Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মন্দিরময় অযোধ্যা-বনকাটি

প্রণব ভট্টাচার্য

 

বনকাটি। মন্দিরময় বনকাটি।

সে কোন বনকাটি। কোন সে বনের ধারে।

বিখ্যাত গড় জঙ্গলের গায়ে গা লাগিয়ে আমাদের এই বনকাটি। সে এক প্রাচীন গ্রাম। কিন্তু আজ আর তা বলা সম্ভব নয়। বন কেটে বসত কবে শুরু হয়েছিল।

বনকাটির সঙ্গে জুড়ে আছে অযোধ্যা নাম। অযোধ্যা-বনকাটি। যমজ গ্রাম। আর আমরা জোড়ে বলতেই ভালোবাসি, আর অবস্থান বোঝাতেও সুবিধা।

সুবিখ্যাত ‘গড় জঙ্গল’। যার নামের মাঝেই লুকিয়ে যেন অনেক কথা কাহিনি।

হ্যাঁ, গড় ছিল জঙ্গলের ভিতরে। ঘন; দুর্ভেদ্য সে জঙ্গল। কোথাও কোথাও দিনের আলো প্রবেশ করে না। এই জঙ্গলভূমির কথা আছে হান্টার সাহেবের ‘Annals of Rural Bengal’ সহ মিনহাজুদ্দিনের লেখাতেও।

উত্তরে অজয়। দক্ষিণে ল্যাটেরাইট মাটির উপর ‘মহাবৃক্ষ’ শালের ঘন জঙ্গল। এখনকার পূর্ব বর্ধমান জেলার আউসগ্রাম আর পশ্চিম বর্ধমানের কাঁকসা থানার অন্তর্ভুক্ত জঙ্গলভূমিই দুই বর্ধমানের জঙ্গলমহল।

এই সেই ‘ধর্মমঙ্গল’ কাব্যের বীর ইছাই ঘোষের রাজত্বভূমি। অজয়ের এপার ওপার দুপার জুড়ে ছড়িয়ে আছে ইছাই-লাউসেন যুদ্ধের নানা কথাকাহিনি। নানা স্থল-স্থাননামে তার স্মৃতি। ‘লাউসেনতলা’ লাউগড়ে। রক্তনালা, কাঁদুনে ডাঙ্গা, গড় ঘাটা এবং দেবী শ্যামারূপা আর দুপার জুড়ে লাউসেন পূজিত ‘ধর্ম ঠাকুর’-এর নানা থান। প্রায় সব গ্রামে ধর্মঠাকুরের পুজো। ওপারে লাউসেনতলায় ১৩ বৈশাখ ঢাকঢোল বাজছে তো এপারে ‘বুধো রায়ের তলায়’ সেই ধর্মরাজের পুজো।

পাল রাজাদের আমলে ছিল সীমান্তবর্তী এই এলাকায় গড়।

গড়ের অধিপতি কর্ণসেনকে অতর্কিত আক্রমণে ইছাই ঘোষ তার সৈন্যবাহিনি নিয়ে গড় দখল করে নেন। আবার পরে ধর্মঠাকুরের বরে কর্ণসেনের পুত্র লাউসেন ইছাইকে পরাজিত ও নিহত করে পুনরায় গড় দখল করে নেন। ইছাই-এর দেবী মা ভবানী শ্যামারূপা প্রিয় ভক্তের হত্যায় কেঁদে বেড়ালেন কাঁদুনে ডাঙ্গায়। মারাত্মক সে যুদ্ধে অনেক রক্তক্ষয় হয়েছে। রক্ত গড়িয়ে গেছে রক্তনালা দিয়ে। পরবর্তীকালে ইছাই-এর স্মৃতিবিজড়িত সেই স্থানে নির্মিত হয়েছিল বিখ্যাত পুরাকীর্তি ‘ইছাই ঘোষের দেউল’। অনেক পর্যটক আসেন এই দেউল দেখতে। দেউলের নির্মান কাল নিয়ে নানা বিতর্ক। তা থাক। কিন্তু এ এক বিখ্যাত দেউল।

টালির মতো পাতলা ছোট আকৃতির পোড়া ইটের তৈরি সুউচ্চ এই দেউল পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বিখ্যাত দেউল।

ইছাই ঘোষের দেউলের বর্তমান রূপ

 

১৯৪০ আলে ইছাই ঘোষের দেউল (চিত্রঋণ— শ্রী শুভ মজুমদার, আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া)

বনকাটি। মন্দিরময় বনকাটি।

পর্যটকরা চলে যান বনকাটির ভিতর দিয়েই। কিন্তু না জানার জন্যে তাঁদের দেখা হয় না বাঙ্গালার প্রাচীনতম পিতলের রথ। ১২৪২ বঙ্গাব্দে নির্মিত। এ রথের কারুকার্য নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। ঠিক তার পাশেই রয়েছে অনুপম টেরাকোটা শোভিত গোপালেশ্বর শিব মন্দির। ১৭৫৪ শকাব্দে নির্মিত। পিছনে নির্মাতা বিখ্যাত ধনী লাক্ষা ব্যবসায়ী জমিদার মুখোপাধ্যায় পরিবারের ভগ্ন প্রাসাদ।

একটু উত্তরে নীচে দিকে গেলে রায় পরিবারের বিখ্যাত কালীমন্দির। এবং একই প্রাঙ্গণে পাঁচটি শিবমন্দির। ১৭০৪ শকাব্দে নির্মিত উত্তরমুখী দুটি এবং ১৭৫৬-৫৭ শকাব্দে নির্মিত পূর্বমুখী একই ভিতের উপরে তিনটি বৃহৎ দেউল রীতির মন্দির। পূর্বে বিষ্ণু দালান। দালানের ওপারে চট্টোপাধ্যায় পরিবারের ভগ্ন প্রাসাদ। তার সামনে মুখোমুখি দুটি শিবমন্দির। তাদের টেরাকোটা ফলকগুলি নির্মমভাবে ছাড়ানো হয়েছে কোনও সময়ে। তার পূর্বে প্রায় ভগ্ন এক শিবমন্দির। রায় পরিবারের দ্বিতল বিষ্ণু দালানের ভগ্ন দেওয়াল। আর প্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ। সামান্য দূরেই দক্ষিণমুখী দুর্গাদালান। এক বটবৃক্ষের সহস্র বাহু দিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে আছে। পশ্চিমমুখী বিষ্ণুদালান। উত্তরমুখী দুটি ভগ্ন শিবমন্দির।

অতি প্রাচীন বয়স-না-জানা কদমগাছের নীচে দাঁড়ালে ইতিহাস মনের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলে উঠবে।

১৭০৪ শকাব্দ থেকে শুরু করে ১৭৫৬-৫৭ পর্যন্ত সময়কালে নির্মিত হয়েছে এই সব মন্দিরগুচ্ছ। সুড়ঙ্গ, গুপ্ত কক্ষ সহ প্রাসাদ। ডাকাতের ভয়। বর্গীদের আক্রমণ। ইংরেজদের সঙ্গে রাজা ত্রিলোক চাঁদ, চিত্রসেন-দের বিবাদ। তার প্রভাব পড়েছিল বনকাটির মুখোপাধ্যায় পরিবারের ওপর।

রায় পরিবারের মন্দির, টেরাকোটার কাজ, অশীতিপর অনিল রায় মহাশয় এবং ভগ্ন প্রাসাদ

সংক্ষেপে বলা হল প্রাচীন সে বনকাটির কথা।

নিশ্চয়ই একটু বিস্তৃত হতেই হবে। তা না হলে আমাদের মন যে ভরে না। ইতিহাসটাকে না জানলে হয়?

সে প্রায় দুশো বছর আগের কথা।

‘বারো ঘর এক উঠোন’-এর মতো প্রায় একই প্রাঙ্গণে বসবাস করেন একসঙ্গে অনেকগুলি ব্রাহ্মণ পরিবার। সবাই নিজের নিজের মতো ব্যবসা করেন। ব্যবসা করে তাঁরা বিরাট বড়লোক হয়েছেন। লাক্ষা বা গালা, কাঠকয়লা, নানা বনজ দ্রব্য এবং পরে কয়লার ব্যবসা। ব্যবসা চলে জলপথে। নালা বেয়ে ডিঙ্গি নৌকা যায় অজয়ে। সেখান থেকে ইলামবাজার। আরও দূরে। কলকাতার ইংরেজ বাণিজ্যিক হাউসগুলির সঙ্গেও ব্যবসা।

রায় পরিবারের কর্তা অশীতিপর অনিল রায় মশাই দাবী করেন তাঁরাই প্রাচীনতম পরিবার। আদতে বন্দ্যোপাধ্যায়। রায় পদবী তাঁরা পেয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব দরবার থেকে। বনজঙ্গল কেটে পরিষ্কার করে গ্রাম স্থাপনা; চাষাবাদের জন্য পত্তনী পেয়েছিলেন তাঁরা। তাঁদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন বাংলার বিখ্যাত সেন রাজাদের তন্ত্রগুরু মহেশ্বর প্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়।

এই পরগণার প্রাচীন নাম ‘সেনপাহাড়ি’। দক্ষিণ ভারতের কর্ণাট দেশ থেকে সেন রাজাদের পূর্বপুরুষরা এখানে এসে প্রথম এই এলাকায় বসতি স্থাপন করেছিলেন। নাম তাই সেনপাহাড়ি। কথিত আছে তন্ত্রসাধনার জন্য রাজা বল্লালসেন বা লক্ষ্মণসেন এই জঙ্গল ভূমিতে আসতেন। এখানেই নাকি রাজা লক্ষ্মণসেনের সঙ্গে কবিবর জয়দেবের সাক্ষাৎ হয়েছিল। রাজার দ্বারা অনুরুদ্ধ হয়েই কবি রচনা করেন তাঁর অমর কাব্য ‘গীত গোবিন্দম’।

সেনপাহাড়ির রাস্তা

একসঙ্গে বসবাস। পারস্পরিক আত্মীয়তার সম্পর্ক, বৈবাহিক সূত্রে। রায় পরিবার বড় হয়েছে। নানা শাখা।
পরস্পর জোট বেঁধে থাকা। একসঙ্গে ব্যবসা। আবার স্বাধীনভাবেও। এদের মধ্যে মুখোপাধ্যায় পরিবার লাক্ষা বা গালার ব্যবসায় বিশাল ধনী হয়ে উঠেছেন। তাঁদের পরিবারের প্রধান রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় নির্মাণ করিয়েছিলেন বিখ্যাত গোপালেশ্বর শিবমন্দির। ১৭৫৪ শকাব্দে। অনবদ্য তার টেরাকোটার কাজ। পঞ্চরত্ন এই শিবমন্দিরের সামনের দিকই টেরাকোটা শোভিত। রামসীতার রাজ্যাভিষেক। অন্যান্য নানা পৌরাণিক চিত্র। দশ মহাবিদ্যা। চৈতন্যলীলা। নানা সামাজিক চিত্রণ।

পঞ্চরত্ন গোপালেশ্বর শিবমন্দির

শেষটুকু বনকাটির পিতলের রথের কথা ধরেই করি।

তারাপদ সাঁতরা মশাই উল্লেখ করেছেন, বাংলায় যে ৪২-৪৩টির মতো পিতলের রথ আছে তার মধ্যে বনকাটির রথটিই প্রাচীনতম। ১২৪১ বঙ্গাব্দের ২ মাঘ এর নির্মাণকাজ আরম্ভ এবং ১২৪২ বঙ্গাব্দের ১৫ আষাঢ় নির্মাণকাজ শেষ। তার সম্মুখভাগে খোদিত আছে। লোহার ফ্রেম, ৮টি লোহার চাকা, সম চতুষ্কোণ প্লাটফর্ম-এর ওপর পঞ্চরত্ন মন্দিরের আদলে রথটি নির্মিত। উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট। পিতলের পাত দিয়ে মোড়া। আর এই রথ বিখ্যাত এর গায়ের অলঙ্করণের জন্য। এত বিষয়বৈচিত্র্য আর সাবলীল ড্রইং-এর উপর অসাধারণ এনগ্রেভিং। রামায়ণ, মহাভারতের কাহিনির চিত্ররূপ তো আছেই, অন্যান্য পৌরাণিক চিত্রাবলিও যুগের রীতি মেনে আছে। পাশাপাশি আছে নানা সামাজিক চিত্র। আছে যুদ্ধযাত্রা, সৈনিকদের অবয়ব। তার দুপাশে আছে দুটি মিথুন দৃশ্য, যা নানাভাবে ভাবায়। আছে মেয়েদের জিমন্যাস্টিক, সামাজিক নরনারীর নানা চিত্রণ, সম্মুখভাগে রামসীতার রাজ্যাভিষেক, আর এক দিকে ভীষ্মের শরশয্যা। অর্জুন পাতালগঙ্গা থেকে তীর নিক্ষেপ করে ভীষ্মকে জলপান করাচ্ছেন। আবার কোথাও অর্জুনের লক্ষ্যভেদ। আছে চৈতন্যলীলার নানা চিত্র, নরনারীর প্রেমালাপ, নারী বীণাবাদিকা ইত্যাদি। এতটাই এর বিষয়বৈচিত্র্য। নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। আর সমগ্র রথের চারদিকের অলঙ্করণ দেখতে হলে আসতে হবে রথযাত্রার একদিন আগে। তখন রথটিকে বের করা হয়।

এই রথের অলঙ্করণ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল শিল্পাচার্য নন্দলালের। তিনি তাঁর ছাত্রদের নিয়ে সম্ভবত ১৯৪২-৪৩ সালে এসেছিলেন। ছাত্রেরা বেশ কিছু চিত্র রাবিং করে নিয়ে গিয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনের কালো বাড়ির গায়ে কমপক্ষে চার-পাঁচটি রিলিফ ভাস্কর্য আছে যার চিত্র এখান থেকে গৃহীত। কৌতুককর একটি চিত্র। লাঠি হাতে কোমর বাঁকিয়ে এক ব্যক্তি। তার পিঠের উপর বানরছানা। শিল্পীদল কারা? তাঁরা কি স্থানীয়? বা আগত স্থানীয় সূত্রধর বা কর্মকার সমাজের, না কি বাইরের? পটচিত্রের লাইনের সঙ্গে এখানকার চিত্রের লাইনের মিল আছে। কোনও পটুয়াদের দল কি আঁকলেন? নানা বিতর্ক আছে এ নিয়ে।

রথের বিভিন্ন কারুকার্য

আরও অনেক বিশিষ্ট মানুষ এই রথ দেখে গেছেন। শিল্পী মুকুল দে, অমিয় কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ।

কোণার যে মৃত্যুলতা তা ঢালাই-এর। রথের সারথি এবং অশ্বদ্বয়ও ঢালাই-এর। পরে রথের সময় জোড়া হয়। এগুলি পিতলের। এই কাজ যে আদুরিয়া অমরপুর বা টিকরবেতার শিল্পীদের তাতে মনে হয় সন্দেহ নেই।

এই রথটি নির্মাণ করিয়েছিলেন সেই সময়ের বিখ্যাত ধনী, লাক্ষা ব্যবসায়ী জমিদার রামপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। শোনা যায় লাক্ষা ব্যবসায়ের এক দিনের লাভের টাকাতে নাকি নির্মিত হয়েছিল এই অসাধারণ শিল্পকীর্তিটি।

সমগ্র অযোধ্যা-বনকাটি, তার মন্দিররাজি এবং পিতলের রথ— এসবের যথাযথ সংরক্ষণ দরকার।


*ছবিগুলি লেখকের