Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বেড পাওয়ার সহজ উপায়

বেড পাওয়ার সহজ উপায় -- অনন্য মুখার্জি

অনন্য মুখার্জি

 

প্রতি হাজার রোগীর জন্য দেড়টারও কম বেড, একজন নার্সপ্রতি বরাদ্দ ৬৭০ জন রোগী আর একজন ডাক্তারের ওপর ১৫১১ জন রোগীর জীবনের দায়িত্ব। যে দেশে মোট জাতীয় উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশেরও কম স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বরাদ্দ সে-দেশে এর চেয়ে বেশি কিছু হবে এরকম আশা শুধু কিছু ‘আচ্ছে দিনে’র ভক্তরাই করেছিলেন। ঢাল-তলোয়ার নেই, নিধিরাম সর্দার-মার্কা স্বাস্থ্যব্যবস্থার অবস্থা বা বলা ভালো দুরবস্থার কথা যারা জানেন আর সেই দুরবস্থাকে এই অসাধারণ পর্যায়ে নিয়ে যেতে যাদের প্রত্যক্ষ যোগদান আছে— যেমন আমাদের বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী— তাঁরা প্রথমদিন থেকেই জানতেন যে করোনা অতিমারির সামনে দেশের হাল ওই রামভরোসে। সব কিছু বেসরকারি যখন হয়েই গেছে ফলে এখন আর বেশি কিস্যু করার নেই। থালাবাসন বাজানো, উলুধ্বনি, প্রদীপ প্রজ্জ্বলন, অগ্নিকাণ্ড ইত্যাদি বাদে। জনগণও সেটা মনে মনে জানতেন বলেই এত ব্যাপকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেন— কারণ এতদিন সবকিছু ‘বেসরকারি হোক’ বলে দু হাত তুলে নেচে যে ফলাফল হয়েছে তার সম্যক অভিজ্ঞতা জনগণের যে নেই তা একেবারেই নয়; সে অভিজ্ঞতা নিজেদের পকেট কাটিয়েই তাঁরা করেছেন— ফলে মনে মনে একটা পাপবোধ তাঁদের কাজ করে বৈকি। তাঁরাও জানতেন এ-যাত্রা ওই গোমাতার হিসি, করোনিলের শিশিই জুটবে; এর বেশি কিছু জোটার ব্যবস্থাই রাখেনি তো শুধু শুধু আশা করা মানে পিঁপড়ের পাখা গজানো। ফলে সরকারবাহাদুরও বেশি চাপ না নিয়ে দেশের মাত্র ২ শতাংশ জনগণকে দেওয়ার মতো টিকার অর্ডার দিলেন— ১০০ জনে ২ জন হিসেবে টিকা দেওয়ার এই প্রাথমিক সিদ্ধান্তের পেছনে কোন আনুপাতিক পরিমাপক কাজ করেছে সেটা এখনও অজানা।

যাই হোক, এসবের ফলে যা হওয়ার ছিল তাই হল বা হচ্ছে। কেউ বাড়িতে যত পারছে অক্সিজেন সিলিন্ডার গুঁজে রাখছে, মজুতদার সিলিন্ডার নেই বলে সঙ্কট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে নিচ্ছে; আর কেউ না-পেয়ে হাঁফিয়ে মরছে;  সরকারি হাসপাতাল কাউকে ফেরাতে পারছে না আবার রাখতেও পারছে না— সেই সুযোগে বেসরকারি নার্সিংহোম হাসপাতাল করার পেছনে যে একমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য থাকে অর্থাৎ যতটা সম্ভব লাভ করে নেওয়া— বেড নেই দেখিয়ে গেল-গেল রব তুলে ৫০ হাজার থেকে এক-দুলাখে আইসিইউ বেড, দিনপ্রতি ৪০ হাজারে অক্সিজেন বেড আর ৩০ হাজারে হোটেলের ঘরে আইসোলেশন সেন্টার করার ব্যবসা রমরম করে চলছে। চারিদিকে অর্থনৈতিক মন্দায় লোকজনের ছাঁটাই চলতে থাকলেও ওষুধ ভ্যাকসিন আর অক্সিজেন প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোর শেয়ারের দাম চড়চড়িয়ে বেড়ে শেয়ার মার্কেট সূচককে ৫০ হাজারের নিচে নামতেই দিচ্ছে না। শোনা যেত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাজারে লোহালক্কড় বিক্রি করে অনেকে টাটাবিড়লা হয়েছিল আর আজকাল মানুষকে হাঁফিয়ে মারলে লোকে নাকি ‘পুনাওয়ালা’ হচ্ছে। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে।

আর ট্র্যাডিশন মোতাবেক কিছু বোকারাও রয়েছে যারা সেইমুহূর্তে হোক বা এইমুহূর্তে, নতুন করে পৃথিবী সাজানোতে স্বপ্নদুষ্ট। এদের সবকিছুতেই হাত-পা-গলা ছেড়ে চিৎকার চেঁচামেচি করার অভ্যেস; সে কোথায় কার ওপর রাষ্ট্রীয় অতি-আচার হোক বা কৃষকের ফসলের দাম না পাওয়া হোক। হতভাগাগুলো জুটেই যায়। কিন্তু এবার এই বোকার দল একটু চালাক হয়েছে। নাগরিকত্বের সংজ্ঞা যে সমাজে ঘোলাটে, নাগরিকতার অধিকারবোধ যেখানে দুৰ্বল সেই গণতান্ত্রিক কাঠামোতে শুধু প্রতিবাদ করে যাওয়াটা ওই ভরদুপুরে মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে ‘আমরা কারা? নাগরিক’ বলে ড্যা ড্যাং ড্যা ড্যাং করে কাঁসরঘন্টা বাজানোর মতোই অশ্বডিম্ব প্রসবকারী— সেটা মনে হয় এই বোকাদের একটু বোধগম্য হয়েছে। আজকাল তারা এই বাজারে নতুন একটা কথা নিয়ে এসেছে— ইনফ্লুয়েন্সার। কথাটা একটু উত্তর-আধুনিক শোনালেও আদতে বিষয়টা নতুন কিছু নয়। খুব গোদাভাবে বুঝতে হলে যা দাঁড়ায় তা হল প্রথমেই দ্ব্যর্থহীনভাবে ধরে নিতে হবে যে যেকোনও পলিসি তৈরি (এক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত) বা বর্তমান পলিসির সংযোজন পরিমার্জন ইত্যাদির দায়ভার বা দায়িত্ব একমাত্র রাষ্ট্রের এবং বকলমে রাষ্ট্রের শাসনযন্ত্রের প্রতিনিধি প্রশাসনিক আধিকারিক ও রাজনৈতিক নেতানেত্রীদের বা ভোট লড়া দলগুলোর। এবং একমাত্র এই কাঠামোর মাধ্যমেই (যাকে সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় পলিটিকাল সোসাইটি বলা হয়ে থাকে) একজন সাধারণ মানুষ, যাঁর সাংগঠনিক যোগাযোগ দুর্বল বা একেবারেই নেই, অথচ তাঁর জীবনের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও চেতনার  মধ্যে দিয়ে বুঝতে পারছেন যে কী ধরনের সম্ভাব্য সাধ্যমাফিক সমাধানসূত্র বর্তমান অবস্থাকে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদিভাবে শোধরাতে বা বদলাতে পারে, তিনি নিজে একজন তথাকথিত ইনফ্লুয়েন্সার হিসেবে সামাজিক ভূমিকা নিতে পারেন।

এই ভূমিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে অবশ্য কিছু পূর্বশর্ত রয়েইছে (এপ্রসঙ্গে উৎসাহীরা সল এলিনস্কির ‘রুলস ফর রেডিকালস’ পড়ে দেখতে পারেন)। প্রথম শর্ত হল, পলিটিকাল সোসাইটির প্রতিনিধিদের মধ্যে কে বা কারা রয়েছে যাদের প্রভাবিত করা সম্ভব অর্থাৎ সহজভাষায় কারা কথা শুনতে পারে তাদের চিহ্নিত করা ও তাদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম বা কমিউনিকেশন চ্যানেল স্থাপন করা। যাকে আজকাল নেটওয়ার্কিং বলা হয়ে থাকে। যখন চিহ্নিত করা নেই, তখন প্রাথমিকভাবে সমস্ত সম্ভাব্য দিকেই ছড়িয়ে দেওয়ায় প্রচেষ্টা করা যেতে পারে— সোজা কথায় একমুঠো ঢিল নিয়ে অন্ধকারে ছুড়ে মারা, যেখানে যেখানে ঢিল লেগে শব্দ হল সেগুলোকে আলাদা করে চিনে রাখা। দুই, অনেক কিছু বলার ইচ্ছে, তাই সুযোগই পেলে সব জড়িয়ে-জাপটে হুড়হুড়িয়ে বলে দিলাম— এই প্রবণতাকে বাতিল করা। ইনফ্লুয়েনস করতে হলে চাই একেবারে সুস্পষ্ট মেসেজ এবং তাকে ফ্রেম করার প্রক্রিয়াও সুস্পষ্ট ও সুচারু হওয়া প্রয়োজন। প্রথমে প্রয়োজন তথ্যপ্রমাণসহ সমস্যার মূলগত বা উৎপত্তিগত কথা, যাকে সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার ধারায় এভিডেন্স-বেসড প্রবলেম স্টেটমেন্ট ও রিসার্চ কোয়েশ্চেন বলা হয়ে থাকে। তার প্রেক্ষিতে শুধু আকাশকুসুম দাবি না জানিয়ে দরকার সব চাওয়াগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি ভিশনের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে সহজসাধ্য বা তাৎক্ষণিক, একটু কষ্টসাধ্য বা স্বল্পমেয়াদি, বেশি কষ্টসাধ্য বা দীর্ঘমেয়াদি এবং অসাধ্য বা সুদূরপ্রসারী সমাধান হিসেবে পর্যায়ক্রমিক ভাগ করা। সহজসাধ্য বা তাৎক্ষণিক এবং অসাধ্য বা সুদূরপ্রসারী, এই দুই ধরনের সমাধানসূত্রই কিন্তু একেবারে অপরিহার্য। সহজসাধ্য বা তাৎক্ষণিক সমাধানসূত্র স্বাভাবিকভাবেই যেকোনও পলিটিকাল সোসাইটির প্রতিনিধির কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য হবে— মেসেজের গ্রহণযোগ্যতার সঙ্গে যিনি মেসেজ ফ্রেম করেছেন বা নিয়ে যাচ্ছেন তারও প্রাথমিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে সাহায্য করবে। আবার অসাধ্য বা সুদূরপ্রসারী সমাধানসূত্র এই শাসনকাঠামোর ঊর্ধ্বে এটি বিকল্প রাজনৈতিক পরিমণ্ডল বা গঠনের বার্তাকেও সমান্তরালভাবে বহন করবে— যেটা না থাকলে পুরো প্রয়াসের অরাজনীতিকরণ হয়ে গিয়ে কানাগলিতে ঘুরপাক খেয়ে শেষে দেওয়ালে মাথা ঠুকে মরতে হবে। শেষে পূর্বশর্ত তিন, পুরো প্রয়াসের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিদিনের জীবনের লড়াইয়ের সঙ্গে, সমস্যার সঙ্গে যে শ্রেণির মানুষের কথা বা মেসেজ পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে তাদের সঙ্গে গণআন্দোলনগত যোগাযোগ না হলেও ব্যাক্তিগত স্তরেও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরিসরে বা মাইক্রোলেভেল স্পেসের উপস্থিতি থাকতেই হবে। যার অভাবে কার কথা নিয়ে যেতে চাইছি, কী কথা নিয়ে যেতে চাইছি, এর যে ইনপুট নেওয়ার জায়গাই থাকবে না; শুধু ঠান্ডাঘরে বসে সমাজবিচ্যুত জ্ঞান দেওয়াই হবে।

এখানে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, এত কষ্ট না করে সরাসরি কোনও রাজনৈতিক দলে যোগদান করলেই তো মিটে গেল! সেটা করাই যেতে পারে, কিন্তু ভোটের রাজনীতি করা দলে যোগ দিলে দুটো প্রধান সমস্যাকে সবসময় প্রতিহত করে যেতে হবে। এক, প্রচলিত বন্দোবস্তের কারণে নিজেদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতার হকদার প্রমাণ করতে রাজনৈতিক দলগুলোকে বছর বছর ভোটে জিততে হয়। যদিও সেই একই ব্যবস্থার জন্যই তথাকথিত ইনফ্লুয়েন্সারও নিজেদের প্রভাব খাটানোর জায়গা পায়। কিন্তু আবার এই ব্যবস্থার ফলেই রাজনৈতিক দলগুলো এমন সব নীতি বা কর্মকাণ্ড সারাবছর করে থাকে যেগুলোর বিরোধিতা করাটাই স্বাভাবিক; অথচ দলের শৃঙ্খলা, ইমেজ ইত্যাদির কারণে সাধারণত দলের ভেতরে থেকে সেগুলোর বিরোধিতা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না— ঢোক গিলে হজম করতে হয়। দ্বিতীয় সমস্যাটা আরও গুরুতর। ভোট রাজনীতি করার ফলে সব রাজনৈতিক দলেই বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী শ্রেণির মানুষের সমাবেশ হলেও প্রায় সবক্ষেত্রেই একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি বা শ্রেণিগোষ্ঠীর স্বার্থই দলের প্রাধান্যকারী স্বার্থ হয়ে কাজ করে যার ওপর নির্ভর করে সেই দলের কার্যকলাপ বা সোজাকথায় দলের পলিসি। ভারতে নাগরিকতা, নাগরিক অধিকার এবং তার ওপর দাঁড়িয়ে বাম-ডানের যে সংজ্ঞায়ন ও বিভাজন করার চেষ্টা সাধারণত হয়ে থাকে সেগুলোর মাপদণ্ড বা সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় মেথডোলজিকাল ফ্রেমওয়ার্ক পশ্চিম থেকে ধার করা; যার সঙ্গে ভারতীয় সমাজের বিবর্তন ও বাস্তবতার অনেকটাই পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু বাম হোক বা ডান, রাজনৈতিক দলগুলো তো তৈরি হয়েছে ওই ধার করা ধারণা থেকে জন্ম নেওয়া মতাদর্শের ভিত্তিতেই; ফলে যখন বাস্তবের মাটিতে এই দলগুলো গিয়ে পড়ে তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী সব দলই তার রাজনীতি বা মতাদর্শের পরিবর্তন করে। এই অবধি ঠিকই আছে; কিন্তু সমস্যাটা শুরু হয় যখন এই রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের রাজনীতি নিয়ে সম্পূর্ণ নমনীয়তা দেখালেও ধরে নেওয়া শুরু করে যে তাদের ভোটার বা কর্মী-সমর্থক শুধুমাত্র তাদের দলের ঘোষিত ও কথিত রাজনীতির নামেই দলের প্রতি অনুগত থেকে যাবে।  দল সাবজেক্ট আর তার সমর্থক ভোটার-জনতা শুধু অবজেক্ট।  তাই কর্মী-সমর্থক-জনগণ রাজনৈতিক নমনীয়তা দেখালে তাকে একেবারেই মেনে নেওয়া হয় না। ঠিক যেমন কথায় বলে— নিজের বেলা আঁটিশুঁটি, পরের বেলা চিমটি কাটি।

এইজন্য বলেছিলাম না, দিনবদলের স্বপ্ন দেখা বোকাগুলো আজকাল একটু একটু চালাক হয়েছে। করোনা অতিমারির দ্বিতীয় ঢেউ যখন বাংলায় এসে পৌঁছয় তখন অধিকাংশ গণউদ্যোগ, সে তা ব্যক্তিগত হোক বা সাংগঠনিক, যখন প্রথম ঢেউরের মতোই ওই পাড়া স্যানিটাইজেশন, খাবার-অক্সিজেন সিলিন্ডার ঘাড়ে করে পৌঁছে দেওয়াতে আর তার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে ‘জীবন বাজি রেখে অন্যের জীবন বাঁচানোর’ আত্মতৃপ্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেল; তখন এই ধরনের স্বেচ্ছাসেবীদের একাংশ বুঝলেন যে রাষ্ট্র ছাড়া জনস্বাস্থ্যের এই সঙ্কট কারও পক্ষে সমাধান করা সম্ভব নয়। আর এই রাজনৈতিক বোধ থেকে খুব ক্ষুদ্র হলেও অনেক সুসংহত স্থানীয় স্তরের নতুন ধরনের উদ্যোগ উঠে এল। এই উদ্যোগগুলো ফ্রি-খাবার রেশন, হাসপাতাল বেড-অক্সিজেন-ওষুধ-অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি শুরু করল তথ্যসংগ্রহ। অক্সিজেন সিলিন্ডারের মজুতদারি, ওষুধের কালোবাজারি, বেসরকারি হাসপাতাল বেডের অস্বাভাবিক দামে বিক্রি কারা করছে, কী প্রক্রিয়ায় হচ্ছে, কোন ব্যাবস্থার অনুপস্থিতির কারণে এসব করা সম্ভব হচ্ছে, তার প্রমাণ সংগ্রহ করা হতে লাগল। লক্ষ করা গেল যে ১৫-২০ দিনে ধরে একনাগাড়ে একটিও বেড নেই বলে তথ্য দিয়ে চলা কোনও কোনও নার্সিংহোম সাধারণ রোগীর পরিবার ও স্বেচ্ছাসেবকদের ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করালেও শহরের কোনও এক-দুইজন প্রভাবশালী ব্যক্তির শুধু ফোনকলে কীভাবে মন্ত্রবলে মহার্ঘ্য আইসিইউ বেড মিনিটের মধ্যে হাজির করায়। আর এই সব তথ্যপ্রমাণ একজায়গায় করে নির্দিষ্ট সমাধানসূত্র সহযোগে পাঠানো হতে লাগল সমস্ত স্তরে ও মাধ্যমে যাতে ওই পলিটিকাল সোসাইটির প্রতিনিধিদের কাছে পৌঁছয়— একমুঠো ঢিল নিয়ে অন্ধকারে ছুড়ে মারার মতোই।

এই প্রয়াসগুলো স্থানীয়ভাবে আকারে ক্ষুদ্র হলেও এবং কোনও একক সাংগঠনিক রূপ না পেলেও বিভিন্ন স্তর ও মাধ্যমে একযোগে সঞ্চারিত হওয়ায় তার একটা জৈবিক প্রসার বা অর্গানিক অ্যামপ্লিফিকেশন ঘটল বা ঘটছে। সমাধানসূত্রগুলোতে উঠে এল তাৎক্ষণিকভাবে সরকারি হাসপাতালে বেড বাড়ানোর কথা, সরকারি স্বাস্থ্যসাথী কার্ডকে সর্বত্র গ্রহণযোগ্য করার কথা; স্বল্পমেয়াদি সমাধান হিসেবে বলা হল প্রতি জেলায় ও শহরে কোভিড টাস্কফোর্স গঠনের কথা, যা সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যপরিষেবাক্ষেত্রের ওপর, অক্সিজেন ও ওষুধ সাপ্লায়ারদের নিয়মিত নজরদারি চালাবে। যেমন দীর্ঘমেয়াদি দাবি হিসেবে বলা হতে লাগল প্রতি ব্লক ও ওয়ার্ডে ফিভার ক্লিনিক স্থাপন করার কথা, সেফ হোমগুলোতে অক্সিজেন পরিষেবা দেওয়ার কথা, তেমনি সুদূরপ্রসারী দাবি হিসেবে হতে লাগল সবার জন্য বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেওয়ার, লকডাউনের ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবী ও স্বনিযুক্ত উদ্যোগে যুক্ত পরিবারগুলোকে পরিবারপিছু মাসিক ৭৫০০ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথাও। আর এর ফলও মিলতে শুরু করেছে হাতেনাতে। তাৎক্ষণিক ও স্বল্পমেয়াদি এমনকি কিছু দীর্ঘমেয়াদি সমাধানসূত্র ইতিমধ্যেই প্রশাসনিকস্তরে গ্রহণ করার ইঙ্গিত মিলছে; স্থানীয় পর্যায়ে হলেও মজুতদারি রুখতে কিছু তৎপরতা দেখা যাচ্ছে। এমনকি অস্বাভাবিক ফি নেওয়ার দায়ে আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে কিছু বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। তবে এগুলো একেবারেই যথেষ্ট নয় যতক্ষণ না সার্বিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনার রূপ পাচ্ছে আর এখানেই এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নাগরিক উদ্যোগ বা ইনফ্লুয়েন্সারের ভূমিকা আরও বেড়ে যাচ্ছে, নতুন সম্ভাবনার জায়গা খুলে দিচ্ছে জনস্বাস্থ্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে।

কিন্তু শুধু জনস্বাস্থ্য নয়, খুব গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে আজকের সামাজিক প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক সমাজকে প্রভাবিত করার এই সম্ভাবনা আরও প্রশস্ত যা সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন বা হস্তক্ষেপ করার ক্ষেত্রে কিছু সুদূরপ্রসারী ও স্থায়ী পরিবর্তন ইতিমধ্যেই এনে ফেলেছে। সেটা গণআন্দোলনের আঙিনা থেকে উঠে এসে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ক্যাম্পেনের তাৎক্ষণিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের ভোটরাজনীতিতে ও গণআন্দোলনের ফর্ম পরিবর্তনের ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন এনে দেওয়াই হোক বা সারাদেশে প্রশান্ত কিশোর থুড়ি আইপ্যাক ধরনের টেকনোক্র্যাটিক ঘরানার ইনফ্লুয়েন্সার ফর্মেই হোক। অধ্যাপক কল্যাণ সান্যাল তার ‘রিথিংকিং ক্যাপিটালিস্ট ডেভেলপমেন্ট’ বইতে নিওলিবারাল পুঁজির নিজের রাজনৈতিক বাধ্যতার জায়গা থেকেই ইনফরমাল ইকনমি বা পেটি কমোডিটি প্রোডাকশনকে ‘পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থায় বাতিলদের আশ্রয়স্থল’ হিসেবে জন্ম দেওয়ার, প্রতিপালন করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সঙ্গে এও বলেছিলেন যে এই বৈপরীত্য ‘বাতিল’দের নিজেদের উপস্থিতি জানান দেওয়া শুধু নয় বরং তার জন্মদাত্রী প্রক্রিয়াকেও মূলগতভাবে চ্যালেঞ্জ করার সম্ভাব্য ক্ষেত্র হতে পারে। যার সূত্র ধরে ‘ডেমোক্রাসি আন্ড ইকোনোমিক ট্রান্সফরমেশন অফ ইন্ডিয়া’ প্রবন্ধে অধ্যাপক পার্থ চ্যাটার্জী নাগরিক সমাজের পরিবর্তে রাজনৈতিক সমাজের মধ্যকার নিয়ত দ্বন্দ্ব ও তার তীব্রতাকে বাড়িয়ে নিয়ে চলার সচেতন প্রয়াসের ওপরেই সামাজিক গণতন্ত্রের ভবিষ্যত লেখার দায়িত্ব আরোপ করেছিলেন। আজ নাগরিক সমাজের বাহ্যত ‘অরাজনৈতিক’ হস্তক্ষেপের উন্নাসিক স্বনির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে ব্যক্তির বা ক্ষুদ্র ব্যক্তিগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সমাজের সঙ্গে ও মধ্যে থেকে হস্তক্ষেপ করার এই সামাজিক পরীক্ষা ও তার সামগ্রিক ফলাফল হয়তো সেইদিকেই পথনির্দেশ করছে— যাকে অগ্রাহ্য করার আর কোনও জায়গা নেই।

 

রেফারেন্স: