Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

খাদ ও খাদের কিনারা

আশীষ লাহিড়ী

 



বিজ্ঞানের দর্শন ও ইতিহাসের গবেষক, প্রবন্ধকার, অনুবাদক

 

 

 

 

২০২১ সালের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রসঙ্গে আমার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া এই যে আমরা একটা খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছিলাম, কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল আমরা এখনই খাদে পড়ে যাচ্ছি না, কোনওক্রমে ওখানেই দাঁড়িয়ে রয়েছি। কারণ এই অবস্থায় যদি বিজেপি ক্ষমতায় আসত, তাহলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই সবদিক থেকে, মূলত অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে, একটা বিপুল বিপর্যয় হতে পারত। হতই। সেটা আপাতত ঠেকানো গেল।

ভোটের রেজাল্ট যে এভাবে বিজেপির বিরুদ্ধে যাবে তা ভাবিনি। ভেবেছিলাম যেভাবে খোলাখুলি সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি ওরা করেছে, দুর্ভাগ্যজনক হলেও তাতে তাদের আসন সংখ্যা আরও বাড়বে। তবে নো ভোট টু বিজেপি প্রচারটা কিছুটা কাজ করেছে বলে মনে হচ্ছে, অন্তত শহুরে নাগরিকদের মধ্যে তো বটেই। আমার ধারণা এবারে নাগরিক ভোটের একটা বড় অংশই নেগেটিভ ভোট; অর্থাৎ তৃণমূল ভোট পেয়েছে তাদের প্রতি শহুরে নাগরিকদের প্রবল ভালোবাসার কারণে নয়, ভোটটা আসলে পড়েছে বিজেপির বিপক্ষে। কারণ বিজেপির আর কোনও বিকল্প দল আছে বলে মানুষ মনে করেননি।

এই বিকল্পের কথা এলেই অনিবার্যভাবে যাদের কথা মনে হয়, সেই বামপন্থীরা, বিশেষত সংসদীয় বামপন্থীদের বর্তমান অবস্থা আমাদের একটি পরম দুঃখের জায়গা। অনেকেরই মনে আছে, বিহার নির্বাচনে অনেকগুলি সিট পাওয়ার পর সিপিআই (এম-এল) লিবারেশন-এর সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য একটা ইন্টারভিউতে খুব স্পষ্ট বলেছিলেন যে বিহারে আমরা মানুষের কাছে কিছুটা পৌঁছতে পেরেছি তার কারণ আমরা মানুষকে বোঝাতে পেরেছি যে এই মুহূর্তে প্রধান বিপদ বিজেপি। এই একটি বিপদকে আইসোলেট করে আমরা জোট বাঁধার চেষ্টা করেছি। পশ্চিমবঙ্গেও আমাদের সেটাই করা উচিত। উনি জোট বাঁধার কথা পশ্চিমবঙ্গের সংসদীয় বামপন্থীদের বলেছিলেন। তার উত্তরে বিমান বসু বলেছিলেন, দীপঙ্করবাবু নাকি পরিস্থিতি বুঝতে পারেননি, পশ্চিমবঙ্গের বাস্তবতাটা বিহারের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এখানে সংসদীয় বামপন্থীদের ক্ষমতা নাকি এত বেশি যে তাঁরা একাই এ রাজ্যে একদিকে তৃণমূলের দুর্নীতি ও অপশাসন অন্যদিকে বিজেপির সাম্প্রদায়িকতা ও নোংরামি, দুটোকেই আটকে দিতে পারবেন। কতখানি বাস্তববিচ্ছিন্ন হলে আজকের পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়িয়ে একটি বামপন্থী বলে কথিত দলের পক্ষে এই ধরনের কথা বলা সম্ভব! তাঁরা যে ভুল ছিলেন তা তো হাতেকলমে প্রমাণ হয়ে গেল। কিন্তু কতকগুলো বাচ্চা বাচ্চা ছেলেমেয়ে, বিশেষত কটি মেয়ে, যেমন মীনাক্ষী মুখার্জি, ঐশী ঘোষ, দীপ্সিতা ধর এঁদের কথাবার্তা, রাজনৈতিক বোধ এমনকি বডি ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে বোঝা যাচ্ছিল যে এঁরা  সততার সঙ্গে রাজনীতি করছেন এবং মানুষের জন্য কাজ করবেন বলেই ময়দানে নেমেছেন। আমার প্রশ্ন, সংসদীয় বামপন্থী নেতৃত্ব কোনও প্রস্তুতি না নিয়ে এইসব বাচ্চা ছেলেমেয়েদের কীসের মুখে ঠেলে দিলেন? এই উজ্জ্বল তেজি ছেলেমেয়েদের তাঁরা নামিয়ে দিলেন এমন এক পরিস্থিতিতে যেখানে একদিকে রয়েছে বিজেপির মতো একটি চরম সাম্প্রদায়িক শক্তি, অন্যদিকে তৃণমূলের নোংরামি, গুণ্ডামি, অসভ্যতা, অসাংস্কৃতিক আচরণ। তাঁদের বলা হল এই দুটোকেই তোমাদের ঠেকাতে হবে। সেটা কি আদৌ সম্ভব ছিল? এই ছেলেমেয়েরা জানপ্রাণ লড়িয়ে কাজ করেছে, তা দেখেছি। ময়দানে নেমে মানুষের সঙ্গে মিশে কাজ করেন এমন দু চারজন  ঘনিষ্ঠ মানুষজনের মধ্যেও এঁদের প্রতি উচ্ছ্বাস দেখেছি, কিন্তু এই ছেলেমেয়েগুলোর প্রতি তঁদের নেতৃত্বের পক্ষ থেকেই সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতকতাটা করা হল। কারণ তাঁদের নেতারা তাঁদের সামনে আর কোনও বিকল্প রাখেননি, হয় ভোটে জেতো নতুবা পেরিশ (perish)।

বামপন্থী নেতৃত্বের ভুল যে শুধু এই একটা তা নয়। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন থেকে শুরু করে ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচন হয়ে এবার অর্থাৎ ২০২১-এর ভোটে— বামপন্থীদের ধারাবাহিক ভোটক্ষয়ের আরও একটা বড় কারণ তাঁরা নিজেদের ভোট বিজেপিকে হস্তান্তর করার এক ভয়ঙ্কর ও আত্মঘাতী স্ট্র‍্যাটেজিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সবচেয়ে বড় কথা, মার্ক্সবাদের দোহাই দিয়ে তাঁরা বলছেন, স্ট্র‍্যাটেজি আর ট্যাক্টিক্স,  এগুলো তো মার্ক্সবাদের একটা প্রধান অঙ্গ; তাঁরা ট্যাক্টিক্স হিসেবে ওই পন্থা নিয়েছিলেন। সংসদীয় অর্থে তাঁদের প্রতিপক্ষ যেহেতু শাসক তৃণমূল, তাই তাঁরা  বিজেপির সঙ্গে হাত মেলাবেন। প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও তাঁরা যে গোপনে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। আর খুব ঢেঁড়া পিটিয়ে না বললেও এটা তো মুখে মুখে চলছিলও যে এবার বিজেপি আসুক, এর পরের নির্বাচনে বিজেপিকে সরিয়ে আবার রাজ্যের ক্ষমতা দখল করা যাবে। এইটা বামপন্থীদের জনবিচ্ছিন্নতার চরম পর্যায় বলে আমার মনে হয়। কখনও কোনও সংসদীয় বামপন্থী দল এর আগে এমন চরম মূর্খামির পরিচয় দিয়েছে বলে আমি মনে করতে পারছি না। পশ্চিমবঙ্গে তাঁদের অনেক দোষ-ত্রুটি সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সে কার না আছে। কিন্তু তাঁরা তো সারাক্ষণই হিমালয়ান ব্লান্ডারের কথা বলেন, এটা তাঁদের ডাবল হিমালয়ান ব্লান্ডার৷ কেরলের সঙ্গে তুলনা করলেই সেটা বোঝা যায়। করোনার বিষয়টা যখন এল, পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীরা মাঠে নামলেন, সত্যি সত্যিই অনেক মানুষের কাছে পৌঁছে গেলেন, কিন্তু এটা তাঁরা ক্যাশ-ইন করতে পারলেন না। যেভাবে মোদি ও অমিত শাহ করোনাকে সারা দেশে ও বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে সর্বনাশের মতো ছড়িয়ে দিল, এত বড় একটা ইস্যু হাতের কাছে পেয়েও তাঁরা তার সদ্ব্যবহার করতে পারলেন না। ওই ইস্যুতে একটা বিরাট গণআন্দোলন দাঁড় করাতে পারলে তাঁদের ভোট নিয়ে এতটা ভাবতে হত? শুধুমাত্র তৃণমূল বিরোধিতাকে পুঁজি করে তাঁরা ফ্যাসিবাদের মতো ভয়ঙ্কর সঙ্কটটাকে শুধু ফুটনোটে রেখে দিলেন। মানুষের মন, মানুষের অস্তিত্বের সঙ্কটকে পড়তে পারেননি তাঁরা। মানুষ কিন্তু তাঁদের চিনে নিয়েছেন এবং তাঁদের মধ্যে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব লক্ষ করে পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করেছেন।

২০২১-এর এই সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের ফলে উপকার কি তাহলে কিছুই হল না? উপকার এটুকুই হল যে বিজেপি আপাতত ক্ষমতায় এল না। তারা ক্ষমতায় এলে যা হত তা সত্যিকারের একটা বিপর্যয়। পশ্চিমবঙ্গে যে তৃণমূল ক্ষমতায় এসেছে, তাতেই আমরা প্রায় মূর্চ্ছা যাই তাদের অসভ্যতা ও অসাংস্কৃতিক আচরণ ইত্যাদি দেখে। কিন্তু এদের বদলে বিজেপি এলে কী হত? আমি শ্রমজীবী মানুষের কথা না হয় আপাতত বাদ দিলাম। তাঁদের ওপর বিজেপির নেতৃত্বাধীন কেন্দ্র ও অন্যান্য রাজ্য সরকার কী ভীষণ আক্রমণ নামিয়ে এনেছে তা আমরা জানি। বিজেপি ক্ষমতায় এলে এ রাজ্যেও তার ব্যতিক্রম হত না। তবে আমি এখানে বাঙালি ভদ্রলোকদের কথা বিশেষ করে বলছি, কারণ আমাদের এই শ্রেণিটার নাম মধ্যবিত্তও নয়, নিম্নমধ্যবিত্তও নয়, শ্রেণিটার নাম বাঙালি ভদ্রলোক শ্রেণি। এই তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালি ভদ্রলোকরা যারা দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের পাশাপাশি একটু রবীন্দ্রনাথ, একটু সুকান্ত, কার্ল মার্ক্স অথবা কবীর সুমন নিয়ে একটি পরিশীলিত বোধের জগত নির্মাণ করেছে, নিজেদের কিছুটা স্বতন্ত্র বলে ভাবতে ভালোবাসে, বিজেপি ক্ষমতায় এলে সেই প্রগতিশীল বাঙালির সর্বনাশ হয়ে যেত। তারা আর কোথাও একটু দাঁড়াবার জায়গা পেত না। আপাতত সেই জায়গাটুকু তারা পেল।

পাশাপাশি এটাও বলার যে সংসদীয় রাজনীতির মাধ্যমে দেশের মানুষের বিরাট কোনও স্থায়ী উপকার করা সম্ভব বলে আমি মনে করি না। অনেকদিনই মনে করি না। এখন তো আরও মনে করছি না। তবে এটা বুঝছি যে সংসদীয় রাজনীতিতে ছোটখাটো কিছু অ্যাডজাস্টমেন্ট-এর ফলে ছোটখাটো কিছু উপকার অবশ্যই হয়। তার একটা বড় প্রমাণ হল বিজেপির মতো সর্ববিধ্বংসী একটা শক্তিকে আপাতত পশ্চিমবঙ্গে আটকে দেওয়া গেল। তার সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখছি যে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করে যারা ক্ষমতায় ফিরে এল, অথবা যাদের দিয়ে বিজেপিকে এইবারের জন্য ঠেকানো গেল, তাদের মূলগত চরিত্রধর্মটি কি বিজেপির চেয়ে খুব বেশি আলাদা? তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে আদর্শগত ফারাকটা কি সত্যিই খুব বেশি? আমি এখন যেখানে থাকি, সেই অঞ্চলে তৃণমূলকে প্রকাশ্যে বলতে শুনেছি— ‘বিজেপি যদি একটা রামনবমী করে, তাহলে আমরা পালটা দশটা করব।’ অর্থাৎ তোমরা বিজেপির অ্যাজেন্ডাটাই বিজেপির নাম না করে কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগ করার কথা বলছ। বিজেপিকে তোমরা রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে সরিয়ে রাখলে সেটা খুব ভালো কথা। কিন্তু বিজেপির যে নীতি অর্থাৎ সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মকে কেন্দ্র করে রাজনীতি, তা সে যে ধর্মই হোক না কেন, সেই অসুস্থ রাজনীতিটা তো মরল না! বরং এই প্রবণতাটা হয়ত ধীরে ধীরে আমাদের রাজ্যে বাড়বে বই কমবে না। বিজেপি নেতা জয়প্রকাশ মজুমদার এই ভোটের পরেই বলেছেন, ‘হ্যাঁ আমরা যা বলেছিলাম তা করতে পারিনি। তবে এটা ভুললে চলবে না যে আমরা তিন থেকে বেড়ে সত্তর ছাড়িয়েছি— এই লাফটাও কিন্তু কম নয়।’ তার চেয়েও বড় কথা, উনি আরও বলছেন, ‘আজ বিজেপি আর তৃণমূলের মাঝখানে আর কেউ নেই। সংসদীয় বিরোধী বলতে এ রাজ্যে আজ আর কংগ্রেস রইল না, যে কজন সংসদীয় বামপন্থী ছিলেন, তারাও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন। বিজেপি এই রাজ্যে প্রধান বিরোধী নয়, একমাত্র বিরোধী।’ জয়প্রকাশবাবুর এই বক্তব্য কিন্তু এ নির্বাচনের অন্যতম এবং সম্ভবত সর্বাধিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। রাজনৈতিক বিরোধ, কিন্তু মতাদর্শগত মিলের সমন্বয়ে তৃণমূল আর বিজেপি মিলিয়ে ফ্যাসিজমের একটা অদ্ভুত চেহারা এই রাজ্যে ফুটে উঠতে চলেছে।

বিজেপিকে আমরা চিনি। তাদের টাকার অভাব নেই, তাদের কোনও নৈতিকতা নেই, ক্ষমতা দখলের জন্য, হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যেকোনও নীচ পথ অবলম্বন করতে পারে। আর তৃণমূল তো নিজেদের লোকজন বিসর্জন দেওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আছে। টাকার লোভ দেখালেই তারা ওদিকে ছুটে যাবে৷ তাই সরকারে না এলেও ভাঙানির কাজটা বিজেপি চালিয়ে যাবেই। সে কাজে তারা সফল হোক বা না হোক, সব মিলিয়ে পশ্চিমবঙ্গে একটা সামগ্রিক ফ্যাসিস্ট পরিবেশ তৈরি করবে। কারণ বিরোধীদের চেয়ারে বামপন্থী, অন্তত বামপন্থী নামধারী কোনও বিরোধী আর অবশিষ্ট রইল না।

সংসদীয় বামপন্থীদের মধ্যে যে উজ্জ্বল নবীন বিগ্রেডের কথা কিছুক্ষণ আগে বলছিলাম, যাঁদের মধ্যে এখনও কিছু আদর্শবোধ অবশিষ্ট আছে বলে মনে হচ্ছিল, এই ফলাফলে তারাও সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়ল। আমার এক বন্ধু যে অনেকদিন ধরে সিপিআইএম পার্টির সদস্য, একদিন ভোটের আগে বাড়ি এসে প্রায় টেবিল চাপড়ে বলেছিল— এবার দেখো, একটা মিরাকল ঘটবে! অর্থাৎ বামপন্থীদের পক্ষে নাকি অবিশ্বাস্য কিছু একটা ঘটবে। কই, মিরাকল তো কিছু ঘটল না। বন্ধুটির বক্তব্য ছিল পীরজাদা আব্বাস সিদ্দিকিকে এই যে জোটে নিয়ে আসা হল, এর ফল খুব ভালো হবে। তাঁর বক্তব্য, হ্যাঁ, ভদ্রলোকের একটি ধর্মীয় পরিচয় আছে বটে, কিন্তু সে তো সেই পরিচয়ের রাজনীতি করছে না! তাই এই জোট করে সংসদীয় বামপন্থীরা নাকি কোনও ভুল করেনি। দ্বিতীয়ত, আমি যখন বন্ধুটিকে দীপঙ্করবাবুর কথাটা তুলে প্রশ্ন করলাম- তোমার কি এটা মনে হচ্ছে না যে বামপন্থীদেরও বিজেপিকেই প্রধান শত্রু হিসেবে আক্রমণ করার দরকার ছিল? তোমাদের কি এত শক্তি যে তোমরা এই দুটো দলকে একসঙ্গে পরাস্ত করতে পারবে? তোমাদের তো আজকাল আর দেখতেই পাওয়া যায় না। এই করোনার সময় বামপন্থীরা খানিকটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নানা জায়গায় শ্রমজীবী বা সাধারণ মানুষের জন্য ক্যান্টিন চালানো হচ্ছে। রেড ভলান্টিয়ার্স নামে বামপন্থায় বিশ্বাসী ছেলেমেয়েরা করোনা আক্রান্ত রোগীদের নানা জরুরি পরিষেবা পৌঁছে দিচ্ছে, বিপদের দিনে মানুষের পাশে থাকছে। তাদের এই প্রচেষ্টা একটা অত্যন্ত পজিটিভ বিষয়। কিন্তু এই প্রচেষ্টাকে শুধুমাত্র ভোটকালীন রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলে তা মুখ থুবড়ে পড়তে বাধ্য। যেটা এবারে হল। এখন এই ছেলেমেয়েরা তো প্রচণ্ডভাবে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে৷ এবং এই শূন্যতাগ্রস্ত ছেলেমেয়েগুলোকে বলবে যে এই সংসদীয় বামপন্থার রাজনীতি করে কিছু হয় না। তাহলে সংসদীয় কোন রাজনীতি করে কিছু হয়? দেখা যাচ্ছে এই তৃণমূল আসলে যে আদর্শহীনতার রাজনীতি করে তা একটা মূল্য পেয়ে গেল। অর্থাৎ এই আদর্শহীনতার, এই সংস্কৃতিহীনতার রাজনীতিই তাহলে ভোটের বাজারে একমাত্র কার্যকর পন্থা। তৃণমূল যে এত ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বাংলা’ করে, কিন্তু বাঙালির শিক্ষা ও সংস্কৃতির এত বড় সর্বনাশ তৃণমূল ছাড়া আর কেউ করেছে? মানছি যে বিজেপি এলে সেই সর্বনাশটা চতুর্গুণ হত আর সেই সর্বনাশ থেকে তৃণমূল আমাদের আপাতত বাঁচিয়ে দিল। কিন্তু তৃণমূল নিজেই তো সেই সর্বনাশের পথের পথিক। তাহলে সংসদীয় বামপন্থী দলের যে নবীন প্রজন্ম উঠে আসছিল কিছুটা আদর্শবোধ নিয়ে, জোর নিয়ে, তারা দেখল যে ক্ষমতায় থাকতে হলে ওই আদর্শহীনতার রাজনীতি, ওই সংস্কৃতিহীনতার রাজনীতি করাটাই প্রকৃষ্ট পন্থা। আর তা-ই যদি হয়, তাহলে তাদের একটা অংশ এরপর তৃণমূলে যাবে, আরেকটা অংশ বিজেপিতে যাবে। কারণ কমিউনিস্ট পার্টির যে মতাদর্শ, যে মতাদর্শ নিয়ে তারা মরতে মরতেও লাল সেলাম বলতে পারে, ইনকিলাব জিন্দাবাদ বলতে পারে, অন্তত পশ্চিমবাংলায় সেই মতাদর্শ আজ বিলুপ্তপ্রায়। এই নির্বাচনের সবচেয়ে খারাপ প্রাপ্তিগুলোর মধ্যে এটা অবশ্যই একটা।

আর আবারও বলি, সব মিলিয়ে বিজেপিকে ঠেকানো গেছে এটা ঠিকই। বিজেপি ক্ষমতায় এলে এই পরিবেশটা আরও শতগুণে খারাপ হত। সেই অর্থে আমরা হয়তো একটি নিঃশ্বাস নেওয়ার অবকাশ পেলাম। কিন্তু এই অবকাশ আর বেশিদিন পাব বলে মনে হয় না। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরাই সেই নিঃশ্বাসের অক্সিজেনটা ক্রমশ বন্ধ করবেন। ফলে আমরা পশ্চিমবঙ্গবাসীরা সামগ্রিকভাবে খুব একটা ভালো জায়গায় পৌঁছলাম না বলেই মনে হয়।

এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার। আমার কোনও গ্রামের অভিজ্ঞতা নেই। আমি পুরোপুরিভাবে একজন শহরের মানুষ। আমি জানি না গ্রামের মানুষ এই পরিস্থিতিটাকে কীভাবে দেখছেন। তারা যে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন, তারা কি তার মধ্যে পজিটিভ কিছু খুঁজে পেয়েছেন? এই যে মেয়েদের সাইকেল দেওয়া হয়েছে, নানা রকম ‘শ্রী’ চালু করা হয়েছে তার ফলে গ্রামের মানুষ কিছু টাকাপয়সা পেয়েছেন। কিছু উপকার হয়েছে। যেমন একজন আমাকে বললেন— মশাই, আপনার কোনও ধারণাই নেই যে শহর থেকে অনেক দূরে, সুদূর গ্রামাঞ্চলে একটা সাইকেলের মূল্য এখনও কতখানি! সেখানে কারও ঘরে একটা সাইকেল যদি কেউ এনে দেয় তাহলে সে হাতে চাঁদ পায়। এমনটা হতে পারে। ওই একটা সাইকেল দেওয়া, অথবা কাউকে দুশো-পাঁচশো টাকার কোনও গ্রান্ট পাইয়ে দেওয়া— হয়তো এই প্রাপ্তিটুকুর ফলেই তারা কৃতার্থ হয়ে তৃণমূলকে সমর্থন করেছেন। যদি তা-ই হয়, তাহলে তা তো আরও মারাত্মক। এই অর্জনে কোনও শ্রেণিবোধ কাজ করছে না। গ্রামের সেই ভদ্রলোক যে শ্রেণিতে অবস্থান করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই শ্রেণিরই একজন প্রতিনিধি, এই ভেবে কিন্তু সে তার ভোটটি দিচ্ছে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখানে যা চালু করে দিয়েছেন, তাকে খারাপ ভাষায় বললে ‘ভিক্ষের রাজনীতি’ বলা যায়। তাহলে এই ভিক্ষে বা ডোলের রাজনীতি তো এই রাজ্যে প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেই পারেন, আমি ওদের ভিক্ষে দিয়েছি, ওরা আমাকে ভোট দিয়েছেন। অর্থাৎ একদিকে ভিক্ষে দিলে ভোট পাওয়া যায়— এই লেনদেনের রাজনীতি, অন্যদিকে একটা সামগ্রিক ফ্যাসিস্ট বাতাবরণ, এবং সংসদীয় বামপন্থার যে সামান্য স্ফূরণ দেখা যাচ্ছিল, একটু আশার আলো, তার অকালে নির্বাপিত হওয়া— সব মিলিয়ে বিজেপিকে অন্তত কিছু সময়ের জন্য ঠেকিয়ে রাখা ছাড়া এই নির্বাচন থেকে উল্লসিত হওয়ার মতো আমি আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না৷