Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বিচারের আলোয় গোধরা ও গোধরা-পরবর্তী গুজরাট

সৌভিক ঘোষাল

 

২০০২ সালের গুজরাট আধুনিক ভারতের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িক সংকট ও হিংসার এক দুঃখজনক মাইলফলক হিসেবে রয়ে গেছে। সে বছর পিঠোপিঠি দু’টি মর্মান্তিক ঘটনা দেশ তথা গোটা বিশ্বকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। সেই কম্পনের আফটার শক আজ দেড় দশক পরেও মাঝেমধ্যেই টের পাওয়া যায়। প্রথমে ঘটে গোধরা অগ্নিকাণ্ড এবং তারপর তার সূত্রে বেশ কয়েক সপ্তাহব্যাপী বিরাট দাঙ্গায় রক্তাক্ত হয় গুজরাট।

গোধরায় ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছিল ২০০২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। গোধরা স্টেশনে সবরমতী এক্সপ্রেস যখন পৌঁছায় তখন ট্রেনের এস-৬ কামরায় আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। করসেবকদের একটি দল অযোধ্যা থেকে ফিরছিল সেই কামরায়। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৫৯ জন প্রাণ হারান। তারপর টানা দুই মাস সারা রাজ্যে দাঙ্গা চলেছিল।

গোধরার ট্রেনে আগুন লাগানোর সেই মামলায় ২০১১ সালে সিট (স্পেশাল ইনভেসটিগেশন টিম)-এর বিশেষ আদালত ১১ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ২০ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। সাজাপ্রাপ্তরা রায়ের বিরুদ্ধে অ্যাপিল করেছিলেন। তাতে সাড়া দিয়ে গুজরাট হাইকোর্ট অতি সম্প্রতি, এই অক্টোবরের ৯ তারিখ ১১ জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে ‌যাবজ্জীবন করে দিয়েছেন। রায়দানের সময় বিচারপতি তাঁর মন্তব্যে বিচারে বিলম্বের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন।

এই সাম্প্রতিক রায় আবার গোধরা ও গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গার দিনগুলিকে আলোচনায় ফিরিয়ে এনেছে। গোধরা ট্রেন দুর্ঘটনার পর যে নরসংহার পর্ব শুরু হয় তাতে হাজার মানুষ প্রাণ হারান। দাঙ্গার মোড়কে এর বেশিটাই ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। সেই নরসংহারের বিচারগুলি কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, প্রাথমিক আদালতে রায়ের গতিপ্রকৃতি কীরকম তার কয়েকটির ওপর একবার চোখ রাখা যাক।

নারোদা পাতিয়া হত্যাকাণ্ড – ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০২ আহমেদাবাদের নারোদাতে এই হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়। এতে ৯৭ জন মুসলিমকে খুন করা হয়। প্রাথমিক বিচারের পর আদালত বিজেপি নেতা ও রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী মায়া কোদনানিকে অন্যতম দোষী সাব্যস্ত করে ২৮ বছর কারাবাসের শাস্তি দেয়। পরে হাইকোর্ট জুলাই ২০০৪-এ শারীরিক অসুস্থতার জন্য তার শাস্তি মকুব করে। নারোদা হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী পর্যায়ের বিচার হাইকোর্টে এখনও চলমান। এই হত্যাকাণ্ডের প্রাথমিক বিচারে দোষী সাব্যস্তদের মধ্যে রয়েছেন বিজেপি নেতা কিশান কোরানী এবং বজরং দলের নেতা বাবু বজরঙ্গী।

সর্দারপুরা হত্যাকাণ্ড – ১ মার্চ, ২০০২-তে মেহসানার সর্দারপুরা গ্রামে হত্যাকাণ্ড ঘটে। এতে ৩৩ জনকে জীবন্ত জ্বালিয়ে মারা হয়েছিল। নিম্ন আদালত নভেম্বর, ২০১১-তে এই হত্যাকাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত করে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের শাস্তি দেয়। হাইকোর্টে এর বিচার এখনও চলছে।

নারোদা গাম হত্যাকাণ্ড – আহমেদাবাদ এর নারোদা গাম এলাকায় ১১ জনকে হত্যা করা হয়েছিল। স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন টিম (সিট)-এর প্রাথমিক তদন্ত ও রায়দান প্রক্রিয়া এই ক্ষেত্রে এখনও শেষ হয়নি এবং বিলম্ব বিচারের দিক থেকে এটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য।

ওড গ্রাম হত্যাকাণ্ড – ১ মার্চ ২০০২-তে সংগঠিত এই হত্যাকাণ্ডে ২৩ জনকে খুন করা হয়। প্রাথমিক আদালত এর রায় দিতে গিয়ে ২৩ জন অভিযুক্তকে বেকসুর খালাস করে দেয়। ১৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় ও ৫ জনের হয় সাত বছরের কারাদণ্ড।

দীপদা দরওয়াজা হত্যাকাণ্ড – ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০২-তে উত্তর গুজরাটের ভীশনগর শহরের দীপদা দরওয়াজা এলাকার এক পরিবারের ১১ জনকে হত্যা করা হয়েছিল, যার মধ্যে ছিলেন ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধা ও চারটি শিশুও। ৩০ জুলাই, ২০১২-তে বিশেষ আদালতের রায়ে হত্যাকাণ্ডের জন্য ২১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

বিলকিস বানো ধর্ষণ মামলা – ২০০২-এর ৩ মার্চ ১৯ বছরের কিশোরী বিলকিস বানোকে ধর্ষণ করা হয় গর্ভবতী অবস্থায়। দাহোদ জেলার রাধিকাপুরের এই ঘটনায় ২০০৮ সালের রায়ে ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট এই ঘটনার ক্ষেত্রে সি বি আই তদন্তের নির্দেশ দেন এবং বিচার প্রক্রিয়াকে মহারাষ্ট্রে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

বেস্ট বেকারি হত্যাকাণ্ড – ২০০২-এর ১ মার্চ বরোদার বেস্ট বেকারিতে একদল দুষ্কৃতী হামলা চালায় এবং বেকারি পুড়িয়ে দেয়। এতে ১৪ জন মারা যান। ১৭ জন অভিযুক্তের মধ্যে ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্ট এই ঘটনার পুনর্তদন্তের নির্দেশ দেন এবং এই বিচার প্রক্রিয়াকে সরিয়ে নিয়ে যান গুজরাট থেকে মহারাষ্ট্রে। বোম্বে হাইকোর্ট ৯ জন শাস্তিপ্রাপ্তের মধ্যে ৪ জনের শাস্তি বজায় রাখে এবং বাকি পাঁচজনকে বেকসুর খালাস করে।

গুলবার্গ সোসাইটি হত্যাকাণ্ড – ২০০২ সালে গুজরাট হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে অন্যতম জঘন্য হত্যাকাণ্ড হল ২৮ ফেব্রুয়ারির গুলবার্গ সোসাইটি গণহত্যা। প্রকাশ্য দিবালোকে গুলবার্গ সোসাইটিতে আগুন লাগানো হয়, ৬৯ জনকে খুন করা হয়। প্রাক্তন সাংসদ ইসান জাফরি ছিলেন আক্রমণের লক্ষ্য। তাঁর হাত দুটি কেটে উলঙ্গ করে হাঁটানো হয়, তারপর জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। জাফরির কয়েক শো প্রতিবেশী তাঁর কাছে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং সকাল ৯.৩০ মিনিট থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টা ধরে জাফরি মরিয়াভাবে পুলিশ, রাজনৈতিক নেতা, গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ও দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করে যান। কিন্তু এ সমস্ত ফোনে কিছুই লাভ হয় না এবং পুলিশের কর্তাব্যক্তিরা গুলবার্গ সোসাইটিতে এলেও খুনে দাঙ্গাকারীদের হঠিয়ে দিতে কোনও পদক্ষেপই গ্রহণ করেননি। এই ঘটনা দাঙ্গাদমনে তৎকালীন গুজরাট সরকারের আন্তরিকতাকে প্রবল প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছিল।

গুলবার্গ সোসাইটি ঘটনায় বিজেপি নেতা বিপিন প্যাটেল সহ ৩৬ জনকে বেকসুর খালাস করে বাকি অভিযুক্তদের মধ্যে ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও বারো জনকে সাত বছরের জন্য কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একজনকে দশ বছরের কারাবাসের সাজা দেওয়া হয়। কিন্তু সামগ্রিকভাবে এই রায় হতাশাজনক ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী বলেই অনেকের কাছে মনে হয়েছে। কেননা সোসাইটির বাইরে কয়েক ঘণ্টা ধরে সশস্ত্র দাঙ্গাকারীরা যে জড়ো হয় সে সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীদের প্রাথমিক সাক্ষ্যকে এই রায়ে উপেক্ষা করা হয়েছে। পুলিশ কর্তারা ঘটনাস্থলে যান, দাঙ্গাকারীদের দেখতে পান, তা সত্ত্বেও দাঙ্গাকারীদের হঠিয়ে দিতে বাহিনীকে ডাকা হয়নি— এই অবিসংবাদী তথ্যকেও এই রায়ে অগ্রাহ্য করা হয়। বিপরীতে এই রায়ে ইসান জাফরি যে গুলি ছুঁড়েছেন সে সম্পর্কে ‘ইচ্ছাকৃত স্মৃতিবিলোপের’ অভিযোগে প্রত্যক্ষদর্শীদের নিন্দা জানানো হয়। রায়ে বলা হয় যে উপস্থিত উচ্ছৃঙ্খল লোকেরা কেবলমাত্র গাড়িই পোড়াতে চেয়েছিল এবং জাফরির গুলিচালনার পরই কেবলমাত্র এই লোকেরা খুন করতে শুরু করে।

একই দিনে গুলবার্গ সোসাইটির কাছেই নারোদা পাটিয়ায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকারীরা মুসলিমদের হত্যা করে। সমস্ত গুজরাট জুড়েই বিভিন্ন স্থানে মুসলিমদের হত্যা করা হয়। স্পষ্টতই সাম্প্রদায়িক গুণ্ডারা মুসলিমদেরই হত্যা করতে চেয়েছিল, এমনকি যে সমস্ত স্থানে জাফরি বা গুলি চালনার মতো কেউ নেই সেখানেও তারা মুসলিমদের হত্যা করে। গুলবার্গ সোসাইটিতে সাম্প্রদায়িক হিংসাকে কীভাবে স্বতঃস্ফূর্ত বলা যায়, যেখানে জাফরির দ্বারা তথাকথিত গুলি চালনার আগেই কয়েক ঘণ্টা ধরে সাম্প্রদায়িক গুণ্ডারা জড়ো হয়? এই গুণ্ডাদের হঠিয়ে দিতে পুলিশের হাতে যথেষ্ট সময় ছিল– কিন্তু কেন তারা তা করেনি? এই প্রশ্নগুলোকেই আদালত অগ্রাহ্য করতে চেয়েছে যা দুর্ভাগ্যজনক। এই রায় খোলাখুলিভাবে আক্রান্তদেরই দোষী সাব্যস্ত করে, দাঙ্গাকারীদের আক্রমণ থেকে তাদের নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য কোনও অধিকারই গ্রাহ্য করেনি। এই রায়ে নিরাপত্তার দায় আক্রমণকারী ও পুলিশ প্রশাসনের ওপর না দিয়ে আক্রান্তদের আচরণের ঘাড়েই চাপানো হয়েছে, অথচ এ ধরনের আক্রমণকে রোখার দায়িত্ব পুলিশ-প্রশাসনেরই ছিল। এই ধরনের এক রায় ঘোষণা করে বিশেষ আদালত যেন নরেন্দ্র মোদীর পুরনো কথাই প্রতিধ্বনিত করে। মোদী ২০০২ সালে গুলবার্গ গণহত্যার জন্য জাফরির গুলি চালনাকেই দায়ী করেন এবং নিউটনের সূত্র এবং ‘ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া’-র তত্ত্বের উল্লেখ করেন।

গোধরা অগ্নিকাণ্ড নিয়ে উচ্চ আদালতের রায় সবেমাত্র বেরোল। গোধরা-পরবর্তী বহু দাঙ্গার বিচার এখনও চলছে। এই বিলম্ব ন্যায়বিচারকে লঘু করে দেয়, বিচারপ্রত্যাশী আক্রান্তদের মনোবলে আঘাত করে। ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে জাকিয়া জাফরি ও গুলবার্গ গণহত্যায় অন্যান্য জীবিতদের প্রচেষ্টা ইতিমধ্যে বহু বাধাবিপত্তির সম্মুখীন। সুপ্রিম কোর্টের তৈরি করা সিট এই মামলা চাপা দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্রেই লিপ্ত হয়েছে। কেন্দ্রে ক্ষমতাসীনরা এখন তিস্তা শীতলাবাদ ও অন্যান্য যাঁরা ন্যায়বিচারের জন্য জীবিতদের লড়াইকে সমর্থন করছেন, সেই সমস্ত সমাজকর্মীদের বিরুদ্ধে হুমকি ও হয়রানির অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এখন যদি উচ্চ আদালত গুলবার্গ সহ নানা মামলায় বিচারের প্রহসনকে সংশোধন না করে তবে তা হবে ভারতীয় বিচারব্যবস্থারই লজ্জা।

আরেকটি লজ্জার কথা এখানে না বললেই নয়, তা হল দাঙ্গার সময় গুজরাট সরকারের ভূমিকা। একথা আজ পরিষ্কার যে গোধরা কাণ্ড যেমন পরিকল্পিত ছিল, গোধরা-পরবর্তী দাঙ্গাও তাই। একটি ঠাণ্ডা মাথার কেন্দ্রীয় পরিকল্পক ও পৃষ্ঠপোষক না থাকলে এত দীর্ঘ সময় ধরে দাঙ্গা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আর কোনও রাজ্যের নির্বাচিত ও ক্ষমতাসীন সরকারের চোখের সামনে দীর্ঘ দুই মাস ধরে দাঙ্গা চললে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে যেমন প্রশ্ন ওঠে, তেমনি সরকার যে প্রশাসনিকভাবে চূড়ান্ত ব্যর্থ তা নিয়ে কোনও সংশয় থাকে না।

গোধরা অগ্নিকাণ্ড ও তৎপরবর্তী দাঙ্গা– দুইয়েরই দ্রুত ন্যায়বিচার হবে, দোষীরা উপযুক্ত শাস্তি পাবে, আর আমরা এই কলঙ্কময় ইতিহাসকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব, শঙ্কিতচিত্ত নিয়েও এই প্রত্যাশা থাকছে।