Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রকৃতি-আবছায়া

সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

 



প্রাবন্ধিক, গবেষক

 

 

 

 

আমার বন্ধু ভাস্কর। ভাস্কর মুখোপাধ্যায়। অমায়িক, হাসিখুশি ভালো মানুষ। অপূর্ব ছবি তোলার হাত। জ্যোতির্বিজ্ঞানে উৎসাহী। আকাশের মানচিত্র ছিল তার চেনা। হারিয়ে গেল পাহাড়ে। অনকোলিঙ্ক নামের একটি সেবামূলক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের অন্যতম কর্ণধার। বেড়াতে ভালোবাসত। হারিয়ে গেল। পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে পারি মাত্র। কিন্তু গেল ওই পরিবারের, প্রতিষ্ঠানের।

তারপর খবর পাওয়া যাচ্ছে রাণাঘাট, বেহালা, বাগনান থেকে। বড় বেদনাদায়ক খবর। মোট তেরোজন কি আরও বেশি হবে সংখ্যাটা। আমাদের সহনাগরিকরা হারিয়ে গেলেন ট্রেকিং-এ গিয়ে। কেউ একটু কমবয়সি, কারও বয়স একটু বেশি। সবাই স্বাস্থ্যবান, শক্তিতে ভরপুর। সবাই ট্রেকিং-এ গিয়েছিলেন। কেউ বাড়িতে বলে গিয়েছিলেন নবমীর দিন ঠিক ফিরে আসব। কারও ফেরার কথা ছিল একটু পরে। ফেরা হল না।

যাঁরা পাহাড়ে যান তাঁরাই জানেন পাহাড়ের কেমন আকর্ষণ। আমার মত ঘরকুনো, যে ঘরের পাশে শিশিরবিন্দু দেখে মনে করে খুব সুন্দর প্রকৃতিপাঠ হল, সে বুঝতে পারবে না অনুভব করতে পারবে না সেই অমোঘ টান। পরিবারের জন্য চিন্তাও যেখানে তুচ্ছ হয়ে যায়। আজ তো নতুন নয়। যদি এই শতাব্দীকেই ধরি দেখব এই একুশ বছর বয়সি শতাব্দীর ২০১০ সালে মৃত্যু হয় আটজনের। আজ আমাদের রাজ্য থেকেই তেরোজনের। যাঁরা চলে গেলেন তাঁদের মধ্যে অনেক অভিজ্ঞ মানুষ ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে গিয়েছিলেন কম অভিজ্ঞরা। তাই তো হয়। বড়রাই তো হাতে ধরে শিখিয়ে দেন ছোটদের। যাওয়ার আগে হোম-ওয়ার্ক করেন। যোগাযোগ করেন, রুট ঠিক করেন, জিনিসপত্র গোছগাছ করেন, তারপর ট্রেনে অথবা প্লেনে চেপে বসেন। সময় বেছে নেন আবহাওয়া অনুযায়ী। এখানে ধরে নেওয়া যেতে পারে সবার অল্পবিস্তর ট্রেনিং নেওয়া আছে। ট্রেকিং রুটের কথা কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়ে গেছে। সুতরাং চলো।

এখানে একটা বিষয় বাদ পড়ল। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে তথ্য সংগ্রহ করা। বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করা। ‘হিমবিদ্যা’ একটি জরুরি বিষয়। এই বিষয়টি বৃষ্টি বা তুষারপাতের ধরণধারণ জানার জন্য কাজে লাগে। ফিল্ডে এটি খুব কাজের। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষিপ্রতা দরকারি। বিশেষ করে যিনি লিড করেন। তাঁর সিদ্ধান্তহীনতা মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। এর মধ্যে আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। সেটি হল তাঁবুর জায়গা নির্ধারণ করা। এই বিষয়গুলো সবার জানা। আরও জানা শুধু শরীরের জোর বা মনের জোর হিমালয়ের গভীরে তুচ্ছ।

তবে কি অভিযানকে নিরুৎসাহিত করা কর্তব্য? মানুষের মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করতে হবে পাহাড়ের প্রতি আকর্ষণকে? একেবারেই না। হিমালয়ের বৈচিত্র্যকে চিনতে হবে। মান্যতা দিতে হবে। টেকনিক্যালি সাউন্ড হওয়া জরুরি। আরও সময় দিতে হবে। সরকারের তরফে অতীত অভিজ্ঞতার তথ্যসম্বলিত বছরে অন্তত একটি পুস্তিকা প্রকাশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতিকে ভালবাসার আবেগের সঙ্গে মিশতে হবে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। অক্টোবরে এমন বৃষ্টি! এমন তুষারপাত! কে প্রেডিক্ট করবে? আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা সাহায্য করবেন। তাঁরাই বলছেন আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ পৃথিবীর গড় উষ্ণতা ১ ডিগ্রি বৃদ্ধি পাবে। আর এই শতাব্দীর শেষভাগে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফল— হিমবাহের পশ্চাদপসরণ, আবহাওয়ার অনিশ্চয়তা। তবে অনুমান কিসের ওপর ভিত্তি করে হবে? পাহাড়কে সময় দিতে হবে নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার। ২০১৩ সালে কেদারনাথে হড়পা বানে ৬০০০ মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। তাঁর কারণ অনুসন্ধান করা হয়েছে ঠিক, কিন্তু সময় দেওয়া হয়েছে কি?

মনে রাখতে হবে আমরা শহুরে সভ্যতাকে বরণ করেছি উন্নয়নের প্রতীক হিসেবে। সেখানে পরিবেশবান্ধব উন্নয়নকে গ্রাহ্যের মধ্যে রাখিনি। স্বভাবতই কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমনকে আমাদের মেনে নিতে হচ্ছে। সঙ্গে অন্য গ্রিনহাউস গ্যাস। আবহাওয়ার পরিবর্তন অনিবার্য। একটি হিসেব বলছে— ১৯৯০ সালে ভারতে জনপ্রতি কার্বন ডাই অক্সাইডের নির্গমনের পরিমাণ ছিল বছরে ০.৮ টন। ২০১৩ সালে ১.৭ টন আর একই মাত্রায় বৃদ্ধি যদি ধরা যায় এখন প্রায় ২ টনের বেশি। ২০১২ সালের হিসেব অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের দেশের তালিকায় ভারতের স্থান তৃতীয়। তাঁর প্রভাব হিমালয়ে পড়বেই। সুতরাং সেইমত পরিকল্পনা করতে হবে। তার পরেও কি রোধ হবে হাহাকার? না। কমবে। যাঁরা যান তাঁরাই বোঝেন বাস্তব অন্যরকম। মেলে না অনেককিছুই। তবু এত কথার একমাত্র কারণ হল এতজন মানুষের চলে যাওয়া আর তার জন্য অশ্রুপাত।

হিমালয়ের অসাধারণ সৌন্দর্যের, নিসর্গ প্রকৃতির নৈঃশব্দের দুর্নিবার আকর্ষণে মানুষ ছুটে যাবে বারবার সেটা স্বাভাবিক। তবে তার সঙ্গে চাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, চিকিৎসকের পরামর্শ। আমাদের আবহাওয়ার পরিবর্তনের কথা মাথায় রাখতেই হবে। আর মনে রাখতে হবে পরিবারের ওই মানুষগুলোকে যাঁরা আপনাকে ভালবাসে। আমার মতো ঘরকুনো মানুষের এটাই অনুভব।