Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ধায় রাত্রি

কৌশিক দত্ত

 

দুঃসংবাদ পেয়ে পড়িমরি করে বাড়ি ফিরে বার্নি লিভিংস্টোন দেখল বাবা মারা গেছেন। সেখানেই আঘাতের শেষ নয়। সদ্য পিতৃহারা বিধ্বস্ত তরুণ জানতে পারল, বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ার পর পাশের ব্লকের এক চিকিৎসককে ডাকা হয়েছিল। তাঁর সাথে পূর্ব-পরিচয় ছিল না। তিনি আসতে রাজি হননি, বদলে রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পরামর্শ দেন। বার্নির মনে হল, এই লোকটা চেষ্টা করতে পারত। তাহলে হয়ত এখনও তার একজন বাবা থাকত পৃথিবীতে। মনে হল লোকটার কলার চেপে ধরে সেই কথা বলে একবার, মনে হল সব হিংস্রতা নিয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

এক প্রবীণ প্রতিবেশী তাকে বোঝালেন, এটাই আমেরিকার বাস্তব। ডাক্তার যদি আবেগের বশে রোগীকে বাঁচানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে মামলা হতে পারে, তখন আদালত হয়ত তাকে দোষী সাব্যস্ত করবেন। অপরপক্ষে রোগী দেখতে অস্বীকার করা তাঁর আইনসিদ্ধ অধিকার। নানা কারণে তিনি রোগী দেখার মতো পরিস্থিতিতে না-ই থাকতে পারেন, তাতে কোনও বিচারক দোষ ধরতে পারবেন না। অনেক চিকিৎসকই তাই গুরুতর অসুস্থ অপরিচিত রোগীদের দেখতে চাইছেন না। অবাক হয়ে শুনেছিল বার্নি। সত্যকে মেনে নিয়েছিল। পরবর্তীকালে সে নিজেও চিকিৎসক হয়েছিল এবং চিকিৎসাব্যবস্থার রূঢ় সত্যকে অস্বীকার করতে পারেনি। ভালো মানুষ হয়েও সিস্টেমের দাসত্ব তাকে বহুদূর অব্দি মেনে নিতে হয়েছিল।

এই পর্যন্ত এরিক সিগালের উপন্যাস। কোথায় ব্রুকলিন, কোথায় নিউ ইয়র্ক, কোথায় বস্টন? সেখানে সমাজ কোন পথে গেল, তাতে আপনার-আমার কী যায় আসে? ভূগোলক যখন গ্রামে পরিণত হয়, তখন টেক্সাসের সংস্কৃতি খুব দ্রুত কোলকাতাকে গ্রাস করে। র‍্যাঙ্গলার জিনসের পকেটে করে পুরো কনজিউমারিজমের প্যাকেজ হানা দেয় বর্ধমানের মফস্বলে। বাদ যায় না চিকিৎসার ক্ষেত্রটিও। ক্রমশ সেই আমদানি আর তার সাথে জুড়ে যাওয়া খাঁটি স্বদেশী বাহুবলী রাজনীতি এটা নিশ্চিত করবে (প্রায় করে ফেলেছে) যে আপনার পরিবারের বহুদিনের পরিচিত অশীতিপর মহীতোষ ডাক্তার মরে গেলে তাঁর নাতি ক’দিন আগে পাশ করা পরিতোষ আর রাতবিরেতে আপনার পিসিমাকে দেখতে আসবে না। ভয় পাবে। না, আপনি ভালো মানুষ, আপনাকে ভয় পাবার কোনও যুক্তি নেই। পরিতোষ ডাক্তার ভয় পাবে যেকোনও অচেনা মানুষকে, এমনকি চেনা মানুষের হঠাৎ অচেনা হয়ে ওঠার ক্ষমতাকে। তার ভয়কে পাথেয় করে বৃহৎ পুঁজির ঘরে আসবে আরও কিছু অর্থ, আর আপনার ঘরের খিড়কি দোরের চাবি খুলে রাতবিরেতে বুকে হেঁটে সেঁধোবে হিলহিলে হিমহিম মৃত্যু।

একটা কথা প্রথমেই মেনে নেওয়া ভালো, যে রোগী-চিকিৎসক সম্পর্কে টানাপোড়েন আছেই, আদি যুগ থেকে আছে। রোগ ও মৃত্যু সম্বন্ধে ভীতি, রোগী ও তাঁর প্রিয়জনের অসহায়তা, ক্ষমতার অসম বণ্টন, আদিম ম্যাজিকের রহস্যময়তা এবং আধুনিক বিজ্ঞানের অতি জটিলতা (যা তাকে সাধারণের কাছে ম্যাজিকের মতোই দুর্জ্ঞেয় আর রহস্যাবৃত করে রাখে, যতই গুগুলজ্যাঠা থাকুন), ডাক্তারের ভগবান হয়ে ওঠা, ইত্যাদি নানারকম ট্র‍্যাডিশনাল মনস্তাত্ত্বিক কারণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক চিকিৎসার বিপুল খরচ এবং ফাঁপিয়ে তোলা অবাস্তব প্রত্যাশা। এই সবকিছু মিলিয়ে বাস্তবেই এক ক্ষোভের পরিবেশ। ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি অনেকদিন ধরেই লাভা সঞ্চয় করছিল, অগ্ন্যুৎপাত ছিল সময়ের অপেক্ষা। এই বিষয়ে অন্যত্র আলোচনা করেছি (“গুরুচণ্ডা৯” এবং “স্বাস্থ্যের বৃত্তে” পত্রিকায় প্রকাশিত “অসন্তোষের কারণ” নামক একটি প্রবন্ধে)।

একথাও স্বীকার করতে হবে যে অসন্তোষ, অতৃপ্তি, প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ বর্তমান যুগলক্ষণ। দীর্ঘকাল ধরে অবদমিত, শোষিত কোনও জনসমষ্টি যখন জাগে, তখন সিজমোগ্রাফের কাঁটা নড়ে উঠবেই। সবকিছু মেনে নিতে অভ্যস্ত অদৃষ্টবাদী ভারতবাসী এখন সবখানে নিজেদের অধিকার বুঝে নিতে চাইছে। তার যে ঘনঘন মাথা নাড়া, তাতে অস্থিরতা থাকলেও তার একটা ভালো দিক আছে। এমন সংঘাত সারা পৃথিবী জুড়ে, যা ভবিষ্যতে বাড়বে, বস্তুত এই সংঘাত বাড়া ছাড়া বিকল্প পথও নেই। সমস্যা হল, এ জাতীয় প্রতিরোধ ভায়োলেন্সের সামগ্রিক চিত্রটির একটি খণ্ডাংশমাত্রকে ব্যাখ্যা করতে পারে। বেশিরভাগ গুণ্ডামি, দাঙ্গা বা যুদ্ধের পিছনে ক্ষমতাবান, ক্ষমতালিপ্সু, অর্থলোলুপ এবং/অথবা সুযোগসন্ধানীদের হাত। ছোট থেকে বড় বিভিন্ন স্তরে এঁরা নানারকম তীব্রতার হিংসাত্মক কাজ চালিয়ে যান স্বার্থসিদ্ধির সংকীর্ণ উদ্দেশ্যে। আন্তর্জাতিক রাজনীতি থেকে গ্রাম পঞ্চায়েত, পেট্রোলিয়াম থেকে শিক্ষা বা স্বাস্থ্য, কোনও ক্ষেত্রকেই এঁরা বাদ দেন না।

হাসপাতালে ভাঙচুর, ডাক্তারদের মারধর, একেবারে নতুন প্রবণতা নয়, যদিও এর তীব্রতা সম্প্রতি মারাত্মকভাবে বেড়েছে। চিকিৎসকদের খলনায়ক হিসেবে তুলে ধরার রাজনীতি আমাদের দেশে শুরু হয়েছিল দুই দশকেরও বেশি আগে। তার মানে এই নয়, সব চিকিৎসক বাস্তবে মহানায়ক ছিলেন। রূঢ়ভাষী চিকিৎসক, অহংকারী চিকিৎসক, কম পড়াশুনা করা পণ্ডিতম্মন্য চিকিৎসক, ব্যবসায়ী চিকিৎসক এবং দায়িত্বজ্ঞানহীন চিকিৎসক, এই সবরকমের বাস্তব উদাহরণ বেশ কিছু ছিল এবং আছে বাস্তব পৃথিবীতে। এসব থাকলে তা নিয়ে অসন্তোষও থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। সমাজ তখন চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করবে। তার একটা পদ্ধতি হতে পারে আইন। সুপ্রাচীন অতীতে হ্যানিবল এই লক্ষ্যে একটি ভয়াবহ কোড রচনা করেছিলেন চিকিৎসকদের জন্য, যার কিছু আধুনিক প্রতিবিম্ব আর প্রয়োগ দেখতে পেয়ে আমরা মাঝেমাঝে চমকে উঠি। বেশিরভাগ সময় এই নিয়ন্ত্রণ প্রয়াস নির্ভর করেছে চিকিৎসকদের শুভবুদ্ধির উপর। রচিত হয়েছে এথিকস আর কোড অব কন্ডাক্ট, যা মেনে চলার (বা সহকর্মীদের মানতে বলার) দায়িত্ব ন্যস্ত থেকেছে চিকিৎসকদের উপরেই। সংক্ষেপে আত্মনিয়ন্ত্রণ। বাজারমুখী অর্থনীতি এবং জীবনদর্শন মানুষকে অধিকার করার সাথে সাথে সর্বক্ষেত্রে এথিকস রুগ্ন হতে থাকে, চিকিৎসাও তার ব্যতিক্রম নয়। ক্রমশ মুখের কথার আলো ফিকে হয়ে তার জায়গা নিল লিখিত চুক্তি, এথিকসকে সিংহাসনচ্যুত করে জাঁকিয়ে বসল আইন, তার জটিলতা এবং ফাঁকফোকর। ধীরে অথচ নিশ্চিতভাবে নীতি ও আন্তরিকতাকে অপসারিত করে জরুরি হয়ে উঠল কৌশল।

আইনের কাছে সহজে পৌঁছতে পারে না সব মানুষ। পারলেও সেখানে তাৎক্ষণিক তৃপ্তিবিধানের ব্যবস্থা নেই। গ্রামের সালিশি সভার মতো সাথে সাথে মাথা ন্যাড়া করে দেবার নিদান বা দু’টো ছাগল জরিমানার ব্যবস্থা নেই আদালতে। শুনানি, প্রমাণাদি সমেত সে এক দীর্ঘ পথ। অতদিন ক্রোধ সংবরণ করার বদলে “আদিম হিংস্র মানবিকতার” প্রতিবর্ত প্রেরণায় মারমুখী হয়ে ওঠাই সুযোগ ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত আমাদের জনগণের পক্ষে স্বাভাবিক। প্রশ্ন হল, তাঁদের এই ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ কি সতত স্বতঃস্ফূর্ত, নাকি পর্দার পিছনে লুকনো অপরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? কে বা কারা সেই পুতুল নাচের পরিচালক? কী তাঁদের উদ্দেশ্য? এমনকি এই প্রশ্নেরও মুখোমুখি হতে হবে, ক্রোধটি আদৌ তাঁদের (ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের) তো? প্রায়শই দেখা যায়, যাঁরা মারামারি ভাঙচুর করে গেলেন, তাঁরা আদৌ রোগীর পরিজন নন। এঁরা কারা? কী তাঁদের উদ্দেশ্য? তোলা আদায়ের জন্য নার্সিংহোমকে চাপে রাখা, ডাক্তারের উপর ব্যক্তিগত রাগ মেটানোর ফিকির, ভোটের রাজনীতিতে চার-ছয় রান সংগ্রহমানসে সরকারি হাসপাতালে ভাঙচুরের পুরনো খেলা সম্বন্ধে অনেকেই নানা কথা বলে থাকেন। গত কয়েক বছর যাবত নাকি বিল না মেটানোর জন্যেও কেউ কেউ রোগীকে বাড়ি নিয়ে যাবার প্রাকমুহূর্তে অকারণে অশান্তি করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে। এগুলো সত্যি, কিন্তু নেহাতই খুচরো সমস্যা। এগুলোকেই একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে তুলে ধরলে দু’টো বিষয় আড়ালে চলে যায়।

প্রথমত, রোগীর আত্মীয়ের সত্যিকারের ক্ষোভের অস্তিত্ব ও সম্ভাবনা অস্বীকার করা অনুচিত। রোগী মারা গেলেই যেমন চিকিৎসক দোষী নন, তেমনি ভুল বুঝে ক্ষুব্ধ হলেও প্রত্যেক ক্ষেত্রে রোগীর আত্মীয়দের ক্রিমিনাল বলে ধরে নেওয়া ঠিক নয়। বরং তাঁদের ক্ষোভের, এমনকি ভুল বোঝার কারণগুলো নিয়ে যত্নশীল আলোচনা হওয়া উচিত বৃহৎ পরিসরে।

দ্বিতীয়ত, তোলা আদায়, বিল না মেটানো বা ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণে যাঁরা হাঙ্গামা করছেন, তাঁরা নেহাত দাবার বোড়ে। রাজা-মন্ত্রী-গজ-ঘোড়ারা এত ছোট ব্যাপারে মাথা ঘামান না। যাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে এসব হাঙ্গামায় উৎসাহ দিয়ে চলেছেন, হিংসার পক্ষে নানাভাবে যুক্তি সাজাচ্ছেন এবং সুচারুভাবে তথ্য পরিবেশন তথা তথ্য গোপনের মাধ্যমে লোক খ্যাপাচ্ছেন, তাঁদের দীর্ঘমেয়াদী উদ্দেশ্যটা বোঝা অনেক বেশি জরুরি, শুধু চিকিৎসকদের স্বার্থে নয়, রোগীর স্বার্থেই।

একটি আধুনিক স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকার সব মানুষের থাকবে কিনা, তা নিয়ে ঢের তর্ক। যাঁরা সোচ্চারে বলেন যে এর কোনওটাই নাগরিক অধিকার নয়, সব কিনে নিতে হবে, তাঁদের রাজনৈতিক অবস্থানে লুকনোর কিছু নেই। সমস্যা তাঁদের, যাঁরা সাধারণ মানুষের অধিকারের কথা বলেই রাজনীতি করেন, অথচ বাস্তবে সেই অধিকার সুরক্ষিত করতে নানা কারণে অক্ষম অথবা অনিচ্ছুক। তাঁদের একটা মুখ লুকনোর জায়গা চাই। ভারতের মতো দরিদ্রপ্রধান দেশে যেহেতু ধনীদের সেবা করতে চাইলেও সংখ্যাতাত্ত্বিক কারণে দরিদ্র ও সাধারণ মধ্যবিত্তের ভোটে জিতেই মসনদে আসীন হতে হয়, তাই প্রায় সব রাজনৈতিক দল সাধারণ মানুষের অধিকারের কথাই বলে এসেছে এখন পর্যন্ত। উন্নত পশ্চিমের উগ্র দক্ষিণপন্থীদের ভাষায় কথা বলার মতো আর্থসামাজিক পরিস্থিতি এদেশে এখনও সম্পূর্ণ তৈরি হয়নি। (ভবিষ্যতে সেসব শোনার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি অবশ্য।) সুতরাং স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ওয়েলফেয়ার স্টেটের দায়িত্ব প্রচ্ছন্নভাবে নিজের কাঁধ থেকে নামাতে চাইলে, ফসল কাটার জন্য ক্ষেত্রটিকে গোপনে নবাব সাহেব বা শেঠজির পেয়াদার কাছে উন্মুক্ত করে দিতে চাইলে এবং সেই সংক্রান্ত গণবিক্ষোভের মোড় অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইলে মানুষের চোখের সামনে একটা শ্রেণীশত্রু খাড়া করা অত্যাবশ্যক। তার ভূমিকা কাকতাড়ুয়ার মতো। সে দৃশ্যমান এবং দণ্ডায়মান, যাতে জমির মালিক বাড়িতে আরাম করতে পারে।

সেই লক্ষ্যে অতএব চলতে থেকেছে অসুর নির্মাণ, হাতে খড়্গ, গলায় স্টেথোস্কোপ… জলজ্যান্ত মানুষের রক্ত খাচ্ছে। না, তাতে ক’জন ডাক্তারের কী ক্ষতি হল, তা নিয়ে আপাতত ভাবছি না। সংখ্যার বিচারে ডাক্তারেরা মুষ্টিমেয় এবং সিস্টেমের কাছে আত্মসমর্পণ করলে তাদের সামনে বেঁচে যাবার একটা পথ খোলা থাকবে। ভাবতে চাইছি, এই নির্মাণ আর ঢাকের বাদ্যির অবসরে কোটি কোটি সাধারণ মানুষের কপালে কী লেখা হল?

জটিল রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক খেলা ছেড়ে প্রকাশ্য প্রচারের ইতিহাসটুকু খেয়াল করুন, তাহলেই খানিকটা বুঝতে পারবেন। প্রায় আড়াই-তিন দশক আগে আমাদের সংবাদপত্রগুলো একটু একটু করে (ক্রমশ উঠে-পড়ে) সরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে প্রচারে নেমেছিল। তখন কিন্তু প্রাইভেট হাসপাতালের বিরুদ্ধে খুব বেশি খবর থাকত না। জনমানসে ক্রমশ একটা ধারণা তৈরি করা হল, সরকারি হাসপাতালগুলো অত্যন্ত নোংরা, কোনও চিকিৎসা হয় না, গেলেই মরে যাবেন। অনুচ্চারিত করোলারি হল, বাঁচতে চাইলে এবং ট্যাঁকের জোর থাকলে প্রাইভেট চিকিৎসা করান। এভাবে ক্রমশ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়কে সরকারি চিকিৎসা ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এখন প্রধানত গ্রাম-মফস্বলের মানুষ এবং শহরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষ এই ব্যবস্থাটির সুবিধা নেন। তাঁরা জানেন না বিজ্ঞান বা বর্তমানে কোন জায়গায় এবং কী ধরণের চিকিৎসা পরিষেবা পাওয়া সম্ভব। তাঁদের পক্ষে অবুঝ হয়ে ডাক্তারের মুখে বিষ্ঠা মাখানো সম্ভব, কিন্তু পরিকল্পিতভাবে উপযুক্ত পরিষেবার জন্য তথ্য ও যুক্তিসহ দাবি পেশ করা বা আন্দোলন গড়ে তোলা খুব কঠিন, শিক্ষিত মানুষের সাহায্য ছাড়া প্রায় অসম্ভব। অথচ শহুরে মধ্যবিত্তের তো কিছু যায়-আসে না আর এসব নিয়ে, কেন তারা এসবের মধ্যে থাকবে? পাশাপাশি নানা পদ্ধতিতে সরকারি চিকিৎসকদের হয় আজ্ঞাবহ ভৃত্যে পরিণত করা হয়েছে (বা করার চেষ্টা হয়েছে) অথবা তাড়ানো হয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপে চিকিৎসার খরচবৃদ্ধি। খরচ কেন বাড়ে? চিকিৎসকের লোভ নিশ্চয় তার জন্য দায়ী হতে পারে কিছু ক্ষেত্রে, কিন্তু কর্পোরেট হাসপাতালে চিকিৎসার সামগ্রিক খরচার পাঁচ শতাংশেরও কম যায় চিকিৎসকের ফি বাবদ। বাকিটা নানা ওষুধ, ইনভেস্টিগেশন, যন্ত্রপাতির খরচা, ইত্যাদি। নতুন টেকনোলজির উদ্ভাবন হলে এবং তার প্রয়োগ হলে চিকিৎসার উন্নতি হয় এবং তাতে খরচ কিছুটা বাড়তে পারে। তবে তার একটা স্বাভাবিক গতি আছে। ব্যবসায়িক মুনাফার পক্ষে সেই স্বাভাবিক গতি সর্বদা যথেষ্ট নয়। সেই গতিকে কৃত্রিমভাবে বাড়াতে গেলে চিকিৎসকদের উপর নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করতে হয়, যার একটা উপায় হল আইনের কৌশলী ব্যবহার। আইন-আদালতের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা অটুট, কিন্তু মাননীয় বিচারকেরা আইন প্রণয়ন করেন না, আইন অনুযায়ী রায় দিতে পারেন মাত্র। ফলত সেই রায় বৃহত্তর অর্থে জনমুখী হবে কিনা, তা নির্ভর করে আইনের চরিত্রের উপর। চিকিৎসা ক্ষেত্রকে ক্রেতা সুরক্ষা আইনের আওতাধীন করার ঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল চিকিৎসকদের দায়বদ্ধতা বাড়ানো। উদ্দেশ্য মহৎ, যদিও এভাবে দায়বদ্ধতা বাড়ানো সম্ভব কিনা, তা তর্কযোগ্য। প্রশ্ন হল দায়বদ্ধতা মানে কী? দেখা গেল, সাম্প্রতিকতম গাইডলাইন মানা, প্রোটোকল অনুসারে যাবতীয় পরীক্ষানিরীক্ষা করা, অন্যান্য বিভিন্ন খুঁটিনাটি নিয়মনীতি (যা প্রায়শ রোগীর কাজে লাগে না) মেনে চলা এবং সবকিছু লিখে রাখা, ইত্যাদিই দায়বদ্ধতার মাপকাঠি হিসেবে চিহ্নিত হল। “সব ঠিক হয়ে যাবে, আমি আছি তো”, বলে মাকে সান্ত্বনা দেওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। “আপনার সন্তানের অবস্থা গুরুতর, মৃত্যুর আশঙ্কা প্রবল,” লিখে মাকে দিয়ে সই করিয়ে নেওয়া বরং আইনসঙ্গত ঢাল হতে পারে।

আধুনিক চিকিৎসায় এভিডেন্স বেসড মেডিসিনের ভূমিকা অনস্বীকার্য এবং বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় গাইডলাইন থাকা খুবই ভালো ব্যাপার। সমস্যা হল অনেক গাইডলাইন সবরকম আর্থসামাজিক পরিবেশে সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। দু’বছর আগে অতি সম্মানিত একটি ডায়াবেটিস চিকিৎসার গাইডলাইনে দেখা গেল, পুরনো বেশিরভাগ ওষুধ পছন্দের তালিকায় নেই, নতুন ওষুধপত্র দিতে বলা হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক যুক্তি আছে এই নির্দেশাবলীতে, কিন্তু চিকিৎসকদের মধ্যে থেকেই শোনা গেল প্রতিবাদী কণ্ঠস্বরও। অনেকে বললেন, পেটেন্ট ফুরিয়ে যাওয়া পুরনো ওষুধ বাতিল করে নতুন দামি ওষুধ লিখতে বাধ্য করে বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যেই এই গাইডলাইন তৈরি। এরকম অনেক আছে। যদি তৃতীয় বিশ্বের চিকিৎসকদের এসব মেনে চলতে বাধ্য করা হয়, তাহলে কিছু অর্থবান মানুষ উন্নততর চিকিৎসা পাবেন ঠিকই, অধিকাংশ সাধারণ রোগী আর চিকিৎসাই পাবেন না।

মহামান্য শীর্ষ আদালত অবশ্য একাধিকবার বলেছেন যে চিকিৎসক আরোগ্যের গ্যারান্টি দিতে পারেন না, দেখতে হবে তিনি যথাযথ যত্ন নিয়েছেন কিনা। কথাটা অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ এবং স্পষ্ট বোঝা যায় যে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ির বিপদ সম্বন্ধে মহামান্য আদালত সচেতন। কিন্তু যথাযথ যত্ন কাকে বলব, সেটা নিয়ে কিছু সমস্যা থাকবে। স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষভাবে তার সংজ্ঞা নির্ধারিত হতে পারে না। যেমন, প্লুরাল ট্যাপ জাতীয় যাবতীয় কাজ আল্ট্রাসাউন্ড গাইডেড হলেই ভালো, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, কিন্তু সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যে অজস্র রোগীর ফুসফুসের বাইরে জমে থাকা জল বের করতে হয় ওয়ার্ডেই বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে, স্রেফ স্টেথোস্কোপ আর চিকিৎসকের হাতের আঙুলের ওপর ভরসা করে। যদি বলা যায়, আল্ট্রাসাউন্ড ছাড়া ট্যাপ করলে একচল্লিশ লক্ষ টাকা জরিমানা হবে (বা হতে পারে), তাহলে আতঙ্কে কোনও চিকিৎসক আর ওয়ার্ডে দাঁড়িয়ে কাজটি করবেন না। ফলে চিকিৎসার খরচ কয়েকগুণ বাড়বে, সময় লাগবে বেশি এবং অনেক রোগী চিকিৎসা করাতেই পারবেন না। অবশ্য আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনের (এবং অন্য বিভিন্ন যন্ত্রের) বিক্রি বাড়বে, প্রস্তুতকারী সংস্থারা পুষ্ট হবে, সেটা একটা ভালো দিক।

১৯৯৪ সালের একটি ঘটনায় মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট এক চিকিৎসককে জরিমানা করেছেন, তার কারণ তিনি এমন একটি নার্সিংহোমে রোগিণীর অপারেশন করেছিলেন, যেখানে ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট ছিল না। ওই সময় আমাদের কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজেও কার্ডিওলজি আর কার্ডিওথোরাসিক সার্জারির নিজস্ব আইসিইউ/আইটিইউ ছাড়া সার্জারি বা মেডিসিনের গুরুতর অসুস্থ রোগীদের রাখার জন্য কোনও আইটিইউ ছিল না। আজকের দিনে তাহলে আইটিইউ ছাড়া হাসপাতাল বা নার্সিংহোমে কোনও অপারেশন করা চলবে না। তার অর্থ মহকুমা হাসপাতালগুলোতেও সিজারিয়ান সেকশন ডেলিভারি করা যাবে না, তেমন প্রয়োজন হলে আপনাকে যেতে হবে জেলা হাসপাতালে, যেখানে অবশ্যই বেড পাওয়া দুষ্কর হবে। অগত্যা আপনি ছুটবেন শহর বা মফস্বলের আইটিইউ সম্পন্ন দামি নার্সিংহোমগুলোতে।

এর সাথে যোগ করুন রোজকার গুণ্ডামি। ডেবরার দুজন চিকিৎসক চরম অপমানিত হয়ে চাকরি ছেড়ে দিলেন। ওই অঞ্চলের মানুষ এবার কোথায় পরিষেবা পেতে দৌড়বেন? সরকারই বা রাতারাতি বিকল্প চিকিৎসক কোথায় পাবেন? ধরা যাক, মফস্বল শহরের এক সার্জেন বেশ কিছু জটিল অপারেশন সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যেই করে দিচ্ছিলেন বহু বছর ধরে। একজন রোগীর ক্ষেত্রে তিনি সফল হলেন না, কমপ্লিকেশন হল এবং রোগী মারা গেলেন। তর্কের ক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যাক, রোগীকে প্রথমেই অনেক বড় হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলে তিনি বাঁচতে পারতেন। যদি এই কারণে কেউ দলবল নিয়ে সেই চিকিৎসকের বাড়ি গিয়ে তাঁর স্ত্রীকে বাঁশপেটা করে আসেন আর পুলিশ তাঁর অভিযোগ নিতে অস্বীকার করেন, তাহলে সেই চিকিৎসক বা তাঁর কোনও সহকর্মী আর কোনও জটিল রোগীর দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেবেন না। অগত্যা সবাই ছুটবেন শহরের বড় হাসপাতালে। সব রোগীর পরিবারের পক্ষে কি তা সম্ভব? যেখানে চিকিৎসা পরিষেবার বিকেন্দ্রীকরণের কথা ভাবা হচ্ছিল, সেখানে ঘটনাচক্র অধিকতর কেন্দ্রাভিগ করে তুলছে ব্যবস্থাটিকে।

পশ্চিমবঙ্গে প্রায় হাজার পঁচিশেক ছোট বা মাঝারি নার্সিংহোম আছে বলে শোনা যাচ্ছে। এদের অনেকগুলোই বন্ধ হয়ে যাবে। এগুলো বন্ধ হয়ে যদি তার জায়গায় সকলের জন্য সরকারি পরিষেবা চালু হত, তাহলে আনন্দের হত। কিন্তু বাস্তবে তা হবে না। সরকারের তরফ থেকে গত কয়েক বছরে কিছু উন্নতির চেষ্টা সত্যিই হয়েছে, কিন্তু সমগ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থা একা হাতে সামলানো বর্তমান পদ্ধতিতে সরকারের পক্ষে বাস্তবিকই সম্ভব নয়। অতএব এই সমস্ত বন্ধ হয়ে যাওয়া ছোট সংস্থার উপভোক্তারা ছুটবেন বড় শহরের কর্পোরেট হাসপাতালে, যেখানে নানাবিধ নিয়ম মেনে অনেক বেশি খরচে আপনার চিকিৎসা হবে। দশজনে একজনের হয়ত সেটা সত্যি প্রয়োজন ছিল, বাকিদের জন্যে বাড়তি পরিষেবা এবং বাড়তি খরচ। যতদিন চিকিৎসকের মনের জোর ছিল, ততদিন আপনার আর্থিক পরিস্থিতি বুঝে কিছু নিয়ম না মেনে নিজের মতো করে সেই খরচ লাঘব করার ক্ষমতা কিছুটা হলেও চিকিৎসকের ছিল। এখন সেই দুঃসাহস আর কারও হবে কিনা সন্দেহ।

অতএব আপনি এখন সরাসরি বৃহৎ পুঁজির পণ্যের ক্রেতা। পারলে দাম দিয়ে কিনবেন চিকিৎসা, না পারলে সরে যাবেন পৃথিবী ছেড়ে। আপনাদের মাঝখানে স্টেথোস্কোপ গলায় দাঁড়িয়ে ছিল যে মানুষগুলো, তাঁদের তো মেরে তাড়ানো হয়েছে। তারা এখন নিয়ম এবং হিসেব মেনে পরিষেবা সরবরাহ করবে, তার বেশি সাতে-পাঁচে থাকবে না। যে চিকিৎসক সেদিন অব্দি রোগী দেখার সময় প্রায় ধ্যানস্থ হয়ে একমাত্র রোগী ও তাঁর রোগের কথাই ভাবতেন, তিনি এখন মনের অর্ধেকটা দিয়ে ভাববেন আপনি কী কী ছুতোয় মামলা করতে পারেন, কোন কাজটা করার বা না করার জন্য তিনি ফেঁসে যেতে পারেন… আড়চোখে দেখবেন আপনার বড় ছেলের দিকে… মারবে না তো ছেলেটা? এইভাবে মনের অর্ধেকটা দিয়ে তিনি কী চিকিৎসা করবেন? যাঁকে শত্রু ভাবছেন, তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টার মধ্যে বিশুদ্ধতা থাকবে কি আর? ১০-২০% চিকিৎসকের কাজে আগেও নিষ্ঠা ছিল না, এবার বাকি আশি শতাংশও গেল।

অতএব আপনি এখন ক্রেতামাত্র। আপনার একমাত্র পরিচয় আপনার ক্রয়ক্ষমতা। ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য অগত্যা ইনসিওরেন্স। যখন বহুসংখ্যক গ্রাহক পেয়ে যাবে সংস্থাগুলো, তখন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে প্রিমিয়াম আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়বে ক্লেম ডিনায়াল (প্রয়োজনের মুহূর্তে পয়সা না দেওয়া)। আমেরিকার স্বাস্থ্যবীমার ইতিহাস একটু খুঁটিয়ে দেখলেই এটা বুঝতে পারবেন। বছর বছর কুড়ি-ত্রিশ হাজার টাকা করে প্রিমিয়াম জমা দিয়ে দশম বছরে অসুস্থ হয়ে যখন দেখবেন আপনার তথ্যের খুঁটিনাটি খুঁত বের করে আপনাকে অর্থপ্রদান করতে অস্বীকৃত হচ্ছেন আপনার ইনসিওরার, তখন অসুস্থ শরীরে কার দরজায় কড়া নাড়বেন? হয়ত রাগ গিয়ে পড়বে ডাক্তারের ওপরেই। নিশ্চয় ব্যাটা এমন কিছু লিখেছে ফাইলে, যার জন্য দিল না টাকা। মার ব্যাটা কাকতাড়ুয়াকে!

কথায় কথা বাড়ে। বিষয়টা এত বড় আর জটিল যে তার সামগ্রিক আলোচনা একটি লেখায় অসম্ভব। কলম বন্ধ করে এবার একটু কাঁদি সেই মায়ের জন্য। কী হয়েছে তাঁর? সন ২০১৯। অসুস্থ অষ্টাদশী কন্যাকে নিয়ে তিনি গেলেন পাড়ার ডাক্তারের বাড়িতে। ডাক্তার বললেন, “আমি তো মেয়েকে দেখতে পারব না, আমার মহিলা অ্যাটেন্ডান্ট এখন ছুটিতে।”

“তাতে কী ডাক্তারবাবু? আমি তো আছি!”

“পারব না মা। আমার মাস্টারমশাই মায়ের সামনে একটি মেয়েকে পরীক্ষা করে কয়েক হপ্তা হাজতবাস করেছেন বুড়ো বয়সে।”

মা ছুটলেন অন্য পাড়ার লেডি ডাক্তারের কাছে। তিনি জেনেরাল ফিজিশিয়ান। পেটে ব্যথা দেখে বললেন, গাইনোকোলজিস্টের কাছে যেতে। গাইনোকোলজিস্ট বললেন, কাশিও তো আছে, হাসপাতালে যান। নার্সিংহোম বলল, রক্ত কম, হয়ত পেটে ব্লিডিং হচ্ছে। এর চিকিৎসার ক্ষমতা আমাদের নেই। মহকুমা হাসপাতালের অভিজ্ঞ চিকিৎসক জিজ্ঞেস করলেন মেয়ের বিয়ে হয়েছে কিনা? মা জানালেন, লুকিয়ে বিয়ে করেছিল মাস দুই আগে, বর পালিয়ে গেছে গয়নাগাটি নিয়ে। ডাক্তার বুঝলেন, একটোপিক প্রেগন্যান্সি ফেটে গেছে। অপারেশন লাগবে, নইলে মৃত্যু। অথচ আইটিইউ না থাকায় হাসপাতালে অপারেশন হয় না আর। তাড়াতাড়ি যাও বড় হাসপাতালে।

হেমন্তের রাত ঝরছে শিশিরবিন্দু হয়ে আর অন্ধকার মেখে এক পাগলপারা জননী তাঁর ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া মেয়েটি নিয়ে ছুটছেন মাঠ পেরিয়ে, গ্রাম পেরিয়ে, শহর পেরিয়ে, দেশ পেরিয়ে… দুনিয়া পেরিয়ে….