Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রভাবিত জীবন-জীবিকা

বিবর্তন ভট্টাচার্য

 


বিজ্ঞানকর্মী

 

 

 

প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মূল কারণ রাষ্ট্রের উন্নয়নের মডেল। ১৭৫০ সালের শিল্পবিপ্লবের পর থেকে পৃথিবী-পৃষ্ঠের গড় উষ্ণতা ইতিমধ্যে ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এইভাবে গ্রিন হাউস গ্যাস বৃদ্ধি পেতে থাকলে পৃথিবীর এক স্থায়ী পরিবর্তন ঘটে যাবে আর তা মেরামতের অযোগ্য হয়ে যাবে। হিমালয়ের হিমবাহগুলির ৩৮ শতাংশ অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। সারা পৃথিবীর হিমবাহগুলি ব্যাপকভাবে গলে ছোট হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে প্রতি বছর গঙ্গানদীর মূল উৎস গঙ্গোত্রী হিমবাহ ১৯ মিটার হ্রাস পাচ্ছে। হিমাচল প্রদেশের বহু গ্রামে পানীয় জলের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। মানুষ গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন, হচ্ছেন শহরমুখী। আমরা যখন ঘুমিয়ে থাকি তখন (এই ধরনের প্রাকৃতিক কারণ ও নদীবাঁধ, পরমাণু চুল্লি স্থাপন বা কয়লা উত্তোলনের জন্য গ্রামীণ জীবন-জীবিকা হারিয়ে) কত লক্ষ মানুষ রাতের ট্রেনে এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে চলে যান আমরা জানতেও পারি না।

সুন্দরবনে আয়লার পরে চাষাবাদ আর যখন হচ্ছিল না তখন উত্তরপ্রদেশের আলিগড়ে তালা তৈরি করতে চলে গেছিলেন তুষখালি কিংবা সন্দেশখালির মানুষ। ছিলেন চাষি, হয়ে গেলেন শিল্পশ্রমিক। কাশ্মিরের উলার লেকের প্রচণ্ড দূষণের ফলে ওখানকার মৎস্যজীবীগণ চলে গিয়েছেন জম্মুতে এবং দিল্লিতে— তাঁরা অটো অথবা ট্যাক্সি চালান। নর্মদা বাঁধ তৈরি হওয়ার পর বহু মানুষ যে কোথায় গেছেন তার পরিসংখ্যান সঠিকভাবে ভারত সরকারের কাছেও নেই।

বড় বড় চওড়া রাস্তা তৈরি হচ্ছে, কাটা হচ্ছে লক্ষ লক্ষ গাছ— পৃথিবী গরম হচ্ছে। আমরা আমাদের ঘর ঠান্ডা করার জন্য এয়ারকন্ডিশন লাগাচ্ছি ও পৃথিবীকে আরও গরম করছি।

ভূ-উষ্ণায়নের ফলে সামুদ্রিক ঝড় ও বজ্রপাত বাড়ছে। আর এর ফলে চাষের অবস্থা ও চাষির অবস্থা খারাপ হচ্ছে। গ্রামে এখন প্রচলিত কথা ‘চাষে লাভ নেই’। চাষির ছেলে চাষ বাদ দিয়ে মোবাইলের দোকান দিচ্ছে। ঘনিয়ে আসছে এক ভয়ানক খাদ্যসঙ্কট।

‘সবুজ বিপ্লব’-এর যে খারাপ পরিণতি তা পাঞ্জাবের কৃষকগণ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছেন। একটি কৃষিনির্ভর রাজ্য কীভাবে তিলে তিলে শেষ হয়ে গেল আমরা তা প্রত্যক্ষ করেও অবুঝ।

আবার সুন্দরবনের কথায় আসি, চারিদিকে জল, কিন্তু পানীয় জল পেতে গেলে ১২০০ ফুট গভীর নলকূপ চাই। হ্যামিলটন সাহেবের সময় গোসাবাতে ২০০ ফুটেই সুন্দর পানীয় জল পাওয়া যেত। তাই তো ক্যানিং থেকে কলকাতার বাবুদের বাড়িতে কাজ করবার জন্য সকালবেলার একটি ট্রেনকে ঝিদের ট্রেন বলা হয়, যাঁরা সত্যিকারের কৃষিশ্রমিক হতে পারতেন।

প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও দূষণ যে ভয়ঙ্করভাবে মানুষের জীবন ও জীবিকাতে হাত দিয়েছে তার প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে নদিয়াতে যে ৬টি নদী নিয়ে আমরা কাজ করি সেগুলিতে। নদীর জল ভালো থাকলে মাছ পাওয়া যায়, কিন্তু বাংলাদেশের অপরিশোধিত বর্জ্যে (কেরু মদ কোম্পানি, বাংলাদেশ) চূর্ণি ও মাথাভাঙার সম্পূর্ণ জল কালো হয়ে যায়। এদিকে আবার বাদকুল্লা ও কৃষ্ণনগর শহরের নোংরা অপরিশোধিত জল, অঞ্জনা হয়ে চূর্ণিতে পড়ছে। ফলে মৎস্যজীবীদের আর কাজ নেই। তাঁরা কেউ ১০০ দিনের কাজে যান, কেউ ভ্যানচালক, কেউ টোটো চালিয়ে সংসার নির্বাহ করেন।

মৎস্যজীবীরা তাঁদের বংশানুক্রমিক জীবিকা থেকে অনেক দূরে যাচ্ছেন।

আমি সারারাত একজন মৎস্যজীবীর নৌকাতে থেকে বুঝেছি কী কষ্ট করে ওঁরা মাছ ধরেন। যেদিন মাছ হল সেদিন ওঁরা রাজা, কিন্তু তারপর আর সাত দিন মাছ নেই। যদি কেউ একদিন ১৫০০ টাকার মাছ পান, তাকে ৭ দিয়ে ভাগ দিলে যা হয় সেটাই তাঁর দৈনিক আয়। চূর্ণির পাড়ের গ্রাম গোবিন্দপুরের বাসিন্দা বাসুদা একজন মৎস্যজীবী— এই লকডাউনের আগে অভাবের ফলে হার্টের চিকিৎসা না করাতে পেরে মারা গেছেন।

তাঁর স্মরণসভাতে গিয়েছিলাম। আমি একদিন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি তো গোবিন্দপুরে প্রায় পঞ্চাশ বছরের বাসিন্দা। সেই সময় গোবিন্দপুর তো জঙ্গল ছিল। এখানকার মৎস্যজীবীরা তো প্রত্যেকেই দুই-এক বিঘে জমির মালিক। যখন বাংলাদেশের কেরু কোম্পানি চূর্ণিতে কালো জল ছাড়ে তখন তো মাছ পাওয়া যায় না, তখন কীভাবে চলে?

উত্তর দিলেন, চলে না বাবা। গ্রামের শাকপাতা সেদ্ধ খেয়ে চলে। আসলে আমরা তো কোনওদিন ভাবতে পারিনি নদীতে মাছ পাওয়া যাবে না।

নদীতে মাছ নেই, আকাশে পাখির দেখা মিলবে না— কীরকম ভয়াবহ লাগে না ভাবতে! তখন চূর্ণিতে বড় বড় বাগদা চিংড়ি। মাজদিয়া বা গেদের হাটে গেলেই বিক্রি। বাকিটা খাওয়া আর মাঠে তাস খেলা আর গল্পগুজব। সুন্দরভাবেই চলে গেছে জীবন। কিন্তু এই দূষণের ফলে নদীর পরিবর্তনের ফলে আজ অর্ধাহার। আসলে জল— জলাভূমির দূষণ যত বাড়ছে তত মৎস্যজীবীদের জীবিকার পরিবর্তন হচ্ছে।

এখন গ্রামীণ হাটের অবস্থাও খুব খারাপ। বড় বড় রাস্তার পাশে শপিং মল।

আর ‘চুক্তি চাষ’-এর ফলে হাটের গুরুত্ব আরও কমেছে। কৃষক এখন মাঠে শ্রমিক ও শপিং মলের দারোয়ান। চাষ করো আর পয়সা নাও, বাড়ি যাও— চুক্তি চাষের এই নিয়ম। তাই পরিবেশের অর্থনীতি এখন বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। প্রকৃতির সমস্ত বিষয় এখন পণ্য— জল থেকে বাতাস। পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার মূল কথা হল মুনাফা। তাই গাছ কাটো, মোবাইল টাওয়ার বসাও, সমুদ্র ও ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের শেষ করে সমুদ্রবন্দর বানাও। প্রকৃতিকে পাশে ও সঙ্গে রেখে জীবন-জীবিকার যে ধারণা তা এখন পুরাতন। তাকে মূল থেকে উৎপাটিত করে, ডিজিটাল ইন্ডিয়ার দিকে এগোও। এখন মুনাফামুখী পরিবেশপ্রেম। শিল্প-স্বাস্থ্য-শিল্পকর্ম-খেলাধূলা-সঙ্গীত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য থেকে শুরু করে ফুলের গন্ধ-শিশুর হাসি-নারীর কমনীয়তা-পুরুষের পেশল শরীর সব কিছুই এখন পণ্য। তাই এই মাৎস্যন্যায়, বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।

জীবন-জীবিকা ও মানুষের বেঁচে থাকা আরও দুরূহ হয়ে উঠবে। ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি শুধু সময়ের অপেক্ষা।