Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ফ্যাসিস্ট ডাকাতরা চোর ধরতে এলে…

বর্ণালী মুখার্জী

 



রাজনৈতিক ও গণ-আন্দোলনের কর্মী, রাজনৈতিক ভাষ্যকার

 

 

নীরবতা না প্রশ্রয়?

আমরা ভদ্রজনেরা বিজেপি তৃণমূলের এই সিবিআই কোন্দলে ঢুকব না। তৃণমূলের নেতারা দুর্নীতি করে ধরা পড়েছে। ফলে এই পাঁকে প্রবেশ না করাই ভাল। তার চেয়ে বরং প্যালেস্তাইন নিয়ে দুই-চার কথা হয়ে যাক। যদি সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হয় তখন না হয় একটা মিছিল করা যাবে, অনেক লোক আসবে। আমাদের ভোট নেই, কিন্তু লোক আছে।

মনে পড়ে যাচ্ছে ১৯২০-র দশকে জার্মান কম্যুনিস্টদের সেই মূর্খামি। রোজা লুক্সেমবুর্গদের হত্যাকাণ্ডকে অজুহাত করে তারা ভাইমার খুনি সরকারকে বাঁচাতে চায়নি। যুক্তি ছিল, হিটলার ভোটের মধ্য দিয়েই ক্ষমতায় এসেছেন, ফলে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হয়নি!

পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল নেতাদের গ্রেপ্তারের পর আবার এদেশের ভদ্রজন সেই একই কথা বলছেন, সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হলে দেখা যাবে, এখন মদন মিত্রদের রক্ষা করার দায় আমাদের নেই। “ওরা যখন মদনকে ধরতে এসেছিল, তখন আমি কিছু বলিনি কারণ আমি মদন নই। ওরা যখন শোভনকে ধরতে এসেছিল তখনও আমি কিছু বলিনি। কারণ আমি শোভনও নই।” যদিও ফিসফিসিয়ে হিসহিসিয়ে শোনা যাচ্ছে ‘সিবিআই জিন্দাবাদ’।

ভদ্রজনেরা বলছেন, ‘তদন্ত তদন্তের পথে এগোক।’ তাই রাতের অন্ধকারে যখন একজন ভিআইপি-কে (বুর্জোয়া ব্যবস্থায় যে যত বড় চোর সে তত বড় ভিআইপি) বিছানা থেকে তুলে আনা হল তদন্তের নামে তখন আমরা নীরব। কোনও প্রশ্ন উঠল না ভদ্রমহল থেকে! এমনকি সিংভি সাহেবকেও দেখা গেল না এই নিয়ে প্রথম দিনই আদালতকে চেপে ধরতে। যারা ওভাবে বিছানা থেকে তুলে আনল তারা আইনরক্ষক নাকি গুন্ডা? সংবিধানের কোন ব্যাখ্যাতে পাওয়া যাবে এহেন গুন্ডামির ছাড়পত্র? তৃণমূলের এই নেতারা কেউ খুনের আসামী নয়, কেউ নীরব মোদিদের মত ফেরারও নয়। চিদাম্বরমও তা ছিলেন না। অথচ তাঁকে গ্রেপ্তার করার জন্য পাঁচিল টপকে বাড়িতে ঢোকা হয়েছিল! এভাবে গুন্ডামি করে জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করা হচ্ছে। এই সিবিআই গুন্ডাদের গ্রেপ্তার করা হোক, বললেন না অভিযুক্তদের উকিল সিংভি সাহেব। কেনই বা তুলবেন। উনিও তো আগামীকাল মন্ত্রী হবেন, তখন এই অশোকবাবুদেরকেই প্রয়োজন হবে ওনারও। ‘তদন্ত তদন্তের পথে এগোক’। তাই অভিযুক্তদের না ডেকে, তাদের উকিলকে না ডেকে, রাতারারতি বেল-এ স্থগিতাদেশ দিল উচ্চ আদালত। এই তদন্তের নামে প্রহসন নিয়েও ভদ্রজনেরা নীরব। ‘তদন্ত তদন্তের পথে এগোক’। অথচ জনগণ দেখল তাদের চার নেতাকে (এক মাসও হয়নি এদেরকেই জনতা নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন) টানতে টানতে সিবিআই নিয়ে যাচ্ছে। জনগণের কোনও ক্ষমতা নেই, হাতে পুলিশ নেই, তাদের একমাত্র ক্ষমতা তাদের জোট। অথচ তাঁরা যখন সেই জোটের ভরসায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন তখন তাঁদের এই জোটের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে সিবিআই গুণ্ডাদের জোটকে। যারা দল বেঁধে মন্ত্রীদের বাড়ি থেকে তুলে আনেন। তাই অশোকবাবু সেই বাকি রাতে নিশ্চয়ই কোনও এক রাজ্যের গভর্নরের জীবন কেমন হবে সেই স্বপ্নে বিভোর ছিলেন।

কেউ বলছেন, চক্রান্ত হোক, কিন্তু মহামারির সময় নয়। কেউ বলছেন চক্রান্ত হোক, কিন্তু মুকুল-শুভেন্দু সমেত। কেউ বলছেন, এটাকে রাষ্ট্রপতি শাসন ইত্যাদির সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়। বিপদ চোরদের, আমরা ভদ্রজন। আমাদের গর্ব, আমরা তিন দশকের ভদ্রজন। আমাদের বিরুদ্ধে সিবিআই কেস করতে পারেনি। এক কথায় বললে, ভদ্রকুল নিশ্চিন্ত, তাদের কোনও বিপদ নেই।

যদিও জনগণ এতটা নিশ্চিন্ত নয়। তারা অনেক কষ্টে জাতীয় মহাচোর মোদিদের হারিয়েছেন। কিছুতেই যাতে ওই ব্যাঙ্ক মহাচোররা ঢুকতে না পারে তাই সারদা চোর তৃণমূলকে জিতিয়েছেন। তার কারণ এটা নয় যে জনগণও চোর। তার কারণ তারা জানে আজ মহাচোরদের ‘চোর ধরো কমিটি’কে যদি প্রশ্রয় দেওয়া হয় তাহলে আগামীকাল বাড়ি থেকে রাতের অন্ধকারে তাদেরই পায়ে দড়ি বেঁধে হিঁচড়োতে হিঁচড়োতে নিয়ে যেতে পারবে এই রাষ্ট্রীয় গুন্ডারা। মন্ত্রীদের সঙ্গে যদি এমন আচরণ করতে পারে গুন্ডারা, তারা তো স্রেফ পাতি ভোটার।

তাই ভোটাররা ইতিহাসের বই না পড়েও বোঝেন যে মুকুল, শুভেন্দুকে বলি দিতে ফ্যাসিস্টদের দুই দিনও সময় লাগবে না। ভদ্রজনেরা যদিও ইতিহাস বই থেকেই জানেন যে আর্নস্ট রম-কেই (ernst rohm) আগে হিটলার সরিয়েছিল।

 

বিপদ আজ ওদের, কাল সকলের

বিশ্বটা ক্রমেই পাকিস্তান-আফ্রিকা হয়ে যাচ্ছে। মিলিটারি শাসন। বিরোধী পক্ষের মুখ বন্ধ করতে স্বৈরতন্ত্রের হালফ্যাশনের হাতিয়ার— দুর্নীতি। আজ পাকিস্তানে ইমরান ক্ষমতায়। যখন মিলিটারির সঙ্গে তাঁর ঝামেলা লাগবে, তাঁকে ফেলে দেওয়া হবে কোনও না কোনও দুর্নীতির দায়ে। গ্রেপ্তার করা হবে, তার পর হয় তিনি দেশ ছেড়ে পালাবেন, নতুবা ফাঁসি হবে। আমাদের দেশেও একই কায়দায় আঞ্চলিক দলগুলিকে ক্রমে ধ্বংস করা হয়েছে। মায়াবতী, লালু, সব বাঘা বাঘা নেতানেত্রীদের সিবিআই দিয়ে পরাস্ত করে বিহার উত্তরপ্রদেশ বিজেপি দখল করেছে। ‘বাইনারি, বাইনারি’ করে ভদ্রলোকেদের কান্নাকাটি দেখেছি, এখন কিন্তু সেই স্পষ্ট বাইনারির দিকে দেশকে নিয়ে যাওয়ার চক্রান্তকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন তারা।

ভারতের সবচেয়ে বড় চোর মোদির ‘চোর ধরো কমিটি’-র শেষ উদ্দেশ্য অবশ্যই মমতা ব্যানার্জীকে গ্রেপ্তার করে সরকার ফেলে দেওয়া। এবং আইন শৃঙ্খলার অবনতি দেখিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনি মোতায়েন করা।

ভদ্রজনেরা নিশ্চয়ই ভুলে যাননি, ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৭-র ইতিহাস। বহু মানুষ ছিলেন বামবিরোধী। ১৯৬৭ সালে অনেকেই কংগ্রেসকেই ভোট দিয়েছিলেন। কিন্তু ওদের স্বৈরাচারের ফলে ১৯৬৯ সালে এসে অপছন্দ হলেও বামদেরকেই ভোট দিয়েছিলেন মানুষ। কারণ জনগণ সস্তা শত্রুতা দিয়ে চলেন না। জনগণ ভোট নষ্টও করেন না। এই একবারই জনতা সুযোগ পায় রাজা হওয়ার। প্রজার আসন থেকে এক দিনের জন্য তাদের পদোন্নতি ঘটে। বিপরীতে ভদ্রজন মূলত প্রতিবাদী প্রজা। ক্ষমতায় যাওয়ার, রাজা হওয়ার কোনও বাসনা নেই। মুখে বুলি, যে লঙ্কায় যায়, সেই রাবণ হয়। তাই দ্বিমেরুর প্রাকৃতিক নিয়মকে অস্বীকার করতে ভদ্রজন কুণ্ঠা বোধ করেন না। রাস্তায় থাকার, মিছিলে থাকার অস্তিত্ব নিয়েই ভদ্রজন খুশি। রাস্তাই রাস্তা। নৌবিদ্রোহের নেতৃত্বে থেকেও কম্যুনিস্ট পার্টি ভদ্রজনের পার্টি হয়েই থেকে গেল। ক্ষমতার ভাগ পেতে ক্যাবিনেট মিশনে অংশ নেওয়ার কোনও প্রচেষ্টাই নিল না। আন্দামানের সেলুলার জেল ভর্তি তাদের দিয়েই, অথচ সোলাপুর কম্যুনের নেতারা ১৯৩০ সালের ইংরেজ কমিশন যখন স্বাধীন ভারতের সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করল, লিগ ও কংগ্রেস, দুই পক্ষই সংবিধান বানিয়ে ফেলল, কম্যুনিস্টরা ভারতের বিকল্প সংবিধান বানাল না, গোল টেবিল বৈঠকে যাতে তাদেরও প্রতিনিধি থাকে, যাতে আঞ্চলিক ভোটগুলোতে তারাও অংশ নিতে পারে তার প্রচেষ্টাও নিল না। ওই তিন নম্বরী তত্ত্ব। ভদ্রজনোচিত তত্ত্ব।

নাম্বার লাইন অসীম। কিন্তু বস্তুর মেরু দুটোই। তৃতীয় বিশ্ব থাকবে, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন থাকবে। কিন্তু রাউরকেল্লা স্টিলের জন্য বা বাংলাদেশ যুদ্ধের জন্য সোভিয়েতের সাহায্য নিতে হবে। তিন দুনিয়ার নেতা মাও সেতুং-কে কোরিয়ান যুদ্ধে এক পক্ষ নিতে হবে আবার সোভিয়েত রাশিয়া তাদের পরমাণু বোমা বানাতে না দিলে আর এক মেরুর দিকে কাত হতেই হবে। স্তালিন হিটলারের সঙ্গে চুক্তি করবেন, আবার কিছুদিনের মধ্যেই চার্চিল-রুজভেল্টের সঙ্গেও করবেন। দুইয়ের মধ্যে মাথা গলাবে তিন। ভারতেও ১৯৪২ সালে ইংরেজদের সঙ্গে তাঁদের হাত মেলাবেন কম্যুনিস্টরা। কেরেন্সকি বনাম কর্নিলভের দ্বন্দ্বে তিন নম্বর হয়ে না থেকে কেরেন্সকিকে রক্ষা করবেন লেনিন।

অনেকেই বলছেন সিবিআই তৃণমূল দ্বন্দ্বে সিপিআই(এম) মোটেই ভদ্রজনের মত আচরণ করেনি, তাদের রাজ্য কমিটির বিবৃতি ছিল স্পষ্ট সিবিআই বিরোধী। কিন্তু চালসে পড়েছে বলে কি না জানি না, আমার তা মনে হয়নি। আমার মনে হয়েছে, এই বিবৃতি ছিল কসমেটিক বিরোধিতা। অনেকটা ২০২১ সালে তাদের নির্বাচনী স্লোগানের মতো। ২০১৯ সালের অবস্থান থেকে বদল ঘটেছিল, কিন্তু কসমেটিক। ২০১৮ সালের চূড়ান্ত স্বৈরাচারের পর ২০১৯ সালে কম্যুনিস্টরা এরাজ্যে ‘তৃণমূল হারাও’, এই স্লোগানেই মনোনিবেশ করেছিলেন। শুধু বামফ্রন্ট নয়। বিজেপিকে একটাও ভোট নয়, এই স্লোগান নিয়ে কোনও বামপন্থী দলই উঠে আসেনি সেদিন। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারে থাকা শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে তাদের ১৮টা সিট পেতে সাহায্য করেছিল কম্যুনিস্ট মহল। কিন্তু ২০২১ সালে এসে সিপিআই(এম) নেতৃত্ব নিজের দলে থাকা রিঙ্কুদেবীদের কোণঠাসা করতে চাইলেন এবং নিয়ে এলেন ‘যাহা তাহা’ তত্ত্ব— যাহা বিজেপি, তাহাই তৃণমূল। বিজেমুল। কসমেটিক বদল। অবৈজ্ঞানিক বহুত্ববাদের জন্ম হল। একদিকে এই বদলের প্রতিফলন ঘটল বালি-কামারহাটি-কসবার মত বহু কেন্দ্রে। বামেরা না থাকলে ওই আসনগুলিতেও বিজেপি জিতত। ২০১৯ সালের থেকে অনেক বেশি ভোট পেলেন বামেরা ওই সব কেন্দ্রে। অর্থাৎ বিজেপিকে তৃণমূলের মতই খারাপ বলার ফলে কিছু বাম ভোটের ঘর ওয়াপসি হল। কিন্তু বিজেপিকে তৃণমূলের থেকে বেশি খারাপ না বলার ফলে জনগণ সিদ্ধান্ত নিলেন, নেতাদের বাদ দিয়েই বিজেপি বিরোধী সংযুক্ত মোর্চা গঠন করবেন তারা। বাম ভোটার, আদি বিজেপি ভোটার, আব্বাসের ভোটার, কংগ্রেসের ভোটার মিলে তৃণমূলকে জেতালেন। বলাই বাহুল্য, দলগুলির মধ্যে মোর্চা হলে বাম, কংগ্রেস, আব্বাস, তৃণমূল, সকলেই আসন ভাগ করে পেতেন। কে না জানে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের বদলে বহুত্ববাদের চর্চা ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়। তৃণমূল আর বিজেপি ভরা বিধানসভা আবার সেই সম্ভাবনা তৈরি করছে।

সিবিআই নিয়ে রাজ্য কমিটির বিবৃতিও তেমনই কসমেটিক বহুত্ববাদী বিবৃতি। সাংবিধানিক সঙ্কট কবে হবে সেই অপেক্ষায় থাকার বিবৃতি। এই মুহূর্তে সিবিআই-র বিরুদ্ধে রাস্তায় না নামার বিবৃতি।

 

পুরনো ইতিহাসের থেকে…

দিমিত্রভ ছিলেন জার্মান ভদ্রজনদের প্রতিনিধি। জার্মান কম্যুনিস্টদের সেই ভদ্রজনোচিত ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার হিম্মত হল না ভারতের বাম দলগুলির। ১৯৩৫ সালে এসে দিমিত্রভ যুক্তফ্রন্টের স্লোগান দিলেন! তার দু বছর আগেই হিটলার এসে গেছে। প্যাদানির নাম ধনঞ্জয় তখন। অথচ তার আগে ৮টা নির্বাচন হয়ে গেছে। নির্বাচনে এসপিডি ও কেপিডি লড়লেই হিটলারদের জোট হেরে যেত। কিন্তু না, তৃতীয় আন্তর্জাতিকের নাকি বারণ ছিল। ১৯২৪ সালের আগে দলীয় জোটের প্রক্রিয়া নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না। ২৪ থেকে ৩৪, এই দশ বছর ধরে চলেছে নৈরাজ্য— জনগণের মধ্যে জোট চলবে, দলগুলির মধ্যে জোট চলবে না। দলীয় ঐক্য ছাড়াই নাকি শ্রেণি ঐক্য গড়ে উঠবে!! মাও সেতুং ভাগ্যিস আন্তর্জাতিক নেতাদের মাতব্বরি বরদাস্ত করেননি।

এত সব পুরনো কথা তোলার একটাই উদ্দেশ্য।

আমরা চাই খুনে ডাকাতদের চোর ধরার বিরুদ্ধে আদালতে সিংভি-কল্যাণ ব্যানার্জী ও বিকাশ ভট্টাচার্যকে একসঙ্গে দেখতে।