Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ইনফোসিস, রাজারহাটের জমি, নয়া চুক্তি ইত্যাদি নিয়ে যাহা যাহা “নেশন ওয়ান্টস টু নো”

সৌভিক ঘোষাল

 

একাদশীর ভাসান আর বিসর্জন নিয়ে যখন মিডিয়ায় তুমুল তর্ক চলছে, তখন একটা খবর ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেছে। আমরা সেটা নিয়ে আপাতত দু’টো কথা বলি।

ইনফোসিস আগের বাম সরকারের আমলে রাজারহাটে ৫০ একর জমি কিনে রেখেছিল। সেখানে আই টি পার্ক হবার কথা ছিল। অনেকদিন কেটে গেলেও প্রাইম লোকেশনের এই জমিতে কিছু করছিল না তারা। জানা যাচ্ছিল একমাত্র সেজ-এর তকমা পেলে তবেই তারা আই টি হাব করবে এখানে, নচেৎ নয়। জমি অধিগ্রহণ বিরোধী আন্দোলন করে ও সেজ না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার কিছুতেই সেজ দিতে রাজী হতে পারছিল না। সেজ-এর নাম ব্যবহার না করে “সব” রকমের সুবিধা দেবার কথা অবশ্য রাজ্য সরকার বারবারই বলছিল। শেষমেষ জানা গেল ওখানে আই টি হাব করতে রাজী হয়েছে ইনফোসিস। সেজ-এর তকমা না পেয়েই। কোন শর্তে এই রফা হল, সেজ-এর বদলে কী কী ধরনের সুযোগ সুবিধে তাদের দেওয়া হল– সেটা নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই একটা আগ্রহ তৈরি হয়।

প্রথমেই যেটা জানা যাচ্ছে সেটা হল লিজ-এর বদলে ফ্রি হোল্ড। সরকার কোনও সংস্থাকে যখন শিল্পস্থাপনের জন্য জমি দেন, তখন সেটা লিজ হিসেবেই সাধারণভাবে দেওয়া হয়ে থাকে। যে উদ্দেশ্যে সরকার জমি দিল, অর্থাৎ শিল্পস্থাপনা, তা পূরণ না করলে সরকার এক্ষেত্রে জমি ফিরিয়ে নেওয়ার অধিকারী। এই লিজকেই রাজ্য সরকার এক্ষেত্রে বদলে দিয়েছে ফ্রি হোল্ড-এ। এর ফলে জমি নিয়ে তারা কী করবে না করবে সে ব্যাপারে ইনফোসিস পুরোদস্তুর ছাড় পেয়ে গেছে।

ইনফোসিস কি এই জমির পুরোটা আদৌ শিল্পস্থাপনের জন্য ব্যয় করবে? সংশয়টা তৈরি হয়েছে কারণ জানা যাচ্ছে এখানে এক হাজার লোকের কর্মসংস্থানের কথা বলা হয়েছে। পুরো জমিটাকে আই টি হাবের জন্য ব্যবহার করলে যেটা বেশ কয়েক গুণ হবার কথা। ফলে ইনফোসিস শিল্পের জন্য দেওয়া মহার্ঘ জমিকে অন্য কাজে ব্যবহার করবে, এমন সম্ভাবনা থেকেই যায়। সেজ-এর বদলে দেওয়া অন্যতম স্পেশাল ইনসেনটিভ সম্ভবত এটাই। সরকার জানিয়েছে ৫০ একরের মধ্যে ৫১ শতাংশ অর্থাৎ ২৬ একরে শিল্প করলেই হবে। বাকীটা অর্থাৎ ২৪ একর তারা অন্য কাজে ব্যবহার করে নিতে পারে। এই অন্য কাজ কী হতে পারে? আবাসন ব্যবসা বা এ ধরনের কিছু কি? তার জন্য প্রোমোটারদের কাছে চড়া দামে জমি বেচে দেওয়া হবে কি?

২০১০ সালে ইনফোসিসকে বাজারদরের থেকে অনেক অনেক কম দামে এই জমি দিয়েছিল সরকার। শর্ত ছিল এই জমিতে ইনফোসিস ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে এবং ৫০০০ লোকের কর্মসংস্থান হবে। মাত্র ৭৫ কোটি টাকায় এই নির্দিষ্ট শর্তে পাওয়া জমির অর্ধেক ইনফোসিস এখন যে কোনও ভাবে ব্যবহার বা বিক্রি করে দিতে পারবে। যে অর্ধেকেরই বর্তমান বাজারদর ২৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ যে ৭৫ কোটি টাকায় ইনফোসিস এই ৫০ একর জমি কিনেছিল তার অর্ধেক বেচেই (যে অধিকার সরকার তাকে দিয়েছে) সে জমি কেনার সম্পূর্ণ টাকা, সুদ, শিল্প স্থাপনের খরচ ইত্যাদি তুলে ফেলতে পারবে এবং তারপরেও তার হাতে কিছু থেকে যাবে।

২০১১ সালে যখন রাজ্যে প্রায় এক গণ-রায়ের মাধ্যমে পরিবর্তন এসেছিল, তখন তার কেন্দ্রীয় প্রশ্নটি ছিল জমি অধিগ্রহণ ও তার ব্যবহার। সিঙ্গুরের আন্দোলনের অন্যতম দাবি ছিল সরকার কোন শর্তে টাটাকে জমি দিয়েছে তা প্রকাশ করতে হবে। ১০০০ একর জমি পুরোটাই শিল্পের জন্য দেওয়া হচ্ছে, না অন্য কাজে ব্যবহারের অধিকার তার থাকছে– সেটা জানতে চেয়েছিল মানুষ। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এই সমস্ত প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে চুক্তি প্রকাশে অনীহার কথা জানিয়েছিলেন, বলেছিলেন এটা ট্রেড সিক্রেট, চুক্তি প্রকাশ করা যাবে না। মানুষ এর বিরুদ্ধে আন্দোলনে উত্তাল হয়েছিল। এই দাবি নিয়ে সামনে ছিলেন বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ও সেদিনের বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। এখন ঘটনাচক্রে তিনিই ক্ষমতায়। আবার একই প্রশ্ন উঠছে ইনফোসিসের রাজারহাটের জমি ব্যবহার প্রসঙ্গটিকে ঘিরেও। জমি আন্দোলনকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় আসা সরকার ইনফোসিসের সাথে তার চুক্তি জনসমক্ষে আনুক, এই দাবি আবারও থাকছে। আমরা শঙ্কিত, আপাতত অপেক্ষায় রইলাম।