Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

এ মুহূর্তের বাংলাদেশ

রুখসানা কাজল

 



গল্পকার, গদ্যকার, ঢাকা তেজগাঁও মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান

 

 

 

কুমিল্লার পূজামণ্ডপে কোরআন শরীফ রেখে হনুমানের গদা নিয়ে পালিয়ে গেছে সন্দেহভাজন তরুণ। পেছনে ফেলে গেছে ইতিহাসের কুৎসিততম ঘটনার বীভৎস পুনরুত্থান।

ধরা সে পড়বেই। কিন্তু এই পলাতক গদাচুরিধারী কি বলবে, কে বা কারা ওর মত নগণ্য ভবঘুরে, ইয়াবাসেবীকে দিয়ে এ জঘন্য কাজটি করিয়ে নিয়ে বাংলাদেশের মুখে কলঙ্ক লেপে দিয়েছে?

ধর্মান্ধ মুসলমানদের বেশ কয়েকটি মজারু অন্ধবিশ্বাস আছে। যেমন, পর্দা বা বোরখা পরতে হবে। নারী যেহেতু তেঁতুলসম ভোগ্যচোষ্য। টিপ পরা হারাম, কপালে আরবি লেখা আছে। নেইলপালিশে আছে শূয়োরের রক্ত। চুল খাটো রাখা চলবে না। মরার পর বড় চুল কাফনের মত ব্যবহার করলে পূণ্য হবে। এরম কতশত। খেয়াল করলে দেখা যাবে, এগুলোর সবটাই মুসলিম নারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তো নারী তুমি কার? ধর্মের। ধর্ম কে? কতগুলো নিয়মনীতিতে ঠাসা কিতাবস্য কিতাব। তো মুসলিম পুরুষদের জন্যে এ কিতাবে কী আছে? তেমন কঠিন কিছু নেই। বরং সুবিধাই সুবিধা। হুরের লোভ, বিবাহের লোভ, নারীর চাইতে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকার, সন্তানের পিতৃপরিচয়ের একচেটিয়া দখলদার, ইত্যাদি ইত্যাদি।

বাংলাদেশের এক শ্রেণির নারীপুরুষ ধর্মনীতির এই ফাঁকফোঁকর ধরে ফেলেছে। তাই ধর্মকে ধর্মের জায়গায় রেখে তারা এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়াটা ধর্মান্ধ শ্রেণির লোকদের পছন্দ হচ্ছে না। এদের মগজ চুলকাচ্ছে। এই চুলকানি আরও বেড়ে গেছে আফগানিস্তানে তালিবান শকুনদের ক্ষমতা দখলের খবর জেনে। আর এর মধ্যে এসে পড়েছে সর্বজনীন দুর্গাপূজা।

বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে ইশকুল কলেজ বিশ্ববিদ্যলায়ে দুর্গাপূজার ছুটি থাকে দশ দিনের। দুর্গার সঙ্গে এ বাংলার হিন্দু-মুসলিম ঘরের বিবাহিত মেয়েরা বাপের বাড়ি বেড়াতে আসে। দুর্গা আসবে বলে যে অভ্যর্থনা কমিটি হয়, তাতে মুসলিম সদস্যরা থাকে। দুর্গার থাকা খাওয়া আরাধনা বিদায়ের খরচাতেও মুসলিমদের অংশ থাকে। ভোগের লাইনে হিজাব বোরখা টুপিরা নিঃশঙ্কে একটি প্যাকেট নিয়ে আরেকটির জন্যে হাত বাড়িয়ে দেয়। সোৎসাহে আরতি নাচে মুসলিম ছেলেমেয়েরা। পূজা উপলক্ষে হয় নৌকা বাইচ। দুর্গার সর্বজনীন রূপ ফুটে ওঠে বাংলাদেশে। তাহলে প্রতি বছর প্রতিমা ভাঙে কারা? কার্তিকের ময়ূর, গণেশের নাক, লক্ষ্মী সরস্বতীর বুক, দুর্গার মাথা, অসুরের হাত, কারা ভেঙে ভয় দেখায়— সুবোধ তুই পালিয়ে যা!

যারা ভাঙায় তারা অন্ধকারে থাকে। তারা বেহেশতের লোভ আর টাকা দিয়ে এ কুকর্মগুলো করিয়ে নেয়। এই অন্ধকার-ঢাকা ঘৃণ্য লোকগুলোই ভারতবর্ষকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে নেওয়া সেই ধর্মান্ধ ভূতদের উত্তরাধিকারী। আর এদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে অনেকগুলো স্বার্থবাদী গোষ্ঠী, ক্ষমতাসীন সরকারের বিরোধীপক্ষ, সরকারের অভ্যন্তরে সুঁই হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরুনো ঘাপ্টিবাদী এবং ঈর্ষান্বিত দেশিবিদেশি শক্তিবর্গ। যেমন কিনা ছিল পঁচাত্তরের বাংলাদেশে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধর্মহীনতা বলে অপপ্রচার করে সাধারণ মুসলিমদের ক্ষেপিয়ে তুলেছিল এরা।

গত দশ বছরে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন স্বনির্ভর মুখ হয়ে উঠেছে। বিদেশি অনেক রাষ্ট্র বাংলাদেশের তাক্‌ লাগানো এ অবস্থা দেখে বিস্মিত। ভয়াবহ কোভিড মহামারি বাংলাদেশের এ উত্থানকে চোট লাগাতে পারলেও একেবারে পর্যুদস্ত করতে পারেনি। প্রবাসী আয় বেড়েছে অভূত পরিমাণে। রাজনীতিতে রয়েছে স্থিতিশীলতা। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হিসেবে সামরিক অভ্যুত্থান সহজে সম্ভব হলেও আগের সেই প্রবণতা নেই। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও রয়েছে ভারসাম্যনীতি। আভ্যন্তরীণ উন্নয়নে পদ্মাসেতু এবং মেট্রোরেল ধামাকা জাগিয়েছে। বিশেষ করে কানকথা শোনা কুয়োব্যাং বিশ্বব্যাঙ্ককে ঝামা ঘষে নিজেদের পয়সায় পদ্মাসেতু করে বিশ্ববাসীকে শিরদাঁড়াটা বুঝিয়ে দিয়েছে এক সময়ের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’। সরকারপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী পাচ্ছেন যথেষ্ট প্রশংসা এবং সম্মান।

এটা কি করে সহ্য করে সরকারবিরোধী এবং ঈর্ষান্বিত দেশিবিদেশি বন্ধুরা!

ফলে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে হত্যা করতে যেমন মহম্মদ বেগের মত অনুল্লেখ্য লোকের প্রয়োজন হয়েছিল লর্ড ক্লাইভ এবং মীর জাফরের, তেমনি এসেছে কুমিল্লার সন্দেহভাজন হনুমানজির গদাচুরিধারী। ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে কুমিল্লা শহরের নানুয়া দীঘি অঞ্চলের একটি মসজিদ। সন্দেহভাজন ব্যক্তি এবং কয়েকজন লোক। পবিত্র কোরআন শরীফ হাতে বেরিয়ে আসছে একজন এবং কিছুক্ষণ পর হনুমানজির গদা কাঁধে হেঁটে চলে যাচ্ছে সেইজন। তো হাতের কোরআন শরীফটি গেল কোথায়?

দেখা গেল পূজামণ্ডপে হনুমানজির কোলে। দুর্গাপূজার অনেক উপাচার রয়েছে জানতাম কিন্তু কোরআন শরীফ তো কোনও উপাচার নয়! আর সংখ্যাগুরু মুসলমানের দেশে টিমটিম করে জ্বলতে থাকা হিন্দু সম্প্রদায় কোন সুখে প্রতিমার কোলে পবিত্র কোরআন শরীফ রেখে নিজেদের বিপদ ডেকে আনবে?

কিন্তু বিপদ এসেছে এবং কোরআন শরীফ অবমাননার অভিযোগে গত কয়েকদিনে বাংলাদেশের কয়েকটি জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘর বাড়ি প্রাণ ধ্বংস হয়েছে। পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে কয়েকজন উন্মত্ত দাঙ্গাকারী। হায় রে ধর্মান্ধদের দল, আল্লাহ সর্বত্র বিচরণময়। তার ইশারা ছাড়া গাছের পাতাও নড়েচড়ে না তাই যদি বিশ্বাস হয় তবে তো নানুয়া দীঘির পাড়ে পূজামণ্ডপেও আল্লাহর অগাধ অপ্রতিদ্বন্দ্বী উপস্থিতি ছিল। তাহলে দাঙ্গা করতে হল কেন?

হল।

কারও মতে ভারতের এনআরসি রোধে এটা হিন্দুরাই করেছে। সাতচল্লিশের দেশভাগের স্বপক্ষে ছিল হিন্দু-অধ্যুষিত জনগণের ভোট। জাতপাতে বিভক্ত শুদ্ধাচারে বিশ্বাসী হিন্দুসমাজ ম্লেচ্ছ মুসলিমদের সঙ্গে থাকতে চায়নি। অন্যদিকে মুসলিম-অধ্যুষিত জনগণের ভোট ছিল দেশভাগের বিপক্ষে। ফলে দুই সম্প্রদায়ের ভেতর একটি অবিশ্বাসী সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কয়েকবার ভয়াবহ দাঙ্গাও হয়ে গেছে। নিরাপত্তার জন্যে বাংলাদেশের যে কোনও হিন্দু পরিবারের কিছু সদস্য যে ভারতে থাকে এটা ওপেন সিক্রেট। এনআরসি নিয়ে মোদিজি বড্ড জ্বালাচ্ছেন। সুতরাং একটি দাঙ্গা হলে…

কেউ আবার পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি এবং মমতা ব্যানার্জির কাছে গোহারা হারায় মোদীপন্থীরাই এটা করিয়েছে বলে গোপনে মত দিচ্ছে।

কেউ কেউ আবার কাটাকুটির যুক্তি দিচ্ছে। ভারতে কি মুসলিম নির্যাতন হয় না? খুন করে ফেলে দিচ্ছে, জমি কেড়ে চাষ করে দিচ্ছে। চাকরিক্ষেত্রে বৈষম্য রেখেছে। এমনকি মুসলিম শুনলে বাড়িভাড়া পর্যন্ত দেওয়া হয় না। বিশ্বে উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত ভারতে যদি ধর্মবাদী দল ক্ষমতায় বসতে পারে তো ধর্মধারী দল নিয়ে বাংলাদেশের প্রগতিশীলদের এত জ্বলনপুড়ন কেন বাহে!

সচেতন জনগণ মাত্র জানে এগুলো লাগসই যুক্তি নয়। ধর্মবাদী দলকে মেনে নেওয়ার মানেই হচ্ছে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে স্বীকার করে নেওয়া। এ শক্তির লেজ ধরে যে তালিবানি শকুনরা চলে আসবে না তার নিশ্চয়তা কি?

এমনিতে যতখানি ধর্মাচরণ করলে চলে তার চেয়ে বেশি দেখনদারি চলছে বাংলাদেশে। এখন পর্যন্ত সংবিধানে গেঁথে দেওয়া রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের গেরো বদলাতে পারেনি সরকার এবং জনগণ। রাষ্ট্রধর্ম তুলে নিতে চাইলে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে একই রাজনৈতিক বৃন্তে থাকা দলীয় নেতাকর্মীরা। সঙ্গে আওয়ামী-বিরোধী দল আর চৌরাস্তার মোড়ে বাঁশমারা লাশের মত ঝুলে থাকা মৌলবাদীরা। আজ জেলায় জেলায় শহরে নগরে গ্রামেগঞ্জে মার খাচ্ছে সনাতন হিন্দু ধর্মের মানুষ। কাল ঘরে ঘরে চড়াও হয়ে খুন করবে প্রগতিশীল মুসলিম নারীপুরুষদের। গৃহযুদ্ধ সমাগত প্রায়।

ইতোমধ্যে দুজনকে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনি। ধারণা করা হচ্ছে সন্দেহভাজন তরুণকে এরাই কোরআন শরীফ দিয়েছে শহরের নানুয়া দীঘির উত্তর পাড়ে দর্পণ সংঘের পূজামণ্ডপে চুপটি করে রেখে আসার জন্য।

প্রাচীনতম চিত্রনাট্য। সংখ্যাগুরুর দেশে কিছু উদ্ধত অন্ধ কুধর্মচর্চাকারীদের হাতে সংখ্যালঘুদের অত্যাচার নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি হল। তথ্যসম্প্রচারের নীতি ভেঙে পড়েছে গত কয়েকদিনে। অন্যান্য দেশ থেকে অনেকেই ঝুটা ছবি দিয়ে সুযোগ নিচ্ছে। বিভ্রান্তিকর এ অবস্থায় দাঙ্গা ছড়াচ্ছে। ইকবাল হোসেন নামে সন্দেহভাজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তার মাঝে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ। লেখক, কবি সাহিত্যিক, সাংবাদিক, মুসলিম নেতা আলেমারা বলিষ্ঠ ভূমিকা নিয়েছে হনুমানের কোলে কোরআন শরীফ রাখা গদাচুরিধারীদের বিপক্ষে। বরিশাল সহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর গ্রামে মুসলিম জনগণ হাতে হাত বেঁধে মন্দির পাহারা দিচ্ছে। মসজিদ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মিডিয়ায় ইসলামি চিন্তাবিদরা, ‘ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার’ এই শান্তির বাণী প্রচার করছে।

কিন্তু ঘটনা তো যা ঘটার ঘটে গেছে। লজ্জার রঙে ছেয়ে গেছে অসাম্প্রদায়িক বাঙালিদের মন ও মুখ। তবে শুভশক্তি হয়ে এসেছে নতুন গ্রাফিত্তি— সুবোধ তুই পালিয়ে যাস না।