Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বহতা অংশুমালী

পাঁচটি কবিতা -- বহতা অংশুমালী

পাঁচটি কবিতা

 

অভিসার: ধাক্কা ও কুক্কুরী

ক) ধাক্কা

হ্রদের ওপাশের বাড়িগুলোর লাল, হলুদ, আর কমলা আলোর মতো আপনাকে দেখাল
বড় মায়াময়
দেখুন, একটা দুঃস্বপ্ন এই শহর
যেখানে মা বাবা নেই
কখনও থাকবে না
শৈশব বলতে হোমওয়র্কের শেষে একটা সোনালী কিছু
হোমওয়র্ক শেষ করলেই এক্লেয়ার্স ধরনের চকোলেট কিছু
এরকম একটা শক্ত হোমওয়র্ক আমাকে দিন
সেটা শেষ করলে আপনি আমার দরজার বাইরে দাঁড়াবেন
ঘেমেনেয়ে!
ঘামে ভেজা শার্টের প্রসঙ্গ আসতে আসতে আমি ভিতর ভিতর ভিজে যাই
হ্রদের ওপাশের বাড়িদের মতো আপনাকে মায়াময় দেখালে
শহরের বুকের মাঝখান দিয়ে একটা কালো রঙের হ্রদ চলে গেলে
ছাদে উঠলেই উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো অলৌকিক পারঙ্গম হাওয়ায়
আমার মনে হয় আমি এক্ষুনি অভিসারে যাব
এই সময়ে আমাদের জঙ্গুলে আবাসনের পিছনের দরজার সামনে একটা বাস এসে থামে
সেই বাসের কনডাক্টর আমার দিকে এক পলক চেয়ে দেখলে বুঝে যায় আমি অভিসারে চলেছি
যেখানকার টিকেট কাটা সেখানকার নামের ভিতরে জল
আপনার অ্যাপার্টমেন্টের নাম পক্ষীরাজ
তার বাইরে ঘোড়ার খুরের অদ্ভুত প্রতিকৃতি
সেই বাড়িতে একটি পশুচিকিৎসক থাকেন
আর তাঁর শহুরে চুল কাটা দারুণ ইংলিশ বলা বৃদ্ধা মা
আমার সঙ্গে তাঁরা লিফটের ক্ষুদ্র অবসরের হামসফর
অপাঙ্গে তাকিয়েই বুঝে নেন, আমি অভিসারে চলেছি
তারপর আপনার ডোরবেলে একটা কালান্তক গন্ধ
জল আর বায়ু, বৃষ্টি আর মেঘ, আপনার ড্রয়িং রুমে বসে বিচলিত হয়
আপনি নাকি দৈত্যাকার গণকযন্ত্রে জলহাওয়ার সিমুলেশন করেন
বর্ষা আর বাদল একসঙ্গে অদ্ভুত সঙ্গমে মিশে যেতে যেতে হঠাৎ বিকলাঙ্গ হয়ে পড়ে নাকি!
আমার হঠাৎ কলিংবেলে
আপনার জানলার সেই হ্রদ-এর অপর পারের মৃদু আলো
সে এখন এমন বিদারী! এমন বিকট!
আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আপনার প্রকট বিরক্তি সেই আলোয় দেখা যায়
সমস্ত শহর বুঝতে পেরেছিল
এমনকি একটি প্রায় ধর্ষক বাসের প্রায় উদ্যত কন্ডাক্টর
আর একটি ভেটিরিনারি ডাক্তার
বুঝতে পেরেছিল
যে আমি অভিসারে চলেছি
একটি দূরগামী আলো ধাওয়া করে
শুধু আপনার মুখে এক এফোঁড় ওফোঁড়
বিরক্তির তীর
না বোঝার প্রশ্নচিহ্নে থাকে।

 

খ) কুক্কুরী

এরকম একটা ধাক্কার পরে আমি হঠাৎ বসন্তের শহরে ভুল ক’রে আসা শীতের হাওয়ার মতো
বিভ্রান্ত উদ্বেল পদে দৌড়ই
দৌড়তে দৌড়তে আপনার অ্যাপার্টমেন্টের পিছনের গাছে ঘেরা অ্যাভিনিউ
যেখানে হলুদ ল্যাম্পপোস্টের আলো পাতার কাটাকুটিতে মাটিতে শুয়ে শুয়ে দুলছে
সেখানে ওই ভেটিরিনারি ডাক্তার ধূমপান করছিলেন
হাতের বকলশে তাঁর তিনটি কুক্কুরী
আমি তাঁর প্রায় গায়ের কাছে এসে পড়ি
তাঁর চোখটা নানান বোঝাবুঝিতে ভর্তি
যেন মানুষ তার থকথকে কাদায় আটকে যাবে
যেন মানুষ তার ম্যানগ্রোভ শিকড়ে হোঁচট খাবে
খেয়ে পড়ে থাকবে, আর উঠতেই চাইবে না
কেন জানি না, আমি এমন সব উত্থানশক্তিরহিত প্রকল্পেও ভিতর ভিতর ভিজে যাই
সেই ডাক্তার আমাকে ডেকে বলেন,
‘তুমি আমার কুক্কুরী হবে?
রাতের মেনু আজকে চিকেন স্টু
কালকে আমি তোমার বুকে স্টেথো লাগিয়ে সব দুঃখ মেপে দেব’
‘আর আপনি কি আমাকে হোমওয়র্ক দেবেন?
যা শেষ করলে একটা করে পেডিগ্রি ডগফুডের হাড় পাওয়া যায়?’
‘হ্যাঁ
তাও দেব’
আমি অনতিবিলম্বে ডাক্তারের কুক্কুরী হয়ে যাই
তাঁর মা আমাদের সবার গায়ে হাত বুলিয়ে দেন
আমি দুদিন অন্তর তাঁর এক অদ্ভুত ব্যবচ্ছেদের টেবিলে শুয়ে পড়ি
চার পা খুলে, বুকের উপর, উপুড় হয়ে
প্রোনিং ভঙ্গিতে
তিনি আমাকে কী যে করেন
তিনিও ভিজে যান
আমিও ভিজে যাই
আমাদের জলীয় স্রোত ঘরের মাঝামাঝি এসে মেশে
আমার হোমওয়র্ক একটা লাল বল নিয়ে ফেরত আসা
সে বল যেখানেই পড়ুক
আমার হোমওয়র্কের পরে আনন্দ একটা সোনালী রেখার মতো
পেডিগ্রি কোম্পানির হাড় আর আমাদের ব্যবচ্ছেদের টেবিল
মাঝে মাঝে আপনার সঙ্গেও আমার দেখা হয়
লিফটের ঝটিতি হামসফর হিসেবে
আমি অবাক হয়ে দেখি
স্বচ্ছ লিফটের কাঁচের মধ্যে দিয়ে আপনার দুশোতলার ফ্ল্যাটে উঠতে উঠতে
হ্রদের অপর প্রান্তে আমার নিভে থাকা পুরনো জানলার দিকে
আপনি অপলক তাকিয়ে আছেন

 

আবারও

তোমার ছায়া দেখলাম
অক্ষৌর গাল আর প্রাণখোলা হাসির মধ্যে
তোমার ছায়া দেখলাম আবারও
সে যে কী শেখাল তথ্যময়
আমি শুধু ঠোঁট পড়ি যেরকম হয়
ভালোবাসলাম আবারও
মাটিপড়া কফিনের থেকে
নিজের রক্তে ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে
উঠে আসলাম আবারও
ভদ্রতার সেলোফেনে আঙুল ডুবিয়ে দেখলাম
ঢুকে যাচ্ছে কতদূর!
বহুদূর
সুদূরের কাছে
বুকের সামনে এসে লৌহের ডেলা
সেখানে আঙুল ফেটে ডালিমের রসের মতন
লঘু নদী নামে
ফিরে আসলাম আবারও

 

নিমন্ত্রণ ছিল

নিমন্ত্রণ ছিল, তবু পাঠানো হল না
বিকেলের মায়া আলো ডাকবাক্স বন্ধ থেকে যায়
লালের ভিতর থেকে অন্যথার কিছু মরিচায়
অপ্রার্থিত প্রেম হয়ে রাধাচূড়া ফুল ঝরে পড়ে
নিমন্ত্রণ ছিল তবু পাঠানো হল না
সুড়ঙ্গে অথচ কিছু জলোচ্ছ্বাস হল— শান্তভাবে।
নিরুচ্চার নিঃশব্দ আমন্ত্রণ থেকে গেল শুধু
যেন কোনও পুরাতন জমিদার বাড়ি
অতিথি আসার এক সুদূরের মৃদু ইঙ্গিতে
জলসাঘর ঘষে মেজে রাখে

 

অশনি সঙ্কেত

এত বছর ধরে এই পৃথিবীতে হাঁটলাম
কত পাথর যে কুড়োলাম, হারালাম
পিরিয়ডিক টেবিলে তাদের খনিজের নাম জানলাম না কীভাবে?
ওগো! আমি এত তথ্যবিহীন এত ঠিকানাবিহীন রয়ে গেলাম কীভাবে?
নিজের ভিতর কাকে যেন খুঁজতে খুঁজতে দিন যায়
গানেদের সুরকার মনে নেই
লেখাদের কবি
কেবল অন্ধ লণ্ঠন নিয়ে
মাঝে মাঝে তোমার মুখ চিনতে পারি
রাস্তা ঠুকরে ঠুকরে হাঁটতে হাঁটতে
ফিরে দাঁড়াই
অন্ধের যষ্টি সরে যায়
হঠাৎ উন্মেষ
অশনি সঙ্কেত
বাকি সব হারিয়েছি
যেভাবে!

 

জানেন, আজ কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছি

তোমারে যে বুক থেকে ছিঁড়িব পদ্মের নাল
ব্যথা হবে কিরকম ভাবিতে এন্তেকাল আসে
তোমারে জড়ায়ে ধরি ঠান্ডা সাপ ঘুমায়েছে পাশে
তুমি ভেসে যাবে শুনে সে অবাক তাকায়েছে দেখো
সরীসৃপ তবু তারে বুঝিয়াছি হৃদি মাঝে আমি
ভালোবেসে, নদী আর সাপ, বদ্ধ পাঁক ও মানুষী
একে অপরের অন্তর্যামী