Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আইআইটি-তে আবিষ্কৃত ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্র: অজ্ঞতা, না, দুরভিসন্ধি?

অশোক মুখোপাধ্যায়

 



প্রাবন্ধিক, সেস্টাস-এর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক

 

 

 

 

খড়গপুর আইআইটি এই বছর এক ক্যালেন্ডার প্রকাশ করেছে, যেখানে বিভিন্ন মাসের পাতায় “ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্র” থেকে এক একটা পাকা আপেল তুলে এনে সেঁটে দিয়েছে। স্বভাবতই দেশে বিদেশে এই ক্যালেন্ডারে উত্থাপিত বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। পক্ষে বিপক্ষে অনেকেই নানারকম আলোচনা করছেন। আমাদের দেশের বেশ কয়েকজন নামকরা ইতিহাসবিদ এবং বিজ্ঞানী ইতিমধ্যেই এর প্রস্তাবগুলিকে সমালোচনা করে বেশ কিছু মূল্যবান বক্তব্য তুলে ধরেছেন। এই চলমান বহু-আলাপনে যোগ দিয়ে আমিও কিছু কথা উপস্থাপন করতে চাই।

 

[এক]

আমার প্রথম যে বিষয়টাতে বিস্ময় জেগেছে, তা হল, এই ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্র (Indian Knowledge System) কথাটা। আরও বিস্মিত হয়েছি এটা দেখে যে বেশিরভাগ সমালোচক এই ধারণাটিকে আঘাত করছেন না। সম্ভবত তাঁরা অনেকেই উত্তরাধুনিক চিন্তাস্রোতের প্রভাবে এই শব্দবন্ধের মধ্যেকার অন্তর্নিহিত বিভ্রমের ঘটনাটা লক্ষ করছেন না।

অথচ, সঙ্ঘ পরিবারের হাতেগোনা দালাল ও মধুপ বুদ্ধিজীবীদের বাদ দিলে, জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চার সঙ্গে বিভিন্ন মাত্রায় যুক্ত যে কোনও ব্যক্তিই জানেন, জ্ঞানের কোনও ভৌগোলিক পরিসীমা হয় না। যে কোনও বিষয়ে জ্ঞানের একটা উৎপত্তিস্থল থাকতে পারে, থাকেও। কিন্তু একবার উৎপন্ন হলে তা সমগ্র পৃথিবীর, সমগ্র মানবজাতির জ্ঞান সম্পদ হয়ে যায়। জ্ঞানবিজ্ঞানের ইতিবৃত্তলেখ (historiography)-এ কোন জ্ঞানবিন্দু কোথায় প্রথম আয়ত্তে এসেছে তা অবশ্যই নথিভুক্ত হয় এবং হবে। পিথাগোরাসের উপপাদ্যের জন্ম গ্রিসে হয়েছে বলে সেটা গ্রিসের জ্ঞানতন্ত্র বলে মনে করেন না কেউ। মহাকর্ষ বা জীব বিবর্তনের তত্ত্বগুলি ইংল্যান্ডের জ্ঞানতন্ত্র নয়। আধুনিক আপেক্ষিকতাবাদ জার্মানির বা ইহুদিদের জ্ঞানতন্ত্র নয়। এযাবত এইভাবে কেউ ভাবেননি। ঠিক তেমনই শূন্যের ধারণা, দশমিক স্থানমান পাতন ইত্যাদি মূল্যবান গাণিতিক ধারণাগুলি ভারতে বা চিনে বিকশিত হলেও এগুলো ভারতীয় বা চিনা জ্ঞানতন্ত্রের বিষয় নয়। পর্তুগালের শূন্য ধারণা কিংবা বলিভিয়ায় জীব বিবর্তনের তত্ত্ব অন্য আর একরকম— এরকম নয় জিনিসগুলো। কিংবা, এমনও নয় ব্যাপারটা যে কেনিয়ায় জ্যামিতিতে অ্যাপলোনিয়াসের উপপাদ্য জাতীয় কিছু নেই; ওটা ওদের লাগে না। বা মালয়েশিয়ায় মহাকর্ষ তত্ত্ব খাটে না। ওখানে ফল পাকলে বোঁটা ছিড়ে আকাশের দিকে উঠে যায়।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর শিক্ষা বিষয়ক এক প্রবন্ধে বলেছেন, “সত্যের কোনও জিওগ্রাফি নাই।”[1] স্বল্প দৈর্ঘ্যের এই চতুষ্পদী বাক্যটির তাৎপর্য এবং মূল্য অপরিসীম। এটাকে বিজেপি বা আরএসএস তাদের কথিত ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্রের মধ্যে ধরবে কিনা জানি না, কিন্তু ধরলে ওদের পক্ষে এক মহা বিপর্যয় হয়ে যাবে।

জ্ঞানের চরিত্রই এরকম। একেবারে সেই শুরুর দিন থেকেই মানুষ যা কিছু জেনেছে, তা প্রথমে এক নৈর্ব্যক্তিক বা ব্যক্তিনিরপেক্ষ চরিত্র অর্জন করেছে। খগেন যেদিন জানল, সাতজেলিয়া নদীতে কামট আছে এবং সে জলে নামলে নিখুঁতভাবে পা কেটে খেয়ে নিতে পারে, সাতজেলিয়া গ্রামের সকলেরই সেই জ্ঞান লাভ হয়ে গেল। তারপর আশেপাশের গ্রামের লোকেরাও জানল। অল্প কদিনের মধ্যেই সুন্দরবনে আসা সমস্ত লোকেই জেনে গেল। সে আর সাতজেলিয়ার জ্ঞানতন্ত্র হয়ে বেঁচে নেই। আবার মজা হচ্ছে, দুনিয়ার সকলে এটা জেনে যাওয়ার পরেও সাতজেলিয়ায় এই জ্ঞান লোপ পায়নি।

অর্থাৎ, জ্ঞানের যে সর্বজনীনতা, তাতে তার উৎপত্তিস্থলের বা উৎপাদকের কোনও ক্ষতি হয় না। সার্বজনিক চরিত্র হলেও যে বা যারা প্রথম জেনেছিল, তাদের থেকে তা হাতছাড়া (প্রকৃতপক্ষে মগজছাড়া) হয় না। নিউটনের তত্ত্ব ফ্রান্সের লোকেরা জেনে নেওয়ার ফলে ইংল্যান্ডের কোনও ক্ষতি হয়নি। একইভাবে, ভারতে যে জ্ঞানের জন্ম হয়েছে, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে বলে তা ভারতছাড়া হয়নি। জানতে বা নিতে আপত্তি না থাকলে তা আজও ভারতেও বিদ্যমান। সুতরাং আজ আবার তাকে “ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্র” বলে দাগিয়ে রাখার কোনও অর্থ নেই।

যদি না এর মধ্যে অন্য কোনও দুরভিসন্ধি থাকে!

অতএব এই প্রসঙ্গে আমার মূল কথাটা হল, প্রাচীন ভারতে জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশের একটা ইতিহাস থাকলেও এবং তা নিয়ে যুক্তিসম্মত পদ্ধতিতে আলোচনার সুযোগ থাকলেও ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্র বলে কিছু হয় না। খড়গপুর আইআইটি-র মতো একটা নামকরা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার প্রতিষ্ঠান যে কীভাবে এই সত্য ভুলে গিয়ে সরকারি শাসকদলের মতান্ধতার শিকার হতে রাজি হল, এটা আমাদের বুদ্ধির সত্যিই একেবারে অগম্য।

 

[দুই]

সপ্তর্ষি কারা?

যে সাতজন আদি ঋষির নাম দিয়ে তাদের ভারতীয় হিন্দুদের আদি জ্ঞানী পুরুষ হিসাবে দেখানো হয়েছে, সেই নামগুলো লক্ষ করুন। কাশ্যপ, ভরদ্বাজ, গৌতম, জমদগ্নি, ও অন্যান্য। অনেক কাল আগে প্রথমে ক্ষিতিমোহন সেন এবং পরে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় দেখান যে এই নামগুলোর অধিকাংশই আসলে কোনও ব্যক্তিবিশেষের পরিচিতি নয়, এসব হল প্রাচীন বৈদিক জনজাতিগুলির ট্রাইব্যাল সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী এক এক গোষ্ঠীর কুলকেতু (totem), যাকে তারা মনে করত তাদের বংশের প্রথম উৎস। বেদের যুগ পেরিয়ে, অন্তত হাজার খানেক বছর পরে যখন থেকে পুরনো পুরাণগুলির যুগ শুরু হল, তখন এই টোটেমগুলিকে আর টোটেম নয়, সেই সেই গোষ্ঠীর জনগণ তাদের জীবিত পূর্বপুরুষ এবং ঋষি বলে ভাবতে লাগল।

কীরকম সেটা?

কাশ্যপ মানে হল কচ্ছপ। কোনও এক কালে, সম্ভবত ঋকবেদ রচনাকালে, একটা গোষ্ঠীর মানুষ মনে করত, তারা সকলেই কচ্ছপ থেকে উৎপন্ন হয়েছে। এ ছিল তাদের কুলকেতু। অনুরূপভাবে যে গোষ্ঠীর মানুষজন মনে করত, তারা গরু (গৌতম)-এর বংশধর, তারা নিজেদের গৌতম গোত্রের অন্তর্ভুক্ত বলে দাবি করত। ভরদ্বাজ (< ভরত + বাজ) হচ্ছে এক ধরনের দ্রুতগামী ঘোড়া। সেই ঘোড়াকেও একদল তাদের কুলকেতু বানিয়েছিল। সেই অনুযায়ী তারা ছিল ভরদ্বাজ গোত্রভুক্ত। এরকম আরও আছে। শাণ্ডিল্য গোত্রের অন্তর্ভুক্ত মানুষদের কুলকেতু হচ্ছে ষণ্ড বা ষাঁড়। হয়ত সেই কালেই কোনও জনজাতির একদল মানুষ মনে করত, তারা সকলেই ষাঁড়ের থেকে উদ্ভূত হয়েছে। বৎস মানে বাছুর। অর্থাৎ, কোনও গোষ্ঠীর কুলকেতু ছিল বাছুর।

বাকিগুলিও কমবেশি একইরকম।

ক্যালেন্ডারের এই উল্লেখগুলি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। এদের কাউকে জ্ঞানী ঋষি বলে চিহ্নিত করতে হলে, এরা কে কী জ্ঞান প্রদান করেছে সেগুলো বলতে হবে। নইলে এই ঋষি বা মুনি শব্দ দিয়ে কাউকে মহিমান্বিত করলেও তার মহিমা এক ইঞ্চিও বৃদ্ধি পায় না। স্বয়ং বিদ্যাসাগরমশাই তাঁর সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক এক প্রবন্ধে এই ব্যাপারে তাঁর আপত্তির কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন।[2]

তবে, বিদ্যাসাগরের মূর্তিভাঙা দলের লোকেরা ও তাদের অনুগত বিদ্বান সদস্যেরা যে বিদ্যাসাগরের শিক্ষার প্রতি কোনও গুরুত্ব দেবে না, তা বলাই বাহুল্য। বোধশক্তির রিক্ততার প্রশ্ন না হয় নাই তুললাম!

 

[তিন]

ঋকবেদে এই ক্যালেন্ডার শূন্য এবং এক খুঁজে পেয়েছে। কোথায় কীভাবে পেল কে জানে। আমি চারটে বেদ এবং উপনিষদের কোথাও শূন্য-এর সংখ্যাগত ধারণা দেখতে পাইনি। সংখ্যাগত ধারণা হিসাবে তিন এবং সাত-এর ব্যবহার অনেক জায়গাতেই চোখে পড়ে। তিন বেদ (প্রাচীন ভারতে অথর্ববেদকে বেদ হিসাবে ধরা হত না), সপ্ত সিন্ধু (সাত নদী) ইত্যাদির আকারে। এক-এর ধারণা থাকলেও খুবই কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বহু-ধারণার বিপরীতে। যেমন ধরুন, “একম্‌ সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি।” যস্যার্থ, একই বস্তুকে বিদ্বান লোকেরা বহু নামে ডাকে।

ঋকবেদের দশটি মণ্ডলের ক্রমিক সংখ্যার মধ্যে তাঁরা দশমিক সংখ্যালিখন পদ্ধতি দেখেছেন। একথা এখন প্রায় সাধারণ জ্ঞান যে ঋকবেদ মুখে মুখে রচিত, উচ্চারিত ও প্রচারিত এবং স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয়েছিল অন্তত পাঁচ থেকে সাত হাজার বছর। তারপর তার সঙ্কলন ও লিখন শুরু হয়। যাঁরা এই কাজ করেন, এই বিশাল সঙ্কলনের কাব্য ভাণ্ডারকে তাঁরাই খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত করে এক এক অংশের জন্য এক এক মণ্ডল নির্ধারণ করেন। ফলে এই এক থেকে দশ ক্রমিক সংখ্যার উদ্ভাবক ও ব্যবহারক বৈদিক গোষ্ঠীর লোকেরা নন, তাঁদের একশো-দেড়শো প্রজন্ম পরের উত্তরসূরিরা। সেই উদ্ভাবন কীভাবে অত আগেকার পূর্বপ্রজন্মের কাঁধে ফেলে দেওয়া যায়?

এই সংখ্যা আবিষ্কারের ভিত্তিতেই তাঁরা দাবি করেছেন, এতে নাকি কম্পিউটারের পক্ষে সবচাইতে উপযোগী ভাষা তৈরি হয়েছিল।

একটা সহজ প্রশ্ন যে কোনও বুদ্ধিমান মানুষের মাথাতেই আসার কথা, অবশ্য যদি প্রশ্ন ঢোকার দরজা খোলা থাকে— যাঁরা কম্পিউটার এবং/অথবা স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে থাকেন, তাঁদের তো চোখে পড়ে যাওয়ার কথা, কম্পিউটারে এবং/অথবা স্মার্ট ফোনে যে ভাষায় সব কিছু সাজানো থাকে, তা ইংরেজি এবং বিশেষ করে আমেরিকান ইংরেজি। আপনি বাংলা বা অন্য ভাষায় কাজ করতে পারেন, কিন্তু সেই ভাষা পছন্দ করার অপশন পর্যন্ত আপনাকে সেই আমেরিকান ইংরেজিতেই লিখতে হবে। সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার এর মধ্যে কোথায়? কেউ দেখেছেন নাকি?

দ্বিতীয়ত, কম্পিউটার যে ভাষা বোঝে তার সঙ্গে কোনও মানবীয় ভাষার কোনও সিধা সম্পর্ক নেই। সেটা এক ধরনের গাণিতিক ও সাঙ্কেতিক ভাষা। সেই ভাষায় অক্ষর মাত্র দুটো— ০ (শূন্য) আর ১ (এক)। সেই দুই অক্ষরের সাহায্যেই কম্পিউটারের সঙ্গে যাবতীয় তথ্যের আদানপ্রদান করা হয়। কম্পিউটার কীরকমভাবে কাজ করে বোঝার জন্য আজকাল বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমরা যখন কোনও পোর্টালে প্রকাশিত প্রবন্ধ, সংবাদ, ছবি, ঘটনা ইত্যাদির লিঙ্ক দিই, যার নিপুণি নাম ইউআরএল, তার জন্য যে অক্ষরপুঞ্জ দেখতে পাই সেটা বুঝতে হবে। এবং আইআইটি লবির দুর্ভাগ্য, সেই সব ইউআরএল-ও এখন পর্যন্ত ফিনিশীয় বর্ণমালায় দেওয়া হয়ে থাকে, দেবনাগরীকে নাসা বা অন্য কোনও সংস্থা পছন্দ করেছে বলে শোনা যায়নি। এমনকি, ভারতের ভাজপা পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার যে সমস্ত লিঙ্ক দেয় বা ব্যবহার করে, তাতেও সংস্কৃতকে এখন অবধি জায়গা করে দেওয়া যায়নি।

তিন নম্বর কথা হল, বিজ্ঞানসম্মত ভাষাটা আবার কী জিনিস? আলাদা করে একটা বিশেষ ভাষাই বা কেন বিজ্ঞানসম্মত হতে যাবে? পৃথিবীতে যত ভাষা আছে, সবই স্বাভাবিক মানবিক প্রক্রিয়ায় উদ্ভূত হয়েছে, এবং সেই অর্থে তাদের সবই বিজ্ঞানসম্মত ও সমতুল্য। বিভিন্ন ভাষার মধ্যে নানা দিকে পার্থক্য আছে। ব্যাকরণে, শব্দ গঠনে। বিভিন্ন ভাষার জ্ঞান বহনের সামর্থ্যেও (gnosiological capacity) পার্থক্য আছে। সংস্কৃত এক কালে জ্ঞান বহনের সামর্থ্যের যত আশ্চর্যজনক ক্ষমতাই দেখিয়ে থাকুক না কেন, মধ্যযুগের শেষে তার তুলনায় চার পাশের স্থানীয় ও লোকভাষা সমূহ— যথা: বাংলা, হিন্দি (উর্দুকে ধরে), ওড়িয়া, তামিল, মালয়ালম, কানাড়া, তেলুগু, পাঞ্জাবি, মারাঠি, ইত্যাদি অধিকতর ক্ষমতা নিয়ে গড়ে উঠতে থাকে এবং সংস্কৃত তাদের তুলনায় পিছিয়ে পড়তে থাকে। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের দাপট অক্ষুণ্ণ রাখতে গিয়ে সংস্কৃতকেই জবরদস্তি সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার একমাত্র মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা এবং তাতে দেশের এক বৃহত্তর অংশকে বঞ্চিত রাখার ফলে ধীরে ধীরে তাকে এক ধরনের স্থবিরতা ঘিরে ধরে এবং অবশেষে তা জ্ঞানজগৎ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। আর এই কথাটা শুধু আমরা ভারতমাতার কুলাঙ্গার সন্তান “সেকু-মাকু”-রাই বলছি এমন নয়, স্বয়ং বিবেকানন্দও তাঁর একটি চমৎকার রচনায় বলে গেছেন।

একটু না হয় শুনেই নিন সেই কঠিন বাক্যগুলো:

আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে সংস্কৃতয় সমস্ত বিদ্যা থাকার দরুন, বিদ্বান এবং সাধারণের মধ্যে একটা অপার সমুদ্র দাঁড়িয়ে গেছে। বুদ্ধ থেকে চৈতন্য রামকৃষ্ণ পর্যন্ত— যাঁরা ‘লোকহিতায়’ এসেছেন, তাঁরা সকলেই সাধারণ লোকের ভাষায় সাধারণকে শিক্ষা দিয়েছেন। পাণ্ডিত্য অবশ্য উৎকৃষ্ট; কিন্তু কটমট ভাষা— যা অপ্রাকৃতিক, কল্পিত মাত্র, তাতে ছাড়া কি আর পাণ্ডিত্য হয় না? চলিত ভাষায় কি আর শিল্পনৈপুণ্য হয় না? স্বাভাবিক ভাষা ছেড়ে একটা অস্বাভাবিক ভাষা তয়ের করে কী হবে? … আমাদের ভাষা— সংস্কৃত গদাই-লস্করি চাল— ঐ এক-চাল নকল করে অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে … সংস্কৃতর দিকে দেখ দিকি। ‘ব্রাহ্মণ’-এর সংস্কৃত দেখ, শবরস্বামীর ‘মীমাংসাভাষ্য’ দেখ, পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’ দেখ, শেষ আচার্য শঙ্করের ভাষ্য দেখ, আর অর্বাচীন কালের সংস্কৃত দেখ। এখুনি বুঝতে পারবে যে, যখন মানুষ বেঁচে থাকে, তখন জ্যান্ত-কথা কয়, মরে গেলে মরা-ভাষা কয়। যত মরণ নিকট হয়, নূতন চিন্তাশক্তির যত ক্ষয় হয়, ততই দু-একটা পচা ভাব রাশীকৃত ফুল-চন্দন দিয়ে ছাপবার চেষ্টা হয়। বাপ রে, সে কি ধুম— দশপাতা লম্বা লম্বা বিশেষণের পর দুম করে— ‘রাজা আসীৎ’!!! আহাহা! কি প্যাঁচওয়া বিশেষণ, কি বাহাদুর সমাস, কি শ্লেষ!!— ও সব মড়ার লক্ষণ। যখন দেশটা উৎসন্ন যেতে আরম্ভ হল, তখন এই সব চিহ্ন উদয় হল।[3]

এখন সেই রাজীব গান্ধির আমল থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এবং হিন্দুত্ববাদী মৌলবাদী শক্তি হিসাবে বিজেপি-র তরফে কৃত্রিমভাবে একে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রচুর টাকাপয়সা ঢাললেও এর আর বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

তাঁরা আরও দাবি করেছেন, সংস্কৃতই নাকি ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর আদিতম জননীস্বরূপ ভাষা। এও এক অদ্ভুত দাবি, যখন ভাষাতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক অসংখ্য সাক্ষ্যের দ্বারা এটা সুনিশ্চিতভাবে প্রমাণিত যে সংস্কৃত হচ্ছে এই গোষ্ঠীর সবচাইতে নবীন সদস্য। এমনকি ঋকবেদের ভাষাও সংস্কৃত নয়, তা একরকমের কথ্য অমার্জিত ভাষা, যা বৈদিক ভাষা নামে প্রচলিত, যাকে সংস্কার করেই আমাদের পরিচিত সংস্কৃত ভাষার উদ্ভব হয়েছিল।

খড়গপুর আইআইটি-র এই বিদ্বান লোকেরা ফেব্রুয়ারি মাসের পাতায় ফস্‌ করে বলে ফেলেছেন, “Sanskrit means the most perfected and cultured among languages.” খেয়াল করেননি, এটা বললে, সংস্কৃতকে আর আদিতে ফেলা যায় না। উৎকর্ষ লাভের জন্য সময় লাগে, অন্যত্র লক্ষিত ত্রুটি থেকে মুক্ত হতে হয়, তবে তো সে সর্বোৎকৃষ্ট হবে। মুশকিল হচ্ছে, গরু, গোবর গোমূত্র দিয়ে মগজ ভর্তি করে ফেললে কোন দাবির সঙ্গে অন্য কোন দাবি ম্যাচ করে, বা করে না, তা বোঝার ক্ষমতা যায় হারিয়ে।

অতএব এই সব দাবিও অসার অযৌক্তিক অনৈতিহাসিক ও তথ্যভিত্তিহীন।

 

[চার]

উপরোক্ত ক্যালেন্ডারে দাবি করা হয়েছে, প্রাচীন ভারতে বৈদিক যুগে জ্যোতির্বিদ্যা এবং মহাজাগতিক বিদ্যার এমন বিকাশ হয়েছিল, যা নাকি আজকের দিনেও প্রাসঙ্গিক।

আকাশসম্বন্ধীয় সুপ্রাচীন যে শাস্ত্রের বাস্তবে অস্তিত্ব ছিল, তার নাম বেদাঙ্গ জ্যোতিষ। নামে বেদাঙ্গ যুক্ত থাকলেও এর সঙ্গে বৈদিক সাহিত্য বা যুগের সম্পর্কে নেই। কেন না, বেদাঙ্গ শাস্ত্রগুলির অনুমিত রচনাকাল বেদ উপনিষদের অনেক পরে, সম্রাট অশোকের কাছাকাছি সময়ে। আর তাতে মহাজাগতিক তো দূরের কথা, সৌরপরিবারের সমস্ত সদস্যদের পরিচয়ও পাওয়া যায় না। জগত, সংসার, ব্রহ্মাণ্ড জাতীয় শব্দগুলি বৈদিক ও বেদোত্তর সাহিত্যে উল্লেখ থাকলেও তাদের দ্বারা সূচিত এলাকা খুব বড় নয়। কোনওরকমে এই পৃথিবীকে বুঝিয়েছে। মঙ্গল বৃহস্পতি শুক্র গ্রহের উল্লেখ আছে, কিন্তু বুধ বা শনির নাম দেখা যায় না। গ্রহ এবং তারার মধ্যে তখনও তারা পার্থক্য করতে পেরে ওঠেনি। সেখানে সূর্যের তুলনায় চাঁদের গুরুত্ব অনেক বেশি। তাতে উল্কা বা ধূমকেতুর বিষয়ে কিছু লেখা নেই।

ষষ্ঠ শতাব্দের জ্যোতির্বিদ বরাহমিহিরকে আইআইটি ক্যালেন্ডার তাদের ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্রে স্থান দিয়েছে। সেই বরাহমিহির গ্রিক-রোমান জ্যোতির্বিদ্যা— যা আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের কাছাকাছি সময়ে ভারতে আসে— তাকে বেদাঙ্গ জ্যোতিষের তুলনায় শ্রেয়তর বলেছেন। তাদের তুলনায় বেদাঙ্গ জ্যোতিষকে বলেছেন “দুর্বিভ্রষ্ট”। এটা মনে হয় হিন্দুত্ববাদী রাজত্বে ভারতীয় জ্ঞানতন্ত্রে জায়গা পাবে না।

সৌরজগতেরই বেশিরভাগ সদস্যদের অনুপস্থিতি সত্ত্বেও কীভাবে যে আইআইটি ক্যালেন্ডার রচয়িতাদের মনে হল, এতে মহাবিশ্বের খবরাখবর আছে, তা আমাদের জ্ঞানতন্ত্রের সীমিত সামর্থ্যে বোঝা সম্ভব নয়।

 

[পাঁচ]

আইআইটি ক্যালেন্ডারের সবচাইতে বিতর্কিত অংশ অবশ্য দুটো। মনে হয়, এই ক্যালেন্ডার রচয়িতারাও খুব জেনেবুঝেই এই দুটি থিসিস বাজারে এনেছেন। সংশ্লিষ্ট সকলেই জানেন এগুলো আরএসএস-এর অনেক দিনের দাবি এবং অ্যাজেন্ডা।

ক) ভারতীয় “আর্য”রা বাইরে থেকে ভারতে আসেনি। তারা ভারতেরই আদিবাসী। এখান থেকেই তারা পশ্চিমি দেশগুলিতে শাখা বিস্তার করেছিল।
খ) হরপ্পা সভ্যতা বৈদিক সভ্যতারই অংশ। বৈদিক “ঋষি”-রাই এক সময় হরপ্পা সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল। এই দুটোর মধ্যে কোনও স্বাতন্ত্র্য বা বিচ্ছিন্নতা নেই।

সঙ্ঘ লবি মনে করে এবং প্রচারও করে থাকে, এসব হল বিদেশিদের ভারত-বিরোধী অপপ্রচার।

প্রথম বিষয়টা নিয়ে প্রথমে কিছু কথা বলা যাক।

বৈদিক গোষ্ঠীর জনজাতিগুলি (যাদেরকে ভুল করে অনেকেই, এমনকি মার্ক্সীয় এবং যুক্তিবাদী বস্তুবাদী ঐতিহাসিকেরাও “আর্য” বলে সম্বোধন করে থাকেন) যে সিন্ধুগঙ্গা অববাহিকার আদি বাসিন্দা নয়, বহিরাগত— এই বিষয়টি আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে একটা সমাজবৈজ্ঞানিক তত্ত্বকল্প হিসাবে থাকলেও এখন আর তা নয়, বহুকাল আগেই তা চূড়ান্ত তথ্য ও সত্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। পঞ্চাশ বছর আগে পর্যন্ত এর সপক্ষে ভাষাতাত্ত্বিক যুক্তি ছাড়া আর বিশেষ কিছু প্রত্ন সাক্ষ্য হাতে ছিল না। কিন্তু সেই ভাষাতাত্ত্বিক প্রমাণই এত শক্তিশালী ছিল যে উনিশ শতকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর থেকে শুরু করে বিশ শতকে সুনীতিকুমার চ্যাটার্জী, বটকৃষ্ণ ঘোষ, এমনকি রমেশচন্দ্র মজুমদার, যিনি মতাদর্শগতভাবে হিন্দু মহাসভার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, প্রমুখ সকলেই এটা সর্বান্তঃকরণে মেনে নিয়েছিলেন। তাঁদের অন্তত এই বিষয়ে তথ্যাভাবজনিত কোনও সন্দেহ ছিল না।

পরবর্তীকালে এর সপক্ষে বেশ কিছু প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য পাওয়া যায়। যেমন, ঘোড়ার ফসিল। সকলেই জানেন, ঘোড়া ভারতের স্বাভাবিক পশু নয়। নয় বলেই মেহেরগড় ও হরপ্পা প্রত্নক্ষেত্রে ঘোড়ার একটাও জীবাশ্ম পাওয়া যায়নি। কিংবা উল্টোভাবে বলা যায়, প্রায় ছয় হাজার বছরের সীমানায় যখন একটাও ঘোড়ার জীবাশ্ম পাওয়া গেল না, তখন মানতে হবে যে এই অঞ্চলে ঘোড়া স্বাভাবিকভাবে ছিল না। আর ঋকবেদে অশ্বের উল্লেখ গরুর চেয়ে অনেক বেশি। অন্তত ২১৫ বার। তার মানে, বৈদিক জনজাতির সঙ্গে ঘোড়ার খুবই ভাবভালোবাসার সম্পর্ক। তারা যদি উত্তর-পশ্চিম ভারতের আদিবাসীই হয়, তারা ঘোড়া পেল কোত্থেকে? ঘোড়ার হঠাৎ করে উদয় হল কীভাবে?

ক্যালেন্ডারে কি এই সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে?

না, তার বদলে বিবেকানন্দ আর অরবিন্দের উদ্ধৃতি দিয়ে তারা তাদের থিসিস প্রমাণ করতে চেয়েছে। এ অনেকটা রবীন্দ্রনাথের উদ্ধৃতি দিয়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সমস্যা সমাধানের মতো। কিংবা, বসু সংখ্যায়ন-এর সাহায্যে মাইকেলের কবিতার অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যাখ্যার সদৃশ। তা, সে কি আর করা যায় না? যায়, শুধু তাতে হাস্যকর রকমের ভুল হয়।

ইউরোপে ঘোড়ার জীবাশ্ম অনেক প্রাচীনকাল থেকে পাওয়া যায়। তার মানে ওখানে ঘোড়া স্বাভাবিক পশু হিসাবে ছিল। ইরানে ৪০০০ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ সময়ের এক ঘোড়ার ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে। আর হরপ্পা ক্ষেত্রের আশেপাশে ২২০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়কালের ঘোড়ার জীবাশ্ম পাওয়া গেছে। অর্থাৎ, এও যেন এক ক্যালেন্ডার। ঘোড়া সময়ের সারণি বেয়ে পশ্চিম থেকে পুবে আসছে। আসছে মানেই কেউ আনছে। কোনও একটা জনগোষ্ঠী ঘোড়া সঙ্গে নিয়ে আসছে।

আরও অনেক তথ্য ও যুক্তি আছে। আমার এক অনুজপ্রতিম বন্ধু এই বিষয়ে সম্প্রতি এক চমৎকার প্রবন্ধে সেই সব কথা তুলে ধরেছেন। যাঁরা আরও বিস্তৃত জানতে চান, পড়ে দেখতে পারেন।[4]

এই সব কঠোর তথ্য অস্বীকার করা যায়?

যায়, স্বার্থ থাকলে। কমরেড ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন একবার বলেছিলেন, সামাজিক স্বার্থের প্রশ্ন জড়িত থাকলে লোকে জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধগুলিকে নিয়েও বিতর্কের জন্ম দেবে।[5] তা বৈদিক জনগোষ্ঠীর ভারতে অভিবাসনের প্রশ্ন তো কোন ছার!

এখানে আবার কী স্বার্থ?

সঙ্ঘ পরিবারের অনেকদিনের থিসিস সমর্থন: হিন্দুরা ভারতে দেশি, আর মুসলমানরা এখানে বহিরাগত। তাদের মুসলিম বিরোধী ঘৃণা বিদ্বেষ প্রচারের রাজনীতির এটা একটা বড় হাতিয়ার। তো, হিন্দুদের পূর্বপ্রজন্মের লোকেরাও যদি সেই বাইরে থেকেই এসে থাকে, তাহলে আর এই রাজনীতিটা করা যায় না। অতএব যে কোনও মূল্যেই এই থিসিসকে ঠেলে তুলতেই হবে। ক্ষমতায় জমিয়ে বসার দরুন এখন কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনাধীন সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় ও সদৃশ প্রতিষ্ঠানগুলির কর্মকর্তা নিয়োগে সুযোগ তাদের হাতে। আইআইটিগুলিতেও তারা দলের অনুগত অথবা মধুলোভী বুদ্ধিজীবীদের নিয়োগ করছে। আর তারা এসে সঙ্ঘ পরিবারের অ্যাজেন্ডাকে এগিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু তারা যেটা ধরতে পারছে না, আইআইটির গবেষকরা স্বাধীনভাবে গবেষণা করে এরকম সিদ্ধান্ত নিলে যে লাভটা হত, চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তে সেটা হবে না। আবার এটাও ঠিক, গরুর পেচ্ছাপ নিয়ে গবেষণার টাকা জোগান দিলে এরকম বুদ্ধিই হবে। অন্যরকম কিছু হওয়ার নয়।

এই একটা দাবিতে যাতে কেউ আর সন্দেহ করতে না পারে, সেই জন্য এত মিথ্যার চাষ করেও শেষ পর্যন্ত কোনও লাভ হল না। বিশ্বের জ্ঞানতন্ত্র একে গ্রহণ করেনি।

 

[ছয়] 

দ্বিতীয় থিসিসটার দিকে এবার নজর দেওয়া যাক: হরপ্পা আর বৈদিক সংস্কৃতি একই ধারাবাহিক সভ্যতার অঙ্গ এবং বৈদিক ঋষিরাই হরপ্পা নগরসভ্যতার জন্ম দিয়েছিল।

এটাও সঙ্ঘ দপ্তরের অনেক দিনের প্রচার অ্যাজেন্ডা। হরপ্পার দখল চাই। বৈদিক ঋষিদের হরপ্পার মাথায় চাপাতেই হবে। এর জন্য বহুকাল ধরে তারা কতরকম কসরত যে করে চলেছে তার ইয়ত্তা নেই। গত তিরিশ চল্লিশ বছর ধরে হরিয়ানা রাজস্থানের শুক্‌নো ঘগ্‌গর খাতকে ঋকবেদ-কথিত সরস্বতী নদী বানিয়ে সেখানে তপোবন আশ্রম তৈরি করে সিন্ধু সভ্যতাকে সরস্বতী সভ্যতা বানানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। আর একবার সরস্বতীর নামে সভ্যতাকে স্থানান্তরিত করে ফেলতে পারলে ঋকবেদে সরস্বতীর স্তব দেখিয়েই হরপ্পা সভ্যতার উপর বৈদিক সিলমোহর বসিয়ে ফেলতে অসুবিধা হবে না।

এই মতলব হাসিল করার জন্য বিজেপি-র লোকেরা ১৯৯৭ সালে গুজরাতের ভদোদরায় মহারাজ শাহজি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভূতাত্ত্বিক সম্মেলনের আয়োজন করে সেখানে সঙ্ঘানুরাগী বিজ্ঞানীদের দিয়ে উপগ্রহ ছবিকে ব্যবহার করে (আসলে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করে) ঘগ্‌গর-হাকরা শুষ্ক খাতের সঙ্গে শতদ্রু ও যমুনার প্রত্নখাতের সংযোগ দেখিয়ে সেই সংযুক্ত নদীপথকে সরস্বতী বলে চিহ্নিত করার এক মহা-অপচেষ্টা চালিয়েছিল। তাতে সেকালে বেশ কিছু ধীমান ইতিহাসবিদও বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। আমি সেই সময় একটা দুর্বল প্রচেষ্টা করেছিলাম এই জঘন্য অপকর্মকে উন্মোচন করে দেখাতে।[6] সম্প্রতি আমি আরও একবার সেই বেদ কথিত সরস্বতী নদী উদ্ধার প্রকল্পের নীলনকশার চরিত্র উন্মোচন করে একটা বিস্তারিত ই-প্রবন্ধে তথ্যবিরোধগুলি উত্থাপন করেছি।[7]

কেন হরপ্পা সভ্যতা বৈদিক সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না?

১) প্রথম কারণ, ঐতিহাসিক মানদণ্ডে হরপ্পা একটি উন্নততর নগরসভ্যতার পরিচায়ক, যা এক বিস্তীর্ণ প্রত্নক্ষেত্র জুড়ে (কমপক্ষে পাঁচ লক্ষ বর্গমাইল) অনেকগুলি এলাকায় ছড়িয়ে আছে— যথা, হরপ্পা, মহেন-জো-দারো, চান-হু-দারো, ঢোলাবিরা, কালিবঙ্গান, ইত্যাদি। বৈদিক সংস্কৃতি নগরসভ্যতার স্তর থেকে অনেকখানি পিছিয়ে থাকা এক গ্রামীণ জীবনপট। ইতিহাসে সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে একটা সুনির্দিষ্ট পার্থক্য আছে। তাকে এই ক্ষেত্রে কোনওভাবেই অগ্রাহ্য করা যায় না।

২) সিন্ধু সভ্যতা মোটামুটি ১৮৫০ খ্রিস্টপূর্ব নাগাদ অবসিত হয়ে যায় (কেন এবং কীভাবে সে কথা পরে বলছি)। তারপরে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে আবার ভারতে নগরসভ্যতার সাক্ষ্য পাওয়া যায়, ষোড়শ মহাজনপদের কথা আমরা জানতে পারি। মাঝখানের প্রায় দেড় সহস্র বছর জুড়ে ভারতে পাকাবাড়ি, দেওয়াল, পরিখা, নিকাশি নালা, শস্যভাণ্ডার— ইত্যাদির কোনও প্রত্ন সাক্ষ্য নেই। বৈদিক লোকেরা হরপ্পা বানাতে পারল, আর মাঝখানে এতকাল ধরে কোনও নাগরিক কাঠামোর জন্ম দিতে পারল না, এর কোনও ব্যাখ্যা হয় না।

৩) সিন্ধু সভ্যতার প্রতিটি প্রত্নক্ষেত্রেই কৃষি ও বাণিজ্যের নানা রকম প্রত্ন সাক্ষ্য আছে। বৈদিক সংস্কৃতির যে পরিচিতি বৈদিক ও বেদোত্তর সাহিত্যে বিধৃত, তাতে শুধু পশুপালনের লক্ষণ দেখা যায়। কৃষি ও বাণিজ্যের কোনও সাক্ষ্য নেই। রামায়ণে সীতা ও অহল্যার উপকথাগুলি ইঙ্গিত করে যে মহাকাব্যের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রস্ফুটনকালে, অর্থাৎ, বুদ্ধোত্তরকালে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলিতে কৃষির সূচনা হতে থাকে।

৪) নগরসভ্যতার বৈশিষ্ট্য হিসাবেই হরপ্পা ক্ষেত্রগুলিতে প্রাপ্ত সিলসমূহে লিপি, ওজন, সংখ্যা, পরিমাপের পর্যাপ্ত সাক্ষ্য পাওয়া যায়। বৈদিক ও বেদোত্তর সাহিত্য তার ঐতিহ্যক্রমেই প্রাক্‌লিপি পর্যায়ে শ্রুতি হিসাবে অবস্থিত। খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দের আগে ভারতে সংস্কৃত ভাষায় লিখন ও ব্যাকরণের কোনও প্রমাণ নেই এবং আদিমতম লিপি হিসাবে এ পর্যন্ত যা পাওয়া গেছে, ব্রাহ্মলিপি, তারও নিদর্শন খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের আগে পাওয়া যায়নি। যদি একই জনজাতিসমূহ হরপ্পা ও বৈদিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়ে থাকে, তবে তারা এক জায়গায় যা পারল, অন্যত্র তা পারল না কেন— এর কোনও সদুত্তর নেই।

৫) ঘোড়াভিত্তিক পার্থক্যের কথা আগেই বলেছি। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাগোষ্ঠীর জনজাতিগুলির একটি প্রায় সর্বজনীন সাধারণ অর্জন হল অশ্ববাহিত রথ। রথ একটি দ্রুতগামী যান, যা প্রধানত যুদ্ধে ব্যবহৃত হত। এর চাকায় স্পোকের আয়োজন দেখা যেত। সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নক্ষেত্রে যে যানবাহন দেখা গেছে তা মূলত ভারি মালপরিবাহী মন্থর গাড়ি, যার চাকা ভরাট ও সুঠাম, ভার বহনের উপযুক্ত। সেখানে রথসদৃশ কোনও যানবাহনের দেখা মেলে না, ঠিক যেমন বৈদিক সাহিত্যে মাল পরিবহনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনওরকম গাড়ির সন্ধান বা উল্লেখ নেই। ইত্যাদি।

৬) হরপ্পা সভ্যতা সত্যিই বৈদিক জনগোষ্ঠীর অবদান হলে হরপ্পার সিলগুলিতে কী লেখা আছে তা সংস্কৃতজ্ঞ ও বেদজ্ঞ পণ্ডিতদের পক্ষে পড়ে উঠতে পারার কথা। অক্ষরগুলি অধ্যবসায় সহ প্রয়াসে এত দিনে চিনে ফেলবার কথা। চেনা যে গেল না, সেটাও আরও একটা কঠোর প্রমাণ যে উপরোক্ত সভ্যতার সঙ্গে বৈদিক ঐতিহ্যের কোনওরকম সম্পর্কই নেই।

আরও অনেক পার্থক্যের কথাও হয়ত বলা যায়। তবে আমার ধারণা, যতটুকু বলা হল, তাতেই এটা স্পষ্ট যে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে বৈদিক জনজাতিগুলিকে কোনওভাবেই জড়িয়ে ফেলা যাবে না। আইআইটি ক্যালেন্ডার খুব তন্বিষ্ঠ আরএসএস ক্যাডারদের মতো বিশ্বাসগুলিকে সুন্দর করে ক্যালেন্ডারে সাজিয়ে দিয়েছে সাক্ষ্যপ্রমাণ ও মান্য ইতিহাসের শিক্ষার পরোয়া না করে। এতে ওদের বিশ্বাসের প্রতি অন্ধতার নিদর্শন মিলেছে, কিন্তু সত্য ও জ্ঞানের প্রতি দায়বদ্ধতার অভাবই পাশাপাশি প্রকট হয়ে উঠেছে।

হরপ্পা সভ্যতার অবসান সম্পর্কে দু-এক কথা বলা প্রয়োজন। এই প্রত্নক্ষেত্র আবিষ্কারের পর থেকে বহুকাল পর্যন্ত মনে করা হত, বৈদিক জনজাতিগুলির দলে দলে আগমন ও আক্রমণের ফলেই সিন্ধু ক্ষেত্রের জনজাতিগুলি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তাদের নির্মিত সভ্যতাও ধ্বংস হয়ে যায়। বর্তমানে গবেষণার অগ্রগতির মধ্য দিয়ে প্রায় নিশ্চিত হওয়া গেছে: এখানে যে তাম্রব্রোঞ্জ সভ্যতা গড়ে উঠেছিল, তা এক সময় এক ভয়ঙ্কর পরিবেশ বিপর্যয়ের সামনে পড়ে। বিস্তৃত কৃষি ক্ষেত্র ও নগরায়নের জন্য সিন্ধু নদীর অববাহিকায় দেড় দুহাজার বছর ধরে বিপুল পরিমাণ গাছপালা কেটে ফেলার ফলে ধীরে ধীরে বৃষ্টিপাত কমে যায়, শুষ্ক মাটির পক্ষে জল ও জলীয় বাষ্প অণু ধরে রাখার ক্ষমতাও কমে আসে। থর মরুভূমির বিস্তার ঘটতে থাকে। ফলে বৈদিক গোষ্ঠীর লোকজন এই অঞ্চলে বসতি স্থাপনের অনেক আগেই জায়গাটা খালি হয়ে যায়।

 

[সাত]

সাম্প্রতিক অতীতে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে যারাই ফ্যাসিবাদ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন, ফ্যাসিস্টরা কীভাবে তাদের প্রচারকার্য চালায় খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ করেছেন, তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন—

Fascist politics, however, makes room for the study of myths as fact. In fascist ideology, the function of the education system is to glorify the mythic past, elevating the achievements of members of the nation and obscuring the perspectives and histories of those who do not belong. . . . In fascist ideology, the goal of general education in the schools and universities is to instill pride in the mythic past; fascist education extols academic disciplines that reinforce hierarchal norms and national tradition. For the fascist, schools and universities are there to indoctrinate national or racial pride, conveying for example (where nationalism is racialized) the glorious achievements of the dominant race.[8]

ইতালি জার্মানি থেকে শুরু করে আজকের বিশ্বেও যেখানেই নানা ফ্যাসিবাদী শক্তি বিভিন্ন মাত্রায় কাজ করছে, এটাই তাদের একটা সাধারণ লক্ষ্য। যে জাতি বা নৃজাতির জয়গান তারা গাইতে চায়, তাদের অতীতকে বাস্তবের তুলনায় অধিকতর মহান করে চিত্রিত করতে গিয়ে তারা কোনও মিথ্যা প্রচারেই কুণ্ঠিত হয় না, এবং সরকারি ক্ষমতায় থাকলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিকক্ষ থেকেই সেই মিথ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত মিথগুলিকে বাজারে প্রামাণ্যজ্ঞান হিসাবে তুলে ধরতে থাকে। খড়গপুর আইআইটি ক্যালেন্ডার ভারতীয় হিন্দুদের অতীত গৌরবগাথা তুলে ধরার নামে ঠিক সেই কাজটাই করছে।

সত্যকারের ভারত ইতিহাস তুলে ধরতে হলে, জ্ঞানে বিজ্ঞানে ভারতের প্রকৃত অবদান জানতে ও জানাতে হলে এবং তার অর্জনের পেছনে শতসহস্র মানুষের ভূমিকা বুঝতে হলে এই সমস্ত মিথ্যা প্রচারের মুখোশ খুলে দিতে হবে।


[1] শিক্ষার বাহন।
[2] সংস্কৃতভাষা ও সংস্কৃতসাহিত্যশাস্ত্রবিষয়ক প্রস্তাব। বিদ্যাসাগর রচনা সংগ্রহ, ৩য় খণ্ড। ১৯৭২।
[3] বাঙ্গালা ভাষা। ভাববার কথা। লিঙ্কও একটা দিয়ে রাখি:- https://www.thakurmaaswamiji.com/2021/07/bhabbar-katha.html#point13
[4] দাস, রাধাপদ। খড়গপুর আইআইটি-র ক্যালেন্ডার (২০২২) – প্রমাণের নামে ভারতের সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতা সম্পর্কে এক ধর্মীয় মৌলবাদী চিন্তার মিথ্যা প্রচার। পূর্বাঞ্চল ওয়েব পত্রিকা। ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২।
[5] মার্ক্সবাদ ও সংশোধনবাদ, ১৯০৮
[6] Mukhopadhyay, Ashoke. Rigvedic Sarasvati River: Myth or Reality. Breakthrough. December 2000. আরও দ্রষ্টব্য: বেদ-কথিত সরস্বতী নদী— দাবি বনাম তথ্য। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস: বিশ্বাস বনাম যুক্তিতথ্য। ২০১৮।
[7] সঙ্ঘ পরিবারের ভূগোল বিজ্ঞান: বেদ কথিত “সরস্বতী” নদী। অন্যস্বর। ৮ জানুয়ারি ২০২২।
[8] Stanley, Jason. How Fascism Works. 2018.