Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আনখশির মার্কস্‌বাদী, কিন্তু আশিস কখনও ‘ইয়েচুরি’ দিয়ে বিখ্যাত হতে চায়নি

সুপ্রতিম পাল

 



লেখক পেশায় সাংবাদিক

 

 

 

 

—আশিস, কোথাও কিছু পেলে?
—নাহ্‌। এখন তো কোত্থাও কোনও কাজ নেই। যেখানেই খোঁজ করছি সেখানেই শুনছি, নেই।
—তোমার তো অনেক জানাশোনা, একটু চেষ্টা করে দ্যাখো না!
—আমরা তো চেষ্টা করেছিলাম। মাজিতিয়া ওয়েজ বোর্ড করিনি? কিন্তু কটা কাগজের মালিক সেইটা চালু করল? আজ আমরা সবাই ডুবে যাব, কিন্তু তরী ভাসবে মালিকের।

মাসপাঁচেক আগের কথা। কয়েকদিন হল আমাদের সংস্থা সবাইকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে, তারা আমাদের খবরের কাগজ তুলে দেবে— কবে তুলে দেবে সেটি অবশ্য বলেনি। করোনা-কবলিত সময়ে এ কোনও নতুন খবর নয়— আমরাই এইরকম অগুণতি খবর ছেপেছি তার আগের চার-পাঁচ মাস ধরে। কিন্তু কোনওদিন এভাবে সবাই মিলে খবর হয়ে যাব, সেটা ঘূণাক্ষরেও ভাবিনি। আসলে সুবিধাবাদী উচ্চ-মধ্যবিত্ত মানসিকতা আমাদের অন্যরকম ভাবতেও দেয় না। একদিন অফিসের সময় কোনও একটা পাতা ছাড়ার আগে আশিসের সঙ্গে কথা হচ্ছিল এইসব নিয়ে।

কলেজ যার সেন্ট স্টিফেন্স, বাবা যার বামপন্থী আন্দোলনের বহু দশকের অবিসংবাদী নেতা, তার চিন্তাভাবনা তো একটু অন্যরকমের হবেই। মাজিতিয়া ওয়েজ বোর্ড গঠন কিন্তু বামপন্থী আন্দোলনের ফল। এর সুবিধা অনেক সাংবাদিক পায়নি আজও। আমার মনে পড়ছে, এক সংস্থা তাদের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধানকে দায়িত্ব দিয়েছিল, সমস্ত ওয়েজ বোর্ড সদস্যদের বুদ্ধি করে হয় তাড়াতে হবে, নয়তো তাদের বার্ষিক চুক্তিভিত্তিক শর্তে বহাল রাখতে হবে। স্বভাবতই প্রথমে কেউ আসতে চায়নি, কিন্তু বিভাগীয় প্রধান একে-একে সবাইকে বিভিন্ন অজুহাতে এবং ভয় দেখিয়ে নিয়ে আসেন চুক্তিতে। পেটের দায়ে কেউ ‘না’ বলতে পারেনি, আর তিনি উন্নতির মইয়ে চড়ে উঠে পড়েন সংস্থার বেশ উচ্চপদে। একদিন হঠাৎ তারও চাকরি গেল, স্বাভাবিক নিয়মে। আশিসকে এই গল্পটা বললাম। ও খুব হাসতে পারত। প্রাণখোলা হাসি। আমি ফোনের এ-প্রান্তে থেকে শুনছিলাম ওর সেই অট্টহাস্য!

—বাজারি ব্যবসায়ীরা তো এমনভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে। আমাদের মুশকিলটা কোথায় হয়েছে, জানো?

আমি জিজ্ঞাসা করি, কোথায়?

—যেদিন থেকে তোমরা ভাবা শুরু করেছ বামপন্থীরা দেশের শত্রু। আজকেও বলো, তোমরা কি কেউ মামলা করবে, শ্রম আদালতে? আমাদের যেভাবে চিঠি দেওয়া হল এক শনিবারের বারবেলায়, সেটা যদি কলকাতার কোনও চটকলে ১৯৭২ সালে হত? তুমি ভাবতে পারছ তার ফল? কিন্তু আজ কিচ্ছু হবে না… যে যার মতো নিঃশব্দে সরে যাবে।

তখনও জানতাম না, এই পৃথিবী থেকেই আর চারমাসের মধ্যে আমাদের ছেড়ে নিঃশব্দে সরে যাবে বিকু। আশিসকে ওর সহকর্মীদের অনেকেই এই নামেই ডাকত।

ডিসেম্বরের এক বিকেলে আমাদের সম্পাদক জানালেন আশিস ছেড়ে দিচ্ছে। পদত্যাগপত্রও পাঠিয়ে দিয়েছে। আশিসকে তৎক্ষণাৎ ফোন করলাম, কী ব্যাপার? হঠাৎ? বলল, মন ভাল নেই। পুনেতে প্রায় আট মাস ধরে গৃহবন্দি দশায় থেকে প্রতিদিন অফিস করেও এই প্রাপ্তি— এটা ও নিতে পারেনি। আসলে, অভিবাসী শ্রমিকদের থেকে আমাদের অবস্থা যে খুব ভাল তা তো নয়— পার্থক্যটা শুধু কলারের রঙে— সাদা আর নীল।

গত বছর ঠিক এই সময়, এমনই দাবদাহের মাঝে পুণে থেকে হেঁটে চলেছে শ্রমিকেরা— কেউ গুজরাত, কেউ রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, এমনকী উত্তরপ্রদেশের পথে। আমরা, কাগজের লোকেরা, প্রতিদিন যন্ত্রের মতো লিখে চলেছি তাদের কথা। আশিস ফোন করল, এই কপিগুলো কি না লিখলেই নয়? এর চেয়ে ভাল প্রচেষ্টা হতে পারে কর্মহীন এই শ্রমজীবী মানুষদের জন্য কিছু ব্যবস্থা করা— খাবারের সংস্থান করে দেওয়া, একটু সাবধানে এই শহরেই যেন থাকতে পারে।

সংবেদনশীল মন নিয়ে কাগজ চালানো কষ্টসাধ্য। তবুও এইরকম একজন আশিস তো থাকে সব নিউজ়রুমেই।

আমাদের নিউজ়রুমে তখনও যোগ দেয়নি আশিস। আমার ওপর দায়িত্ব পড়ল ওর সম্পর্কে খবর নেওয়ার— কর্পোরেট ভাষায় যাকে বলে ‘ব্যাকগ্রাউন্ড চেক’। বিশ্বাস করুন, আমি তখনও জানতাম না ও সীতারামবাবুর ছেলে। দিল্লিতে কয়েকটা ফোন ঘোরাতেই মালুম হল ব্যাপারটা। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করবে না যে, ওটাই শেষবার আমি আশিস আর সীতারামবাবুর সম্পর্কের কথা নিয়ে ভেবেছি। ও আমাদের বিভাগে আসার পর থেকে একদিনও এই প্রসঙ্গ আসেনি। এমনকী শ্রীনগর বিমানবন্দরে যেদিন সীতারামবাবুর গ্রেফতার হলেন, সে কপিও আশিস নিজেই লিখেছিল। কারণ, সেদিন ও ‘নেশন’ পাতার দায়িত্বে ছিল। রাতে আমি ওকে বলি, “আমি দুঃখিত যে এই কপিটা তোমায় করতে হল।” কিন্তু আশিস নির্বিকার। যেন, এ তো ‘প্রফেশন্যাল হ্যাজার্ড’— হয়েই থাকে। সীতারামবাবুও কোথাও কখনও আশিসকে আলাদা করে কোনও সুবিধা করে দিয়েছেন বলে শুনিনি। একদিনই পেলাম আশিসের কথা ওঁর কোনও মন্তব্যে— ২২ এপ্রিল সকালের সেই হৃদয়বিদারক ট্যুইট।

আশিসের সবচেয়ে বড় গুণ ছিল বিভিন্ন বিষয়ে খবর রাখা। অধিকাংশ সাংবাদিক নিজের বিষয়ের বাইরে অন্য কিছু নিয়ে খুব একটা ভাবে না। কিন্তু নিউজ়ডেস্কের এক বড় সম্পদ ছিল আশিস। প্রায় প্রতিদিন রাতেই ও কোনও একটা খবর পাঠাত; আর আমাকে বলতে হত, “পাতা ছাপা হয়ে গেছে, তবে তোমার এই খবর আমি ওয়েবসাইটে দিয়ে দিচ্ছি।”

লিখতে লিখতে মনে পড়ল, সেদিন আমেরিকায় ভোটগণনা চলছে। নিউজরুমে উত্তেজনা তুঙ্গে। জো বাইডেন জিততে চলেছেন বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু কোনও সংবাদসংস্থা নিশ্চিত করে কিছু বলছে না। এদিকে আমাদের পাতা পাঠানোর সময় হয়ে আসছে। হঠাৎ আশিসের ফোন। ঠান্ডা গলায় বলল, “ট্রাম্প হোক আর বাইডেন— আমাদের কোনও পরিবর্তন হবে না, মিলিয়ে নিও! ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিস আমেরিকার উপরাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন, তাই নিয়ে এ-দেশের গণমাধ্যমে তখন রীতিমত ‘ইউফোরিয়া’— নিরন্তর লেখালেখি, বিশ্লেষণ চলছে। কাগজে-টিভি-তে চুলচেরা আলোচনা, ভারত কী কী সুবিধা পাবে ইত্যাদি। আজ যখন দেখছি তারা মজুদ করে রেখেছে টিকা, বা আমাদের রফতানি করছে না টিকা তৈরির উপকরণ— তখন মনে হয় বিশ্বের বৃহত্তম ধনতান্ত্রিক দেশ সম্পর্কে আশিসের ভাবনা কতদূর সঠিক ছিল। ভারতীয় বংশোদ্ভূত আমেরিকাস্থিত দেশি আর ভারতের দেহাতিদের মধ্যে তো অনেক পার্থক্য।

বিত্তের স্তরে পরিবর্তন হলে নীচের দিকে আর তাকাব না— এই চিন্তাধারা আমাদের দেশের এখন এক অভিশাপ। দেশগঠন শুধু বিত্তের সংস্থানে হয় না, নিজেকেও সেই বৃত্তে ফেলে দেখতে হয় কীভাবে বেঁচে আছে আপামর জনসাধারণ। আশিস ছিল সেইরকমই এক বৃত্তের মধ্যে; দুঃখের কথা, এই ধরনের মানুষের সংখ্যা ইদানিং ক্রমশ কমে আসার পথে।