Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কথা হয়নি, কেবল ভেবেছিলাম…

অভিজিৎ মুখার্জি

 




প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক

 

 

 

 

আমি নিজে কবি নই, সত্যি বলতে কী, কবিতার তেমন নিয়মিত পাঠকও নই। একজন প্রধান কবির প্রয়াণে তাঁর স্মৃতিতর্পণে আমাকে আহ্বান জানানোয়, স্বাভাবিকভাবেই আশ্চর্য হয়েছি। প্রমুখ কবি, খ্যাতনামা অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণে, এটাই স্বাভাবিক যে, স্মৃতিতর্পণের দায়িত্বের প্রতি সুবিচার করতে পারবেন কবিতার জগতের কোনও মানুষ, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায় কৃতবিদ্য কোনও ব্যক্তিত্ব, নিদেনপক্ষে যে সারস্বত সমাজের প্রকৃত অভিভাবকের ভূমিকা উনি জীবৎকালে পালন করেছিলেন, সেই সারস্বত সমাজের অন্তর্ভুক্ত কোনও ঘনিষ্ঠজন। আমি তো এর কোনওটাই নই। অনুমান করে নিলাম, ঘনিষ্ঠ ও যোগ্যজনের বাইরেও একেবারে সাধারণ মানুষের মধ্যেও তো বড় মানুষদের নানা স্মৃতি থেকেই যায়, খুবই ব্যক্তিগত মাত্রায় সম্পূর্ণই ভিন্ন-ভিন্নভাবে হলেও মনে প্রতিক্রিয়া হয়, সেরকম প্রতিক্রিয়া ও স্মৃতিরও স্থান করে দিতে আমায় আহ্বান করা হয়েছে।

ওঁর একটা কবিতা, ‘যাবার সময় বলেছিলেন’। সেটার শেষের দিকের খানিকটা এখানে তুলে দিচ্ছি।

ক্রান্তিকাল? তোমরাও কি ভাবো ক্রান্তিকাল?
তোমাদের জীবনমুদ্রায় কোনও চিহ্ন নেই তার।
কেন? কেন নেই?
এসো এই মুমূর্ষুর বুকে রাখো হাত
এর ক্ষীণ রক্ত থেকে তোমার রক্তের দিকে
বয়ে যাক দাহ
ঘটুক সংঘাত
দেখো তার মধ্য থেকে ভিন্ন কিছু জেগে ওঠে
কি না।
অন্ত নিয়ে এতটা ভেবো না
রাখো এ প্রবাহ
শেষ বিশ্বাসের সামনে কথা দাও তুমি দেশ
তুমিই এ প্রসারিত দেশ
তোমারই স্নায়ুর মধ্যে বহমান কাল—
যাবার মুহূর্তে আমি আজ শুধু নিয়ে যাব এইটুকু
রক্তিম প্রবাল!

আমি জানি না এই কবিতাটা লিখে ওঠার পিছনে যে উপলক্ষ কিংবা চিন্তা কাজ করেছিল, সেই নিয়ে উনি কোথাও কিছু লিখেছিলেন কি না, যদি অন্য কোনও প্রসঙ্গ এনেও থাকেন সেই লেখায়, আমার কাছে তবু এই লাইনগুলো অবধারিতভাবে কেবল জাপানি লেখক মিশিমা ইউকিও ও তাঁর স্বেচ্ছামৃত্যুর কথাই বয়ে আনবে।

হ্যাঁ, জাপানি গদ্যসাহিত্যের আমি একজন আগ্রহী পাঠক, সেই সূত্রে ওই সাহিত্যধারার নানা মহীরূহ লেখকদের মানসিক জগৎ এবং জাপানের ইতিহাস ও সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাঁদের মননের যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, তা সম্বন্ধেও কিঞ্চিত অবহিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী জগৎসভ্যতার পরিণতি নিয়ে নিজের উৎকণ্ঠার নানা দিক ও সেসবের ভিত্তিতে ছিল যেসব দার্শনিক চিন্তার সমাহার, এই নিয়ে মিশিমা-র লেখা উপন্যাস চতুষ্টক অর্থাৎ টেট্রালজি, ‘উর্বরতার সমুদ্র’ যাঁরা আমার মতোই আগ্রহ নিয়ে পড়েছেন, প্রভাবিত হয়েছেন, তাঁদের কাছে ওপরের ওই ষোলটা পংক্তি ব্যতিক্রমহীনভাবে, নিজের দেশ ও জাতির প্রতি মিশিমার অন্তিম সময়ের বার্তা বই অন্য কোনও কিছুকে মনে করিয়ে দেবে না কিছুতেই।

মিশিমা-র আরেকটা উপন্যাস, ‘কিংকাকুজি’, এটা সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা নিয়ে জাতির প্রতি একপ্রকার আশ্বাসবাণী। সেখানে উনি স্পষ্ট করেই বলছেন যে, জগতের নিয়মেই সময়ের সঙ্গে অনেককিছু বদলে যাবে, হারাতে হবে অনেক কিছু, কিন্তু তাতে জাতির সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা বিঘ্নিত হয় না। হারানোর মানসিক প্রস্তুতি রেখে নিত্য সৃষ্টিশীলতাই ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে প্রধান সম্বল। চলিষ্ণুতার কোনও বিকল্প নেই। আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন যে কারণে, নীচের ঠিক এই পংক্তিগুলোতেই আছে তার প্রকাশ,

ঘটুক সংঘাত
দেখো তার মধ্য থেকে ভিন্ন কিছু জেগে ওঠে
কি না।
অন্ত নিয়ে এতটা ভেবো না
রাখো এ প্রবাহ
শেষ বিশ্বাসের সামনে কথা দাও তুমি দেশ
তুমিই এ প্রসারিত দেশ
তোমারই স্নায়ুর মধ্যে বহমান কাল—

এত শক্তিশালী সেই উপন্যাস যে, আমি আড়াই বছর ধরে সারারাত জেগে জেগে অনুবাদ করে ফেললাম উপন্যাসটা। এই বার্তা সবার কাছেই পৌঁছনো দরকার।

এইসব কথা যে আমি শঙ্খ ঘোষের প্রয়াণ উপলক্ষে লিখছি, অনেকেরই নির্ঘাৎ এটা বেশ কষ্টকল্পনা বলেই মনে হচ্ছে। জাপানের কোনও এক সময়ের সামাজিক পরিস্থিতি ও তখনকার এক লেখকের মনোজগতের সঙ্গে ওঁর সত্যিই কি তেমন নিবিড় পরিচয় হয়েছিল? ২০১১-তে রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ উদ্‌যাপন উপলক্ষে জাপানের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয়ের গভীরতা নিয়ে একটা লেখা ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় ছাপানোর জন্য আমার থেকে নিয়েছিলেন ওই সংখ্যার কার্যনির্বাহী সম্পাদক, কবি মেঘ মুখোপাধ্যায়। লেখাটা জমা দেওয়ার কিছুদিন পরে, কী মনে করে সম্পাদককে ফোনে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সম্পাদকমণ্ডলীর পছন্দ হয়েছে কিনা লেখাটা। উনি খুব আবেগের সঙ্গে জানিয়েছিলেন, প্রুফ তৈরি হলে শঙ্খবাবু নাকি ওই লেখাটা একবার আলাদা করে দেখে দেবেন। জাপানের কোনও জায়গার নাম, অনেক খ্যাতনামা ব্যক্তির নাম, ইত্যাদির উল্লেখ আছে তো লেখাটায়, এমন কেউ একবার দেখে দেওয়া দরকার— যাতে মুদ্রণপ্রমাদ না থাকে।

সেবারই প্রথম ইঙ্গিত পেয়েছিলাম, শঙ্খবাবু হয়তো আর পাঁচজনের চেয়ে ওই ব্যাপারে অনেকটাই বেশি ওয়াকিবহাল। তারপর ২০১৬-তে, রবীন্দ্রনাথের প্রথম জাপানযাত্রার শতবর্ষ উপলক্ষে যখন একটা ইংরিজি দৈনিকে রবীন্দ্রনাথ ও জাপানের প্রথম পরিচয়ে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়া বিষয়ে নানা ব্যক্তিত্বের সংক্ষিপ্ত মতামত ছাপা হয়েছিল, আমি মন দিয়ে সেসব পড়েছিলাম, কারণ বেশ কিছুদিন আমি নানা সূত্র থেকে বিষয়টা সম্বন্ধে একটু খুঁটিয়ে অবহিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলাম একসময়। দেখলাম, কত পরিণত এবং নির্ভুল শঙ্খবাবুর সে বিষয়ে ধারণা এবং প্রকাশভঙ্গি। অন্যদের ধারণায় অসম্পূর্ণতা, কখনও কিঞ্চিৎ ভ্রান্তি আমার চোখে পড়েছিল। এবার আমি নিশ্চিত হলাম যে, হয়তো রবীন্দ্রচর্চা সূত্রে শুরু করে একসময় প্রাচ্যের কিছু দেশ সম্বন্ধে উনি সনিষ্ঠভাবে অনেকটা খুঁটিয়ে জেনেছিলেন। আর এর কিছুদিনের মধ্যেই অধ্যাপক গৌতম ভদ্রের বাড়িতে গিয়ে আমার হাতে এল ‘নির্মাণ আর সৃষ্টি’ বইটি। এবার আর বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না, অনেকেরই অজানিতে, সামান্যও বিজ্ঞাপন না-করে কতখানি নিবিড়ভাবে উনি জানার চেষ্টা করেছিলেন জাপানকে।

তাই বহু পরিশ্রমে অনুবাদের কাজটা শেষ করে, একসময় ‘স্বর্ণমন্দির’ বইটা বেরনোর পর আমার একান্ত ইচ্ছে হল, জ্ঞানপীঠ সম্মানে সম্মানিত কবিকে নয়, প্রবাদপ্রতিম অধ্যাপককে নয়, সাহিত্যসমাজের অভিভাবককে নয়, নেহাতই জাপান, তার ইতিহাস, তার দর্শন, তার সংস্কৃতিকে এই শহরে যিনি অনেকটা গভীরে গিয়ে জেনেছিলেন, সেই শঙ্খ ঘোষকে বইটি একটু পড়ে দেখতে অনুরোধ করার। কাউকে কাউকে জিজ্ঞেস করে জেনেও নিয়েছিলাম, উল্টোডাঙায় যেখানে উনি থাকতেন, সেখানকার পথনির্দেশ। ভেবেছিলাম, এই করোনার প্রকোপটা একটু কমুক, গিয়ে অনুরোধ করব। যদিও চিনতেন না, কথা হয়নি কখনও, কিন্তু শুনেছি উনি ফেলতে পারতেন না এ-ধরনের অনুরোধ। শেষপর্যন্ত হল না আর দেখানো। উনি হয়তো কিছু দামি উপদেশ দিতেন, কিছু কিছু জিনিস হয়তো আমি একটু অন্যভাবে ভাবতে শিখতাম। সম্ভাবনা ছিল। সেই সম্ভাবনার কথা ভাবব কিংবা কল্পনা করব কখনও কখনও। আমরা যারা খানিকটা অস্পষ্ট কারণেই মাঝে-মাঝে কিছু লিখতে বসি, সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কীই বা চালনা করে আমাদের তখন?

বৌদ্ধদর্শনের জেন শাখায় সাধনা করতে হয় অপ্রত্যক্ষভাবে আহৃত, লোগো-সেন্ট্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বা ধারণার ঊর্ধ্বে ওঠার। ওতে কিছুরই সম্যক রূপ ধরা দেয় না। সেই সাধনায় আছে শূন্যতার ধারণা, যা রিক্ততা নয়, বরং এতই সম্পূর্ণ সমৃদ্ধি যে, আলাদা করে লোগো-সেন্ট্রিক (কথায় ধৃত) বর্ণনায় তা অধরা থাকে। চূড়ান্ত পূর্ণতাই সেখানে এক শূন্য পরিসরের জন্ম দেয়। আবার নদীর স্রোতে ঘূর্ণিও তো এক শূন্যতাই সৃষ্টি করে প্রকৃতপক্ষে। তাই, যে মানুষ অস্তিত্বকে সম্যক ও পূর্ণভাবে চেতনায় ধারণা করার পথে এগোবে, সে কখনও কথার দিকে ধাবিত হবে না। চেতনাকে নিঃশব্দে উন্মুক্ত করে দেওয়া আর সম্ভাবনার ওপর আস্থা, অস্তিত্বের স্বরূপ উদ্ঘাটনের সাধনায়, আমাদের আর কীই বা সম্বল? আর ‘আয়ু’ তো অস্তিত্বই।

স্রোতের ভিতরে ঘূর্ণি, ঘূর্ণির ভিতরে স্তব্ধ
আয়ু
লেখো আয়ু, লেখো আয়ু
চুপ করো, শব্দহীন হও।