Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তিনটি অণুগল্প

খালিদা খানুম

 

এমন খারাপ স্বপ্ন মানুষ দ্যাখে?

তনিমা ছোটে। পাগলের মতো ছোটে। একটা ট্রেন আসছে। ধরতে হবে। পেছনে কারা যেন ধাওয়া করছে। মুখগুলো চেনা আবার চেনা না। ট্রেনের হুইসল।

মায়ের কণ্ঠ— তনি ওঠ ওঠ।

হোস্টেলের বিছানায় ফাতিমা ইফতারের থালা সাজিয়ে বসেছে। তার রুমমেট। রোজা রাখে মেয়েটা। তনিমাকে ডাকছে— আয়, আমি একা খাব নাকি?

তনিমা মুখ ঘুরিয়ে দ্যাখে তার ঠাকুমা। দুধ সাবু নিয়ে বসে, সামনে শিবলিঙ্গ।

বাড়িতে বাবার বন্ধুরা এসেছে। তনিমাকে নিয়ে ফিসফাস, সে নাকি রাজ্জাকের সঙ্গে প্রেম করছে। কাকু নাকি বাবা কে জানি বলছে— ওরা চারটে বিয়ে করে। ফুর্তি করার জন্য হিন্দু মেয়েদের সঙ্গে প্রেম করে।

সনাতনকাকুর মুখটা বিশাল বড় হতে থাকে। বিশাল বড়। হাঁয়ের মধ্যে বিশাল এক মন্দির। মন্দিরের মধ্যে রক্ত।

আজান।

হাইয়া আলাস সালাহ….  হাইয়াআলাল ফালহ…
ও রক্ত মুসলিম রক্ত।

আল্লাহ আকবর
ও রক্ত মুসলিমের রক্ত

আল্লাহ আকবর
এর প্রতিশোধ নিতে হবে।

এমন আজান তনিমা শোনেনি। এ কেমন আজান? কারা ডাক দিচ্ছে এমন।

সনাতনকাকুর মুখের ভেতরটা বড় হতে হতে আকাশের আকার ধারণ করে। আকাশের রং গেরুয়া। এই বুঝি আগুন লাগল! তনিমার ভয় লাগে। তনিমা দৌড়াতে থাকে। ট্রেনটা ধরতেই হবে।

ঝমঝমিয়ে ট্রেন আসে। ফাঁকা ট্রেন। তনিমা দৌড়ায়, তবু ধরতে পারে না।

 

ঘুম ভেঙে যায়। তাহলে দুঃস্বপ্ন ছিল!

ধুস এমন বাজে স্বপ্ন মানুষ দ্যাখে! বেলা করে ঘুম ভাঙলে যা হয়!

সকালবেলাতেই কারা যেন এসেছে। বাইরের ঘরে তনিমার বাবার সঙ্গে বসে।

টুকরো টুকরো কথা ভেসে আসছে— নোয়াখালি… কলকাতা… এনআরসি… মোল্লা… কম্যুনিস্ট… বুড়ো ভাম… লাভ জিহাদ… কাশ্মির… জওয়ান… হিন্দু রাষ্ট্র!

কলকাতার দাঙ্গায় নাকি বাবার কাকু মারা গিয়েছিল। হারিয়ে গিয়েছিল দু-এক জন বন্ধু। তাদের খোঁজ পায়নি তার বাবা।

তনিমা বাবাকে বলতে শুনেছে— ও সব দুঃস্বপ্নের মতন রে। আমি আর সাদিক এক সঙ্গে ফিরছিলাম। বাড়ি ফিরে শুনি কাকা খুন হয়েছে দোকানে। সাদিকের সঙ্গে সেই শেষ দেখা। যদি কোনও একদিন ঘুম থেকে জেগে উঠে বলতে পারতাম— ধুস, এমন বাজে স্বপ্ন মানুষ দ্যাখে!

যে সব শব্দ বাইরের ঘর থেকে ভেসে আসছে তাতে তনিমার পা ঘামছে আবার! ভয় হচ্ছে। ঘুমের মধ্যে দেখা স্বপ্ন এর চেয়ে ভয়ঙ্কর লাগছে। এ স্বপ্ন শুরু হলে শেষ হবে না।

তনিমা অপেক্ষা করে, কখন বাবা বলবে— এমন খারাপ স্বপ্ন মানুষ দ্যাখে!

 

দিন কাল

আজকাল অনিকেতের বাইরে বেরোতে হেজিটেশন হয় বড্ড। মনে হয় সবাই যেন তাকে দেখছে। বিশেষ দরকার না হলে সে বাইরে বেরোয় না। রবিবার এলে সপ্তাহের বাজার না করার অজুহাত খুঁজতে থাকে। বাজারে গেলেও ফর্দের অর্ধেক জিনিস না নিয়েই ফিরে আসে। তার বৌ মুখ ঝামটা দেয়— বুড়ো না হতেই ভীমরতি ধরল নাকি তোমার! পুঁই এনেছ কুমড়ো আনোনি! লাউ এনেছ চিংড়ি আনোনি? আমার মাথা দিয়ে রাঁধব?

‘শুভকে পাঠাও’ বলে বাথরুমে ঢুকে যায় অনিকেত।

–শুভকে পাঠাও! ছেলেটা এখন অনলাইন ক্লাস করছে, আর এখন ওকে বাজারে পাঠাও!

অনিকেত শোনে, কিছু বলে না। বলতে ভালো লাগে না। একটু বাদেই সব্জিওয়ালা রবিনের হাঁকডাক শুরু হবে— উচ্ছে আছে পটল আছে সিজিনের শেষ সজনা ডাটা আছে।

রবিন নতুন। সে একটু দেরি করে আসে। সকালের দিকে দু জন আসে, তারা পুরাতন সব্জিওয়ালা। তাদের জন্য রবিন সকালের স্লটে পাড়ায় ঢুকতে পারে না। রবিন প্রথম ফেজের লকডাউনের পর সব্জির বিক্রি করছে ভ্যান গাড়িতে, আগে ব্যাঙ্গালোরে না দিল্লিতে বেসরকারি ফার্মে কাজ করত। পাড়ার ছেলে। অনিকেত চেনে ওকে, কলেজে প্রথম ইয়ারের পরীক্ষা দিয়ে চলে যায়। ক্লাবে ক্যারাম খেলতে আসত কখনও কখনও। যাওয়ার আগে বলল— এখানে পড়াশোনা করে চাকরি পাব কি! কত স্টার পাওয়া ছেলে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে, আমি তো পাশ ছাপ! তার চে ওখানের লাইফ ভালো।

রবিনের মুখোমুখি হতে পারে না অনিকেত। জুনিয়র হলেও মুখ তুবড়ে গেছে। মুখে অনিশ্চয়তার আঁকিবুঁকি দাগ।

অনিকেতের এখন কোনও কাজ নেই। বসে থাকা কেবল। করোনার খবর ভোটের খবরের চেয়ে বেশি ফুলছে। আবার কি লকডাউনে?

পাড়ার মোড়ে কানাকানি।

–স্কুল ম্যাস্টারদের বেতন বন্ধ করে দেওয়া হোক!
–শালাদের কেবল করোনা হচ্ছে। আর কারু হচ্ছে না! পুরা একটা বছর বসে কাটাল!
–ম্যাস্টারগুলাই চায় সবচেয়ে লকডাউন হোক! বসে বসে মাইনে পাবে যে!

অনিকেত কিছু বলতে চায়। বলতে পারে না।

ছেলেটার ঘরে ছড়ানো ছিটানো বই-পাতা-জেরক্স। মোবাইলে ঘাড় গুঁজে আছে।

–বললাম একটা ল্যাপটপ দাও বাবা। সাবজেক্ট ভিডিও পরিস্কার বোঝা যায় না। অনিকেতকে দেখে তার ছেলে বলে।
–পড় না, যা আছে তাই দিয়ে! যে ভারী অনলাইন ক্লাস!
–বাবা, তোমাদের ওই ওল্ড ফ্যাশনের ব্ল্যাকবোর্ড-চক-ডাস্টারের চেয়ে ইউটিউব ভিডিওতে অনেক ভিজ্যুয়ালাইজেশন গুড। আর দ্বিতীয়বার লকডাউন হলে এইভাবে আমি পড়তে পারব না বাবা!

সুলতা রান্নাঘর থেকেই বলে— বেটার ভবিষ্যতের জন্য একটু ইনভেস্টমেন্ট লাগে বুঝলে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হয়। ভালো রেজাল্ট না হলে ভবিষ্যৎ কোথায়! অনিশ্চিত লাইফ!

অনিকেত মুখ লুকানোর জন্য জায়গা খোঁজে। টিভি অন করে। দিল্লিতে লকডাউন শুরু। আবার মানুষ পথে বেরোবে। রেল লাইন ধরে হাঁটবে। স্কুল খুলবে না। ছেলের জন্য ল্যাপটপ কিনতে হবে।

অনিকেত শ্বাস নিতে পারে না।  চোখের সামনে শব্দের ঝড়— বেতন… ল্যাপটপ… রাস্তা… শালারা… ভবিষ্যৎ….

 

প্রেমের গল্প

–এটা হল গিয়ে আমার সাত নং প্রেম। এবং সবচেয়ে ছোট সময়ের প্রেম। বিয়েবাড়ির প্রেম।
–ব্রেকআপ হল কী করে?
–আরে মেয়েটার ফোন নং নিইনি। ঠিকানাও জানতাম না। বাড়ি ফিরে কিছু দিন খুব মনে পড়ল তারপর ভাবলাম… যা গেছে তা যাক না!
–তুই একটা অসভ্য। এতগুলো প্রেম করেছিস আবার আমার সামনে বড় বড় করে বলছিস।
–কই মোটে তো সাত নং বললাম, আরও আছে। আরও সাত-আটজনের নাম মনে আছে। বাকিদের নাম মনে নেই…
–সঞ্জু সিনেমাটা রিসেন্ট দেখেছিস না? পেছনে মেয়েদের লাইন দেখিয়ে হিরো হতে চাইছিস?
–তোর সামনে হিরো হয়ে কী করব? তোকে বলছি।
–আচ্ছা বল।
–আইসক্রিম খাবি?
–তারপর বল।
–কী বলব? এই জন্য বলি প্রেম টেম বলে কিছু হয় না রঞ্জনা।
–এই যে সাতটা প্রেমের গল্প শোনালি, আরও সাত-আটখানা স্টকে আছে, সে সব কী?
–সে সব প্রেম আবার প্রেম না। এই একটু ঘোরাঘুরি, টাইমপাস।
–ধুর তোর সঙ্গে ফালতু বকবক করে খাতা কিনতে হত ভুলে গেলাম।
–চল খাতা কিনে আনি।
–তুই বাড়ি চলে যা। আমি পরে নিয়ে নেব।
–চল না এখুনি। আরেকটা প্রেমের গল্প শোনাব। রাস্তায় বোরিং লাগবে না।
–গল্প মানে সত্যি না? আমি জানি এগুলো তোর বানানো ঢপ।
–আরে গল্প আবার সত্যি ও। তোকে মিথ্যা বলব কেন?
–তুই কলেজে আমাকেই পাস, এই জগাখিচুড়ি গল্প শোনাতে?
–হ্যাঁ…
–কেন? আমাকে কি তোর গাধী মনে হয়? মনে হয়, এই গাধীর তো কোনও কাজ নেই?
–না তা না।
–তাহলে কী?
–যদি ধর, অনেক বছর পর প্রেমের গল্প শোনাতে বসব কাউকে, তখন বলব, একজনের সঙ্গে সারাটা রাস্তা হাঁটতাম। বাড়ি ফেরার পথ ছোট হয়ে যেত। মনে হত রাস্তাটা শেষ না হয়। তাকে আমি মিথ্যা প্রেমের গল্প শোনাতাম। আরেকটু সময় চাইতাম কেবল।

দুজনে থমকে দাঁড়ায়। মুখে কারও কথা নেই।