Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এ মাসের কবি: কৌশিক বাজারী

এ মাসের কবি: কৌশিক বাজারী | আলোচনা: নিরুপম চক্রবর্তী

নিরুপম চক্রবর্তী

 

দ্রাক্ষাবনে ঋতু বসন্ত

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের জনৈক কর্মী আমাকে অনুরোধ করেছেন তাঁদের কাগজে এ মাসের নির্বাচিত কবি কৌশিক বাজারীর প্রকাশিতব্য কবিতাগুলির একটি সংক্ষিপ্ত মুখবন্ধ রচনা করতে। এই কবির সৃষ্টির সঙ্গে আমার প্রাথমিক পরিচয় হয় কয়েক বছর আগে, পরোক্ষভাবে সেও এই কাগজেরই সুবাদে। চার নম্বর পত্রিকার অন্য এক কার্য্যকর্তা একটি অনবদ্য কবিতার প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। আমি পড়ি:

সচেতনে যেও বঁধু ইস্টিশন ঘাটে, ওভার-ব্রীজের নিচে
মড়া শুয়ে আছে, সে মড়ার বাঁকা ভুরু, আঁকা চোখ
শিয়রে ময়ূরপুচ্ছ নাচে…
কলসি ডুবাও রাধা, দেখ জল খল খল হাসে
সাবধানে যেও বঁধু, ঘোরকালো পরকীয়া মড়া উঠে বসে
ফিসপ্লেট খোলা আছে, অদূরে রেলের বাঁশি বাজে…

এ কবিতার নাম মাধুরীর সঙ্গে নাই কেউ, তার স্রষ্টার নাম কৌশিক বাজারী। সেই প্রথম আমি এই কবির নাম শুনি, সেই প্রথম আমি তাঁর কবিতাপাঠে একবিংশ শতাব্দীর কোনও এক রাধিকার যন্ত্রণাক্লিষ্ট, অমঙ্গলদীর্ণ ঘনঘোর বিরহে অন্বিত হই। ফলশ্রুতি হিসেবে আমি তাঁর কবিতার অন্বেষণে রত হই এবং পরবর্তীতে জানি যে এ কবিতাটি স্নিগ্ধ মধ্যযুগীয় প্রজ্ঞায় রচিত তাঁর একগুচ্ছ কবিতার অন্তর্গত, যার কেন্দ্রবিন্দুতে এই ক্লিন্ন বর্তমানের এক বিপন্না, পরিত্যক্তা নারী; তার শেষ বাস ছেড়ে গেছে, তার সামনে ফিসপ্লেট খোলা লাইনে ছুটে আসছে ট্রেন!

বাজুবন্ধ, স্বর্ণকঙ্কণ, একে একে আলোর প্রতীক সব
খুলিয়াছে দ্বারে
চলেছে শ্রীমতী দৃঢ় নীল অভিসারে
শরীর ঢেকেছে কালো মলমল, অন্ধকার ঢাকিয়াছে তারে
বাতিস্তম্ভে কৃষ্ণপক্ষ, জেগে আছে শুধু তার মুখ,
শেষ বাস চলে গেছে, অবনত চাঁদ চ্যুত-কক্ষ তার
ডুবিয়াছে অভিসারে, কৃষ্ণ-আঁধারে
থির মুখের বিজুরি…

এই অনবদ্য সিরিজটি অবশেষে ‘মাধুরীর সঙ্গে নাই কেউ’ নামে গ্রন্থিত হয়। আর যে প্রবল বিস্ময়ে আমার কৌশিক বাজারীর কাব্য পাঠের সূচনা, তাঁর বহু কবিতা পাঠান্তে, তাতে আজও আমি লগ্ন হয়ে আছি: এই মল্লভূম নিবাসীর গভীর নির্মাণগুলিতে এই কবিতা পাঠকের শ্রবণে বিষ্ণুপুরী ধ্রুবপদ বেজে ওঠে।

এই ধ্রুবপদ শব্দটির কোনও বিকল্প আমি মুহূর্তে অন্বেষণে অক্ষম, কেননা লিখতে লিখতে সমস্ত অন্তরাত্মা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে কৌশিক বাজারীর ‘নাচে জন্ম নাচে মৃত্যু’ নামক একটি কবিতার কিছু অমোঘ পদাবলী যা সমনামের একটি কাব্যগ্রন্থে সংকলিত:

নক্ষত্রবীথির ফুল ঝরে পড়ে ব্রহ্মাণ্ডের ভোরে
সে ফুলের রেণু অতি আলোকবর্ষ দূর হতে
ছড়িয়ে রয়েছে অন্ধকারে

মীনযোনি পক্ষীযোনি পশু আর বৃক্ষযোনি মাঝে
জন্ম লাগি মৃত্যুলাগি রেণুর কণিকা ভিক্ষা মাগে …

ভাবতে আশ্চর্য লাগে এই প্রগাঢ় দার্শনিক কসমিক উপলব্ধির উৎসমুখ খুলে যায় রাঢ় বঙ্গের বহিরঙ্গে রুক্ষ অথচ অন্তরঙ্গে পেলব মৃত্তিকায়। যেখানে কবির নিজস্ব জবানে তাঁর “মায়ের বালিকাবেলা সাদা কালো গরুগুলি খুলে দিয়ে বিচুলি খাওয়ায়। গ্রামের মেয়েরা তাকে মোহরী মোহরী বলে ডাকনামে ডেকে ডেকে ফেরে”। কবি লেখেন “আমার বাবা বরাবর চা-দোকানি। মাঝে একবার মুদির দোকান দিয়েছিল, সেখানে আলোচনা চলত ফিদেল কাস্ত্রো কীভাবে শেষ-পর্যন্ত ব্যক্তি-অপমানের জ্বালায় জ্বলতে জ্বলতে, বাতিস্তার স্বৈরশাসন উপেক্ষা করে একাই এক পার্কের বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে পড়ে তার ক্ষোভ বমন করতে থাকে” এই সেই নিম্নবিত্ত গর্বিত যাপন যা এককালীন স্বঘোষিত ‘ফেরিওয়ালা’ কৌশিক বাজারীর  শৈশব নির্মাণ করে, গড়ে তোলে তাঁর জীবনদর্শন, যাতে অন্বিত হয় মানবিক বামপন্থী সচেতনতার সঙ্গে এক শাশ্বতকালীন সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার, যেখানে ভগবানের উপর পড়ে মানুষের ছায়া, যেখানে ধর্মান্ধতার প্রবেশ নিষেধ।

কৌশিক বাজারীর কবিতা জুড়ে তাই ঊষার আলোর মতো এক স্নিগ্ধ উদারতার স্পর্শ জড়িয়ে থাকে:

সেই দোকানের চত্বরে ভগবানের উপর ছায়া ফেলত মানুষ। আর তাই বড় হয়ে, যখনই মাঝে মাঝে মাথা ঘুরে গেছে প্রবল রৌদ্রে, তখনই চাঁদের আলোয় দেখেছি সেই জ্যোৎস্নামাখা ভূত, যার নাম মানুষ, সে এসছে এইসব রোদ বৃষ্টি পার হয়ে। আলোকবর্ষ দূর থেকে আসা নক্ষত্রলোকের সেই মানুষকে বলেছি বারবার: ওগো, দু’দণ্ড বসে যেও, এতখানি পথ যদি এলে…

এই সুগভীর মানবিকতায় প্রোথিত দার্শনিকতা শক্ত হাতে ধরে থাকে কৌশিক বাজারীর কবিতার হাল, আর আঙ্গিক নির্মাণে তাঁর স্বাভাবিক দক্ষতা সে কবিতা তরণীর অমল ধবল পালে মন্দ মধুর পবনসম বয়ে যায়। ছন্দে এই কবি অনায়াস, অথচ কোথাও তা প্রদর্শনের কালোয়াতি প্ৰচেষ্টা নেই, তাঁর গদ্যাঙ্গের নির্মাণগুলিকেও কবিতা বলে সনাক্ত করতে দ্বিধা হয় না একটুও। ঐতিহ্যের সুদৃঢ় প্রেক্ষিতে স্থিতধী এই কবি ফর্মের পরিবর্তন ঘটান বিষয়বস্তু তথা অনুভূতির রূপায়নের স্বার্থে, যথার্থ প্রয়োজনে, বিনা গিমিকে, এবং সহজাত অনায়াসে। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম যে কবিতাগুচ্ছ ছাপতে চলেছে, সেখানে কৌশিক বাজারীর প্রকাশভঙ্গি তাঁর পূর্বতন কবিতার তুলনায় বহুলাংশে বিবর্তিত। আমি বিস্তারিত আলোচনায় যাবো না। বিদগ্ধ পাঠককূল নিজগুণে তা অনুভব করুন, সেখানে আমার হস্তক্ষেপের প্ৰয়োজন নেই।

কিছু নিতান্ত ব্যক্তিগত অবলোকন তবু ধরা থাক এখানে। বাণিজ্যিক কবিতায় আমার প্রবল অবিশ্বাস, আমার অবিশ্বাস দলবদ্ধতায়, আমার সংশয় কবিতার পদক প্রাপ্তিতে। একজন সফল কবি প্ৰকৃতপ্রস্তাবে, অন্তত: আমার বীক্ষণে, একজন একাকী মানুষ, অথচ তিনি অসামাজিক নন, তাই আত্মজকে নিয়ে কৌশিক বাজারীর ‘বুবুর সঙ্গে দ্রাক্ষাবনে’ পুস্তিকাটির প্রকাশ সন্দেশে আমি পুলকিত হয়েছিলাম। দুর্ভাগ্যবশত বইটি সংগ্ৰহ করা হয়ে ওঠেনি, তাই খেদ রয়ে গেল মাধুরী কিংবা নাচে জন্মের কবিতাগুলির সঙ্গে কৌশিক বাজারীর দ্রাক্ষাবনের কোনও নিদর্শন এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধে উপস্থিত করতে না পেরে।

আমার নিজস্ব অনুভবে কৌশিক বাজারীর কবিতাকৃতি যদিও আজ পূর্ণ প্রস্ফুটিত: ফুল্লকুসুমিত সে দ্রাক্ষাবনে, আজি বসন্ত আওল রে!

 

কৌশিক বাজারীর কবিতা

ঘুমন্ত

পাথরে ঘুমন্ত মুখ কার—

যেন সকালের রোদ উঠে গেছে

…কালো স্থির জল
মাঝেমাঝে হাওয়া বয়,

ঢেউ ওঠে
জলের ভিতরে যেন স্বপ্নে কেউ
স্নান সেরে নিল

আমি তার ওইপারে ঝুঁকে পড়া

নিমডালে
মাছরাঙা… নিমগ্ন, অস্থির

 

বারান্দায় জাফরির রোদ

এমন মুখ করে এসেছ কেন আজ?
যেন আমারই মুখ, পথের ধুলা-সাজ
কুড়িয়ে এনেছ আনমনে, দুখী দুখী
তোমার আলোর মায়া, পড়ে আছে তাজ
ভগ্ন বারান্দার পাশে একমুখী…
তোমার নীরব এক মুখর উত্তর,
দক্ষিণের দিকে বয় শীত
শরীরে শিউর জাগে, জ্বর,
এরকম মুখ করে ছায়াও রয়েছে

আচম্বিত! ঋতু ঘুরে যায়…

 

ভেতরের ভূমণ্ডল

ঘুমন্তকে ছুঁয়ে দেব?
স্বপ্নের ভেতরে যদি নিদ্রা ভেঙে যায়!

যদি তার দুই চক্ষু, বাইরে নয়, নিজের ভেতরে খুলে যায়!
আমিও কি উঁকি দেব?
ভেতরের ভূমণ্ডলে কতদূর উড়ে গেল দিগন্তের পাখি
তার ডানার পালকে সেই বিকালের রং রোদে ভেসে যায়
ছুঁয়ে দেব?
এরপর স্পর্শের আর কিছু বাকি থেকে যায়?

 

হন্তারক

আর দ্বিধা জেগে উঠবে না?
যখন মধ্যরাত উগলে দেয় চাঁদ
চাঁদের শিয়রে জাগে অমা
কী যে অন্ধকার হয়ে আসে দেহ!
এই শীত, প্রখর হাওয়ার ফাঁদ
এই দেহ ঘূর্ণিময় সমা
যা কিছু অব্যক্ত আর পানপাত্রে সুরা
যা কিছু উজাড় জাগ্রত
তার পাশে রাখো এই অগ্নিগর্ভ গেহ
ভীষণ করাল গ্রাসে মুগ্ধ হলে প্রাণ
কে বা ছিল কার হন্তারক!
সবুজ আপেলে জাগে বর্ণময় ক্ষত…

 

সংসার

অস্থায়ী অস্থায়ী অস্থায়ী বালুচর
ঘর তুলছি, আবাদ, মাটি খুঁড়লে উঠে আসে জল
জলের উপরে মাটি, মাটি ভেবে আঁকড়ে ধরি ঘর।
ভোরবেলা সরে যাচ্ছে ঘুম, স্বপ্ন ভাঙছে বেলা করে খুব
আবাদ, মাটির ধন, স্বপ্নে দেখা সোনা সোনা ফল।

জলে ভেসে যাচ্ছে চরাচর…

 

জগৎ

অন্ধকার, ডুবে যাচ্ছি
এইমাত্র একখণ্ড চাঁদ সৃষ্টি হল
এন্ড্রোমিডা মিশে গেল অন্য এক
ছায়াপথে এসে
নইলে আমরা নই কেউ নই কিচ্ছু নই, ধ্যান
এইমাত্র গ্রহাণু সংঘাতে চূর্ণ দিগবিদিক জ্ঞান
নক্ষত্র সংঘাত ওই আলোকবর্ষ ব্যাপী ভুল?
যেভাবে ছুঁয়েছ তুমি মৃণালের বোঁটা
যেভাবে ছুঁলাম ওই ফুল
সৌরপ্রেম, অভিকর্ষ, তারার প্রপাত ভালবেসে?

এন্ড্রোমিডা মিশে গেল ছায়াপথে এসে…

 

দেখা

যখন পৃথিবী তার পরিক্রমা বহুদূর সমাপ্ত করেছে
আরও কিছু পাহাড় ও নদ তার বিনষ্ট হয়েছে
ইতিহাস বেড়ে গেছে কয়েকশো পুস্তকে
আর ইতিহাস মুছে গেছে তোমাদেরও
চারিদিকে নতুন মানুষ আর নতুন নগর দেশ ঘাট
সেই পুরাতন পথগুলি মাটির অনেক গভীরে ডুবে গেছে
উপরে নতুন পথ, গাছপালা, নতুন রিরংসা
যেন গাছের শেকড় থেকে আরো বহু নিচে
অন্ধকারে জমে আছে সুপ্রাচীন কথকতাগুলি…
সেইখানে অকস্মাৎ দেখা হয়ে যাবে আমাদের
সেদিনও গ্রামের পথে হয়ত এসেছে এক নবীন ভিখারি
বীজধানগুলি সব ছড়ানো হয়েছে ভোরবেলা
শাবকের মায়াবী চাহনি দেখে গাভী তার দুধ উথলায়
ঘরে ঘরে প্রেম মায়া, বাতাসে তেজস্ক্রিয়া
কোথাও অমিল কিছু?
ভিক্ষাপাত্রে মাধুকরী জমে উঠেছিল? তবু
ফের একবার অলীক নজরে চেয়ে চলে যাব
অন্য কোনও ভবিষ্যৎ পৃথিবীর দিকে…

আবার অনেক কাল পর দেখা হবে, শোনো…