Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

অভিবাসন, রাজনীতি ও স্বদেশ: তাহার বেন জেলুন-এর উপন্যাস ‘ও পেইয়ি’

পার্থপ্রতিম মণ্ডল

 


ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা-সাহিত্যের শিক্ষক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

তাহার বেন জেলুন-এর লেখার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটে ‘লঁফঁ দ্য সাবল্’ (L’enfant de sable) পড়ার পর। ইংরেজি অনুবাদে এই উপন্যাসটির নাম, The Sand Child। এই উপন্যাসটি বেরোনোর পরই বস্তুতপক্ষে মরক্কোর এই লেখক গোটা বিশ্বে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। ‘লঁফঁ দ্য সাবল’ পড়ার অভিজ্ঞতা ছিল অসামান্য। উত্তর-ঔপনিবেশিক মরক্কো, শুধু মরক্কো কেন, সাবেক ফরাসি উপনিবেশগুলির স্বাধীনতা-উত্তর পরিস্থিতি নিয়ে জানার উৎসাহ বেড়ে গিয়েছিল এই উপন্যাসটি পড়ার পরে। ফরাসি সাহিত্যের মূলধারায় সাবেক কলোনিগুলির এইসব লেখালেখি অবশ্য ততদিনে পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছে।

‘লঁফঁ দ্য সাবল্’-র কাহিনি এই উপন্যাসের দুই চরিত্র হাজি আহমেদ সুলেমান আর তার আটনম্বর কন্যাসন্তান মহম্মদ আহমেদকে নিয়ে। হ্যাঁ, কন্যার নাম মহম্মদ আহমেদ। কেননা হাজি আহমেদ সুলেমান পরপর সাত কন্যার জন্ম দেওয়ার পর আটনম্বর সন্তানটির লিঙ্গপরিচয় গোপন রাখে। লোকে জানে, আটবারের বেলা সে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিয়েছে। সেই সন্তান বড় হতে থাকে… সুন্নৎ দেওয়া থেকে শুরু করে তার নারীশরীরের বৈশিষ্ট লোকচক্ষুর থেকে আড়াল করে রাখা, এমনকী নিকট এক আত্মীয়ার সঙ্গে তার বিয়ে দেওয়া… এ উপন্যাস এক অভূতপূর্ব কাহিনি শোনায় পাঠককে। একাধিক ভাষ্যে বলে চলা, বিশ্বাস-অবিশ্বাস্যের দোলাচলে এগোতে থাকা এই উপন্যাস ফরাসি সাহিত্যের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করে দিয়েছিল। আরব সমাজে জেন্ডার-রোল নিয়ে লেখা এমন উপন্যাসের কথা আগে কখনও শোনা যায়নি।

এই কাহিনিরই পরবর্তী অধ্যায় ‘লা নুই সাক্রে’ (La nuit sacré) যখন ফ্রান্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য-পুরস্কার ‘প্রি গঁকুর’ পায় তখন তা সে দেশের বিদ্বৎমহলে শুধু না, সেখানকার রাজনৈতিক মহলেও বেশ আলোড়ন ফেলে দেয়। এর আগে ফ্রান্সের বাইরের কোনও লেখক যে ‘প্রি গঁকুর’ পাননি এমন নয়, কিন্তু উত্তর-আফ্রিকার সাবেক ফরাসি উপনিবেশের কোনও লেখকের ক্ষেত্রে এই ঘটনা প্রথম। অনেকেই বলতে থাকেন, জাতিবিদ্বেষী ল্যপেন-এর ন্যাশনাল ফ্রন্টকে একহাত নেওয়ার জন্যেই নাকি বিচারকমণ্ডলী এই লেখককে বেছে নিয়েছেন। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে অবশ্য এ সম্মানকে স্বাগত জানানোর হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া মিতরঁ তো বটেই, এমনকী ল্যপেন নিজেও একধরনের অনিচ্ছা-মেশানো সাধুবাদ জানাতে বাধ্য হন। ভাবখানা এমন… বিদেশি হোক, ফরাসি ভাষার লেখক তো! কাজেই তিনি কিছু মনে করছেন না।

সম্প্রতি পড়লাম তাহার বেন জেলুনের ২০০৯ সালে প্রকাশিত উপন্যাস ‘ও পেইয়ি’ (Au pays)। ইংরেজি অনুবাদে এই বইটির নাম রাখা হয়েছে A Palace in the Old Village, যদিও ফরাসি নামটির সরাসরি তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘দেশের গ্রামে’। সাম্প্রতিক কালে প্রকাশিত উপন্যাসের মধ্যে জেলুনের এই উপন্যাসটি বিশেষ আলোচনার দাবী রাখে এই কারণে যে, শুধু ফ্রান্স নয়, আজকের বিশ্বপরিস্থিতির নিরিখে ‘ও পেইয়ি’ বেশ প্রাসঙ্গিক ও জরুরি একটি উপন্যাস। সমালোচকদের ভাষায় উত্তর-ঔপনিবেশিক বা ‘পোস্ট-কলোনিয়াল’ নয়, উত্তর উত্তর-ঔপনিবেশিক বা ‘পোস্ট পোস্ট-কলোনিয়াল’ সাহিত্য বলতে যা বোঝায় এ উপন্যাস সেই গোত্রের।

‘ও পেইয়ি’ উপন্যাসেরও কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম মহম্মদ। মরক্কো থেকে চলে এসে ফ্রান্সে চল্লিশটি বছর অভিবাসী শ্রমিক হিসেবে কাজ করার পর তার অবসর গ্রহণের সময় এসেছে। উপন্যাসের শুরুতে আমরা দেখি এই মহম্মদকে নমাজ শেষে দেয়ালে টাঙানো একখানা ঘড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে। ঘড়ির গায়ে আঁকা একখানি ছবি, সেখানে সাদা কাপড় পরা একদল লোক কাবাশরিফ প্রদক্ষিণ করে চলেছে। মহম্মদের মনে পড়ে যায় তার নিজের হজযাত্রার কথা। মহম্মদ ধর্মপ্রাণ, তবু ছবিটি চোখে পড়ায় তার মনে নানা কৌতূহল জমা হতে থাকে। ছবিতে কাবা-প্রদক্ষিণরত মানুষগুলির এই যে উন্মাদনা, তার ব্যক্তিগত ধর্মবিশ্বাসে তার কোনও অর্থ খুঁজে পায় না সে। ভেসে আসে আরও নানা টুকরো ছবি যেসব সে তার ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে মেলাতে পারে না। ভাবনাস্রোত তাকে নিয়ে যায় মরক্কোয় তার ছোটবেলার দিনগুলিতে। সে জানত, বাবা-কাকার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাকেও একদিন চলে আসতে হবে ফ্রান্সে। মনে পড়ে রাবাত থেকে নির্দেশ নিয়ে গাঁয়ের মোড়ল কেমন হাজির হত গ্রামের স্বাস্থ্যবান যুবকদের তল্লাশে! মোড়লটির হাবভাব ছিল ঠিক যেন সেই উপনিবেশের যুগে ফরাসি প্রভুদের মতো!

জেলুনের অন্যান্য উপন্যাসের মতোই এ উপন্যাসেরও বিষয়বস্তু ফ্রান্সে অভিবাসন সমস্যাকে কেন্দ্র করে সেখানকার সামাজিক আর রাজনৈতিক জটিলতা। সস্তার শ্রম আমদানি করার উদ্দেশ্যে একদিন যারা সাবেক কলোনিগুলি থেকে অভিবাসীদের আমন্ত্রণ করেছিল তারাই এখন ইসলামোফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়ে তাদের দেশকে অভিবাসীমুক্ত করতে চাইছে। ফ্রান্সের ক্ষেত্রে এই সমস্যা আরও নতুন মাত্রা পেয়েছে অভিবাসীদের নিজেদের ভেতরকার জাতিগত বৈরিতার কারণে। ইভলিনের যে অঞ্চলে মহম্মদ থাকে সেখানে প্রায়ই ঝামেলা বেধে থাকে। সমস্যাটা মাগ্রেব অর্থাৎ আলজেরিয়া-তুনিশিয়া-মরক্কো থেকে আসা অভিবাসী আর আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে। মহম্মদের সঙ্গে একই প্লান্টে কাজ করত ব্রাহিম। ব্রাহিমের একমাত্র মেয়ে এক সেনেগালীয়কে বিয়ে করে পালিয়ে যায়। ইভলিনের প্রতিটি মাগ্রেব পরিবারে তাই নিয়ে নানা গালগল্প চলতে থাকে। কাদের-এর মতো কৃষ্ণাঙ্গবিদ্বেষী মানুষরা তো তা নিয়ে বিষোদ্গার করার এক মস্ত সুযোগ পেয়ে যায়। “Moi, je n’ai rien contre les Africains, je les trouve mêmes sympathiques, mais ce que je ne supporte pas, c’est leur odeur…” (‘আফ্রিকানদের সঙ্গে আমার কোনও বিরোধ নেই, এমনিতে ওরা ভালোই, কিন্তু আমি যেটা সহ্য করতে পারি না সেটা ওদের গায়ের গন্ধ।’) কাদের মনে করে, তাদের মতো বাববের জাতির মানুষদের সঙ্গে কালো চামড়ার লোকেদের বৈবাহিক সম্পর্ক হয় কী করে? ব্রাহিম আলজেরীয় বা তুনিশীয় হলে তবু কথা ছিল, কিন্তু মরক্কোতে তো কৃষ্ণাঙ্গদের ‘আবিদ’ বলে ডাকা হয়! ‘আবিদ’, যার অর্থ ক্রীতদাস। … কী বললে? আলজেরীয়? মনে রাখবে আলজেরিয়াতে তুনিশিয়া আর মরক্কোর মতো অত কালোচামড়ার লোক বাস করে না! ব্রাহিমের মেয়ে এমনটা করেছে ও মরক্কোর মেয়ে বলেই। … আলজেরিয়ার কথা আর বোলো না! আমরা মরক্কোর লোকেরা তোমাদের মতো রেসিস্ট নই! তাছাড়া আলজেরিয়ার সব মানুষগুলোই বড় মারকুটে, কাউকে সহ্য করতে পারে না। ব্রাহিমের মেয়ের এই বিয়ে প্রমাণ করে যে আমরা জাতিবিদ্বেষী নই।

কূটকাচালি চলতে থাকে। মহম্মদের ঠোঁটের কোণে করুণ হাসির রেখা ফুটে ওঠে। মাগ্রেব থেকে আসা অভিবাসীরা আজ ইওরোপের সর্বত্র জাতিবিদ্বেষের শিকার, অথচ তারা নিজেরাই কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের সহ্য করতে পারে না! কি ফ্রান্সে, কি তাদের নিজেদের দেশে! এসব দেখে সে একটাই ব্যাপার বুঝতে পারে যে, “জাতিবিদ্বেষ সর্বত্র!” (“Le racisme est partout!”) আর একটা বিষয় তার মনকে ভীষণ নাড়া দেয়। তা হল, সন্তানদের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ আর তাদের নেই। “La France nous empêche d’éduquer nos enfants.” (‘ফ্রান্স আমাদের সন্তানদের শিক্ষা দেওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।’)

বস্তুতপক্ষে ‘ও পেইয়ি’ মহম্মদ ও তার সন্তানদেরই কাহিনি। মহম্মদ তার পুত্রকন্যা— মুরাদ, রশিদ, জামিলা, ওসমান, রেকিয়া, সকলকে নিয়ে তার পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে চায়। কিন্তু সন্তানেরা তার মতো শেকড়ের টান উপলব্ধি করে না। রশিদ তো নিজের নাম বদলে রিচার্ড করে নিয়েছে। রিচার্ড বেন আবদাল্লাহ্! আবদাল্লাহ্! ‘আল্লাহ্-র পূজারির পুত্র’, কিন্তু সে হয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র রিচার্ড বেন। মহম্মদ বলতে চায়, নাম বদলে ফেলে বা খাতায় কলমে নাগরিকত্ব পেলেও তারা কোনওদিন ইওরোপীয় সমাজের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে পারবে না। পারিবারিক এই পরিস্থিতি যে শুধু তার জীবনে নেমে এসেছে তা নয়, প্রতিটি অভিবাসী পরিবারেই একই অবস্থা। ঠিক যেমন হয়েছে তার প্রতিবেশী রাবির জীবনে। রাবির দুই মেয়ে ফরাসি নাগরিকত্ব পেলে রাবি বেজায় খেপে যায়, মেয়েদের ওপর চড়াও হয়। মেয়েরা প্রাপ্তবয়স্ক। মিডিয়া, পুলিশ সব মিলিয়ে ব্যাপারটা এতদূর গড়ায় যে রাবির জেলে যাওয়ার উপক্রম হয়। এহেন অবস্থায় সে কোনওরকমে তার কনিষ্ঠ সন্তানটিকে নিয়ে আলজেরিয়া পালিয়ে আসে। তার মনে হয়, অন্তত একজনকে সে ‘লাফ্রঁস’-এর কবল থেকে উদ্ধার করতে পেরেছে। কিন্তু এই ছেলেটির ক্ষেত্রে ঘটনা আবার অন্যদিকে মোড় নেয়। সেই ছেলে লুকিয়ে একদিন আবার সেই ইভলিনেই ফিরে আসে। সেখানে এসে একদল উগ্র ইসলামপন্থী যুবকের পাল্লায় পড়ে, যারা কোরানের কিছু বোঝে না, কিন্তু খ্রিস্টীয় মাটিতে ইসলামের মান রক্ষায় বদ্ধপরিকর। কিছুদিন পর এই উন্মাদদের সঙ্গে সম্পর্কও তার নষ্ট হয়ে যায়। একদিন সর্বসমক্ষে সে ঘোষণা করে বসে যে আল্লাহ্-য় সে বিশ্বাস করে না। কট্টরপন্থী বন্ধুরা তার উপর ভর করা শয়তানকে তাড়াতে উঠেপড়ে লাগে। শেষমেষ তাকে অস্ট্রেলিয়া চলে যেতে হয়, পরিবারের সঙ্গে তার কোনও যোগাযোগই থাকে না।

মহম্মদের নিজের ছেলে মুরাদ বিয়ে করেছে স্পেনীয় কন্যা মারিয়াকে। মারিয়া ক্রিশ্চান। মুরাদ তার বাবামাকে ভালোবাসে না এমন নয়, কিন্তু তাদের চেয়েও সে ভালোবাসে সে নিজের স্বাধীনতাকে। মহম্মদের মেয়ে জামিলা পরিবার ছেড়ে চলে গেছে এক অমুসলমান ইতালীয়কে বিয়ে করে। মহম্মদ এই বিয়েকে মেনে নেয়নি, জামিলার নাম এ বাড়িতে উচ্চারিত হয় না। বাকি দুই ছেলে স্কুলছুট হয়ে দু পয়সা উপার্জনের পথ ধরেছে। একমাত্র কাছে রয়েছে মেয়ে রেকিয়া। তার ইচ্ছা রেকিয়া স্কুলের গন্ডি পার হয়ে কলেজে ঢুকবে। একদিন সে পশুচিকিৎসক হয়ে পাশ করে বেরুবে, আর তাদের পারিবারিক খামারে বাবাকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে।

হ্যাঁ, অবসরগ্রহণের পর মস্ত এক বাড়ি বানানোর সিদ্ধান্ত নেয় মহম্মদ, যে বাড়িতে শুধু রেকিয়া নয়, তার সব ছেলেমেয়েরাই আবার একসঙ্গে থাকা শুরু করবে। কোথায় বানাবে সে তার সেই স্বপ্নের রাজপ্রাসাদ? তার দেশ মরক্কোয়। সে দেশ কেমন? ধূলিধুসরিত, সবুজের চিহ্নহীন, যেখানে মানুষেরা কুয়োর মুখ ঢাকনা দিয়ে বন্ধ করে রাখে যাতে জল বাস্পীভূত হয়ে শুকিয়ে না যায়। যেখানে কোনও মেয়ে পুরুষের দিকে তাকালে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। “জীবন যেখানে সরল এবং ভয়ঙ্কররকমের সরল।” (“La vie est simple, c’est-à-dire terrible.”)। অবসরগ্রহণের পর ট্রেনে দেশে ফেরার পথে মানসপটে সে তার স্বপ্নের বাড়িটার ছবি আঁকতে থাকে। সীমান্তের কাছাকাছি যত সে পৌঁছতে থাকে তত সেই বাড়ি আর শুধুমাত্র শিশুদের কলকাকলিতে মুখর একখানা বাড়ি থাকে না, তা হয়ে ওঠে স্বর্গেরই একটা অংশ, ‘এক সহস্র্র আরব্যরজনী’ থেকে তুলে আনা একটা গল্প।

পাঁচ বছর পর সত্যিই একদিন সেই বাড়ি তৈরি হয়। তবে ঠিক স্বপ্নের রাজপ্রাসাদ নয়, মহম্মদের নিজের হাতে আর প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় যে বাড়িটি নির্মিত হয় তা দেখতে অনেকটা মালবোঝাই একটা ট্রাকের মতো। কিন্তু সেখানে তার প্রত্যেক সন্তানের জন্যে থাকে পৃথক একটি করে ঘর, আর থাকে এক পেল্লাই প্রার্থনাকক্ষ। আচ্ছা, তার সন্তানেরা কি ভালো মুসলমান, না খারাপ মুসলমান? তারা কি রমজান করে? মদ্যপান করে? এসব প্রশ্ন মহম্মদ ভাবতে চায় না। তার সামনে আবির্ভূত হয় কালো জোব্বা-পরা এক বিশাল ছায়ামূর্তি। ছায়ামূর্তি তাকে বলে, ছেলেমেয়েরা কোনওদিনই ফিরে আসবে না তার এই স্বপ্নের বাড়িতে। তবু একদিন মহম্মদ এক এক করে তার সব পুত্রকন্যাকে ফোন করে। ফোন করে আসতে বলে তাদের। এমনকি জামিলাকেও, যে জামিলাকে সে জীবন থেকে বাদ দিয়ে দিয়েছিল। জামিলা জানতে চায়, কেন তাদের বাবা এই পাগলামি করছে? তারা তো আর ছোট নেই, তাদের ঘরসংসার আছে, নিজেদের জীবন আছে।

দেখতে দেখতে মহামিলনের দিনটি উপস্থিত হয। মহম্মদ গ্রামের লোকেদের বলে রাখে তারা যেন কেউ জানতে চাইলে নতুন বাড়ির পথ দেখিয়ে দেয়। তার স্ত্রী সব বুঝেও কোনও কথা বলে না। নিজেকে এসব থেকে দূরে সরিয়ে রাখে সে। মহম্মদের যদিও এই অস্থির প্রতীক্ষার মুহূর্তগুলোতে স্ত্রীকে বড় বেশি কাছে পেতে ইচ্ছে করে।

কেউ আসে না। কোনও গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ শোনা যায় না। মাটির রাস্তায় কোনও ধুলোর পাহাড় জমে ওঠে না। নির্বাক আকাশে চাঁদের দিকে মুখ তুলে তাকায় মহম্মদ। সেখানে তার সন্তানদের কাউকে সে দেখতে পায় না। (“Il fixait la lune et n’y voyait aucun de ses enfants.”)। আর ঠিক তখনই এক পরীর রূপ ধরে তার স্ত্রী এগিয়ে এসে হাত ধরে তাকে নিয়ে যায় ঘরের ভেতর। স্নান করায়, ঘুম পাড়ায়। এর কদিন বাদেই মহম্মদের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় সে আর মানুষ থাকে না, হয়ে ওঠে এক সন্ত।

‘ও পেইয়ি’ পোস্ট পোস্ট-কলোনিয়াল যুগের এক ব্যক্তির জীবনের ট্র্যাজেডি। আবার তীব্র এক রাজনৈতিক ভাষ্যও। উপন্যাসের প্রথম পর্বটি তো ফ্রান্সে আরব অভিবাসীদের জীবনের এক গভীর অনুচিন্তন। নির্বাচনে চিরাকের পরাজয়, জঁ মারি ল্যপেন-এর উত্থান মহম্মদকে বিস্মিত করে না। বরং ল্যপেন জেতার পর তার স্ত্রীর যখন মনে হয, এবার বোধহয় তাদের ফ্রান্স ছাড়তে হবে তখন তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। সে জানে, নির্বাচনে ল্যপেনের মতো জাতিবিদ্বেষী, ফ্যাসিবাদী নেতাদের আরব অভিবাসীদের বড় দরকার! “Le Pen a besoin de nous, oui, imagine ce pays vidé de ses immigrés, il ne pourra plus dire que nous sommes l’origine du mal, de l’insécurité……” (ল্যপেনের প্রয়োজন আমাদেরকে। ভেবে দেখুন, এ দেশে আর একজনও অভিবাসী থাকল না, উনি তো তখন আর বলতে পারবেন না, আমরাই যত নষ্টের গোড়া, আমরাই নিরাপত্তাহীনতার কারণ।) পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পারছেন, কেন এ উপন্যাস আর কোনও একটি দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ‘লঁফঁ দ্য সাবল্’, ‘লা নুই সাক্রে’-র লেখকের কাছ থেকে এ উপন্যাসও আমাদের মস্ত বড় এক পাওনা।