Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

শ্রী শঙ্খ ঘোষ: আমার মাস্টারমশাই, আমাদের সিজি স্যার

দিলীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

 



কবি, অধ্যাপক

 

 

 

 

চারিদিকে মৃত্যুর ভ্রূকুটি। গোটা দেশ শ্বাস নিতে পারছে না। প্রতিমুহূর্তে উড়ে আসছে কাছের-দূরের দুঃসংবাদ। এই আবহেই চলে গেলেন কবি শঙ্খ ঘোষ— আমার, আমাদের সিজি স্যার। চলে যাওয়ার বয়সই হয়েছিল তাঁর, প্রাকৃতিক নিয়মেই চলে যেতেন হয়তো দু-এক বছর আগে পরে। করোনা মহামারি হয়তো উপলক্ষ হয়েই এল। তবু এই বিপর্যয়ের দিনগুলিতে— মহামারি আর তার সুযোগ নিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রের মূলোচ্ছেদকামী এক দানবীয় শক্তির উল্লাসের দিনগুলিতে তাঁকে হারানো বাঙালির বুকে একটু বেশি রকমই বাজল। এ-প্রসঙ্গে একটি গোষ্ঠীগত আনন্দের কথাও বলে নেওয়া ভালো। রবীন্দ্রনাথের পর আর কোনও কবির মৃত্যু জনমানসে এতখানি আলোড়ন তোলেনি। নেতা, অভিনেতা, খেলোয়াড় প্রমুখের মৃত্যু যে গুরুত্ব পায়, কবির মৃত্যু তার কানাকড়িও পায় না— এই দেখেই আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হল। প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক সংবাদমাধ্যম আর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে মনে হল, বাঙালি, অন্তত শিক্ষিত বাঙালি যেন মাথার ওপর থেকে একটা ছাদ হারিয়েছে। প্রায় নবতিপর এক কবির মৃত্যুতে এই শোকের বিপরীতে দেখছি তাঁর মৃত্যুতে উল্লাসেও ফেটে পড়ছেন কিছু বাঙালি। এও অভূতপূর্ব। সব মিলিয়ে বিষয়টা কৌতুককর নিশ্চয়ই। তবু, কৌতুকের সময় এ নয়। তাছাড়া, শঙ্খ ঘোষের মৃত্যুর সাহিত্যিক বা সমাজ-মনস্তাত্ত্বিক গুরুত্ব মাপা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। এ আমার একেবারেই ব্যক্তিগত এক রচনা। আমার মাস্টারমশাই শঙ্খবাবুকে নিয়ে আমার কিছু স্মৃতির উল্লেখ, শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং অবশ্যই মানুষ হিসেবে কবি অধ্যাপক শঙ্খ ঘোষের দু-একটি বৈশিষ্ট্যের ওপর আলোকপাত। পাঠক মার্জনা করবেন, এ লেখায় বাড়াবাড়ি রকমের আমি-আমি থাকবে। হয়তো শঙ্খবাবুর কথার তুলনায় আমার কথাই লিখতে হবে বেশি। কিন্তু আমি নিরুপায়। কবি ও মাস্টারমশাই হিসেবে তাঁর চরিত্রের যে সহজজটিল চেহারাটি আমি আঁচ করেছি, যা সম্ভবত তাঁর অন্য ছাত্রছাত্রীদের ও অন্য বহু অনুজ কবির দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে, তার ধারণা দিতে হলে তাঁর সঙ্গে আমার কথাও বলতে হবে। এ আলেখ্যের দুটিই চরিত্র— শঙ্খবাবু আর আমি। এত আমি যাদের সহ্য হয় না, তাঁরা পাতা উল্টে চলে যান, যেমন আমি নিজেই গেছি কত কত স্মৃতিলেখ পড়তে গিয়ে।

শঙ্খবাবুর সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ অবশ্য ছাত্র হিসেবে নয়। তখনও আমি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নই। সবে বিএ পড়তে এসেছি আশুতোষ কলেজে। পুরুলিয়া থেকে সদ্য এসেছি কলকাতায়। কবিতা লিখি বলে নির্মল হালদারের সঙ্গে পরিচিত। নির্মলদাই একদিন বললেন কিছু বই, পত্রিকা ইত্যাদি শঙ্খবাবুকে দিয়ে আসতে হবে আর আলাপ করে আসতে হবে। কোথায়? না, যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে বিকেলবেলা গিয়ে। দুরু দুরু বুকে গেলাম। সঙ্গে আমার দাদা অসীম বন্দ্যোপাধ্যায়। ইতিমধ্যেই আমরা শঙ্খ ঘোষের কবিতা বেশ পড়ে ফেলেছি। কিছুদিন আগেই বেরিয়েছে ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। পড়ে দু ভাই-ই মুগ্ধ। প্রায়ই আওড়াই— ‘পাথরের ওপর খড় বিছানোর শব্দ, বুকে তোমার হাত।’

তা, শঙ্খ ঘোষ দেখতে কেমন? আশির দশকের সেই প্রথমভাগে কবিদের ছবি তত দেখা যেত না। আমরা অন্তত শঙ্খ ঘোষের ছবি দেখিনি কোথাও। কিন্তু শঙ্খ নামের জন্যই হোক আর তাঁর কাব্যভাষার জন্যই হোক, আমার মনে শঙ্খ ঘোষের একটা ছবি ছিল— টকটকে ফর্সা গায়ের রং, সাদা কোঁকড়ানো চুলের থাক নেমে গেছে কান ছাপিয়ে ঘাড়ের কাছ অবধি। উজ্জ্বল আর আয়ত চোখে বিদগ্ধ স্বপ্নের ছায়া…। জানি না, সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ছবি কোথাও দেখেছিলাম কিনা। সেই ছবিই কি অজান্তে শঙ্খ ঘোষের হয়ে গিয়েছিল মনের মধ্যে?

বিকেলবেলায় আর্টস বিল্ডিঙের তিনতলায় বাংলা বিভাগে গিয়ে দেখি, কেউ কোথাও নেই। অধ্যাপকদের ঘরগুলো সব তালা মারা। হঠাৎ পান-খাওয়া কালো দাঁত ধুতি ফতুয়া পরা একজন (পরে জেনেছি ইনি বিখ্যাত বলরামদা) আসতে তাঁকে শঙ্খ ঘোষের বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে সামনের শেষ ঘরটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন, একটু পরে এখানেই আসবেন, আমরা যেন এখানেই দাঁড়াই, বেশি দেরি নেই, এই এলেন বলে, ইত্যাদি।

আমরা অপেক্ষা করছি দীপ্যমান এক পুরুষের জন্য।

কিন্তু তিনি তো এলেন না। মিনিট পাঁচেক পরে এলেন একজন কালো, রোগা, ছাপোষা মতো মানুষ। অধ্যাপক নন নিশ্চয়ই। আমরা কলেজে অধ্যাপকদের দেখেছি অনেক। আলাদা ডাঁট তাঁদের। আরে, ইনি দেখি ওই ঘরটাতেই ঢুকতে যাচ্ছেন তালা খুলে। তাহলে ক্লার্ক জাতীয় কেউ হবেন। নিশ্চয়ই জানবেন শঙ্খ ঘোষের আসা-না আসার খবর। জিজ্ঞেস করলাম— দাদা, শঙ্খ ঘোষ কি আসবেন, বলতে পারবেন? উনি একটু থতমত খেয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন— হ্যাঁ, মানে আপনারা কোথা থেকে আসছেন? বললাম— পুরুলিয়া থেকে। উনি তালা খুলে ভেতরে ঢুকেই আবার বেরিয়ে এলেন। আকর্ণ হেসে খুব বিনয়ের সঙ্গে বললেন— আসুন আসুন। বসুন। আমাদের তখন অবাক হওয়ার পালা। এই তাহলে শঙ্খ ঘোষ! উনি মিটিমিটি হাসছেন। আমি বলেই ফেললাম— আমরা আপনাকে ভাবিইনি যে…। উনি বেশ মজা পেয়েই হেসে চললেন— তোমাদের কি নির্মল পাঠিয়েছে? শুরু হল কথোপকথন। ক্রমে বুঝতে পারছিলাম, কালো রোগা, থতমত মানুষটির আসল দীপ্তিটি কোথায়। আমাদের সম্পর্কে কত কিছু যে জানতে চাইলেন। জানলেন। পুরুলিয়ার কবিকুলের খবর নিলেন এক এক করে। দাদা কী এক প্রসঙ্গে রিলকের কবিতার কথা তুলতেই সোৎসাহে বলে চললেন রিলকের কাব্যভাবনা আর তাঁর কবিতার দ্বন্দ্বমধুর সম্পর্কের কথা। আমি যে সব বুঝছি তা নয়। আমার পুঁজি পেঙ্গুইনের পেপারব্যাক সিলেক্টেড পোয়েমস। কিন্তু, ওইখানে বসেই ততক্ষণে আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি। এই লোকটার কাছে পড়তেই হবে। এমএ যদি পড়ি তো এখানেই, এই যাদবপুরে। আর কোথাও নয়।

সুতরাং শঙ্খ ঘোষকে মাস্টারমশাই হিসেবে বেছে নিয়েছি আমিই। এখন ভাবি, যদি যাদবপুরে পড়বার সুযোগ না পেতাম? কিন্তু কেন জানি না তখন এসব ভাবিনি। এ প্রসঙ্গে না বললে অন্যায় হবে যে, সেই সময়ের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ছিল নক্ষত্রখচিত। এত উচ্চমানের শিক্ষক আর কোনও কালে আর কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। দেবীপদ ভট্টাচার্য, মদনমোহন গোস্বামী, সুরেশচন্দ্র মৈত্র, পবিত্র সরকার, তপোব্রত ঘোষ, বিভূতি রায় (অভ্র রায়), চিত্তরঞ্জন ঘোষ…। প্রত্যেকে দিকপাল। পড়তে এসে বুঝলাম, প্রত্যেকে আমাদের জন্য নিবেদিত। কিন্তু এর মধ্যেও শঙ্খ ঘোষের একটা আলাদা জায়গা ছিল।

এই আলাদা জায়গাটা নিয়ে খানিক সমস্যাও ছিল। অন্তত আমার অকালপক্ব মন শঙ্খবাবু সম্পর্কে ছাত্রছাত্রীদের পুজো-পুজো ভাবটাকে একদম নিতে পারত না। সত্যিই উনি অসাধারণ পড়াতেন, আরও অসাধারণ পড়তেন। ওঁর রক্তকরবীর ক্লাস যে করেনি তাকে দুর্ভাগা বলতে আজও আমার জিভে আটকায় না। অন্যদিকে ওঁর কবিতা আর গদ্য। কোন কৈশোর থেকে মুগ্ধ হয়ে থেকেছি ওঁর ছন্দে, শব্দে, মায়ায়। মনে আছে, তখন আমি ক্লাস ইলেভেন। এক ঘন বাদলের দিনে আমাকে সাইকেল চালিয়ে গ্রাম থেকে পুরুলিয়া শহর (২৫ কিমি) এসে তক্ষুনি ফিরতে হয়েছিল। এসেছিলাম মাছের ডিম পাসের সরঞ্জাম পিটুইটারি গ্রন্থি সংগ্রহ করে নিয়ে যেতে। সারা রাস্তা অঝোর বৃষ্টি। বিরামহীন একটানা সেই বৃষ্টির ভেতর সাইকেল চলেছে আমার। আর সারা রাস্তা জুড়ে একটাই কবিতা— সদ্য পড়া, পড়েই মুখস্থ হয়ে যাওয়া শঙ্খ ঘোষের ‘বৃষ্টি’। আজও মনে পড়ে অক্লান্ত সেই আবৃত্তি— ‘এমন বৃষ্টির দিন পথে পথে/ আমার জন্মের কোনও শেষ নেই।’ এমন অনেক অনেক দিন-রাত-দুপুর-সন্ধ্যার সঙ্গী শঙ্খবাবুর কবিতা। আমার কলকাতার কবিবন্ধুরা শঙ্খ ঘোষের কবিতা তত পছন্দ করত না। ওদের মনে হত, কেমন যেন বানিয়ে লেখা। নাকি বেশি অ্যাকাডেমিক, কৃত্রিম। ওদের পছন্দ ছিল শক্তি আর বিনয়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমারও খুব প্রিয়, কিন্তু বিনয় মজুমদার যে কেন এত বড় কবি আমি তার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারতাম না। আর শঙ্খ ঘোষ যে কোথায় কৃত্রিম তাও আমার মাথায় ঢোকেনি।

এহেন শঙ্খ ঘোষকে মাস্টারমশাই হিসেবে পাওয়ার আনন্দই আলাদা। কিন্তু এত রিলিজিয়াস আবহাওয়া কেন ক্লাসরুমে? কেন ভক্তির অতিরেক একটা মানুষকে ঘিরে? আরও আশ্চর্যের, এই ভক্ত ছাত্রবৃন্দ কিন্তু শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়ে না। অবশ্য বাধ্য না হলে কার কবিতাই বা পড়ে! তবে কি শুধুই নামের মোহ? শুধুই ব্যক্তিত্বের সম্মোহন? মনে আছে, একদিন শঙ্খবাবুর ক্লাসে, ওইরকম রিলিজিয়াস আবহাওয়ার জন্যই সম্ভবত, কয়েক মুহূর্তের জন্য আমার চোখ বন্ধ হয়ে এসেছিল। দ্রুত সামলে নিতে নিতেই চোখে পড়েছিল, এক সহপাঠীর বিস্মিত দৃষ্টি। পরে সেই বন্ধু জিজ্ঞেস করেই বসল— ‘শঙ্খবাবুর ক্লাসেও ঘুমোচ্ছিস তুই? কী করে যে পারলি!’ হায়, দেবীবাবু, সুরেশবাবু, মদনবাবুদের ক্লাসে, এমনকি তপোব্রতবাবুর ক্লাসেও ঘুমোনোর অধিকার যাদবপুরের ছাত্রের হক, কিন্তু শঙ্খবাবুর ক্লাসে? ওরে বাবা।

আমার দুই সহপাঠিনীর দায় ছিল স্যার ক্লাসে আসার আগে ওঁর মাইক্রোফোন লাগানো বাক্সটি আর এক গ্লাস জল নিয়ে স্যারের আগে আগে ক্লাসে ঢোকা। একদিন অন্য এক মাস্টারমশাই ফুট কাটলেন— শঙ্খদা চললেন, যন্ত্র নিয়ে যন্ত্রের বিরুদ্ধে কথা বলতে। শঙ্খবাবু সহাস্যে বলেছিলেন, একটু ভুল করলে পিনাকেশ, যন্ত্রের বিরুদ্ধে না, যান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে। কথাটা ক্লাসেও বলেছিলেন একদিন। কিন্তু, রক্তকরবীর রাজা যখন আর্তনাদ করে ওঠে ‘আমার যন্ত্র আমাকে ঠকিয়েছে’ বলে, তখন যন্ত্র শব্দের রাবীন্দ্রিক বিস্তারের কাছে সবকিছু ম্লান হয়ে যায় না? মনে হয় না— ‘চতুরতা ক্লান্ত লাগে খুব/ …’?

আসলে শঙ্খ ঘোষ যে কবি, এ আমি ভুলতে পারতাম না। ভোলা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। তাঁর প্রকাশিত প্রায় সমস্ত কবিতা আমার স্মৃতিতে। সেই কবিব্যক্তির সঙ্গে এই শিক্ষকব্যক্তিটিকে অনবরত মেলানোর একটা খেলা যেন পেয়ে বসেছিল আমায়। মিলত কখনও, মিলত না অধিকাংশ সময়েই। তাঁর কবিতায় একটা সজ্জা থাকে, স্কিম থাকে। ভাষায় একটা পরিপাটি আড়াল থাকে। কিন্তু এই সবের ভেতর দিয়ে একটা কাঁচা মানুষ— রক্ত-মাংস-ঘামের একজন মানুষ তীব্রভাবে উপস্থিত। তাঁর রবীন্দ্রনাথ কিংবা সুধীন্দ্রনাথ পড়ানোর মধ্যেও সেই মাটিতে দাঁড়ানো মানুষটাকে খোঁজার, খুঁজে দেওয়ার একটা চেষ্টা দেখতাম। কিন্তু নিজের চারপাশে তিনিও জমিয়ে তুলতেন আড়ালের পর আড়াল। কী জানি, হয়তো এমনই নিয়তি। এমনই নিয়ম।

আবার বলি, শঙ্খ ঘোষ যে কবি এ কথা আমি ভুলতে পারতাম না। আর এইখানেই ওঁর সঙ্গে আমার সম্পর্কের জটিলতার সূত্র। আমাদের ছাত্রাবস্থায় যাদবপুরের যে ছাত্ররা সিরিয়াসলি কবিতা লিখত, লিটল ম্যাগাজিন করত, তাদের সঙ্গে শঙ্খবাবুর সম্পর্ক ছিল খুব নৈকট্যের। স্যারকে না পড়ানো পর্যন্ত তাদের কোনও লেখাই সম্পূর্ণ হত না। তারপর সেই লেখা ছাপা হবে কিনা, হলে কোথায় হবে, বই হলে সে বই কবে কোথা থেকে বেরোবে, কোন লেখা থাকবে আর কোন লেখা বাদ যাবে— এ জাতীয় যাবতীয় বিষয়ে স্যারের ওপর নির্ভরতা ছিল স্বাভাবিক। আর এইখানেই আমার ভেতর থেকে একটা আপত্তি, একটা দ্রোহ কাজ করত। প্রায় তারাপদ রায়ের কবিতার পংক্তি ভেসে বেড়াত আমার মনে— ‘একজন কবির কাছে আরেকজন কবি/ কীরকম ব্যবহার প্রত্যাশা করে… আলেকজান্দার?’ কবিতা লেখার নিজস্ব বৃত্তটিতে আমিও একজন কবি। এখানে কেউ কারও গুরু নয়, স্যার নয়, মসিহা নয়— এই ছিল আমার মনোভাব। ফলে কোনওদিন কবিতা পড়াতে স্যারের কাছে যেতে পারিনি। স্যারও বলেননি কখনও। বই বেরোলে কতজনকে বাড়ি বয়ে দিয়ে এসেছি। কিন্তু শঙ্খবাবুকে না। আমার এক বন্ধু, কবি এবং স্যারের খুব কাছের মানুষ, বারবার বলা সত্ত্বেও— না। অথচ মনে মনে তো আমি চাইতাম স্যার আমার লেখা নিয়ে কিছু বলুন, আগ্রহ দেখান। কিন্তু আমাকেই এগিয়ে যেতে হবে কেন? উনি কেন আসবেন না?

বলা যায় এভাবেই কেটে গেছে আমার ছাত্রজীবনের দিনগুলি। শঙ্খ ঘোষ সিজি স্যারের চেয়ে বড় কোনও জায়গা করে নিতে পারেননি আমার তুচ্ছ লেখকজীবনে। কিন্তু ঘটনা এইটুকু হলে এ লেখা আমি লিখতাম না। এর পরেই আছে আরেকটা দিনের গল্প।

আমি এমএ পাশ করার পর পরই শঙ্খবাবু রিটায়ার করলেন। আমিও কিছুদিনের মধ্যে বিভাগে ফিরে এলাম জুনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসেবে। কবিতা নিয়েই কাজ, কিন্তু ভাষাবিজ্ঞানের দিক থেকে। গাইড ডঃ উদয়কুমার চক্রবর্তী, আমাদের উদয়দা। গবেষণার কাজের পাশাপাশি বিভাগের কিছু কিছু কাজও করতে হয়। বিভাগীয় প্রধান তখন শ্রদ্ধেয়া অধ্যাপিকা সত্যবতী গিরি। একটা দিদি কী একটা কাজে আমাকে বললেন শঙ্খবাবুর বাড়ি যাওয়ার জন্য। গেলাম। ঠিকানা দেখে বাড়ি চিনে যেতে যে খুব অসুবিধে হল তা নয়। বেল বাজাতে স্যারই খুললেন। আমি প্রায় সেলসম্যানের ভঙ্গিতে নিজের পরিচয় দিলাম। কে কী উদ্দেশ্যে আমাকে পাঠিয়েছেন বললাম। ভাবটা এই যে, আমাকে তো চেনেন না, চেনার দরকারই বা কী, ইত্যাদি। স্যার মিটিমিটি হাসছিলেন মনে আছে। বসতে বলায় বসলাম। ভেতরে গিয়ে কিছু বলেও এলেন। এসে নিজের জায়গায় বসে জিজ্ঞেস করলেন— কাজ কেমন এগোচ্ছে? বললাম। এবার আমাকে অবাক করে দিয়ে— লেখালেখি কেমন হচ্ছে? আমি অস্পষ্ট কিছু উত্তর দিতেই কোন প্রসঙ্গে যেন বলে বসলেন— ‘এসো এ ধান্যের কলরবে’। আরে! এ তো আমার কবিতার লাইন। তটস্থার। স্যার পড়েছেন? মনেও রেখেছেন? মুখে তখনও সেই মিটিমিটি হাসি। কথা বলছেন আমার গবেষণার বিষয়ে— কবিতার ভাষা। আর ঘুরেফিরে আমারই কবিতার লাইন, শব্দ, বাক্যাংশ তুলে আনছেন, যেন এমনি এসে যাচ্ছে, কোনও কারণ নেই। আমি কি খুশি হচ্ছি? আমি কি হেরে যাচ্ছি?

স্যারের বাড়ি থেকে প্রায় ঘোরের মধ্যে বেরিয়ে এসেছিলাম। শঙ্খ ঘোষ আমার কবিতা এমন করে পড়েছেন? মনে রেখেছেন? অথচ, আগে যেমন আজও তেমনি একটিবারও বললেন না সহজ দু-চারটি কথা— তোমার কবিতা পড়ে ভালো লেগেছে বা ওইরকম কিছু। বললেন না, কেবল আলোচনার ছলে বুঝিয়ে দিতে চাইলেন— তোমার লেখা আমি পড়ি বাপু, তোমাকে চিনিও হাড়ে হাড়ে। তুমিই কেবল আমার কাছে এলে না।

উল্টোডাঙা থেকে বিদ্যাসাগর কলোনি। দীর্ঘ পথ একটা আবেশের মধ্যে কাটল। বুঝলাম, বুক থেকে অনেক দিনের একটা ভার নেমে গেছে। স্যার আমার লেখা পড়েন। ওঁকে বই দিইনি, তবু জোগাড় করেই পড়েছেন। বাড়িতে ফিরে স্ত্রীকেই (বলা বাহুল্য, ততদিনে স্কলারশিপের টাকায় বিয়ে করে বাসা বেঁধে ফেলেছি যাদবপুরেরই অদূরে বিদ্যাসাগর কলোনির একটা ভাড়াবাড়িতে) বললাম ঘটনাটা। শুনে সেও খুশি। তারপর আমার মনে হল— তাহলে কেন একটা দিনও ডেকে নিলেন না উনি? কেন আজও সহজ ভঙ্গিতে জানালেন না ওঁর মতামত? নাকি উনিও অপেক্ষা করছেন আমার এগিয়ে আসার? আমার স্ত্রী তো বলেই বসল— তুমি একদিন নতুন লেখা নিয়ে যাও না স্যারের কাছে। অন্যদের কাছে এত যাও, নিজের স্যারের কাছে যেতে কী হয়? বললাম— যাব। ভাবলামও বোধহয় যাব। কিন্তু যাইনি। উনিও কোনওদিন ডাকেননি। হঠাৎ একদিন অসতর্ক বিকেলে একবারমাত্র পর্দাটি উঠেই আবার চিরকালের জন্য স্থির হয়ে গেল। একজন কবির কাছে আর একজন কবি কীরকম ব্যবহার প্রত্যাশা করে— এই প্রশ্নে প্রাজ্ঞ অধ্যাপক আর একগুঁয়ে গেঁয়ো ছাত্র দুজনেই বোধহয় একই অনুত্তর বয়ে বেড়িয়েছি এতদিন। স্যারের মৃত্যুর সঙ্গে সমাপ্তি হল এই অসম দ্বন্দ্বের। তিনি আমার প্রিয় কবিদের একজন। কবিতার বাইরে আর কোথাও তাঁকে খুঁজতে চাইনি। কেননা, আর সব ক্ষেত্রে তিনি বোধহয় আমারই মতো— অভিমানী, অবুঝ, কুশলী, এমনকি সুযোগসন্ধানী, অথচ আবেগচালিত। এক কথায় হাজার পারিপাট্যের পরেও সাধারণ, কাছাখোলা। কেবল একটি বিষয়ে মৃত্যুর পর তিনি আমাকে দশ গোলে হারিয়ে দিলেন। কথাটির আভাস লেখার শুরুতেই দিয়েছি। গল্পটা বলে শেষ করি।

গল্পটা আমার না, বন্ধু মধুমিতার। একুশে এপ্রিল দু হাজার একুশ। শঙ্খবাবুর মৃত্যুর কথা ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। বন্ধুদের, বিশেষত যাদবপুরের সতীর্থদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই শোকের ছায়া। সারাদিন কেটে গেল স্যারকে নিয়ে নানা কথায়, নানাজনের সঙ্গে ফোনালাপে। এদিকে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াল চেহারা। মধুমিতার ইচ্ছে হল, মায়ের কাছে যাই। অনেকদিন যাওয়া হচ্ছে না। রিকশা থেকে নেমে ব্যালকনিতে তাকাতেই বুঝল, মাসিমা আজ অপেক্ষাই করছেন। কাছে গিয়ে বসতে মাসিমা বললেন— শঙ্খ ঘোষ মারা গেছেন, শুনছিস? মধুমিতা বলল— হ্যাঁ মা। এর পর ঊনআশি বছরের টিপিক্যাল সাধারণ গৃহবধূ, কোনওদিন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়া না-মাড়ানো, শঙ্খ ঘোষের কবিতা না-পড়া মাসিমার হতাশ গলা— কেমন মনে হইতাসে না, মাথার উপর হইতে একটা ছাত চইলা গেল? কোথাও কিছু অন্যায় হইলে এই একটাই লোক কিছু কইত, যার কথার দাম আছে।

এতদূর আস্থা আর কেউ অর্জন করতে পারেননি। আপনি পেরেছেন। আপনার অনুজ কবিতাপ্রয়াসী হিসেবে, আপনার ছাত্র হিসেবে এ আমার গর্ব। আপনাকে প্রণাম স্যার।