Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

রোমান্টিকতার ট্র্যাজিক স্রোত: দিলীপ কুমার

দিলীপ কুমার | অভিনেতা

চণ্ডী মুখোপাধ্যায়

 




সাংবাদিক, চলচ্চিত্রবেত্তা, বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভামুখ্য

 

 

 

 

 

প্রথম আলাপ হয় দিল্লিতে জাতীয় পুরস্কার অনুষ্ঠানে। সেবার দাদাসাহেব পুরস্কার পান দিলীপ কুমার। পারফেক্ট সাহেব। ঝকঝকে ইংরেজি বলেন। আদবকায়দাও ব্রিটিশ সাহেবদের মত। ভারতীয় সিনেমার সঙ্গে প্রায় সেই চল্লিশের দশক থেকে জড়িয়ে আছেন। বোম্বে টকিজের আমল থেকে। হিমাংশু রায় জার্মানি থেকে এসে বোম্বে টকিজ প্রতিষ্ঠা করেন। বিয়ে করলেন দেবিকা রানিকে। হিমাংশু রায়ের মৃত্যুর পর দেবিকা রানিই মালকিন বোম্বে টকিজের। দেবিকা রানিই প্রথম নায়ক করেন দিলীপকুমারকে। তখন ইউসুফ খান। হিন্দু নাম নিতে হবে, দেবিকা রানির অনুরোধ। তাই দিলীপ কুমার। পেশোয়ারের ছেলে ইউসুফ খান হলেন ভারতীয় সিনেমার দিলীপ কুমার। প্রথম ছবি ‘জোয়ার ভাঁটা’। পরিচালক ছিলেন বাঙালি। অমিয় চক্রবর্তী। এই ছবিতে তাঁর সঙ্গে অভিনয় করেন রুমা গুহঠাকুরিতা। দিলীপসাহেবের স্মৃতি তখনও ঝকঝকে। বান্দ্রায় তাঁর বাড়িতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। বাড়ি তো নয় প্রাসাদ। চেয়ার তো নয় যেন সিংহাসন। অনেকটাই মুসলিম স্থাপত্যধারায় তৈরি বাড়ি। সেই দ্বিতীয়বার দিলীপসাবের মুখোমুখি। বাংলায় ছবি করেছেন সেই সত্তরে। ‘সাগিনা মাহাতো’। পরিচালক তপন সিংহ। হি ইজ পারফেক্ট জেন্টলম্যান। তপন সিংহ সম্পর্কে দিলীপ কুমার জানালেন। “ওই ছবির শুটিং করতে গিয়ে বাংলাটা অনেকটা রপ্ত হয়। তবে সিনেমা জীবনের শুরুতে বাংলা পরিবেশ পেয়েছি। বোম্বে টকিজে বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন বাঙালি।”

সিনেমা জীবনের প্রায় ৫৪ বছর পেরিয়েও ভাঙা ভাঙা বাংলা বলতে পারেন। বোম্বে টকিজের ছবি দিলীপ কুমারকে দারুণ কোনও জনপ্রিয়তা দেয়নি। জনপ্রিয়তা পেলেন মেহমুদ খানের ‘আন্দাজ’ ছবিতে। প্রায় তিন বছর হল তখন ভারত ভাগ হয়েছে। দিলীপকুমারের জন্মভুমি পেশোয়ার তখন বিদেশ। ‘আন্দাজ’ ছবিতে তাঁর সহযোগী ছিলেন রাজ কাপুর এবং নার্গিস। ‘সুপার এন্টারটেনার’ রাজ কাপুর সম্পর্কে জানান দিলীপসাব। যখন এসব কথা হচ্ছে তখন দিলীপ কুমার হলেন গ্রান্ডম্যান অফ ইন্ডিয়ান সিনেমা। এভারগ্রিন। চিরকালই। নাহলে তার চেয়ে ২২ বছরের বড় এক চিরযুবক দিলীপ কুমারকে বিয়ে করেন সায়রাবানু। তাঁদের প্রেম রূপকথার মতই। দিলীপকুমার আমৃত্যু পাশে পেয়েছেন স্ত্রী সায়রাকে।

রাজ কাপুরের পাশে নিজেকে দাঁড় করার জন্যে তিন-এক মেথড-অ্যাক্টিং প্রতিষ্ঠা করেন দিলীপ কুমার। যা তাঁর সমসাময়িক সমস্ত নায়কদের থেকে আলাদা। নির্মাণ করেন অভিনয়ের স্বনির্মিত অন্য এক ধারা। পঞ্চাশ দশকটা যেন দিলীপ কুমারই। পর পর হিট— বাবুল, হালচাল, আন, ইনসানিয়ৎ, দীদার, তারানা, দাগ, সাং দিল, নয়া দৌড়, মধুমতী প্রমুখ।

আর ১৯৬০-এ কে এল আসিফের ‘মুঘল-এ আজম’-এ সেলিম। সেখান থেকেই তিনি হয়ে উঠলেন বোম্বাই সিনেমার ট্র্যাজিক কিং। সুপারস্টার হয়ে ওঠার পরেই নিজেই প্রযোজনায় নামলেন ‘গঙ্গা যমুনা’। দিলীপ কুমারের লেখা গল্প পরিচালনা করলেন নীতিন মুখোপাধ্যায়। নায়িকা বৈজয়ন্তীমালা। “ছবিটি আটকে দিয়েছিল সেন্সর বোর্ড। ২৫০টা কাট দিয়েছিল। আমি ব্যক্তিগতভাবে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু এবং তথ্যমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে মিনিট পনেরো কথা বলি। ওঁদের হস্তক্ষেপে ছবিটি আন-কাট মুক্তি পায়।“

হলিউড থেকে ডাক পেয়েছিলেন দিলিপসাব। লরেন্স অফ অ্যারাবিয়া-তে। ফিরিয়ে দেন। শেষ অবধি রোলটা করেন ওমর শরিফ।

তাঁর একটাই আফসোস তিনি শুধু ট্র্যাজিক কিং কেন? সত্যিই তো তিনি তো রিল ও রিয়েল লাইফে রোমান্টিকতার রাজা। তাঁর সঙ্গে যে সব নায়িকা কাজ করেছেন তাঁরা কোনও না কোনও সময়ে প্রেমে পড়েছেন তাঁর। মধুবালা বৈজয়ন্তীমালা, ওয়াহিদা রেহমান, এইরকম আরও অনেকেই। শোনা যায় ওয়াহিদা নাকি বিয়েও করতে চেয়েছিলেন দিলীপ কুমারকে। সায়রাকে বিয়ে করার পরেও তো বিয়ে করলেন আসমা রেহমানকে। ভুল স্বীকার করে অবশ্য আবার ফিরেও এলেন সায়রার কাছেই। আর আশির দশকে ইনি তো নিজেকে পালটে নিয়ে হয়ে উঠলেন নায়ক থেকে চরিত্রাভিনেতা। আমরা দেখলাম দিলীপ কুমারকে ‘শক্তি’ ছবিতে। অমিতাভের বাবা। সে এক অসামন্য অভিনয়— মাইলফলক গড়ে দিল হিন্দি সিনেমায়।

সেঞ্চুরি ছোঁয়ার বছর দুয়েক আগে চলে গেলেন বলিউডের প্রথম খান— ইউসুফ খান। রেখে গেলেন সিনেমা অভিনয়ের এক ব্যতিক্রমী ইতিহাস। যা স্বমহিমায় উজ্জ্বল।