয়তানের সঙ্গে তার বিশেষ তফাৎ থাকে না’— ‘উইঙ্কল টুইঙ্কল’ নাটকের এই সংলাপের মতোই বাংলার মানুষ শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের কথাকে ফাঁপা শয়তানি ভাবতে শুরু করল। আর তাতে ধুনো দিল দিলীপ ঘোষের মতো দু পয়সার লুম্পেন। জুতোপেটা করার নিদান দিল সে বুদ্ধিজীবীদের। মানুষ হাততালি দিল। ‘নিজেদের মতে নিজেদের গান’-এর প্রতিক্রিয়ায় রগড়ে দেওয়ার কথাও অনেকের কাছেই খুব গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে।

তাহলে ‘নিজেদের মতে নিজেদের গান’ কী পালটাল? মানুষের কি বুদ্ধিজীবীদের প্রতি বিশ্বাস ফিরে এল? ভালো গান, ভালো দৃশ্য, এবং দলহীন প্রোপাগান্ডায় এতজন নামজাদা অভিনেতা ও শিল্পীর এক হওয়া অনেককে কিছুটা হলেও নরম করে দিতে পারে, তবে তা নিতান্তই সাময়িক। এর কোনও রাজনৈতিক অভিঘাত নেই। এরপর এই শিল্পীরা বিভিন্ন ইস্যুতে মুখ খুললেই থ্রেট খাবেন, আইটি সেল ঢালাও ট্রল করবে। তাও এঁদের বিরুদ্ধে আক্রমণের অভিঘাতটা কম ছিল। তাহলে কি বিজেপি আদৌ পাত্তা দিচ্ছে না এই গানকে?

তেমনটাই ভাবা গিয়েছিল। কিন্তু বিজেপির প্যারোডিটা বেরোতেই ছবিটা পরিষ্কার হল। কিঞ্চিৎ অদলীয় বক্তব্য, এবং ‘কাউকেই ভালোবাসো না’ বলে ভালোবাসা বনাম ঘৃণার বৃহত্তর রাজনৈতিক ন্যারেটিভ তৈরির প্রয়াস চট করে অনেককে আকর্ষণ করল। অনেকেই সরাসরি রাজনৈতিক ন্যারেটিভ নির্মাণে অংশ না নিয়েও শুধু সেই বৃহত্তর মানবতাবাদী কথা, (বিজেপি আসার আগে অবধি যা অনায়াসে বলা যেত, ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ ছোটদের রচনার কমন টপিক ছিল) তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েই ছড়িয়ে দিতে লাগল ‘নিজেদের মতে নিজেদের গান’-এর কথা ও সুর। সরাসরি বিজেপির আদর্শকে এই গানে আঘাত করা হয়েছে। ‘তুমি পুরাণকে বলো ইতিহাস, ইতিহাসকে বলো পুরানো’, একথা তো শুধুই ধারণা নয়, রামমন্দিরের রায়ে দেশের মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এই কথাকে মান্যতা দিয়েছে। ‘তোমার কাজ শিক্ষাকে লাঠিপেটা করে মূর্খের জ্বালা জুড়ানো’— জামিয়া বা জেএনইউ-র ঘা তো এখনও শুকোয়নি। মূর্খের জ্বালা জুড়ানো— এই অ্যান্টি-ইন্টেলেক্ট, মোদির হার্ভার্ড বনাম হার্ড ওয়ার্ক রাজনীতিকে সরাসরি আঘাত। ভালোবাসার কথা আসছে সরাসরি সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বিরোধী ন্যারেটিভ হিসেবে। গোয়েবেলসের আয়না, পুরনো হাঙরের দাঁত, মিথ্যে পুজোতে ব্যস্ত ও সত্যি লড়াইয়ে যোগ না দেওয়া (স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজেপি-আরএসএস-এর নিষ্ক্রিয়তা)— অনির্বাণ ভট্টাচার্যর লিরিকে এই সব ইঙ্গিতই রাখঢাক না করে বিজেপিকে সরাসরি আঘাত।

এবার উলটোদিকে দেখুন। লিরিক ধরে ধরে ব্যাখ্যা অসম্ভব, লালমোহনবাবুর ভাষায় ওই ‘কোডোপাইরিন’-মার্কা লিরিক মনে রাখা সম্ভব নয়। তবে প্রথম থেকেই ‘নিজেদের মতে নিজেদের গান’ যা যা কাউন্টার করেছে, তার সাফাই গাওয়া। মিথ্যে বিকৃত ইতিহাসের সিলেবাস পড়তে দেব না, এই ঘোষণা অনেকটা ‘শিন্ডলার্স লিস্ট’ ছবিতে রালফ ফিয়েনেস অভিনীত আমন গোয়েথ চরিত্রের মতো। যেখানে জিউদের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের চারশো বছরের ইতিহাসের পুঁথি ছিঁড়ে ফেলে আমন গোয়েথ ঘোষণা করে, টুডে ইজ হিস্ট্রি। তারপর যাবতীয় হিন্দুদের বিপন্নতার আখ্যান। প্রসঙ্গত, এখানে ‘দলিত মেয়ে পূর্ণিমা’ বলে বাংলাদেশের যে ধর্ষিতা মেয়েটির কথা বলা হয়েছে, আনন্দবাজার পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার দিয়ে সে জানিয়েছে, নির্বাচনী প্রচারের গানের এই অবাঞ্ছিত উল্লেখে সে আরেকবার ধর্ষিত হল। ‘নিজেদের মতে নিজেদের গান’-এর শেষে যে বাচ্চা মেয়েটিকে দেখা গিয়েছে, তাকে কাউন্টার করতেই বারবার হয়তো পূর্ণিমার আখ্যান বলা, কিন্তু বাংলাদেশের এই ঘটনা টেনে আনার রাজনীতিটা বিজেপির পুরনো রাজনীতি। শিমুলিয়া নিয়ে বামেরা নিশ্চুপ, সাঁইবাড়ি, মরিচঝাঁপির কাণ্ডারি তারা, এসবই রয়েছে গানের মধ্যে। মজার বিষয়, অন্য গানটিকে বামপন্থীদের ভাষ্য বলেই ধরে নেওয়া হয়েছে। হয়তো আসল মতাদর্শগত লড়াই তাদের সঙ্গে বলেই, এই গানের উদ্দেশ্য মূলত বামেরাই রইল‌‌। অমিত শাহও তো কয়েকদিন আগে বলেছেন, মমতা তাদের মতাদর্শগত শত্রু নয়। তাই এই প্রচার-গানটা সেই শত্রুদের বিরুদ্ধেই শানানো হল। রোমিলা থাপারের বিরুদ্ধে পি এন ওককে না লড়িয়ে বরং যদুনাথ সরকারকে টানা হল, যাতে বোঝানো যায়, একটা হিন্দু ইতিহাস আছে। যদিও যদুনাথ সত্যি সত্যি পড়লে এতে বিশেষ সাহায্য হবে না।

এডওয়ার্ড সাইদ তাঁর পূর্বসূরি কোনও ইতিহাসবিদের কথা উল্লেখ করে বলেছিলেন, বুদ্ধিজীবীরা হয় স্রোতে মিশে ধান্দাবাজ হবেন, নয় স্রোতের বিপরীতে হারিয়ে যাবেন। ‘নিজেদের মতে নিজেদের গান’-এর কাণ্ডারিরা কিন্তু এই দুইয়ের মাঝের রাস্তা বেছেছেন। স্রোতে মিশে দলীয় হননি, তা ঠিক না ভুল তর্কসাপেক্ষ, কিন্তু হননি। বিশেষত দুই ফুলের বাইনারিতে একেবারেই নাম লেখাননি। স্পষ্ট রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়েছেন, আবার তা জনমুখীও করেছেন। এবার বুদ্ধিজীবীদের নতুন কোনও ভূমিকা আবার এই‌ বাংলায় তৈরি হয় কিনা, সেটাই দেখার।