Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

কোভিড-১৯: সন্দেহ, সন্দেহ-বাতিক, এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব — শেষ পর্ব

সুব্রত রায়

 


ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য

 

 

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ফ্লু-যোগে ফ্লুক?

‘প্ল্যানজ়াইটি’ ন্যারেটিভের গোড়ার কথাই হল এটি। ডাঃ স্থবির দাশগুপ্ত কোভিড-১৯ রোগটাকে বড় জোর ‘ব্যাড ফ্লু’ বলতে রাজি আছেন! এ কথা সত্য যে, কোভিড-১৯ আর মরশুমি ইনফ্লুয়েঞ্জা— দুটো রোগের মধ্যে অনেক মিল। দুটোই মূলত শ্বাসতন্ত্রের অসুখ। উভয়েরই ক্ষেত্রে রোগের প্রকোপ মৃদু থেকে তীব্র অবধি হতে পারে। রোগলক্ষণেও অনেক মিল। জ্বর, কাশির প্রকোপ, গলাব্যথা, স্বাদগন্ধ চলে যাওয়া, অপরিসীম ক্লান্তি; উভয় ভাইরাসই নিউমোনিয়া ঘটাতে সক্ষম। এ কারণে প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষানিরীক্ষা ছাড়া কেবলমাত্র লক্ষণ দেখে এদের চিহ্নিত করা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। খুব সম্ভব, এই বিষয়টির জন্যই কোভিড-১৯কে অনেকে ইনফ্লুয়েঞ্জার অতিরিক্ত কিছু ভাবতে পারেন না। আশ্চর্যের কথা হল, উহানে যখন প্রথম রোগটার উৎপত্তি হল, তখন অধিকাংশ রোগীর মধ্যেই একসঙ্গে দুটো ভাইরাসের উপস্থিতি (coinfection) লক্ষ করা গিয়েছিল। সার্স-কোভ-২-র সঙ্গে সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার ভাইরাসেরও অনেক সাদৃশ্য। উভয়েই এক-তন্তু বিশিষ্ট আরএনএ ভাইরাস, পোষক কোষে সেঁধিয়ে উভয়েই কায়দা করে তাদের আরএনএ-কে বের করে দেয় আর কোষটাকে বাধ্য করে ওই আরএনএ-র কপি করে যেতে। উভয়েই অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজারের মধ্যে বেশিক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে না।

কিন্তু, দুটো রোগের অনেক সাদৃশ্য থাকলেও অনেকগুলি বিষয়েই বেশ কিছু বৈসাদৃশ্যও আছে, শেষ বিচারে যা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়:

(১) দুটোই শ্বাসতন্ত্রের অসুখ হলেও কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টের সমস্যা তীব্র হয়ে দাঁড়ায়, যা কখনও কখনও রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মারাত্মকভাবে নামিয়ে এনে রোগীকে মেরে ফেলতে পারে। মূলত এ সমস্যার কারণেই শারীরিক অবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটতে বেশি দেখা যায় কোভিড সংক্রমণের বেলায়।

(২) সার্স-কোভ-২-র তুলনায় ফ্লু ভাইরাস দ্রুত রোগ ছড়ানোর উপযোগী হয়ে উঠতে পারলেও (ইনকিউবেশন সময় যথাক্রমে ১-১৪ দিন ও ১-৪ দিন), প্রথমটির সংক্রামক ক্ষমতা অনেকটা বেশি। কোভিড-১৯-র ক্ষেত্রে R0-এর মান ২-২.৫, তুলনায় মরশুমি ফ্লু ভাইরাসের R0-এর মান ১.৩ মাত্র।[1]

(৩) কোভিডে মৃত্যুর হার সম্পর্কে এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া গেলেও (আনুমানিক ০.৪-১.৫ শতাংশ), সর্বনিম্ন হিসেব ধরলে তা ফ্লু-র (০.১ শতাংশ) চেয়ে অন্তত চার গুণ বেশি। তবে এই মৃত্যুহার ফ্লু-র চেয়ে বেশি হলেও প্রায় ৮০ শতাংশ রোগী সম্পূর্ণ লক্ষণহীন বা মৃদু উপসর্গযুক্ত থাকেন, ২০ শতাংশ রোগীর চিকিৎসার দরকার হয়, যাদের মধ্যে ৫ শতাংশ রোগী সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে চলে যান।[2]

(৪) শিশুরা ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনায় ও বাহক হিসেবে কাজ করায় এগিয়ে থাকে। বিপরীতে বয়ঃসন্ধিকাল বা তার নীচে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা খুবই কম। ষাটোর্ধ্ব মানুষের ক্ষেত্রে, বিশেষত যাদের উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাঁপানি বা স্থূলতার সমস্যা আছে, তাদের ক্ষেত্রে কোভিডের প্রকোপ অত্যন্ত বেশি। এ প্রসঙ্গে অনেকে বলছেন যে, কোভিড-সংক্রমণে মৃতের একটা বড় অংশ মারা গিয়েছেন শরীরের ওইসব সমস্যায় (comorbidity), কাজেই প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুর সংখ্যা যা দেখানো হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক কম। এটি কুযুক্তির সপক্ষে নেওয়া একটি অমানবিক অবস্থান তো বটেই, একই সঙ্গে পরিসংখ্যানগত হিসেবনিকেশের দিক থেকেও যুক্তিটি বোধগম্য হয় না। বার্ধক্য ও শারীরিক অসামর্থ্যের কারণে কাউকে যেমন ‘খরচের খাতায়’ ফেলে দেওয়া যায় না, তেমনি সত্য এটাও যে কোভিড-সংক্রমণ না ঘটলে ওই ব্যক্তিদের অনেকেরই জীবন দীর্ঘায়িত হত।

(৫) কোষের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার গ্রাহকে প্রভেদ হয়ে যাওয়ায় ফ্লু ভাইরাসের সঙ্গে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্যটি তৈরি হয়ে যায়। করোনা ভাইরাসের খোলকের গায়ে উঁচিয়ে থাকা ‘স্পাইক’ প্রোটিন পোষক কোষের এসিই-২ নামক গ্রাহক উৎসেচকের সঙ্গে যুক্ত হয়। এই উৎসেচকটি আবার শরীরে রক্তে লবণের ভারসাম্য রক্ষা করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে। ফলে সার্স-কোভ-২ যথেষ্ট সংখ্যায় বংশবিস্তার করতে পারলে কেবল শ্বাসযন্ত্রের অসুখ তৈরির মধ্যে নিজেকে আর সীমায়িত রাখে না, মস্তিষ্ক ও হৃদযন্ত্রের স্ট্রোকও ঘটাতে থাকে। শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গগুলিও একে একে আক্রান্ত হয়। কোভিডে মৃত রোগীর দেহ ব্যবচ্ছেদ করে দেখা গেছে, কেবল ফুসফুসেই নয়, হৃদপিণ্ড, বৃক্ক, যকৃৎ, মস্তিষ্ক, রক্ত সর্বত্রই ভাইরাসের উপস্থিতি। এটি নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, কোভিড-১৯ শ্বাসতন্ত্র ছাড়াও পরিপাকতন্ত্র, স্নায়ুতন্ত্র, রেচনতন্ত্র, রক্তসংবহনতন্ত্রে আঘাত হানতে সক্ষম।[3] সেরে ওঠার পরও কোভিড-আক্রান্ত ব্যক্তির কিছু কিছু গুরুতর শারীরিক গোলযোগের তথ্যও সামনে আসতে শুরু করেছে।

(৬) মরশুমি ফ্লু ভাইরাসের ক্ষেত্রে কম তাপমাত্রা ও কম আর্দ্রতা টিঁকে থাকতে সাহায্য করে, তাই গরমকালে এর প্রকোপ দেখা যায় না। করোনা ভাইরাসের এরকম কোনও আবহাওয়াজনিত সীমাবদ্ধতার কথা এখনও জানা যায়নি।

কাজেই, বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপরে নির্ভর করলে কোভিড-১৯-কে কিছুতেই সাধারণ ইনফ্লুয়েঞ্জার সঙ্গে একাসনে বসানো যায় না, বসালে তা হবে ঘোরতর অবহেলা ও অবমূল্যায়নের সামিল। একই সঙ্গে, উল্লেখ করতে হবে এর রহস্যময়তার কথাও। শিশুদের মধ্যে যেমন রোগভিত্তিক ইমিউনিটি কম থাকার কথা, তেমনি অভুক্ত-অর্ধভুক্ত মানুষদের মধ্যে সাধারণভাবে রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতাও কম হওয়া স্বাভাবিক। অথচ কোভিড-১৯-এর ক্ষেত্রে শিশুদের ও দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা নিতান্তই কম। উপরন্তু, ঘনবসতিপূর্ণ অস্বাস্থ্যকর এলাকায় এর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ার কথা ছিল, অথচ মুম্বইয়ের ধারাভি বস্তি কিংবা দিল্লির চাঁদনি চক এলাকায় অতিমারির প্রভাব এখনও পর্যন্ত যৎসামান্য। তথ্যগুলি সংক্রামক রোগ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞানকেই যেন চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে! দুঃখের বিষয়, স্থবির দাশগুপ্ত এ দুর্বোধ্যতাকে গুরুত্ব দিতে রাজি তো ননই, বরং তিনি একে ক্ষমতাবানদের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আমজনতার বিজয় হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন।[4] যদিও, সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ-এর সময়ে আমরা কিন্তু দেখতে পাচ্ছি, গ্রামেও ছড়াচ্ছে সংক্রমণ, এবং রেহাই পাচ্ছে না শিশুরাও।

টিকা বিষয়ক টীকাটিপ্পনী

কোভিড-টিকা নিয়ে ধুন্ধুমার বিশ্বজুড়ে, ভারতেও। টিকার প্রত্যাশায় দীর্ঘ প্রতীক্ষা, নির্ধারিত ডোজ়ের সময়সীমা পেরিয়ে যাওয়া, বিনামূল্যের টিকার পাশাপাশি নগদ কড়ি ফেলে নেওয়ার সমান্তরাল ব্যবস্থা আর রাষ্ট্রের ভাবলেশহীন নীরবতা এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে আমাদের। এরই সঙ্গে চলছে টিকা-বিরোধী নানান প্রচারণা। সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বাতাবরণ পুঞ্জীভূত হয়ে উঠেছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের এক নতুন ও অনিশ্চিত আবিষ্কারকে ঘিরে, যা নাকি উঠে এসেছে প্রবল তাড়াহুড়োর প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে। সভ্যতার ইতিহাস সাক্ষী, তাৎক্ষণিকভাবে হয়তো সব দ্বিধাদ্বন্দ্বের নিষ্পত্তি সম্ভব হয় না, কিন্তু মিথ্যার জাল কেটে রাস্তা করে নিলে জানা-অজানার সীমানাটা অন্তত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

গোয়ালাদের নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে অষ্টাদশ শতকের শেষে ব্রিটিশ চিকিৎসক এডওয়ার্ড জেনার সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণের যে দিশা দেখিয়েছিলেন, ঊনবিংশ শতকের শেষভাগে ফরাসি জীববিজ্ঞানী লুই পাস্তুর তার কার্যকারিতার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হাজির করেন। গুটি বসন্ত, জলাতঙ্ক, পোলিও, টিটেনাস ইত্যাদি রোগ নিরাময়ে টিকা যুগান্তকারী ভূমিকা পালন করেছে। টিকা আজ জনস্বাস্থ্যব্যবস্থার মূল স্তম্ভ। কিন্তু মজার কথাটি হচ্ছে, টিকা-বিরোধিতার ইতিহাসও টিকা আবিষ্কারের মতোই প্রাচীন এবং তা আজও বহমান। জেনারকে প্রথমে তার সহকর্মীদের কাছ থেকেই বাধা পেতে হয়েছিল। ঊনবিংশ শতকের মাঝামাঝি দেখা যায়, মূলধারার চিকিৎসায় টিকা খানিকটা গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠল বটে, কিন্তু পাশাপাশি ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় টিকাকরণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত আন্দোলনও দানা বাঁধতে লাগল। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে এল নেচারোপ্যাথি সমর্থকরা, চিকিৎসা গবেষণায় জীবজন্তু ব্যবহারের বিরুদ্ধাচরণকারীরা (anti-vivisectionists) এবং হোমিওপ্যাথরা। ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত জনৈক হোমিয়োপ্যাথের রচনা থেকে এই আপত্তির ধরন জানা যায়। টিকা-বিরোধীরা এই বলে শোরগোল তুলেছিলেন যে, টিকা নাকি সিফিলিস, যক্ষা ও চর্মরোগের মতো বিভিন্ন সুপ্ত রোগকে জাগিয়ে তুলছে।[5] ২০০২ সালের একটি সমীক্ষাতেও উঠে আসে যে, ব্রিটিশ হোমিওপ্যাথদের প্রায় অর্ধেকই রোগীদের এমএমআর টিকা না নিতে উৎসাহিত করছেন।[6]

টিকার যাবতীয় সাফল্য উপেক্ষা করে টিকা-বিরোধিতার এই উত্তরাধিকার আধুনিক পৃথিবীতেও টিকে আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নানান দেশে টিকা-বিরোধীদের একাধিক জোরদার সংগঠন আছে। জেনে আশ্চর্য হতে হয় যে, মার্কিন স্বাস্থ্যব্যবস্থায় টিকার আওতায় আসা মানুষের সংখ্যা শতাংশের হিসেবে আমাদের দেশের চেয়ে অনেক কম, প্রসূতিরা সকলে টিকা না নেওয়ায় ও দেশে প্রচুর সদ্যোজাত টিটেনাসে মারা যায়। বস্তুত, টিকা-বিরোধীরা জনস্বাস্থ্যে টিকার গুরুত্ব অস্বীকার করে। নানাবিধ কুযুক্তির পাশাপাশি এদের দুটো উচ্চতর ‘দর্শন’ আছে: (১) সংক্রামক রোগের প্রকোপ কমে আসাটা টিকার কল্যাণে ঘটেনি, তা ঘটেছে উন্নত স্বাস্থ্যবিধি ও বর্জ্য নিষ্ক্রমণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার কল্যাণে; (২) রোগ সংক্রমণ দ্বারা অর্জিত ইমিউনিটি টিকা দিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি হওয়া ইমিউনিটির চেয়ে উন্নততর। বলা বাহুল্য, দুটিরই কোনও ঐতিহাসিক সাক্ষ্য ও বৈজ্ঞানিক সারবত্তা নেই। চলতি অতিমারির আবহে দেখতে পাচ্ছি, এই দ্বিতীয় যুক্তিটি ‘প্ল্যানজ়াইটি’ ন্যারেটিভে কখনও কখনও জায়গা তৈরি করে নিচ্ছে। ওই প্রশ্নটির আলোচনার মধ্যে দিয়ে প্রথম প্রশ্নটিরও কিছুটা মীমাংসা হতে পারে।

রোগ সংক্রমণে তৈরি হওয়া ইমিউনিটি আর টিকার সাহায্যে অর্জিত ইমিউনিটির মধ্যে কোনটি শ্রেষ্ঠ— এ প্রশ্নের উত্তর এক-কথায় দেওয়া কঠিন। কারণ আমরা শরীরের অত্যন্ত জটিল একটি ব্যবস্থা নিয়ে মন্তব্য করতে যাচ্ছি, যার ভালোমন্দ অনেকগুলি বিষয়ের উপরে নির্ভর করে। যেমন, ধরা যাক, সংক্রমণের তীব্রতার বিষয়টি। রোগ সংক্রমণের তীব্রতা যদি বেশি হয়, তাহলে শরীরে যতখানি ইমিউনিটি গড়ে ওঠে, মৃদু সংক্রমণে ততটা হয় না। আবার, বিভিন্ন টিকা নির্দিষ্ট রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি গড়ে তোলে ঠিকই, কিন্তু সকল টিকার কর্মপদ্ধতি এক নয়। অন্তত ১০ রকম পদ্ধতিতে কোভিড ১৯-এর টিকা প্রস্তুত করা হয়েছে বা হচ্ছে, যারা ভিন্ন-ভিন্নভাবে শরীরে ইমিউনিটি তৈরির চেষ্টা করবে। উপরন্তু, বিষয়টি ভাইরাসের প্রকৃতির উপরেও নির্ভর করে। যেমন, হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি)-এর ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সংক্রমণে খুবই দুর্বল ইমিউনিটি তৈরি হয়, কারণ এই ভাইরাসটি নানা কায়দায় প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পারে। এক্ষেত্রে ইমিউনিটি তৈরির উপযোগী ভাইরাসের নির্দিষ্ট শারীরিক উপাদানকে টিকার মধ্যে ব্যবহার করে অনেক বেশি ইমিউনিটি নিশ্চিত করা গেছে। হয়তো এর কারণ হল এটি যে, ভাইরাসের খোলক-প্রোটিনের গাঢ়ত্ব স্বাভাবিক সংক্রমণের তুলনায় টিকার মধ্যে বেশি থাকা। আবার, কোনও কোনও ক্ষেত্রে এর উলটো ঘটাও অসম্ভব নয়। কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে, টিকা কিন্তু কেবলমাত্র রোগের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত সুরক্ষা নিশ্চিত করে না, তার অন্যতম লক্ষ্য হল জনগোষ্ঠীকে বাঁচানো। স্বাভাবিক সংক্রমণ দিয়ে গোষ্ঠী ইমিউনিটি (herd immunity) গড়ে তোলা কিন্তু সহজ নয়। যেমন, হাম ও পোলিও-র ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৯৫ শতাংশ ও ৮০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ইমিউনিটি না গড়ে উঠলে গোষ্ঠী ইমিউনিটি অর্জিত হয় না। কোভিড ১৯-এর বেলায় এই শতাংশটি কত তা আমরা এখনও জানি না বটে, কিন্তু বছরাধিক কাল ধরে একটি অতি-সংক্রামক রোগের দাপটের পরেও জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বেশি এখনও সংক্রামিত হয়নি। যদি ধরেও নিই যে, সংক্রামিত প্রতিটি ব্যক্তির ভবিষ্যৎ প্রতিরক্ষার উপযোগী ইমিউনিটি তৈরি হয়েছে, তাহলেও তা গোষ্ঠী ইমিউনিটির জন্য কাঙ্ক্ষিত মানের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি। সুইডেন অতিমারির প্রথম ঢেউ চলাকালীন স্বাভাবিক সংক্রমণজাত সুরক্ষা তৈরির চিন্তাভাবনা করে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলির তুলনার সুইডেনের মৃত্যহার কিন্তু কম ছিল না, তা সত্ত্বেও জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রেখে দেওয়া হয়। গভীর খেদের কথা হল, এই পদ্ধতি অসফল হয়েছে, দ্বিতীয় ঢেউয়ে সুইডেন সংক্রমণ রুখতে জনজীবনে নানারকম বিধিনিষেধ আরোপ করতে বাধ্য হয়েছে।[7] তাহলে কি উচিত হত আরও কিছুকাল অপেক্ষা করা? এখানেই এসে পড়বে নৈতিকতার প্রশ্ন, কারণ, এ হল এক বিপুল সংখ্যক মানুষের মৃত্যু ও অসুস্থতার বিনিময়ে গোষ্ঠী ইমিউনিটি অর্জনের খোয়াব দেখা। গত বছর অক্টোবর মাসে বিশ্ববিখ্যাত জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’-এ ৬৯০০ জন বিজ্ঞানী দ্বারা স্বাক্ষরিত অতিমারি বিষয়ক একটি সর্বসম্মত সাবধান-বার্তা প্রকাশিত হয়েছে, যাতে মন্তব্য করা হয়েছে যে, সংক্রমণ দ্বারা অর্জিত ইমিউনিটির সাহায্যে কখনই অতিমারি রোধ করা যাবে না, বরং পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে অতিমারি দীর্ঘায়িত হবে।[8] কাজেই, জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে গেলে টিকার ভূমিকা কোনওভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। অন্যদিকে, পরিছন্নতা, স্বাস্থ্যকর অভ্যেস, উন্নত বর্জ্য নিষ্কাশন, পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা— এগুলিও জনস্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এগুলো সংক্রমণের সম্ভাবনাকে অনেকাংশে কমিয়ে আনে, কিন্তু পুরোপুরি নির্মূল করতে পারে না। পৃথিবীতে যত অসাম্য থাকবে, মুনাফার লোভে উৎপাদন চলবে, প্রাকৃতিক সম্পদ নিঃশেষিত হবে, জনসংখ্যা বাড়বে, ততই সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়বে। কেবলমাত্র স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন দিয়ে রোগ প্রতিরোধ করা দুষ্কর হয়ে উঠবে, চলতি অতিমারিতে ইউরোপের অনেক দেশের উন্নততর জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা ব্যবস্থার দিকে তাকালে তা বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।

সনাতন টিকা-বিরোধীদের ওজর-আপত্তির অন্ত নেই! তারা ভুয়ো ও বাতিল গবেষণা দেখিয়ে (টিকার সঙ্গে অটিজ়ম-এর যোগসূত্রের অভিযোগ), ধর্মীয় কারণ হাজির করে (সংরক্ষিত ভ্রূণকোষ ব্যবহারের অভিযোগ), টিকার সাহায্যে রোগ সৃষ্টির অভিযোগ তুলে (ফ্লু টিকা থেকে কোভিড ১৯-এর সৃষ্টি সংক্রান্ত মাইকোভিট্‌স্-এর তত্ত্ব, নাইজিরিয়া ও ভারতের কিছু জনগোষ্ঠীর মধ্যে পোলিও টিকার সাহায্যে বন্ধ্যাত্ব তৈরির অভিযোগ) কিংবা তিলকে তাল করে (জীবাণুদের নিষ্ক্রিয়কারক হিসেবে টিকায় খুবই সামান্য পরিমাণে ফর্ম্যালডিহাইডের ব্যবহারে আপত্তি) বিভ্রান্ত করতে অভ্যস্ত। চলতি অতিমারিতে দেখা যাচ্ছে টিকা-বিরোধী আঁতুড়ঘরের কিছু তত্ত্ব জ্ঞানীগুণী মহলেও বেশ সাড়া ফেলেছে। এর অন্যতম হল টিকায় জিনপ্রযুক্তি ব্যবহারে আপত্তি, ‘প্ল্যানডেমিক’ ও ‘প্ল্যানজ়াইটি’ উভয় ন্যারেটিভেই যার সরব উপস্থিতি। জিনপ্রযুক্তি হল জীবদেহের কোষমধ্যস্থ ক্রোমোজ়োমে থাকা বংশগতির ধারক ও বাহকরূপে চিহ্নিত ‘জিন’-এ সরাসরি কারিকুরি ঘটানো। অতীতে কৃষিতে জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহারে আপত্তির ধরন ছিল চার রকম— নৈতিক (খোদার ওপর খোদকারি-র বিরুদ্ধে ধর্মীয় আপত্তি সহ), জৈব (ভোক্তার শারীরিক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া), ইকোলজিগত (খাদ্যশৃঙ্খলে বিপর্যয় ঘটা) ও অর্থনৈতিক (দেশীয় সনাতন প্রজাতিগুলির তুলনায় উৎপাদন ব্যয় প্রথমে কম থাকলেও প্রযুক্তির সত্ত্বাধিকারগত কারণে পরে তা একই থাকবে কিনা)। জিনপ্রযুক্তি নির্মিত খাদ্যদ্রব্যে শারীরিক ক্ষতি সংক্রান্ত অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়া গেলেও পরিবেশের ওপরে এর প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। বর্তমানে কিছু কিছু দেশে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদনে এর ব্যবহার হচ্ছে, যদিও এই প্রযুক্তির প্রতিটি প্রয়োগের জন্য দেশের সংশ্লিষ্ট অনুমোদনকারী সংস্থার ছাড়পত্র আবশ্যিক। শাকসবজি আর মাংস উপাদনকারী প্রাণীদের জিন-এ অদলবদল বিতর্কিত হলেও জৈবপ্রযুক্তির সাহায্যে জীবজন্তুকে রেহাই দিয়ে আজকে ব্যাকটিরিয়ার দেহে দিব্যি ইনসুলিন উৎপাদন করা হচ্ছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ এর সুফল পাচ্ছে। জিনপ্রযুক্তির সাহায্যে টিকা প্রস্তুতিও এই প্রথম নয়, হেপাটাইটিস বি-এর টিকা এভাবেই তৈরি এবং বিগত কয়েক দশকে বহুল ব্যবহৃত হয়েছে। জিনপ্রযুক্তি ব্যবহারের কুফল হিসেবে এতে কোনও বিশেষ পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তথ্যও উঠে আসেনি।

সার্স-কোভ ২-র টিকা বানাতে জিনপ্রযুক্তি ব্যবহারে ঝোঁকের পেছনে মূল কারণ হল, এই প্রক্রিয়ায় পরীক্ষানিরীক্ষা করে টিকা প্রস্তুত করতে সনাতন পদ্ধতির তুলনায় সময় লাগে অনেক কম। আরেকটি বিষয়ও একেবারে অমূলক নয় যে, সরাসরি মৃত বা অর্ধমৃত ভাইরাস ব্যবহার করে সনাতন পদ্ধতিতে টিকা বানালে এর মধ্যে যদি ত্রুটিবশত কোনও ভাইরাস জীবিত থেকে যায়, তাহলে ঘোরতর সমস্যা উপস্থিত হয়। ২০১৯ সালে আফ্রিকার অন্তত চারটি দেশে যে পোলিওর প্রকোপ দেখা গিয়েছিল, তার জন্য দায়ী ছিল টিকার মধ্যে থাকা বিবর্তিত জীবাণু। তবে, একই সঙ্গে, এখানে দুটি তথ্য দেওয়া দরকার: (১) সার্স-কোভ-২ টিকার সবগুলিতেই জিনপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়নি (যেমন, কোভ্যাক্সিন)। (২) টিকা তৈরিতে মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA) ব্যবহার করে নির্মিত টিকাগুলি (যেমন, বায়োএনটেক/ফাইজ়ার এবং মডার্না নির্মিত টিকা) বাদ দিলে জিনপ্রযুক্তির অন্যান্য কায়দাগুলি অপেক্ষাকৃত পুরনো। কেউ কেউ এমনও অভিযোগ করছেন যে, আরএনএ ভাইরাসের টিকা বানানো নাকি সম্ভবই নয়। কথাটা নির্জলা মিথ্যে। পোলিও, এমএমআর টিকা আরএনএ ভাইরাসের বিরুদ্ধেই সুরক্ষা দেয়। আরএনএ ভাইরাসের ক্ষেত্রে সমস্যা হল, দ্রুতগতিতে এর জেনেটিক পরিবর্তন ঘটতে থাকে, তাই অনেক টিকাকেই নির্দিষ্ট সময় অন্তর নতুন ‘স্ট্রেন’ ব্যবহার করে নতুনভাবে প্রস্তুত করতে হয়। যেমন, ইনফ্লুয়েঞ্জার টিকায় প্রতি বছর বদল আনতে হয়। অতিমারি নিয়ন্ত্রণের কথা ভেবে ২০২০ সালে যে নতুন প্রযুক্তি অনুমোদন করা হয়েছে, তা হল টিকায় সার্স-কোভ ২ ভাইরাসের মেসেঞ্জার আরএনএ ব্যবহার করা। এটি নিয়েও টিকা-বিরোধীদের অভিযোগ হল, তা নাকি আমাদের শরীরের জেনেটিক পরিবর্তন ঘটিয়ে দেবে। এই প্রযুক্তিটি অপরীক্ষিত হলেও জিন থেরাপিতে যেমন শরীরের ত্রুটিপূর্ণ জিন বদলের চেষ্টা করা হয়, এখানে তেমন সম্ভাবনা একেবারেই নেই। মেসেঞ্জার আরএনএ-র কাজ হল কোষমধ্যস্থ রাইবোজ়োমকে প্রোটিন তৈরির নির্দেশ দেওয়া। ভাইরাসের শরীর থেকে এমআরএনএ-র একটা অংশ কোশের মধ্যে ঢুকিয়ে দিলে তা ঢুকে যাওয়া কোষগুলির রাইবোজ়োমকে সার্স-কোভ ২ ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন তৈরি করার নির্দেশ দেয়। এর পরেই শরীরে ওই প্রোটিনকে ধ্বংস করার উপযোগী অ্যান্টিবডি ও টি-সেল তৈরি হবে, যা ভবিষ্যৎ আক্রমণের জন্য শরীরকে প্রস্তুত করবে। এই প্রক্রিয়ায় গোটা ভাইরাস দেহে ঢোকে না বলে সংক্রমণের কোনও ভয় থাকে না এবং ভাইরাস এমআরএনএ কোষের নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রবেশ করে না বলে টিকা গ্রাহকের কোষের ক্রোমোজ়োমেও কোনও বদল ঘটার সম্ভাবনা থাকে না।[9]

এবারে কোভিড ১৯-এর টিকা এখনও পর্যন্ত কতটা সফল, তা বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। টিকা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে হলে এ ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বের নিরসন হওয়া প্রয়োজন। কয়েকটি বিষয় খতিয়ে দেখা দরকার:

(১) টিকা হল একটি ওষুধ। একটি রাসায়নিককে ওষুধ হয়ে উঠতে গেলে তার কার্যকারিতা ও নিরাপত্তা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া দরকার। ওষুধবিজ্ঞানে এজন্য নিয়মনীতি স্থির করা আছে। শুধুমাত্র পরীক্ষাগারে মনুষ্যেতর প্রাণীদের ওপর বা সীমিত সংখ্যক মানুষের ওপরে প্রভাব যাচাই করলে ওষুধের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল বোঝা যায় না। প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ। আমাদের অনেকরই হয়তো জানা আছে যে, অতিমারিজনিত আপৎকালীন পরিস্থিতিতে নিয়মকানুন শিথিল করে টিকাগুলিকে জরুরি ভিত্তিতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। কাজেই, পরীক্ষানিরীক্ষার কতকগুলি বিষয় বাদ রেখেই তা প্রয়োগ করা হচ্ছে। অনুমোদন দেওয়া সকল টিকার ক্ষেত্রেই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানতে বাকি আছে যে, ওই টিকা নিলে সার্স-কোভ-২-র বিরুদ্ধে কতখানি অনাক্রম্যতা তৈরি হবে (immunogenicity) এবং তা টিঁকবে কতদিন। এরই মধ্যে কিছু প্রাণঘাতী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তথ্যও প্রকাশিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রোজেনেকা নির্মিত ‘কোভিশিল্ড’ প্রয়োগে রক্ত জমাট বাঁধার তথ্য সামনে এসেছে। ডেনমার্ক, নরওয়ে, জার্মানি ও ফ্রান্স এই ঘটনা সামনে আসতেই টিকাকরণ সাময়িকভাবে স্থগিত রাখে। ডেনমার্ক পরে এই টিকাকে পুরোপুরি বাতিল করে দেয়। নরওয়ের ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেল্‌থ-ও ওদেশের সরকারের কাছে এই টিকা বাতিল করার সুপারিশ করেছে। অবশ্য জার্মানি ও ফ্রান্স পুনরায় এই টিকা দিচ্ছে। ‘কোভিশিল্ড’-এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার যে তথ্য এখনও অবধি পাওয়া গেছে, তাতে স্পষ্ট যে, বিরূপ প্রতিক্রিয়া ঘটেছে খুবই অল্প সংখ্যক মানুষের মধ্যে। যেমন, ডেনমার্কে ৫০ লক্ষ গ্রহীতার মধ্যে মাত্র ৩০টি রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে।[10] স্কটল্যান্ডেও প্রতি ১ লক্ষ টিকা পিছু ১টি রক্ত জমাট বাঁধার ঘটনা জানা গেছে। আমাদের দেশে প্রস্তুত অন্য একটি টিকা ভারত বায়োটেক নির্মিত ‘কোভ্যাক্সিন’-এর ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের সুনির্দিষ্ট তথ্যই পাওয়া মুশকিল। বর্তমান লেখাটি তৈরি সময়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটে কেবল দুটো ধাপের নিবন্ধনের কথা উল্লিখিত আছে। সেখানে আরও বলা আছে যে, প্লাসিবোর বিপরীতে এর কোনও কার্যকারিতার পরীক্ষা করা হয়নি।

(২) টিকা সত্যিই রোগের প্রকোপ কমাচ্ছে কিনা, তা বুঝতে অনেকগুলি তথ্য জানা দরকার। কতজন ব্যক্তি টিকা দেওয়ার পরেও আক্রান্ত হয়েছেন ও হননি এবং যারা আক্রান্ত হলেন তাদের সংক্রমণের তীব্রতা কেমন— এই তথ্যগুলির তুলনা করতে হবে টিকা না গ্রহণ করা ও আংশিকভাবে টিকা গ্রহণ করা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে পাওয়া উপরোক্ত তথ্যগুলির সঙ্গে। উপরন্তু, সংখ্যাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি ব্যক্তির ক্ষেত্রে দেখা দরকার যে, রোগসংক্রমণের দিক থেকে তিনি কতখানি ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন, সংক্রামিত হয়ে কোন মানের চিকিৎসা পেয়েছেন বা কেমনভাবে জীবনযাপন করেছেন ইত্যাদি তথ্যও। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, টিকার প্রয়োগ ঘটছে অতিমারি চলাকালীন ‘রিয়্যাল-ওয়ার্ল্ড’-এর বিশৃঙ্খলা আর জটিলতার মধ্যে। কাজেই, তথ্য সংগ্রহে অহরহ নানা পক্ষপাত (bias) আর অসম্ভাব্যতা (improbability) ঢুকে আসছে। যে পদ্ধতিতে সংক্রমণ চিহ্নিত করা হচ্ছে, সেই আরটি-পিসিআর (Real Time-Polymerase Chain Reaction) পদ্ধতিকে ‘গোল্ড স্ট্যান্টার্ড’ বলে ধরা হলেও, কার্যত এরও সীমাবদ্ধতা আছে। ফলে সব মিলিয়ে যে চিত্রটি উঠে আসছে তার সঙ্গে বাস্তবতা কতখানি মিলবে, তা আগাম বলা মুশকিল। খাতায়-কলমে ‘কোভিশিল্ড’ ও ‘কোভ্যাক্সিন’-এর কার্যকারিতা যথাক্রমে ৮১.৩ ও ৮০.৬ শতাংশ। সম্প্রতি ‘কোভিশিল্ড’-এর দুটি ডোজ়ের ব্যবধান বাড়িয়ে ১২-১৬ সপ্তাহ করা হয়েছে। প্রথমে এই ব্যবধান ছিল ৪ সপ্তাহের। তিন ধাপে একে পরিবর্তন করা হল। যে গবেষণাটিকে মান্য করে শেষবার পরিবর্তন করা হল, তাতে উঠে এসেছে যে, ব্যবধান বাড়িয়ে ১২ সপ্তাহ করা হলে টিকার সাফল্য অনেকখানি বেড়ে যায়। ভারতে প্রয়োজনীয়তার তুলনায় টিকার জোগানের স্বল্পতা সামাল দিতে এই ঘোষণা করা হয়নি বলে যদি ধরেও নিই, তাহলেও এই সিদ্ধান্তটি কিন্তু অনিবার্য যে, টিকার কার্যকারিতা নিয়ে এখনও অনেক বিষয় অজানা থেকে গেছে।

(৩) জনসংখ্যার একটা বড় অংশের টিকাকরণ সম্পন্ন হয়েছে এরকম দেশগুলির সামগ্রিক চিত্রও আমাদের এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে, যদিও এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত তথ্য এখনও হাতে আসেনি। অনেকেই উল্লেখ করছেন ইজ়রায়েলের তথ্য। প্রায় ৬০ শতাংশ টিকাকরণ সম্পন্ন হওয়ার পর ওদেশে মৃতের সংখ্যা ও নতুন সংক্রমণ অনেক কমে গেছে। ৬০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনলে গোষ্ঠীগত ইমিউনিটি হয়তো নিশ্চিত হবে না, কিন্তু তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ অনেকখানি অগ্রগমন। ১১ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে ওদেশে নতুনভাবে সংক্রামিত হয়েছিলেন ৭,৫৫৭ জন এবং মৃত্যু হয় ৩২ জনের; ১৪ মে ২০২১ তারিখে ওই সংখ্যা দুটি নেমে আসে যথাক্রমে ৬৫ ও ১-এ। কিন্তু এ ব্যাপারে অন্যান্য দেশের তথ্য খুব উপযোগী হবে না, কারণ, এই লেখাটি তৈরির সময়ে কোনও দেশেই ৪০ শতাংশের বেশি মানুষের টিকাকরণ সম্পন্ন হয়নি।[11] কাজেই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে গেলে আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। ইজ়রায়েলের ক্ষেত্রেও সংক্রমণের ওই নিম্নগতি সাময়িক নাকি স্থায়ী, তা সময়ই বলবে।

বিড়ম্বনার মুখোশ

আইনরক্ষকরা ইদানীং ভীষণ সজাগ, বাড়ির বাইরে পা রাখলেই নাকে-মুখে এঁটে নিতে হচ্ছে মুখোশ! পোশাকের সঙ্গে রং-নকশা মিলিয়েও আজকাল মুখোশ কিনছেন কেউ কেউ। অনেকের মুখেই আগাম ভবিষ্যদ্বাণী শুনছি যে, মুখোশ এখন থেকে নাকি আমাদের নিত্যসঙ্গী হয়ে গেল! ঠ্যালায় পড়লে মানুষ অনেক কিছুতেই অভ্যস্ত হয়, হয়তো মুখোশেও হয়ে যাবে। আবার, এরই মাঝে, কোথাও কোথাও ফুটে উঠছে অবাধ্যতার বার্তা। ‘প্ল্যানডেমিক’-এর ওই ‘বিজ্ঞান-জানা’ বিজ্ঞানীদের মতোই মুখোশের বিরোধিতা দেখা যাচ্ছে আমেরিকায়, এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও। তখন অতিমারি সদ্য শুরু হয়েছে। আমাদের দেশে তার আঁচ লাগেনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় রোগ সংক্রমণ থেকে বাঁচবার নানা উপায় অহরহ ভেসে আসছে। ওই সময়ে সদ্য ‘এন-৯৫’ খুলে রাখা ইতালীয় নার্সদের ফরসা মুখে ‘লালশিটে’ পড়া দাগ দেখে চমকে উঠেছিলাম। হ্যাঁ, মুখোশ নিয়ে ক্ষোভের কারণ আছে বই-কি! মুখোশ বাস্তবিকই বিড়ম্বনার, বিশেষ করে গরম আর আর্দ্রতায় ঠাসা দিনগুলিতে। তাই এর পেছনে সত্যিই কোনও ‘বিজ্ঞান’ আছে কিনা, তা দেখে নেওয়া দরকার।

সংক্রমণ ছড়ানোর প্রক্রিয়ার সঙ্গে বিষয়টির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। অতিমারির গোড়াতেই আমরা জেনেছিলাম যে, হাঁচি-কাশি কিংবা কথা বলার সময়ে আমাদের নাক-মুখ থেকে যে ফোঁটাণু (droplet/fomite) বের হয়, রোগ ছড়াতে ভাইরাসের ওটাই প্রধান অবলম্বন। ওই ফোঁটাণুগুলির আকার এমন যে, নীচে থিতিয়ে পড়ার আগে হাওয়ায় ভর করে বড়জোর ৬ ফুট দূরত্ব যেতে পারে। কোভিড-আক্রান্ত শরীর থেকে এই ফোঁটাণু বাতাসে ভাসমান অবস্থায় নিঃশ্বাসের মাধ্যমে কিংবা কোনও তলে থিতিয়ে পড়া অবস্থায় কারও স্পর্শবাহিত হয়ে চোখ-মুখ-নাকের সরণি বেয়ে সংক্রমণ ঘটায়। মাস্ক ব্যবহার করে নাক-মুখ ঢেকে দিতে পারলে ওই ফোঁটাণুগুলি মাস্কের ছাঁকনিতে আটকে যায়। এই সূত্রে সতর্কতা হিসেবে ৬ ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার সাবধানতার কথাও উঠে এসেছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে নানান গবেষণায় উঠে আসে এর এরোসল-নির্ভর সংক্রমণের (aerosol-based airborne transmission) কথা। আমাদের কথা বলার সময় বিভিন্ন আকারের ফোঁটাণু মুখ থেকে বের হয়, এদের মধ্যে বড়ো আকারের কণাগুলি (১০০ মাইক্রোমিটার ব্যাসযুক্ত) সামান্য দূরত্ব গিয়ে থিতিয়ে পড়ে, কিন্তু ছোটো আকারের (১০০ মাইক্রোমিটার ব্যাসের চেয়ে কম) কণাগুলি বাতাসের সঙ্গে কলয়েডীয় অবস্থায় চলে আসে (এরোসল), যা দীর্ঘক্ষণ বাতাসে ভেসে থাকতে পারে। অবশ্য এই এরোসলের মধ্যে থাকা জীবাণুকে শনাক্ত করা খুব সহজ নয়, বায়ুবাহিত হাম ও যক্ষ্মার জীবাণুকেও কখনও এভাবে শনাক্ত করা যায়নি। কিন্তু সংক্রমণ সংক্রান্ত অনেক তথ্যই পরোক্ষে সার্স-কোভ-২-র বায়ু-বাহিত সংক্রমণকে নির্দেশ করছে।[12]

তাহলে কি ‘মাস্ক’ বা মুখাবরণী সম্পূর্ণ অপ্রয়োজনীয়? নাহ্, এ কথা বলার সময় এখনও আসেনি। বায়ু চলাচল কম হয় এরকম বদ্ধ জায়গায়, বিশেষত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যানবাহন বা অপরিসর ঘর সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য বিপজ্জনক বলে সাব্যস্ত হচ্ছে। কিন্তু, তা সত্ত্বেও, সার্স-কোভ-২ সংক্রমণ যদি প্রধানত এরোসলের মাধ্যমে হত বা এটাই একমাত্র মাধ্যম হত, তাহলে এর সংক্রামক ক্ষমতা সম্ভবত আরও বেশি হত (হামের R0-এর মান ১৫, যা সার্স-কোভ-২-র চেয়ে অনেকটাই বেশি)। কাজেই, মাস্কের প্রয়োজনীয়তা আছে। প্রথমত, ফোঁটাণু-নির্ভর সংক্রমণ আটকানোর জন্য; দ্বিতীয়ত, এরোসল-নির্ভর সংক্রমণেও কিছুটা লাগাম দেওয়ার জন্য। ম্যানিকিন-নেবুলাইজ়ার-ভেন্টিলেটর যুক্ত সিমুলেশন-মডেলের সাহায্যে দেখা গেছে যে, কাপড়, সার্জিক্যাল বা এন-৯৫— সব ধরনের মাস্কই অনেকখানি সংক্রমণ ঠেকাতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও উঠে এসেছে যে, কোনও মাস্কই (এমনকি এন-৯৫ও) বায়ুবাহিত সংক্রমণকে পুরোপুরি আটকাতে পারে না।[13] মাস্ক নিয়ে কেউ কেউ দাবি করেছেন যে, এতে নাকি অক্সিজেন গ্রহণ ও কার্বন ডাইঅক্সাইড বর্জনের পরিমাণ উভয়ই কমে এবং ফুসফুসের ওপরে চাপ পড়ে। বলা দরকার, মাস্ক পরলে গরম লাগার বা শ্বাসপ্রশ্বাস সম্পর্কে সচেতন থাকার অনুভূতি হতে পারে, কিন্তু অন্যান্য দাবিগুলোর সমর্থনে জোরালো তথ্যপ্রমাণ নেই।

খুঁজি সবে পুঁজিবাদ

‘প্ল্যানডেমিক’ ও ‘প্ল্যানজ়াইটি’ উভয় ন্যারেটিভে ভুড়ভুড়ি কাটা ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড ওয়ান অর্ডার’, ‘নিউ নর্ম্যাল’, ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’ শব্দবন্ধগুলি অতিমারি-পরবর্তী এক নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দ্যোতক। শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়েছে পুরনো ‘সঙ্কটাপন্ন’ পুঁজিবাদী ব্যবস্থা ভেঙে নতুন এক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা স্থাপন করার গোপন পরিকল্পনার অনুষঙ্গে। তীব্র অর্থনৈতিক অসাম্য, কল্যাণকামিতা থেকে রাষ্ট্রের ক্রমশ দূরে সরে যাওয়া, গণতান্ত্রিক পরিসর সঙ্কুচিত হওয়া, বহুজাতিক সংস্থার বেড়ে চলা অনাচার ও লাগামহীন মুনাফা তত্ত্বটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে। বিশেষত, গোটা বিশ্বেই ‘বিগ ফার্মা’ হল অন্যতম ঘৃণিত প্রতিষ্ঠান। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার তথ্য গোপন, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ওষুধবিজ্ঞানের নিয়মকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখানো, অকেজো ও অবৈজ্ঞানিক ওষুধ উৎপাদন এবং অনৈতিকভাবে তার জন্য তদ্বির করে যাওয়া, বাণিজ্যিক স্বার্থ ব্যাহত হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় ওষুধের জোগান নিয়ন্ত্রণ করা— হেন অনাচার নেই, যা তারা করেনি। আর এইসব অনাচারের সূত্রেই তাদের সম্পদের কূলকিনারা নেই। কোভিড-১৯ প্রতিরোধী টিকা উৎপাদনে নিয়োজিত সংস্থাগুলির মুনাফার দিকে তাকালে দেখব জনসন অ্যান্ড জনসন নিউজ়িল্যান্ডের মতো ধনী দেশের চেয়েও সম্পদশালী, ফাইজ়ার তৈল সম্পদে ধনবান কুয়েতের চেয়েও বিত্তবান! এদের অঙ্গুলিহেলনে বিশ্ববাজারে ওষুধের দাম, চাহিদা, জোগান নিয়ন্ত্রিত হয়। বিভিন্ন দেশের সরকারকে কার্যত এরা ক্রীড়নকে পরিণত করেছে। অন্যদিকে, বিগত অর্ধশতককাল ধরে টিকা উৎপাদনের ধারাটিও ক্রমশ শীর্ণ হয়ে আসছিল। সনাতন পদ্ধতি মেনে টিকা উৎপাদন করতে যেমন সময় লাগে অত্যধিক বেশি, তেমনি ঝুঁকিও প্রচুর। টিকায় নিষ্ক্রিয় জীবাণুর বদলে জ্যান্ত জীবাণু থেকে যাওয়ার ঝুঁকি, বছর দশেক ধরে অর্থলগ্নি করে তৈরি টিকায় ব্যর্থতার ঝুঁকি, কোনওভাবে বদনাম ছড়িয়ে গেলে জনরুচি পালটে যাওয়ার ঝুঁকি। বিগত কয়েক দশক ধরে টিকার নতুন প্রযুক্তি তাই অপরীক্ষিত থেকে যাচ্ছিল। অতিমারি পরিস্থিতি বাস্তবিকই ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার সামনে এক নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে, যেমন করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চিকিৎসায় এক্স-রে প্রযুক্তি ব্যবহারের এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অ্যান্টিবায়োটিকের গণ-উৎপাদনের রাস্তা করে দিয়েছিল। টিকা উৎপাদনে নতুন নতুন জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারের অভাবনীয় সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে অতিমারি। দেখতে পাচ্ছি এক আশ্চর্য চিত্র। পারস্পরিক প্রতিযোগিতা ভুলে এক টিকা উৎপাদক সংস্থা অন্য সংস্থার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে, তা সে প্রযুক্তিগত ঘাটতি বা পরিকাঠামোগত অসুবিধে যাই হোক না কেন। কাজেই, পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে গোটা পৃথিবীর বাণিজ্য সম্ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে এগোচ্ছে বহুজাতিক ওষুধ শিল্প— এই তত্ত্বটি স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে।

‘বিগ ফার্মা’-কে ঘিরে বরাবরই নানান ষড়যন্ত্র তত্ত্ব পল্লবিত হয়ে ওঠে। দাবি করা হয় যে, এইডস রোগের ওষুধপত্তর অকেজো ও ক্ষতিকর, ক্যানসার বা অন্যান্য অনিরাময়যোগ্য রোগ সারানোর ওষুধ জানা থাকলেও তা লুকিয়ে রাখা হয়েছে, তথাকথিত ‘অনিরাময়যোগ্য অসুখ’-গুলিকে ‘প্রাকৃতিক’ ভেষজের সাহায্যে সারানো গেলেও তার স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না, কিংবা একটি রোগের কারণ বলে যা দেখানো হচ্ছে তা প্রকৃত কারণ নয়, প্রকৃত কারণ হল খাদ্যে নির্দিষ্ট উপাদানের ঘাটতি। মজার কথা হল, বিভিন্ন তত্ত্বের রকমারি বক্তব্য থাকলেও সর্বদাই ‘বিগ ফার্মা’-কে ভিলেনের আসনে বসানো হয়। সুতরাং, অতিমারি আবহে টিকাবাণিজ্যকে যত বড়ই লাগুক না কেন, তা যে বিশ্ব-অর্থনীতির একটা ভগ্নাংশ মাত্র— এ সত্য অনুধাবন না করেই গোটা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার কর্তৃত্বের দায়ভারও নির্দ্বিধায় তার হাতেই তুলে দেওয়া চলে! ‘সঙ্কটাপন্ন’ পুঁজির নতুন বিন্যাসের তত্ত্বও বিনা প্রশ্নে বৈধতা পেয়ে যায়।

‘পুঁজির সঙ্কট’-এর কথা আমরা মাঝেমধ্যে শুনে থাকি। ভারতীয় বামপন্থায় অত্যন্ত প্রিয় শব্দবন্ধ, যাবতীয় দ্বন্দ্ব-সমস্যার ব্যাখ্যা আর সমাধানের জাদু-ইঙ্গিত নিয়ে হাজির হয় তা! অতিমারির আবহেও ‘সঙ্কটাপন্ন পুঁজি’-র নবতর বিন্যাসের তত্ত্ব উঠে আসতে দেরি হয়নি। বিল গেটস-রকফেলার-ফাউচি-র ‘গোপন অভিসন্ধি’-র খণ্ডচিত্র এই তত্ত্বে শিলমোহর দেয়। এক্ষেত্রে যে প্রশ্নটি অমীমাংসিত থাকে তা হল, সত্যিই পুঁজি সঙ্কটাপন্ন কিনা, নিকট অতীতে ‘সঙ্কটাপন্ন পুঁজি’র কোনও লক্ষণ ফুটে উঠেছে কিনা। ১৯৩০-এর দশকে গুরুতর মন্দা (‘Great Depression’) ঘটেছিল, যাতে বিশ্বপুঁজির ‘মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন’ (Gross Domestic Product, GDP) নামক সূচকটি ৫ শতাংশ অবনমিত হয়। কিন্তু এরপর তেমন কোনও মন্দার কথা আমরা জানি না, যা দিয়ে বিশ্বপুঁজির সঙ্কটকে চিহ্নিত করা যায়। ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক অস্থিরতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি উন্নত দেশের অর্থনীতিতে হানা দিলেও, সামগ্রিকভাবে তার তেমন কিছু প্রভাব অনুভূত হয়নি। আমাদের দেশেও তা টের পাওয়া যায়নি। জিডিপি-র অবনমন ঘটেছিলও খুবই সামান্য, কমবেশি ১ শতাংশ। ইন্টারন্যাশনাল মানিটারি ফান্ড বা আইএমএফ অনুমান করেছে যে, অতিমারির জন্য ২০২০ সালে জিডিপি হ্রাস পাবে প্রায় সাড়ে চার শতাংশ, যা পূর্বের অর্থনৈতিক মন্দার চেয়ে সাড়ে চার গুণ বেশি এবং ১৯৩০-এর দশকের মন্দার প্রায় সমান।[14] কাজেই, এটি বোঝা দুরূহ নয় যে, সাম্প্রতিক অতিমারি কোনও অর্থনৈতিক মন্দা বা সঙ্কটের ফল নয়, অতিমারিটাই বরং অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণ। অর্থনীতি যে চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্যের ওপরে ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে, অতিমারি-পীড়িত পৃথিবীতে সেই ভারসাম্যটিই নড়বড়ে হয়ে গেছে। বাজারের সামগ্রী ও পরিসেবা কিনতে অল্প সংখ্যক উপভোক্তা সামিল হচ্ছেন। কৃষি, খনিজ তেল, উৎপাদন শিল্প, শিক্ষা, ব্যবসাবাণিজ্য সবেতেই এই মন্দার ছোঁয়া; কেবল উন্নতি ঘটেছে ই-কমার্স, খাদ্য পাকেজিং, চিকিৎসা সরঞ্জাম, ওষুধপত্তর, ওষুধ উৎপাদনের কাঁচামাল প্রভৃতি কয়েকটি ক্ষেত্রে। বহুজাতিক ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা নিশ্চয়ই অতিমারি থেকে লাভবান হবে, কিন্তু গোটা বিশ্বপুঁজির সামগ্রিকভাবে এতে কোনও ফায়দা নেই। বাস্তবে, অতিমারি সংক্রান্ত আইনকানুন ও বিধিনিষেধ ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনে। অধিকাংশ শিল্পই আক্রান্ত হয়, ব্যবসাবাণিজ্য লাটে ওঠে। সাধারণ মানুষের দিক থেকে এই অবস্থা যেমন অসহনীয় (‘অক্সফ্যাম’-এর রিপোর্ট বলছে অতিমারি-পরবর্তী এক ভয়াবহ ক্ষুধার অতিমারির কথা), তেমনই উৎপাদনব্যবস্থা বা ব্যবসাবাণিজ্যের দিক থেকেও এই পরিস্থিতি আদৌ অনুকূল নয়। কর্মী ছাঁটাই, উৎপাদন হ্রাস, ‘ওয়ার্ক ফম হোম’ ইত্যাদির মাধ্যমে অভিঘাত কমিয়ে আনার চেষ্টা করলেও ক্ষুদ্র ও মাঝারি পুঁজির পক্ষে এই আঘাত সামাল দেওয়া কঠিন। বৃহৎ পুঁজি আঘাত সামলানোর অনেকখানি ক্ষমতা রাখলেও পরিস্থিতিটা, বলা বাহুল্য, তাদের পক্ষেও সুবিধাজনক নয়। ক্ষুদ্র ও মাঝারি পুঁজির বিপর্যয়ে বৃহৎ পুঁজি কিছুকাল উদাসীন থাকতে পারে, অনন্তকাল নয়, কারণ তার অস্তিত্ব শেষ বিচারে ওই দুটির ওপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল। ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের উদ্গাতা আর প্রচারকদের মুশকিল হল, তাঁরা কী নিয়ে কথা বলতে চাইছেন, সেটাই ভালো করে বোঝেন না। নইলে কি আর কেউ সাধ করে বলে যে, লাভের অঙ্ক কষে ক্যানসারের ওষুধ সামনে আনা হচ্ছে না! সত্যিই, অঙ্ক কষায় এরকম আনাড়িপনার জুড়ি মেলা ভার!

ষড়যন্ত্রের (তত্ত্বের) দুর্নিবার টানে

লেখার শুরুতেই বলেছিলাম যে, আমাদের শৈশব প্রশ্ন করতে শেখায় না। তাহলে এত এত প্রশ্ন আর সন্দেহ আসছে কোত্থেকে? আর সন্দেহ এলেই বা মনের কোনায় জাঁকিয়ে বসছে কীভাবে? আমরা প্রত্যেকেই নিজের নিজের মতো করে অতিমারি-যাপন করে চলেছি বৎসরাধিক সময় ধরে। একজন ভারতীয় হিসেবে অতিমারিকালে আমরা কী দেখলাম? দেখলাম এক ভেঙে পড়া স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে, দীর্ঘ লকডাউনেও যে নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারে না। দেখলাম এক অশিক্ষিত অদক্ষ প্রতারণাময় জনবিরোধী স্বাস্থ্যনীতির প্রয়োগ, দেখলাম গোমূত্র-জড়িবুটি-হোমিওপ্যাথিকে জনগণের সামনে তুলে ধরতে। দেখলাম চূড়ান্ত রাজনৈতিক অপরিণামদর্শিতা, যে অপরিণামদর্শিতা সঙ্কটকালেও দলগত কর্মসূচি কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে দ্বিধাগ্রস্ত হয় না। দেখলাম জনগণের প্রতি শাসকের নির্মম দৃষ্টিভঙ্গি, যে দৃষ্টিভঙ্গি মানুষকে কেবল সংখ্যার অতিরিক্ত অন্য কিছু ভাবে না। অপরিকল্পিত লকডাউন, অভিবাসী শ্রমিকদের প্রতি নিষ্ঠুর মনোভাব, কর্মচ্যুত অসংগঠিত শ্রমজীবী-কর্মজীবী মানুষের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করা, লকডাউনকে কাজে লাগিয়ে একের পর এক জনবিরোধী আইন কার্যকর করা, রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের নেশায় স্বাস্থ্যবিধি লঙ্ঘন করে নির্বাচন নামক প্রহসনটি অনুষ্ঠিত করা, ধর্মের নামে কুম্ভমেলার মতো জনসমাগমকে উৎসাহিত করা, হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে ব্যর্থতা, গঙ্গাস্রোতে লাশের মিছিল— একবিংশ শতকীয় আধুনিক রাষ্ট্রের সঙ্গে নিতান্তই বেমানান সব চিত্র উঠে এল। শুধু তাইই নয়, বিজ্ঞানকেও এমনভাবে প্রয়োগ করা হল, যেন তা নিছক অনুমান আর বিশ্বাস-নির্ভর এক হাতুড়ে বিদ্যা! ইমিউনিটি ‘বাড়ানোর’ কোবরেজি প্রোটোকল নির্মাণ, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন-রেমডিসিভির কুনাট্য, জিঙ্ক-ভিটামিন-সি এর মতো গুচ্ছের অকেজো দ্রব্য চিকিৎসা প্রোটোকলে দীর্ঘদিন ধরে রেখে দেওয়া, ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একের পর এক অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার, টিকা প্রস্তুতিতে ওষুধবিজ্ঞানের নিয়মনীতি লঙ্ঘন— এসব দেখে একজন নাগরিক ‘বিজ্ঞান’-কে তুকতাকের সঙ্গে আলাদা করবেন কীভাবে! ফলে অতিমারির এই সামগ্রিক চিত্রটি থেকে অতিমারি-পীড়িত ভীতসন্ত্রস্ত মানুষ অস্তিত্বের এক ব্যক্তিগত সঙ্কট অনুভব করেন, যেখানে কোনও কিছুই তাঁর কাছে স্বচ্ছভাবে ধরা দিচ্ছে না, কোনও কিছুতেই তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। বস্তুত, এ অবস্থাই হল ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সংক্রমণের জন্য আদর্শ পরিস্থিতি।

ষড়যন্ত্র তত্ত্ব (conspiracy theory) হল কোনও ঘটনা বা পরিস্থিতি বিষয়ে পূর্বধারণা ও অপর্যাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা অনুমান, যা যে কোনও সাড়া জাগানো ঘটনা বা পরিস্থিতির পেছনে গোপন ষড়যন্ত্র ক্রিয়াশীল থাকার এক বয়ান গড়ে তোলে। ‘তত্ত্ব’ কথাটি এখানে সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি, আলগাভাবে বিদ্রূপার্থক অর্থে প্রয়োগ করা হয়েছে। এর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষত্ব হল, এটি ঘটনা বা পরিস্থিতিটি সম্পর্কে ওই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সর্বসম্মত মতামতের বিরুদ্ধাচরণ করে। বর্তমান রচনায় উল্লিখিত বিষয়গুলির মধ্যে থেকে উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে, অর্থনীতির প্রতিষ্ঠিত ধারণা ও চর্চায় ‘ওয়ান ওয়ার্ল্ড ওয়ান অর্ডার’ তত্ত্বের সমর্থন মিলবে না। এই তত্ত্ব মোকাবিলা করার সবচেয়ে বড় সমস্যা হল এর জনসমর্থন। প্রতি তিনজন মার্কিনীর এক জন বিশ্বাস করে যে, বিশ্বউষ্ণায়ন হল এক বিশুদ্ধ গুজব! এবং বিশ্বাসীদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে একে খণ্ডন করাও অত্যন্ত কঠিন। ষড়যন্ত্র হল ‘গোপন ব্যাপার’, তাই তথ্যপ্রমাণ কম। উপরন্তু, যতবারই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বিপক্ষে নতুন নতুন তথ্যপ্রমাণ হাজির করা হয়, ততবারই বিশ্বাসীরা ভাবেন আরও বেশি বেশি লোক এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ও একে আড়াল করতে তৎপর। অর্থাৎ ষড়যন্ত্রের পক্ষে তথ্য-যুক্তির অভাব এবং ষড়যন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তির প্রাবল্য— উভয়ই ষড়যন্ত্র-তত্ত্বের বৈধতা প্রমাণে ব্যবহৃত হয়। এই ধরনের ভ্রান্ত যুক্তিকে বলে চক্রাকার যুক্তি (cyclic reasoning)। একজন বিজ্ঞানকর্মী হিসেবে বিষয়টির সঙ্গে অবিজ্ঞান ও কুসংস্কারের এই মিলটি মোটেই চোখ এড়ায় না যে, উভয়ক্ষেত্রেই ‘খণ্ডনযোগ্যতা’ (‘falsifiability’) ও তথ্য-যুক্তির অভাব প্রকট।

এটা সত্যি যে, কম শিক্ষিতদের মধ্যে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রকোপ স্বাভাবিক কারণেই অত্যন্ত বেশি, কিন্তু তা বলে এ কেবল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষিত লোকেরাও এর শিকার হন যখন ওই ব্যক্তির তাত্ত্বিক অবস্থান (ideological position) বা পূর্বধারণার সঙ্গে তা খাপ খেয়ে যায়। লকডাউন-লাঞ্ছিত শ্রমিকের বিপত্তি আর অর্থনৈতিক একাধিপত্যের উপাদান আছে বলে কিছু রাজনৈতিকভাবে বামমনস্ক ব্যক্তির কাছে অতিমারি সংক্রান্ত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। মাস্কের ব্যবহার ও টিকায় আপত্তির সঙ্গে জুড়ে যায় ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রশ্ন। রাস্তায় নেমে নাগরিকত্ব ও কৃষি আইনের বিরোধিতা করতে চান বলে অনেকের কাছেই অতিমারি সংক্রান্ত আইনের প্রয়োগের সঙ্গে যুযুধান অবস্থানে চলে আসে গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবি।

তবে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের মূল আবেদনটি কিন্তু শুধু তাত্ত্বিক নয়, আবেগজনিতও। আপাত-যৌক্তিক ব্যাখ্যা হাজির করে এই তত্ত্ব কোনও জটিলতাপূর্ণ ঘটনা বা পরিস্থিতিকে সহজবোধ্য করে তোলে। মানুষের মস্তিষ্ক সবক্ষেত্রে বিশ্ব-রাজনীতি, অর্থনীতি বা বিজ্ঞানের জটিল প্রক্রিয়াগুলিকে বুঝতে পারে না। ব্রুনোকে জনতার জয়ধ্বনির মধ্যে পুড়ে মরতে হয়েছিল, কারণ পূর্ব থেকে পশ্চিমে সূর্যের উদয়াস্ত দৌড়ের প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতা ও সহজবোধ্য যুক্তির তুলনায় গ্রহ-নক্ষত্রের আপেক্ষিক গতি সম্পর্কিত কোপারনিকাসীয় জটিল যুক্তিধারা আমজনতার কাছে বর্জনীয় বলে মনে হয়েছিল। অতিমারির পেছনে ফ্লু টিকার ভূমিকা, ‘ফাইভ-জি’ মোবাইল নেটওয়ার্কের তড়িচ্চুম্বকীয় বিকিরণ ইত্যাদি অসম্ভব তত্ত্বও তাই কারও কারও কাছে গ্রহণীয় হয়ে ওঠে। যেমনভাবে কেউ কেউ চাঁদে মানুষের পদার্পণকে জালিয়াতি ভাবেন, ‘নাইন-ইলেভেন’-এর ঘটনাকে আমেরিকার নিজস্ব বদমাইশি বলে মনে করেন, পৃথিবীকে ভাবেন চাকতির মতো যার কিনারায় গেলে মানুষ পড়ে যায়, তাজমহলকে মনে করেন প্রাচীন হিন্দু মন্দির, কিংবা বছর কয়েক আগে যেমনভাবে কেউ কেউ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে, ২০১২ সালে লোপাট হয়ে যাবে পৃথিবী!

সন্দেহ, সন্দেহ-বাতিক এবং সন্দেহবাদ

সন্দেহ হল এক অত্যন্ত স্বাভাবিক ও জরুরি মানসিক প্রক্রিয়া। যখন কোনও বস্তু বা বিষয় সম্পর্কে দুই বা ততোধিক পরস্পরবিরোধী অভিমতের মধ্যে থেকে কোনটি সঠিক বা সুপ্রযুক্ত তা বেছে নেওয়া কঠিন হয়, তখনই মনে সন্দেহ উঁকি দেয়। কিন্তু এই সন্দেহ যখন বাস্তববোধ বিবর্জিত হয়ে কোনও ব্যক্তিকে প্রায় প্রতিটি ব্যাপারেই সংশয়ের দোলাচলে ফেলতে থাকে, তখন তার পক্ষে স্বাভাবিক কাজকর্ম করাই কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এ অবস্থায় নিশ্চিততম বিষয়টি সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত নিতে গেলে চূড়ান্ত অনিশ্চিতি গ্রাস করে। এরই নাম সন্দেহ-বাতিক। বেশ হত যদি এরকম একটা ভ্যাকসিন থাকত, যা সন্দেহ করতে বাধা দেবে না বরং তাতে উৎসাহই দেবে কিন্তু বাতিক চলে এলেই মাথার ভেতর জ্বলে উঠবে লালবাতি! কিন্তু তা তো হওয়ার নয়। কাজেই, সেই আদি আর অকৃত্রিম যৌক্তিক বিচারে ভরসা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু আবারও, মজার কথা হল, এই যৌক্তিক বিচারেরও প্রথম ধাপটাই হল সন্দেহ। কোনও কিছু বিশ্বাস, আপ্তবাক্য, বাজারচলতি ধারণাকে কেউ যদি নিঃসন্দেহে মেনে নেয়, তাহলে তো আর যুক্তি প্রয়োগের দরকারই থাকে না। এই অর্থে, দর্শনে (বা আরও নির্দিষ্টভাবে, জ্ঞানতত্ত্বে) যৌক্তিক বিচারপদ্ধতিকে বোঝাতে কখনও কখনও ‘সন্দেহবাদ’ (ইংরেজিতে ‘স্কেপটিসিজ়ম’) কথাটি ব্যবহৃত হয়। আমরা যারা ধর্ম, অপবিজ্ঞান ইত্যাদি ব্যাপারে যৌক্তিক বিচারের পক্ষে, তারা হলাম গিয়ে ‘সন্দেহবাদী’ বা ‘স্কেপটিক’। আর, যারা যুক্তিবিবর্জিত হয়ে চলে যায় অকারণ সন্দেহ-প্রবণতার কবজায়, তাদেরকে বলে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত বা ‘প্যারানয়েড’। অর্থাৎ মানবমস্তিষ্কের ‘সন্দেহ’ নামক মূলগত প্রক্রিয়াটি যুক্তি ও বাস্তববোধের রাস্তায় হেঁটে যেমন ‘সন্দেহবাদ’-এ পৌঁছতে পারে, তেমনি যুক্তিহীন বেপরোয়া বেসামাল হয়ে উঠে ‘সন্দেহ-বাতিক’-এও পরিণত হতে পারে।

ষড়যন্ত্র তত্ত্বের উপাদান ও রকমসকম, মানবমস্তিষ্কে এর ক্রিয়াপদ্ধতি ইত্যাদি নিয়ে উল্লেখযোগ্য মনস্তাত্ত্বিক চর্চা হয়েছে ও হয়ে চলেছে। কিন্তু মুশকিল হল, কোনটা কী তা বোঝার জন্য সত্যিকারের ষড়যন্ত্র ও ভিত্তিহীন ষড়যন্ত্রতত্ত্বের মধ্যে সূক্ষ্ম সীমারেখা টানার কোনও প্রচেষ্টাই অদ্যাবধি সফল হয়নি। ভাবতে অবাক লাগে যে, বার্টান্ড রাসেলের মতো দিকপাল চিন্তাবিদও মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডি-র হত্যাকাণ্ডের পেছনে রাষ্ট্রের গোপন চক্রান্তে বিশ্বাস করে বসেছিলেন এবং নতুন করে তদন্ত চেয়ে কমিটি তৈরি ও লেখালেখি পর্যন্ত করেছিলেন! অনেক সময়েই ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমর্থনে ভুয়ো ‘তথ্যপ্রমাণ’-কে যেভাবে অতি যত্ন সহকারে ‘নিখুঁত’ করে তোলা হয়, তাতে বিভ্রম আরও ঘনীভূত হয়। পৃথিবীকে চাকতির মতো বলে যারা দাবি করে থাকে তাদের বক্তব্য অনুযায়ী, পৃথিবীকে গোলক ‘করে তুলতে’ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘নাসা’ নিয়মিতভাবে উপগ্রহ-ছবিতে কারিকুরি করে থাকে, এরোপ্লেনের জানালাকে এমনভাবে ডিজ়াইন করা হয় যাতে ওর মধ্যে দিয়ে তাকালে পৃথিবীর দিগন্তরেখাকে বাঁকা দেখায়; এমনকি, একাজে কিছু বিমানচালককেও সাক্ষী হিসেবে দাঁড় করানো হয় যাঁরা নাকি কয়েক কিলোমিটার উঁচুতে উঠেও দিগন্তরেখার বক্রতা দেখতে পান না!

চোখ ফেরানো যাক সার্স-কোভ-২এর উৎস সংক্রান্ত সমস্যাটির দিকে। কোভিড অতিমারিকে ঘিরে গড়ে ওঠা ষড়যন্ত্রতত্ত্বগুলির মধ্যে অন্যতম পুরনো এটি। কিন্তু এ আলোচনা ক্রমেই থিতিয়ে পড়ছিল। এ বছর মে মাসে আমেরিকায় বাইডেন সরকার এ নিয়ে তদন্ত আহ্বান করে স্তিমিত হয়ে যাওয়া বিতর্ককে আবারও উসকে দিয়েছে। সাধারণভাবে ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে খুঁটিয়ে বোঝার জন্য এই বিতর্কটি চিত্তাকর্ষক ও অত্যন্ত উপযোগী। এখানে মূল সম্ভাবনা সাকুল্যে দুটি। ভাইরাসটি হয় গবেষণাগারে কৃত্রিমভাবে সংশ্লেষ করে প্রস্তুত করা হয়েছে নতুবা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে এসেছে। এই দুইয়ের বাইরে আর কোনও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যদি প্রশ্ন ওঠে যে, দুটি ‘তত্ত্ব’ই কি সমান সম্ভাবনাময়? এর নিশ্চিত উত্তর হচ্ছে, কখনওই না। প্রথম সম্ভাবনাটি সত্যি হয়ে ওঠার জন্য এক বিপুলাকায় গোপন কর্মকাণ্ড লাগবে, যার পেছনে বৎসরাধিক কাল ধরে নীরবে ষড়যন্ত্রে মদত দিয়ে চলা এক বিপুল সংখ্যক বিজ্ঞানী, সরকারি আধিকারিক ও সংশ্লিষ্ট সাধারণ মানুষের এক অনৈতিক-অযৌক্তিক আনুগত্য একটানা ও নিপুণভাবে ক্রিয়াশীল থাকা দরকার। বিপরীতে, দ্বিতীয়টির জন্য কেবল জীববিদ্যার এই ধারণাটুকুই যথেষ্ট যে, প্রজাতি বদল ভাইরাসের ক্ষেত্রে অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা এবং তা আকছার ঘটে। কাজেই, কোনটি সত্য জানা না থাকলেও, ল্যাবরেটরিতে বানিয়ে তোলা এক ভয়ঙ্কর জীবাণুর গবেষণাগার গলে বেরিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাটি নিয়ে হইচই করাটা আদৌ কাণ্ডজ্ঞানসম্মত নয়, যদি না তেমন সম্ভাবনার কোনও অত্যন্ত জোরালো ইঙ্গিত মেলে। এভাবে আমরা খাঁটি সন্দেহবাদ ও ষড়যন্ত্রতত্ত্বের মধ্যে তফাত করতে পারি, অন্তত কিছুটা হলেও। আরও লক্ষণীয় যে, সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাসের কৃত্রিমতার তত্ত্বটি একটি সহজসরল গল্প হিসেবেও উঠে আসেনি, তা পরিবেশিত হয়েছে নানান অনুষঙ্গে বিভিন্ন রূপের বিচিত্র সমবায় হিসেবে। এর সরলতম রূপটি হল, উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজি থেকে ঘটনাচক্রে ভাইরাসটি মুক্ত হয়েছে বা প্রতিষ্ঠানের কোনও কর্মী আকস্মিকভাবে এতে সংক্রামিত হয়েছেন। কিন্তু ঘটনার সঙ্গে যুক্ত নানান খুঁটিনাটি বিষয়— ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত, কল্যাণকর গবেষণা না জৈব অস্ত্র, চিন না আমেরিকা নাকি উভয়েই, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা-র জ্ঞাতসারে না অজ্ঞাতসারে, ইত্যাদি জুড়ে গিয়ে তা জটিলতর হয়ে ওঠে। টুকরো টুকরো এই ষড়যন্ত্রতত্ত্বগুলি কোনও না কোনওভাবে পরস্পরবিরোধী, একসঙ্গে সবগুলি সত্যি হতে পারে না। কিন্তু মজার কথা হল, কেউ কেউ একই সঙ্গে একাধিক তত্ত্বে বিশ্বাস রাখতে অস্বস্তিতে পড়েননি! এভাবে, ষড়যন্ত্রের গোপন প্লটের টানে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশে দ্রুতবেগে ছড়িয়ে পড়া একটি রোগসংক্রমণকে ‘অতিমারি’ বলায় অনেকেই আপত্তি করেছেন; এবং তা করতে গিয়ে রোগটির রহস্যময়তা ও ভীতিপ্রদ উপসর্গগুলিকে দিব্যি উপেক্ষা করেছেন। নানা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও চিকিৎসক ও ভাইরাসবিদদের একাংশ একে মরশুমি ইনফ্লুয়েঞ্জার সঙ্গে ঘুলিয়ে দিতে দ্বিধা করেননি। কারণ, এঁদের মাথায় চেপে বসেছিল গুটি কয়েক সংস্থার গাঁটছড়াজনিত অর্থনৈতিক চক্রান্তের তত্ত্ব, অর্থনীতির প্রতিষ্ঠিত চর্চার সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র সঙ্গতি না থাকা সত্ত্বেও। এমনকি, জ়ুনোসিসের পূর্ব-অভিজ্ঞতা নিয়ে সর্বসমক্ষে সংঘটিত জনস্বাস্থ্যের মহড়াকেও ভাবা হয়েছে গোপন চক্রান্ত। সংক্রমণ রোধ করার স্বীকৃত পদ্ধতিগুলির বিরোধিতা করা হয়েছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের তথ্যের বদলে ব্যক্তিস্বাধীনতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলে। টিকা উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেকে নাৎসি ‘ইউজেনিক্স’ চর্চার ভূত দেখতে পেয়েছেন, টিকা গবেষণায় যুক্ত থাকা হাজার হাজার বিজ্ঞানীর ও সামগ্রিকভাবে চিকিৎসাবিজ্ঞান চর্চার কষ্টার্জিত নীতিনৈতিকতাকে তাঁরা ধর্তব্যে আনেননি। টিকা প্রয়োগে প্রস্তুত ইমিউনিটির পরিমাণ ও আয়ু অজানা থাকার যে অসম্পূর্ণতা, তার কথা সব গবেষণাতেই উল্লিখিত হয়েছে এবং আপৎকালীনভাবে টিকা অনুমোদনের সীমাবদ্ধতাগুলিকেও এড়িয়ে যাওয়া হয়নি। তবুও টিকা-বিরোধী গোষ্ঠীর সুরে সুর মিলিয়ে স্বাভাবিক সংক্রমণজাত ইমিউনিটির খোয়াব দেখে চলেছেন এমনকি কতিপয় ভাইরাস বিশেষজ্ঞও, মহামারিবিদ্যার তথ্য ও সুইডেনের হাতেগরম বিপরীত দৃষ্টান্ত তাঁদেরকে দমাতে পারেনি! আর এ সবই ঘটেছে ভবিষ্যতের এক কল্পনাশ্রয়ী অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের ছবিকে সামনে রেখে, বাস্তবে যে ছবিটি ষড়যন্ত্র তত্ত্বের প্রবক্তারা ছাড়া আর কেউই দেখতে পাননি! এভাবে, সকল ষড়যন্ত্র তত্ত্বই এক জায়গায় এসে মিলে গেছে।

কিন্তু, একবার ভাবুন তো, ভাইরাসটি কীভাবে এল— এই আলোচনা কি আসলে আদৌ ততটাই গুরুত্বপূর্ণ যতটা ভাবা হচ্ছে? কোনও ভাইরাসের উৎস নির্ভুলভাবে বের করতে বছরের পর বছর যুগের পর যুগ লেগে যেতে পারে। নিশ্চিত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হলে প্রতিটি বন্য প্রাণীর শরীরে উপস্থিত প্রতিটি ভাইরাসের প্রতিটি রকমের জিনচিত্রকে বিচার করে সার্স-কোভ-২র নিকটতম জেনেটিক আত্মীয়তা খুঁজতে হবে। খড়ের গাদায় সূঁচ খোঁজাও এর চেয়ে অনেক সহজ! চিনকে বলির পাঁঠা করলে অনেকেরই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধে হয়, কিন্তু তাতে অতিমারি সম্পর্কে কোনও জ্ঞানবৃদ্ধি হয় না। বরং ষড়যন্ত্র খুঁজতে গিয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি থেকে নজর ঘুরে যায় তা হল, দেশে দেশে জনস্বাস্থ্যের কাঙ্ক্ষিত মান, সুচিকিৎসা পাওয়ার অধিকার, বিজ্ঞানের জনমুখী প্রয়োগ নিশ্চিত করার দাবি থেকে। কাজেই, সন্দেহ শৃঙ্খলাহীন ও বেপরোয়া হয়ে উঠলে কখনও কখনও তার মধ্যে যুক্তিশীলতার ভানটি বজায় থাকে বটে, কিন্তু তা প্রকৃত সমস্যা থেকে নজর ঘুরিয়ে আসলে কার হাতকে শক্ত করছে সেটাও ভেবে দেখা দরকার বই-কি!


[1] Biggerstaff, M. et al (2014): “Estimates of the reproduction number for seasonal, pandemic, and zoonotic influenza: a systematic review of the literature”, BMC Infect Dis 14, 480.
[2] WHO (2020): Coronavirus disease 2019 (COVID-19): Situation Report – 46, 6 March 2020, [Online], Updated: 8 May 2021.
[3] Nature Editorial (2020): “Progress report on a pandemic”, Nature, 584:325
[4] দাশগুপ্ত, স্থবির (২০২০)। কোভিড ১৯: কোথায় এলাম, কোথায় যাচ্ছি। পরিপ্রশ্ন: নৈহাটি, ঠিকঠিকানা: কলকাতা। পৃ. ২০-২১, ২৮-২৯
[5] Winterburn, G.W. (1886): The value of vaccination: A non-partisan review of its history and results, Philadelphia: F.E. Boericke, Hahnemann Publishing House, p. 145
[6] Schmidt, K.; Ernst E. (2002): “Aspects of MMR”, British Medical Journal, 325:597
[7] Carbonaro, G. (2021): Why Sweden has abandoned its COVID-19 strategy, 13 Jan 2021 [Online], Accessed: 28 April 2021.
[8] Alwan N.A. et al (2020): Scientific consensus on the COVID-19 pandemic: we need to act now, The Lancet, 396: 71-72
[9] Lynus, M. (2020): Yes, some COVID vaccines use genetic engineering. Get over it. [Online], 17 December 2020. Accessed: 14 May 2021.
[10] Jeong, M. (2021): Global COVID-19 vaccine summary: Side effects, [Online], Accessed: [14 May 2021]
[11] https://ourworldindata.org থেকে সংগৃহীত। ১৫ মে ২০২০
[12] Greenhalgh, T.et al (2021): Ten scientific reasons in support of airborne transmission of SARS-CoV-2, The Lancet, 397:1603-05
[13] Ueki, H. et al (2020): “Effectiveness of Face Masks in Preventing Airborne Transmission of SARS-CoV-2”, mSphere, 5:e00637-20
[14] Szmigiera, M. (2021): Impact of the coronavirus pandemic on the global economy – Statistics & Facts, [Online], Accessed: 16 May 2021.