Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মিউটেশন, রিকম্বিনেশন, করোনা অতিমারি ও টিকা বাণিজ্য

স্বপন ভট্টাচার্য

 



প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

 

 

 

সেকেন্ড ওয়েভ। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথম ধাক্কা, যখন মনে হচ্ছিল আমরা মোটামুটি সামলে নিয়েছি,  তখন হঠাৎ হেডলাইন টানতে শুরু করেছে ব্যাকবেঞ্চে চলে যাওয়া করোনা। দাদা-দিদিরা গলা নরম করে বাইট দিয়ে একটা ‘গভীরভাবে চিন্তিত’ আবহাওয়া জেনারেট করার চেষ্টা করছেন তাও দেখছি। এ নাকি সেকেন্ড ওয়েভ! এমন তো হওয়ার কথা ছিল না! সত্যিই ছিল না কি? অতিমারির ইতিহাস থেকে একটুআধটু শিক্ষা নিয়ে থাকলেও জানা থাকতে পারত— এটা হওয়ারই ছিল।

 

স্প্যানিশ ফ্লু

শিক্ষা নেব আর কোথা থেকে ইতিহাস ছাড়া? একশো বছর আগে যে স্প্যানিশ ফ্লু পাঁচ কোটি লোক মেরে দিয়েছিল ১৯১৮ থেকে ২০-র মধ্যে তার চার-চারটে ঢেউ এসেছিল। প্রথম ঢেউয়ের এপিসেন্টার ছিল ইউরোপ। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেন্সরশিপ চলছে। অসুখের আতঙ্কে দেশপ্রেম মার খেলে সেনা পাওয়া যাবে না, ফলে সব দেশই খবর চাপছিল। স্পেন ছিল নিউট্রাল, প্রেস সেন্সরশিপ তারা আরোপ করেনি বলে খবরের সূত্র ছিল ওই স্পেন। তার থেকে নাম স্প্যানিশ ফ্লু। ১৯১৮-র প্রথমার্ধে আক্রান্তের হার কম ছিল না, কিন্তু মৃত্যুহার সাধারণ ফ্লু-র আশেপাশেই ছিল। ১৯১৫-তে আমেরিকায় ফ্লুতে মারা গিয়েছিল ৬৩০০০ আর ১৮-র প্রথম ঢেউয়ে ৭৫০০০, সুতরাং এতটা বিপন্ন বোধ করার কারণ ছিল না। বলা ভালো, সেটা যে ভাইরাস থেকে হচ্ছে এটা বোঝা গেছে ত্রিশ বছর পরে, তখন ফ্লু নয়, দায়ী করা হচ্ছিল ব্যাকটেরিয়াল নিউমোনিয়াকে। যাই হোক, সেকেন্ড ওয়েভ এল আগস্টে। আমেরিকান সৈন্যরা ফিরতে শুরু করেছে সারা বিশ্বের নানা অঞ্চল থেকে। দ্বিতীয় ঢেউ প্রথমে মারতে শুরু করল সৈন্যদের, তাগড়াই, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী অল্পবয়সী ছেলেদের, এবং তারপরে সারা উত্তর আমেরিকায় এবং বছরের শেষে পুরো ল্যাটিন আমেরিকাতেও। এত লোক মরেছিল আমেরিকায় যে সে দেশে লাইফ এক্সপেক্টেন্সি ৫৯ থেকে নেমে এসেছিল ৩৯-এ। যদি একটা লেখচিত্র কল্পনা করেন তা হলে সেটা এই সেকেন্ড ওয়েভে এসে যে তীক্ষ্ণ ডাইভ মেরেছিল তার নজির মানুষের ইতিহাসে আর নেই। যদি বয়সের গ্রাফ কল্পনা করেন তাহলে ২৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সিদের জন্য সেটা রকেট গতিতে ঊর্ধ্বমুখী হয়েছিল। এখানেই শেষ নয়, ১৯১৯-এর জানুয়ারিতে এসেছিল তৃতীয় ঢেউ যখন জাহাজ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা উঠে গেল তখন। আর এর পরেও একটা ছোট চতুর্থ ঢেউ ১৯২০ সালে আমেরিকায়।

স্প্যানিশ ফ্লু অ্যান্টিবায়োটিক-পূর্ব যুগের কথা। গণ-ভ্যাক্সিনেশন তখনও হাইপোথেসিস স্তরে। আজকের দুনিয়ার সঙ্গে তার কোনও তুলনা হয় নাকি? রোগের কারণ যদি ভাইরাস না হয়ে অন্য কিছু হত তা হলে বলা যেত— না, সত্যিই হয় না। কিন্তু ভাইরাস এক অতি ভয়ঙ্কর প্রায় অপার্থিব বস্তু। উপরন্তু, স্প্যানিশ ফ্লু-এর ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস আর আজকের করোনাভাইরাস জেনেটিক ও চরিত্রগতভাবে প্রায় সমধর্মী। এদের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল জিন-চরিত্রে ঘন ঘন বদল এনে ফেলা। এমনিতে ভাইরাসের সজীবতার সপক্ষে যুক্তি বলতে এক, সুনির্দিষ্ট পোষক বা পোষকগোষ্ঠীকে সংক্রামিত করবার ক্ষমতা যাকে আমরা তার অ্যান্টিজেনধর্মিতা বলতে পারি এবং দুই, আক্রান্ত পোষকের দেহকোষের সব জরুরি ক্রিয়াকলাপকে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন করে, কার্যত সেটিকে দাস বানিয়ে ফেলে বংশবৃদ্ধি করা। এই দুটি কাজের জন্যই প্রয়োজনীয় খবরাখবর থাকে ওদের আরএনএ জিনোমে। সেটায় বদল এনে ভাইরাস এই দুটো ধর্মই বদলে ফেলতে পারে। অ্যান্টিজেনধর্মিতায় বদল আনলে শরীরের পূর্বেকার সব চেনাজানাই চৌপাট, মনে হয় ইনি নতুন অতিথি বটেন, শরীরের স্বাভাবিক অথবা টিকাসঞ্জাত প্রণোদিত প্রতিরোধক্ষমতা তাকে চিনে ঊঠতে পারে না। পোষককোষের মধ্যে ঢুকে পড়ার পর সংখ্যা বাড়ানোর করার কাজে নিয়োজিত জিনগুলোর সক্রিয়তা দরকার হয় এবং বদল সেখানেও নিয়ে আসা সম্ভব। সংখ্যাবৃদ্ধি— এই একটিই উদ্দেশ্য সংক্রমণের, এবং জিন-চরিত্রে বদল আনার উদ্দেশ্যও একটিই— আমার সন্তান যেন থাকে দুধেভাতে। যে ছানাপোনারা সংক্রমণের পর তৈরি হবে এবং যে বিপুল সংখ্যায় তৈরি হবে তাদের জন্য নতুন পোষকদেহ, নতুন কোষের সরবরাহ সুনিশ্চিত করা। অসংক্রামিত কোষ যখন নতুন সংক্রমণের মোকাবিলা করবে তখন তার অবস্থা যেন ঝানু ফাস্ট বোলারের সামনে ক্রিজে আসা টেল-এন্ডারের মতই হয় তা সুনিশ্চিত করতেই এই বদল।

 

মিউটেশন ও মিউট্যান্ট

মনে হতে পারে, জিনোম বা আমরা যাকে বলছি জিন-চরিত্রে বদল আনা যে কোনও সময়েই ভাইরাসের কেরামতি এবং তার সুবিধেমত যখন খুশি, তখন এই বদল আনা তো তার বাম হাতের খেল। কথাটা ঠিক নয় পুরোপুরি। জিন বিন্যাসে বদল সবচাইতে স্বাভাবিকভাবে আসে যে পদ্ধতিতে তাকে বলে মিউটেশন। নিউক্লিক অ্যাসিড যখন কোষের মধ্যে প্রতিরূপ তৈরি করে (করতেই হয় কারণ যে কোনও জীবের বংশগতির ধারা বহমান রাখতে মায়ের শরীর থেকে সন্তানের শরীরে সেই বিশেষ জিনোমের প্রতিরূপই সঞ্চারিত হয়) তখন যে পরিমাণ ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে তাতে শিব গড়তে বাঁদর হবার সম্ভাবনাই বেশি। এই সম্ভাবনা মানুষের ক্ষেত্রে যতখানি ভাইরাসের ক্ষেত্রে বিশেষত ইনফ্লুয়েঞ্জা বা করোনাভাইরাসের মত আরএনএ ভাইরাসের তার চাইতে বহগুণ বেশি। একটা করোনাভাইরাসের জিনোম হল ৩২০০০ নিউক্লিওটাইডের (যৌগ, যা ডিএনএ বা আরএনএ-র মত নিউক্লিক অ্যাসিড গঠন করে) সমন্বয় আর এটার প্রতিলিপি তৈরি বা কপি করতে গিয়ে প্রতি ১০০০ নিউক্লিওটাইডের জন্য তার কপি করার যন্ত্র একটি করে ভুল করতে পারে। যন্ত্র বললাম বটে, আসলে কপি করার কাজটি করে আরএনএ পলিমারেজ নামক একটা বিশেষ প্রোটিন। অপটু যন্ত্রই বলা যায় কেন না এত যদি ভুল হয় তাহলে কপি যা বেরোবে তার সঙ্গে অরিজিনালের মিল পাওয়া কঠিন হতে পারে। মানুষের কথা ভাবুন, তার ডিএনএ জিনোমের প্রায় তিন কোটি নিউক্লিওটাইডের মধ্যে প্রতি দশ হাজার বা এক লাখেও এই ভুল থেকে যেত তাহলে মানুষের সন্তান সুস্থ এবং মানবসদৃশ দেহগঠন নিয়েই জন্মানো অসম্ভব হত। তাই প্রকৃতি প্রতিটি কোষের মধ্যেই রেখে দিয়েছে এক প্রুফরিডার। সেটা অন্য একটা প্রোটিন যা ভুল বর্ণবিন্যাসকে বদলে সংশোধন করে দেয় জীবনখাতার প্রতি পাতার এই গুচ্ছ গুচ্ছ ভুল। তথাপি ভুল থেকে যায়, একটা ভুল সংশোধন হতে পারা না পারার কারণে কারও রক্তের হিমোগ্লোবিন স্বাভাবিক নয়, কেউ ভোগে জন্মগত রোগে। কারণটা ওই মিউটেশন। কপি করার সময়কার ভুল ছাড়াও অনান্য নানা কারণে জিনে ত্রুটি দেখা দিতে পারে। আলট্রাভায়োলেট আলো, এক্স-রে, ডিডিটি জাতীয় রাসায়নিক কীটনাশক— কতকিছুই যে জিনে ত্রুটি আনতে পারে তার ইয়ত্তা নেই। উচ্চতর জীবে, এমনকি ব্যাকটেরিয়াতেও এই ত্রুটি অনবরত সংশোধিত হয়ে চলেছে। কিছু কিছু সংশোধন প্রক্রিয়া আবার নিজেই ত্রুটিপূর্ণ। ফলে এভাবেও মিউটেশন আসে জীবজগতে। তাদের মধ্যে কোনওটার ফলাফল হাতে গরম, পরের জনুতেই লভ্য, আর কোনটা ত্রুটি বলে টেরই পাওয়া যায় না। আরএনএ ভাইরাসগুলোর মধ্যে ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে এই প্রুফরিডিং ব্যবস্থা নেই, ফলে তার মধ্যে এই ত্রুটি জমা হয়েই চলেছে। এর কোনও কোনওটা টেরই পাওয়া যায় না কিন্তু অনেকগুলোই প্রভাবিত করছে তার অ্যান্টিজেনধর্মিতাকে। এই কারণে একই ভ্যাকসিন সবরকম ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিরুদ্ধে স্থায়ী প্রতিরোধব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে না এবং দুনিয়ার নানা প্রান্তে সৃষ্টি হওয়া নানা মিউটেশনের বিরুদ্ধে একটা ইউনিভার্সাল ভ্যাকসিনের ভাবনা এখনও ভাবনার স্তরেই রয়ে গেছে। বলবার কথা এই যে  করোনাভাইরাসে প্রুফরিডিং ব্যবস্থা আছে। তার মিউটেশন ঘটানোর প্রবণতা যে কারণে ফ্লু ভাইরাসের তুলনায় কম করেও হাজার গুণ কম। তবে ওই যে বললাম— ত্রুটিপূর্ণ ত্রুটি সংশোধন ব্যবস্থা, সুতরাং তুলনায় কম হলেও করোনা মিউটেশনপ্রবণ বটে। কিন্তু এর থেকেও বড় অস্ত্র যেটাকে সে তার তূণীরের শক্তিশেল করে তুলেছে সেটা হল রিকম্বিনেশন।

 

রিকম্বিনেশন, ডাবল মিউট্যান্ট, ট্রিপল মিউট্যান্ট…

এই দ্বিতীয় ঢেউয়ে করোনাভাইরাস যে আরও মারাত্মক হয়ে উঠল তার প্রধান কারণ হল রিকম্বিনেশন। ধরুন, ইংল্যান্ড থেকে ‘ক’বাবু বয়ে নিয়ে এসেছেন করোনার ব্রিটেন স্ট্রেইন যেটা একটা মিউটেশন X-কে বহন করছিল তার জিনোমটিতে। ব্রাজিল থেকে ‘খ’বাবু আর একটা স্ট্রেইন নিয়ে দেশে ফিরেছেন। এটাও জিনোমের ভিন্নতর জায়গায় অন্য একটা মিউটেশন Y বহন করছে। দুটোই সংক্রামক এবং দুটোই শরীরের প্রতিরোধব্যবস্থাকে কমবেশি খাবি খাওয়াচ্ছে। কলকাতায় এক বিয়েবাড়িতে ‘ক’বাবু ও ‘খ’বাবু দুজনেই নিমন্ত্রিত। দুজনেরই কমন ফ্রেন্ড ‘গ’বাবুর সঙ্গে দেখা হল, হ্যালো হাই হল এবং ব্রিটেন ও ব্রাজিল উভয় দেশের প্রতিনিধিই বাসা বাঁধল ‘গ’বাবুর গলা থেকে ফুসফুসে। আক্রান্ত কোষগুলোর মধ্যে ঢুকে পড়ল দুটোরই জিনোম। এই ঘটনা, কো-ইনফেকশন বা সহ-সংক্রমণ যার নাম, তার একাধিক পরিণতি হওয়া সম্ভব। তার মধ্যে একটা হল এই দুটো জিনোমই নিজেদের মধ্যে খণ্ড বিনিময় করে এমন একটা আরএনএ তৈরি করে ফেলল যার মধ্যে X ও Y দুটো মিঊটেশনই ঢুকে পড়েছে। বুঝতেই পারছেন, X ও Y যারা যথাক্রমে ব্রিটেন ও ব্রাজিলের একমাত্রিক প্রতিভূ তারা পশ্চিমবঙ্গে এসে বিবাহ সম্পন্ন করে যদি দ্বিমাত্রিক X+Y হয়ে যায় তাহলে তার সংক্রমণে বেচারি ‘গ’বাবুর এবং তার থেকে পরবর্তী অন্য সবার কাবু হয়ে পড়ার সম্ভাবনাও দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। এটা বলা যেতে পারে ডবল মিউট্যান্ট। এটা অবশ্যই নতুনতর প্রকরণ যার নাম দেওয়াই যেতে পারে বেঙ্গল স্ট্রেইন। করোনা ভাইরাসের এই দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতার জন্য দায়ী এই রিকম্বিনেশন বা পুনঃসংযোজন যা ভাইরাসের চরিত্রকে ঘনঘন বদলে দিচ্ছে। আক্রান্তের শরীর যখন X ও Y  মিউটেশনের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে চেনাজানা সম্পন্ন করছে, প্রায় কাবু করে এনেছে ব্রিটেন ও ব্রাজিলের প্লেয়ারদের তখন এই এক লপ্তে জোড়া ধাক্কা তার ডিফেন্সকে সম্পূর্ণ বেসামাল করে দিয়ে যেতে পারে।

ভারতে ডবল মিউট্যান্ট প্রথম দেখা গিয়েছিল অক্টোবরে। ফেব্রুয়ারি মাসে মহারাষ্ট্রে কোভিডের যে বাড়বাড়ন্ত আবার নতুন করে দেখা দিল তার কারণও B.1.617 নামের একটা ডবল মিউট্যান্ট যেটা L452R এবং E484Q নামে তার আগে পরিচিত দুটো আলাদা আলাদা মিউট্যান্টের খণ্ড বিনিময়ের জাতক। পরবর্তীতে এই ডাবল মিউট্যান্ট অপর এক বা একাধিক একক বা ডবল মিউট্যান্টের সঙ্গে খণ্ড বিনিময় করে করোনাভাইরাসের এমন কিছু প্রকরণ তৈরি করছে যাদের উৎস খুঁজে পেতে হয়রান হচ্ছেন বৈজ্ঞানিকরা।  হয়রান হচ্ছেন কারণ এই ডবল মিউট্যান্টকে RT-PCR টেস্টেও ধরা যাচ্ছে না। এর কাছাকাছি আর আর একটা প্রকরণ যা মহারাষ্ট্র, ছত্তিশগড় এবং দিল্লির পাশাপাশি বাংলাকেও তছনছ করছে। সম্ভবত এটি একটি ট্রিপল মিউট্যান্ট  B.1.618 যার স্পাইক প্রোটিনে চারটে মিউটেশন আছে। চারটের মধ্যে দুটো অবশ্যই B.1.617 থেকে আসা এবং অপর দুটি দুটি স্বতন্ত্র উৎস থেকে।

 

কতদিন, আর কতদিন?

এভাবে মিউটেশন-রিকম্বিনেশন-নয়া স্ট্রেইনের ভিসাস সাইকেল আরও কতদিন চলবে তা এই মুহূর্তে কারও পক্ষেই নিশ্চিত করে বলা অসম্ভব। এমন কি নভেল করোনার নতুন সংস্করণ SARS Cov-3, SARS Cov-4-এর আবির্ভাব ঘটাও বিচিত্র নয়।

পশু-পাখি-আদুড়-বাদুড়ের মাংস খাওয়া যতদিন চলবে ততদিন এই সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছেই। এটাও আমাদের জানাচ্ছে ইতিহাস— না, লিখিত ইতিহাস নয়, মলিকিউলার ইতিহাস। ভাইরোলজির একটা শাখা আছে যাকে বলা হয় প্যালিওভাইরোলজি— প্রত্নভাইরোলজি যা চর্চা করে মিউটেশন আর রিকম্বিনেশনের ফুটপ্রিন্ট নিয়ে। নভেল করোনা নভেল বা নতুন বটে তবে মানুষকে সংক্রামিত করতে পারে এমন করোনাভাইরাসের ইতিহাস প্রাচীন। এদের ক্রমোদ্ভব রিকম্বিনেশনের মাধ্যমে। মানুষে সংক্রমণকারী আর বাদুড়ে সংক্রমণকারী করোনা প্যাঙ্গোলিনের মধ্যে, উদবেড়ালের মধ্যে, উটের মধ্যে খণ্ড বিনিময় করে মহামারি সৃষ্টি করার নজির এই বর্তমান শতকেরই। বলার কথা এই যে এর কোনওটাই এখনও মানুষের খাদ্যতালিকা থেকে বাদ যায়নি। মিউটেশন বা রিকম্বিনেশন সর্বদাই মারাত্মক তা ভাবা ভুল হবে। বরং ক্রমাগত মিউটেশনের ফলে তারা দুর্বলতর হয়ে যেতে পারে, যেমন হয়েছিল SARS Cov বা MERS Cov মহামারির ক্ষেত্রে। সেই প্রকরণগুলোর মারক ক্ষমতা কোভিডের তুলনায় বহুগুণ বেশি ছিল। কিন্তু ঝটিতি দুর্বল হয়ে আসার ফলে এবং ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা ছিল বলে এদের ক্ষেত্রে কোনও টিকা লাগেনি। SARS Cov-2 কিন্তু দুর্বল হয়ে আসার কোনও লক্ষণ দেখাচ্ছে না এখনও। উপরন্তু প্রুফরিডিং ব্যবস্থা আছে বলে এর মিউটেশন একবার স্থায়ী হয়ে গেড়ে বসলে তা অচিরেই দুর্বল হবে এমন সম্ভাবনা কম। ভৌগোলিক বিস্তার আর সংক্রমনশীলতার দিক থেকে এটি বারবার শতবর্ষ আগের ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারির কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে এবং একশো বছর পরেও মারি নিয়ন্ত্রণে আমাদের সীমাবদ্ধতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে।

 

ভারত ও নোয়ার নৌকা

ভারত এই নোয়ার নৌকোয় আজ এক মূর্তিমান বিভীষিকা। সারা বিশ্বের লড়াইকে যে কোনও সময় ডুবিয়ে দিতে পারে ভারত এবং সেই কারণে, ঠিকভাবে বললে ভুল কারণে ভারত আজ সারা বিশ্বের নিউজ চ্যানেলগুলোতে হেডলাইন। ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল স্ট্রেইনকে ছেড়ে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে ইন্ডিয়া স্ট্রেইন নিয়ে। এখানে কুম্ভ চলছে আটাশ লক্ষের সমাবেশে, ভোট চলছে, র‍্যালি চলছে, লক্ষ কোটি টাকা উড়ে যাচ্ছে অবিজ্ঞানে, কুবিজ্ঞানে এবং অপবিজ্ঞানে, কিন্তু গোষ্ঠী সংক্রমণ আমরা এড়াতে পারলাম না। অক্টোবর থেকে যখন বিদেশে এবং দেশেও দ্বিতীয় ঢেউয়ের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে তখন একশো ত্রিশ কোটির একটা দেশ যে এমন প্রস্তুতিশূন্যতার নজির রাখতে পারে তা পরের অতিমারির সময়ে উদাহরণ বিবেচিত হবে। পৃথিবীতে আর একটিও দেশ নেই যেখানে রোগী অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে। অথচ টাকার অভাব নেই। পিএমকেয়ার নামে একটা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার আছে গেরস্তের ঘরে কিন্তু এই ঢেউ ঠেকাতে তা কোন কাজে এল কেউ বলতে পারবে না। একটা অনুসন্ধান বলছে ১২৪টা নতুন অক্সিজেন প্ল্যান্টের টাকা বরাদ্দ হয়েছিল ওই প্রিপেয়ার্ডনেসের তাগিদে এবং তার কেবল ২৩টি কাজ করছে। বেসরকারি স্তরে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেনের বড় জোগানদার ভারত অথচ সেই দেশে রোগী অক্সিজেনের অভাবে ধুঁকতে ধুঁকতে মরছে। যে ৬৬০০০ ভেন্টিলেটরের বরাত দেওয়া হয়েছিল পিএমকেয়ারে তার ৩২০০০ আদৌ কাজ করে না। সেরাম ইন্সটিটিউট যে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ভ্যাক্সিন নির্মাতা তা আমরা সবাই জানি কিন্তু ঠিক কত বড়? খুব বেশি হলে বছরে ৩০ কোটি মানুষকে ভ্যাকসিন জোগানোর ক্ষমতা তাদের আছে কিন্তু অতিমারিকালে ১৩০ কোটির দেশ যদি জনপ্রতি দুটি করে ডোজ দিতে চায় তাহলে এই ক্ষমতা অন্তত ১৬ গুণ বাড়ানো দরকার ছিল। তা হয়নি। হয়নি ভ্যাকসিন উৎপাদনে স্বনির্ভরতা আনার চেষ্টা। বায়ো-রিঅ্যাক্টর বাড়ানো যায়নি, কোল্ড চেইন বাড়ানো— এ সবের জন্য যে কাঁচামাল লাগে তা আমদানি করতে হয়। বেশিটাই আমেরিকা থেকে এবং ফেব্রুয়ারি মাসে জো বাইডেন আইন করে সেসব রপ্তানির উপর নিষেধাজ্ঞা এনেছে, ফলে আমরা অপ্রতুল পরিকাঠামো নিয়ে টিকা জাতীয়তাবাদের ধ্বজা ওড়াচ্ছি। আমাদের ছেলেরাই ওদেশে এসব তৈরি করে, গবেষণা করে অথচ আমরা তাদের দেশে কাজে লাগাতে পারি না। অতি সম্প্রতি আদার পুনাওয়ালার কম্পানিকে তিন হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে পরিকাঠামো বাড়ানোর তাগিদে যার ফল ফলতে ফলতে এদেশ যে ঠিক কত মৃত্যু দেখবে তা অনুমানও করা যাচ্ছে না। একই কথা অক্সিজেন প্ল্যান্ট সম্পর্কে। প্রায় পুরোটাই আমদানি নির্ভর এবং আমেরিকা ডিফেন্স অ্যাক্ট তুলে না নিলে এই হাত কামড়ানো চলবে। ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিলে এত আতান্তরে পড়বার অবস্থা হত না।

 

টিকা: মুনাফার গন্ধ পাঁউ

টিকা নিয়েও বানিয়াতন্ত্র শুরু হতে চলেছে। যে রোগটার ব্যাপ্তি ১৬০ দেশে, প্রায় ৭৩০ কোটি মানুষের মধ্যে সে রোগ যদি সংক্রামক হয় তাহলে হার্ড ইমিউনিটি ছাড়া তাকে বাগে আনার কোনও উপায় নেই। হার্ড ইমিউনিটি ত্বরান্বিত করার জন্যই টিকাকরণ। আপৎকালীন লাইসেন্স নিয়ে আসা টিকার কার্যকারিতা বা স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে, কিন্তু অভিজ্ঞতা বলছে করোনার এই ট্রায়াল পর্যায়ের টিকা নিয়ে যে মানুষের মধ্যে খুব বিপরীত প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে তা নয়। উপরন্তু টিকা নেওয়া, এমনকি একটি ডোজ নেওয়া মানুষের মধ্যেও টিকাকরণের ফলে কোভিড আক্রান্ত হয়ে হসপিটালাইজেশন, আইসিইউ, ভেন্টিলেটরের চাহিদা টিকা না নেওয়া মানুষের তুলনায় যদি কম হয় তাহলে শুধু পরিকাঠামোর ওপর চাপ কমানোর তাগিদেই তো গণটিকাকরণ একমাত্র বিকল্প হওয়া উচিত। সেটা রাষ্ট্রীয় সঙ্কট মোকাবিলার উপায় যার দায় ও দায়িত্ব সবই রাষ্ট্রের। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে টিকার দায় হাত থেকে ঝেড়ে ফেলার যে প্রচেষ্টা নজরে আসছে তা অপরাধতুল্য। অতিমারিকালে টিকা পাওয়াটা মানুষের মৌলিক অধিকার এবং স্বাস্থ্যের অধিকার হিসাবে বিবেচিত হবে না কেন? সরকারি সিদ্ধান্তে আগামী পয়লা মে থেকে টিকাকরণ প্রক্রিয়াটাই অনেকাংশে বাজার নিয়ন্ত্রিত হতে চলেছে। আদার পুনাওয়ালারা তাদের উৎপাদনের পঞ্চাশ শতাংশ খোলা বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করতে পারবে। দামেরও রকমফের  থাকছে। কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার এবং খোলা বাজারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দাম দাম সরকারই নির্ধারিত করে দিয়েছে। শুরু থেকেই এই বৈষম্য দেখা যাচ্ছিল। সরকারি সংস্থা থেকে যে টিকা বিনামূল্যে পাওয়া যাচ্ছে প্রাইভেট হাসপাতালে সেটাই ডোজপ্রতি আড়াইশো টাকায় কিনতে হচ্ছে। পয়লা মে থেকে সেটাই হয়ে যাবে ছশো বা হাজার বা বারোশো। বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া টিকা কালোবাজারে আরও অনেক বেশি দাম দিয়ে বিক্রি করার সুযোগ এ দেশের সৎ ব্যবসায়ীরা ছাড়বে না। কোভিডের গুরুতর সংক্রমণে ব্যবহৃত অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ রেমডেসিভির নিয়েও এই জিনিস চলছে। কোনওভাবেই মজুতদারি, কালোবাজারি আটকানোর উপায় থাকবে না, বরং স্বাস্থ্যমন্ত্রকের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত এ জিনিসে উৎসাহ জোগাবে। দেশে অতিমারির প্রকোপ যখন সর্বোচ্চ, যখন দিনে প্রায় সাড়ে তিনলাখ লোক টেস্ট করে আক্রান্ত ধরা পড়ছে (এপিডেমিওলজিস্টরা বলছেন টেস্ট না করানো লোক ধরলে সংখ্যাটা অন্তত দশ গুণ বেশি হবে), মৃত্যুহারও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তখন এরকম একটি সিদ্ধান্তকে টিকাকরণ প্রক্রিয়াটা থেকেই সরকারের হাত ধুয়ে ফেলার প্রচেষ্টা এবং একই সঙ্গে কর্পোরেটকে লাভের সুযোগ করে দেওয়া বলেই দেখতে হবে। বাজার থেকে বেশি দামে বা কালোবাজারে আরও বেশি দামে টিকা কিনে নেবার লোকের চাহিদা মেটাতেই এখনকার উৎপাদন হার বজায় থাকলে বছর পার হয়ে যাবে। গরিব মানুষ, প্রান্তিক মানুষ যারা সরকারের ভরসায় থেকে যাবে তাদের অপেক্ষা দীর্ঘতর হবে। তারা হয়তো তোয়াক্কাই করবে না টিকাকরণের, কিন্তু একটা সংক্রমণ যাকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না এবং টিকাকরণই যার একমাত্র প্রতিরোধব্যবস্থা বলে প্রতীয়মান হচ্ছে অন্তত এখনও পর্যন্ত, সেখানে তাদের কাছে পৌঁছে যাবার দায় সরকারের। কমিউনিটি স্প্রেড আটকাতে গেলে দায় সরকারকে নিতেই হবে। নয়তো, বিজ্ঞান বলছে, জিনোমে বদল আনা করোনাভাইরাসের নয়া নয়া প্রকরণ সৃষ্টি হওয়া আমরা আটকাতে পারব না। এতে বাজারের মুনাফা হবে কিন্তু যে উদ্দেশ্যে টিকাকরণ তা ব্যর্থ হবে। টিকা জাতীয়তাবাদ দেশকে কিছুটা বাধ্যই করছে প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছে টিকা পৌঁছে দিতে যাতে নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ বা মালদ্বীপের সামনে অন্তত ফ্রেন্ড ইন নিড ভাবখানা বজায় রাখা যায়। কিন্তু সেরাম ইন্সটিটিউট বা ভারত বায়োটেক যারা উৎপাদনের একটা বড় অংশ এখনই রপ্তানি করছে দেশে অপ্রতুলতা সত্ত্বেও, তাদের জন্য আমেরিকার ডিফেন্স অ্যাক্টের সমতুল্য ব্যবস্থা থাকা দরকার আপৎকালীন ভিত্তিতে, নয়তো অভিজ্ঞতা বলছে দ্বিতীয়ের পর তৃতীয়, চতুর্থ ঢেউ আমরা দেখতেই থাকব। তুলনা করছিলাম ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সঙ্গে। ফ্লু আজও যায়নি, একশো বছর পরেও ফ্লু-জনিত মৃত্যুহার যথেষ্ট উঁচু। তবে ৭৩০ কোটি শরীরের এই ফ্লু ভাইরাসের সঙ্গে চেনাজানা চলছে কয়েক জেনারেশন ধরে, নভেল করোনার সঙ্গে যা হয়ে উঠতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে। ততদিন সেকেন্ড, থার্ড, ফোর্থ ওয়েভ আমরা দেখতে থাকব। দেখতেই হবে, আপনি না চাইলেও সে আপনাকে চিনেই ছাড়বে। চেনাজানা ত্বরান্বিত করার জন্যই ভ্যাক্সিন, তবে এই ফ্লু বা করোনা গোছের ভাইরাসগুলো মহা ধুরন্ধর। আপনার শরীর যদি চেনাজানা সেরে সেটাকে গেটের বাইরে থেকেই বিদেয় করার ছক করে, তা হলে সেটা তো এই সিঁধেলটির পক্ষে খুব সুখবর নয়। অথচ তাকেও তো ছানাপোনা তৈরি করতে, অপ্রতিরোধী এবং অনাক্রান্ত দেহ পেতে হবে তাকে। ফলে টিকা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা এ দু ডোজেই শেষ হয়ে যাবে এটা না ভাবাই ভালো। এই লড়াই লড়ার পরিকল্পনা বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে কর্পোরেট মুনাফাই বাড়বে, ঢেউ আটকানো যাবে না।