Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আমি প্লুটোন বলছি…

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 



প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

হ্যালো! আমি প্লুটোন বলছি। হ্যালো, শুনতে পাচ্ছ? শুনতে পাচ্ছ?… না! এবারও ফোনটা লাগল না! কী যে একটা অরাজকতা চলছে! যতবার ফোন করছি সেই এক কথা ফিরে ফিরে বেজে উঠছে— অল লাইনস ইন দিস রুট আর বিজি। প্লিজ ট্রাই আফটার সামটাইমস। এসবই ওদের কারসাজি! দূরে থাকি বলে আমি কি এসব টের পাই না ভেবেছ! সব টের পাই। দিব্বি ছিলাম সকলে একসঙ্গে, একঠাঁই। আজ থেকে বছর পনেরো আগে আমার চালচলন ঠিক নয় বলে আমাকে দিল তাড়িয়ে। অন্ধকার জগতের দেবতার চালচলনে একটু স্খলন কি খুব অস্বাভাবিক? তোমরাই বলো! না! নিজের অভিমানের কথা কইতে গিয়ে আমি নিজের কাজটাই ভুলে যাচ্ছি! রোসো তোমরা। আগে ধরাদিদির খবরটা নিই। বড় অভিমানিনী আমার দিদি। এতগুলো হুমদো, তাগড়া ভাইয়ের মাঝে ওই একটিই বোন আমাদের। তাকে নিয়ে আমাদের কত জল্পনা! কত আহ্লাদ! দাঁড়াও, আগে আর একবার ফোনটা করি। দিদির আমার ভারি অসুখ! কত ডাক্তার-বদ্দি-হেকিম-কবিরাজ! রোগ সারাবার কতরকম বিধান-নিদান দিলেন তেনারা! এই পাঁচ দশক ধরে (১৯৭২-২০২২) কত সম্মেলন, কত আলোচনাসভা করা হল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। একেই আমাকে বিধিনিয়মের দোহাই দিয়ে, হাজারো নিষেধের বেড়ি পরিয়ে পরিবারের সীমানার বাইরে রেখে দিয়েছে, তার ওপর এত দূরে থাকি (৬০০ কোটি কিলোমিটার) যে, চট করে দিদিকে দেখে আসার জো নেই! তবে সেসবে কি ভাইয়ের মন মানে! একটু দাঁড়াও ভাই। একটা ফোন আসছে বলে মনে হচ্ছে। দেখি ধরাদিদিই হয়তো ফোন করছে মিসডকল দেখে। হ্যাঁ, ঠিক তাই! হ্যাঁ… হ্যাঁ… হ্যালো, ধরাদিদি বলছ?… আমি প্লুটোন বলছি, প্লুটোন। সেই সকাল থেকে চেষ্টা করছি তোমাকে ধরতে। লাইনই লাগে না। কেমন আছ?… ভালো নেই?… ভালো থাকবে কী করে দিদিভাই, কী করে ভালো থাকবে?… আহা! তোমার অমন সুন্দর সাজানোগোছানো সংসার উজাড় হয়ে গেছে?… তোমার কথা শোনা যাচ্ছে না স্পষ্ট করে, কথাগুলো কেমন যেন কেটে কেটে যাচ্ছে… আর কী ক্ষীণ কণ্ঠস্বর!… শোনো, ওই যে কীসব রিপোর্টের কথা বলছিলে, হ্যাঁ… কি আইপিসিসির প্যাথোল্যাবের রিপোর্ট… তাতে কী লেখা আছে? না না, কথা বলতে কষ্ট হলে আর বকবক করতে হবে না… হ্যাঁ, হ্যাঁ… তুমি ওই রিপোর্টগুলো পাঠিয়ে দাও, আমি দেখছি… ভালো থেকো দিদি, ভালো থেকো… আমি আবার তোমার খোঁজ নেব…

কথাই বলতে পারছে না। ধরাদিদির অমন সুন্দর সাজানো সংসারটা এমন করে ভেঙে ছারখার হয়ে যাচ্ছে দেখে মনটা হাহুতাশে ভরে উঠছে। অথচ কোনও উপকরণের তো অভাব ছিল না। গোটা ব্রহ্মাণ্ড চষে ফেললেও এমন একটা প্রাণময় আস্তানা খুঁজে পাবে তোমরা? আমার কথাই ধরো— একে তো অনেক দূরের বাসিন্দা, ফলে রবিমামার তেজোময় দীপ্তি আমার শরীরে একেবারেই পৌঁছয় না। তাই আমি এক অনন্ত শীতলতার স্পর্শে (-২৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) জবুথুবু হয়ে থাকি। আমাকে ঘিরে একটা পাতলা চাদরের মতো বায়ুমণ্ডল আছে বটে, তবে তার গ্যাসীয় উপাদানগুলো, যেমন নাইট্রোজেন, মিথেন এবং কার্বন মনোক্সাইড, সব জমাট বাঁধা অবস্থায় রয়েছে। এতেই শেষ ভেবো না যেন, যখন আমি কাছে আসি তখন এই হাল (অনুসূর), আবার যখন দূরে সরে যাই (অপসূর) তখনকার অবস্থা তো আর বলবারই মতো নয়। এমন অবস্থা বাকি সকলেরই— কেউ প্রচণ্ড উষ্ণ, আবার আমার মতো দূরের বাসিন্দারা হিমশীতল। ধরাদিদিই আমাদের মধ্যে এক ব্যতিক্রম— এক আশ্চর্য উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এমন হাজারো ঠিকানার মধ্যে একমাত্র ধরাদিদির অতিথিশালাতেই রয়েছে নানান ধরনের অতিথি আপ্যায়নের ঢালাও ব্যবস্থা। একবারও কি তোমরা এই বিপুল বৈভবের কথা উপলব্ধি করেছ? একবারও কি ভেবেছ তোমাদের অস্তিত্ব কি নিবিড়ভাবে ধরাদিদির অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ত?

এই যে ধরাদিদির সরাইখানা, তাতে সমস্ত নিখুঁত পরিপাটি। এমন অপার সম্পদের বৈভব আর কোথাও নেই। ধরাদিদির তো মায়ার শরীর, তাই কেমন মায়াময় করে গড়ে তুলেছে তার সংসার— ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ আর ব্যোমের এক আশ্চর্য সমাহার। ধরাদিদির গোটা শরীর জুড়ে কেমন নরম, মখমলি মৃত্তিকার আস্তরণ। এই যে তোমরা সবাই খাও-পিও-জিওর আনন্দে মশগুল রয়েছ, তা তো ওই মাটিমায়ের কল্যাণেই। পাষাণ ভেঙে ধরাদিদির এই মখমলি বসন তৈরি হয় লক্ষ লক্ষ বছর ধরে নানা টানাপোড়েনের ফলে। আসলে মৃত্তিকা হল একটা আধার— পাত্র। আর তোমরা হলে আধেয়। এই আধারের জোরেই যে তোমাদের টিঁকে থাকা তা কি কখনও অনুভব করেছ? কখনও ভেবেছ এই আস্তরণটাকে সরিয়ে নিয়ে ধরিত্রীকে নিরাবরণ করলে তোমাদের কী হাল হবে? ভাবোই না! অথচ এমনটাই করে চলেছ সজ্ঞানে।

তারপর ধরো জলের কথা। দূর থেকে যখন দেখি তখন ধরাদিকে কেমন নীলাভ, মায়াবী মনে হয়। এই যে তোমরা নতুন আস্তানার খোঁজে চারিদিকে হন্যে হয়ে পাড়ি দিয়ে ফিরছ, কোথায় পাবে জীবন টিঁকিয়ে রাখার এমন অপার আয়োজন? সাগর, মহাসাগরের বিপুল জলরাশিই যে জীবনের অমূল্য উৎস। সেই এককোষী অ্যামিবা থেকে শুরু করে দু-পেয়ে হোমো স্যাপিয়েন্স— সকলেই যে এই জলরাশির কাছে ঋণী। কেবল তোমাদের টিঁকিয়ে রাখার জন্যে দিদি নিজের পাষাণগর্ভে মজুত রেখেছে বিপুল পেয় জলের ভাণ্ডার। সেই মিঠা জল মেটায় তোমাদের তৃষ্ণা, মাটির আশ্রয়ে বেড়ে ওঠে সবুজ গাছগাছালি, ফসলেরা পায় বেঁচে থাকার রসদ। জল ছাড়া যে জীবনের বিকাশ, জীবনের অস্তিত্ব সম্ভব নয় তা বুঝেও না-বোঝার ভাণ করে রয়েছ তোমরা।

আর রয়েছে এক আশ্চর্য বাতাবরণ, অ্যাটমোস্ফিয়ার। এই যে অনর্গল ভাষণ দিয়ে চলেছি তা তো এমন প্রাণদ বাতাবরণের জন্যেই। নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইডের এক সামঞ্জস্যপূর্ণ মিশ্রণ ধরাদিদির এই বাতাবরণ। অক্সিজেন আছে তাই হাপরের মতো বুক ঠেলে শ্বাস নিতে পারছ তোমরা। নাইট্রোজেনকে কাজে লাগিয়ে সবুজ উদ্ভিদেরা নিজেদের পুষ্টি সাধন করে, পাশাপাশি কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে রান্নার কাজে ব্যবহার করে সবুজ গাছপালারা বাতাবরণের গ্যাসীয় ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে। নানান স্তর আর উপস্তরে বিভক্ত এই গ্যাসীয় আবরণীর মধ্যেই ধরাদিদি এক আশ্চর্য ছাঁকনির ব্যবস্থা করে রেখেছে যাতে রবিমামার আগুনে তেজে সব জ্বলেপুড়ে খাক না হয়ে যায়, গায়ে বড় বড় ফোসকার মতো কলঙ্ক নিয়ে ঘুরতে না হয় তোমাদের। কী আশ্চর্য ব্যবস্থাপনা! এমন সুষম ব্যবস্থার দৌলতেই তো তোমরা করে-কম্মে টিঁকে রয়েছ!

সেইজন্যই ধরাদিদির এখনকার অবস্থা দেখে মনের মধ্যে ক্ষোভ আর দুঃখের আগুন জ্বলছে। আজ তোমাদের কৃতকর্মের ফল ভোগ করছে এমন সুন্দর একটা ব্যবস্থাপনা। সেতারের তার ছিঁড়ে গেলে যেমন সুর কেটে যায়, আজ ধরাদিদিরও সেই একই অবস্থা। এই আশ্চর্য সুন্দর প্রাণদ ব্যবস্থাপনাকে ব্যবহার করে যে অফুরন্ত প্রাণের সম্ভার, তা আজ তোমাদের, হ্যাঁ হ্যাঁ তোমাদেরই অবিবেচক কাজকর্মের ফলে বিপর্যস্ত। কোনও কৃতজ্ঞতা বোধ নেই তোমাদের। নিজেদের প্রয়োজনের ক্ষেত্রটাকে বাড়াতে বাড়াতে আজ দিদির আঁচল শূন্য করে ফেলেছ। একবারও ভাবছ না এই রিক্ততা তোমাদেরও সমানভাবে রিক্ত-নিঃস্ব করে ফেলছে। তোমাদের গবেষকরা জানিয়েছেন ‘ষষ্ঠ গণবিলুপ্তির পর্ব’ শুরু হয়ে গেছে। মনে রেখো, এই ধরাধামের নবীনতম আবাসিক হলে তোমরা, মানে হোমো স্যাপিয়েন্সরা। অথচ তোমাদেরই হঠকারী কর্মের কারণে তোমরাই হয়তো বিলুপ্ত হবে সবার আগে। কী করুণ পরিণতির পথে পথভোলা পথিকের মতো হেঁটে চলেছ তোমরা!

তোমাদের দেখে আমার কেন জানি না খুব রাগ আর ক্ষোভ হয়। তোমাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করলে এত অভিযোগ জমা পড়বে যে আর পালাবার পথ পাবে না। যেসব উপকরণ অবলম্বন করে তোমরা নিজেদের ক্ষমতা জাহির করেছ তার সবকটিই আজ ভারসাম্য হারিয়ে দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে। আজ তোমাদের যাবতীয় সমস্যা বা প্রবলেমের (P) মূলে রয়েছে আরও তিনটি প্রবলেম বা P। পপুলেশন বা জনবিস্ফোরণ; পলিউশন বা দূষণ; পভার্টি বা দারিদ্র। ভাবো ভাবো! ভাবলে দেখবে কত বড় এক নিষ্ঠুর সত্যের সামনে তোমাদের আজ দাঁড় করিয়ে দিলাম।

এই মুহূর্তে ধরাদিদির সংসারে মোট পুষ্যি মানুষের সংখ্যা কত বলতে পারো? প্রায় ৮০০ কোটি। খুব সম্প্রতি এক অণুজীবের দাপটে বহুসংখ্যক মানুষের অকালমৃত্যু ঘটেছে ঠিকই, তবে মৃত্যুহারকে ছাপিয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে জন্মহার। ফলে পৃথিবীর জনসংখ্যা নিয়তই ঊর্ধ্বমুখী। এই বর্ধমান জনসংখ্যা, যা ক্রমশই বিস্ফোরিত হচ্ছে, বিপর্যয় ডেকে আনছে পরিবেশ ভারসাম্যে। মনে রাখতে হবে পৃথিবীর সম্পদ বা রসদের মজুত ভাণ্ডার অসীম, অনিঃশেষ নয়— বিশেষ করে বস্তুগত সম্পদ। মানুষের জ্ঞানগম্যি, প্রাযুক্তিক বিকাশকে কাজে লাগিয়ে তথাকথিত সম্পদের জোগান আপাতভাবে বৃদ্ধি করা সম্ভব বটে, তবে তেমনটা চিরদিনই ঘটতে থাকবে এমন নয়। বিপুলসংখ্যক জনসংখ্যার চাপ গিয়ে পড়ছে প্রকৃতির ভাণ্ডারে, ভোগদখলের উদগ্র তাড়নায় চলছে অবাধ অবচয়, লুণ্ঠন। বাড়ছে দ্বন্দ্ব-অসাম্য-বৈরিতা। ধরিত্রীর চেনা তন্ত্রগুলি এক সংবেদনশীল ভারসাম্য বজায় রেখে চলে। বর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সহ্য করতে না পেরে ভেঙে যায় প্রাকৃতিক শৃঙ্খলা, পরিবেশমানের অবনমন ঘটে ধীরে ধীরে। বিপুল জনসংখ্যার প্রাথমিক প্রয়োজনগুলি, যেমন খাদ্য, বস্ত্র, আর বাসস্থানের সংস্থান করতে গিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুণ্ঠন চলতে থাকে। তোমাদের ভোগবাদী সমাজে আত্মসুখে মগ্ন থাকতে গিয়ে নিজেদের চেনা পরিবেশটাকে উপেক্ষা করছে তোমরা। এমন লোভী মানসিকতা কখনও প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের কথা ভাবতে শেখায় না তোমাদের। সেই কারণে প্রকৃতির ভারসাম্য আজ খাদের কিনারায় এসে পৌঁছেছে। সাধে কি আর তোমাদের এক মহান নেতা, চিন্তক বলেছিলেন— “The mother earth has enough to meet your needs, but not enough to meet your greeds.”

তোমাদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগটি হল দূষণ, যা এই জনবিস্ফোরণেরই অনিবার্য পরিণতি। এই বিষয়ের আলোচনা যে কোথা থেকে শুরু করব তা ভেবে ভেবে আমি হতাশ হয়ে পড়ছি। ধরাদিদির তিনটি প্রাণদায়ী ব্যবস্থাকেই তোমরা সম্পূর্ণ ধ্বংসের কিনারায় এনে ফেলেছ। তোমাদের দৌরাত্ম্যে বিশৃঙ্খল হয়েছে জলমণ্ডল বা বারিমন্ডলের ভারসাম্য; বিপন্ন হয়েছে ভূমি-ভারসাম্যের ব্যবস্থা; নষ্ট হয়েছে বায়ুমণ্ডল বা বাতাবরণের প্রাণদায়ী গ্যাসীয় অনুপাত। পরিণামে কী পেয়েছ তোমরা? আশঙ্কা-হাহাকার-মৃত্যুভয়। কেমন স্বস্তিতে আছ তোমরা, তাই না? এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী বলেছিলেন না, এ সংসারে দুটো জিনিস অসীম— একটা হল ব্রহ্মাণ্ড, যার কোনও সীমা-পরিসীমা নেই; আর দ্বিতীয়টি হল মানুষের মুর্খামি। কী মারাত্মক সত্যি কথা! জীবকুলে তোমরাই নাকি শ্রেষ্ঠতম! তা শ্রেষ্ঠতমের এ কী পদক্ষেপ! যেখানে তোমাদের হাত পড়েছে সেখানেই উঠেছে সুতীব্র কান্নার রোল, সব হারানোর হাহাকার! এর পরেও বলবে, উই আর দ্য গ্রেটেস্ট? সত্যিই হাসি পায়। সমস্ত কিছুকে ‘ফর দ্য পিপল’ করতে গিয়ে তোমরা উপেক্ষা করেছ অন্যান্য সকলের বেঁচে থাকার মহত্তম দাবিকে। একবারও কি ভেবেছ পৃথিবী-ধরা-বসুন্ধরা-বিশ্ব কেবল মানুষের জন্য নয়। এই ধরা সকলের— এক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীব থেকে শুরু করে বিবর্তনের পথ বেয়ে আসা সকলের— মানুষেরও।

ধরাদিদির শরীরের তাপমাত্রা দিন-দিন বাড়ছে বিগত এক বা দুই শতক ধরে। তোমাদের শরীরের তাপ বাড়লে তোমরা উদ্বিগ্ন হও জ্বর বাড়ছে বলে— আজ যখন ধরাদিদির শরীরী তাপ বারছে তখন কে উদ্বেগ করবে? এই তাপ বেড়ে যাওয়ার জন্য আমি যদি তোমাদের দিকে আঙুল তুলি তাহলে কি খুব অন্যায় হবে? আইপিসিসি তাদের সমীক্ষাতে স্পষ্ট করে জানিয়েছে— It is unequivocal that human influence has warmed the atmosphere, land and ocean. কিছু প্রাকৃতিক কারণ থাকলেও তোমাদের উড্ডয়নমুখী কার্যকলাপই এমন অবস্থার জন্য দায়ী। ওই দেখো সকলে আজ তোমাদের দিকে আঙুল উঁচিয়ে তীব্রকণ্ঠে ধিক্কার জানাচ্ছে। গোটা ধরিত্রী আজ এক জতুগৃহে পরিণত হয়েছে। গ্রিনহাউস গ্যাসের বাড়বাড়ন্ত নষ্ট করেছে সৌরতাপ আদানপ্রদানের স্বচ্ছন্দ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, হু হু করে বাড়ছে দিনমানের গড় তাপমান, দীর্ঘস্থায়ী তাপপ্রবাহে জেরবার হচ্ছে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীরা, বাড়ছে খরার প্রকোপ, দাবানলের আগুনে ছারখার হচ্ছে অরণ্যাঞ্চল ও অরণ্য-সংলগ্ন জনপদ, গলছে বরফ, বাড়ছে সমুদ্রতলের উচ্চতা, বাড়ছে প্রবল সমুদ্রোচ্ছাস, বিপন্ন হচ্ছে উপকূলবর্তী অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জীবন ও জীবিকা, বন্যার দাপট বাড়ার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীরা, সমুদ্রজলের উষ্ণতা বাড়ার ফলে বাড়ছে ঝড়ঝঞ্ঝার প্রকোপ, বায়ুমণ্ডলে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় সমুদ্রজলে অম্লত্বের মাত্রা বাড়ছে যার দরুণ বিপর্যস্ত হচ্ছে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র। এগুলো কিন্তু সব সত্যি কথা— বাস্তব। আর কে না জানে রূঢ় বাস্তব সবাই সহ্য করতে পারে না।

আসলে তোমরা সবাই ভীষণভাবে গরিব হয়ে গেছ। এই দারিদ্র তো কেবল অর্থনৈতিক দারিদ্র নয়— তোমরা মননে, চিন্তনেও দরিদ্র হয়ে গেছ। কার বিরুদ্ধে লড়ছ তোমরা? নিজেরাই নিজেদের মধ্যে এক আত্মধ্বংসী লড়াইয়ে নেমেছ। ধরাদিদির সংসার উজাড় করে কোন ঐশ্বর্যের খোঁজ করছ তোমরা বলতে পারো? অতিমারির পর্ব মিটতে না মিটতেই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মেতে উঠেছে প্রতিবেশী দুই দেশ; নিদারুণ অপশাসনের জেরে দেশছাড়া হচ্ছে লক্ষ লক্ষ মানুষ; ক্ষুধা, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য আর সামাজিক বৈষম্যের শিকার কতসংখ্যক মানুষ তার হিসাব রাখবে কে? এ-সবই প্রকৃতিবিচ্ছিন্নতার ফল। মায়ের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে পথ চলতে গিয়ে পদে পদে হোঁচট খেয়ে পড়ছ তোমরা। বারংবার নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে প্রকৃতি সঙ্কেত পাঠাচ্ছে তোমাদের। তোমরা চোখ উলটে নিস্পৃহ থাকছ, ভাবছ তথাকথিত বিজ্ঞান-প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে সব ঘটনা এড়িয়ে যেতে পারবে! কখনওই পারবে না। জেনো, শেষের সে-দিন ভয়ঙ্কর।

আচ্ছা, তোমাদের যদি প্রশ্ন করি এমন সুন্দর ধরাকে তোমরা কী ফিরিয়ে দিলে? নিজেদের বিকাশ আর উন্নতির দোহাই দিয়ে তো ধরিত্রীকে লুণ্ঠন করছ অবাধে। আর প্রতিদানে প্রকৃতির বুকে জমা করছ বিপুল পরিমাণে বর্জ্য পদার্থ। তোমাদের বিলাসী অপচয় দেখে মনে হয় কতগুলো উড়নচণ্ডী বাউন্ডুলে দু-পেয়ের হাতে পড়ে এমন সুন্দর ধরা নিছকই একটা ল্যান্ডফিল— ধাপার মাঠে পরিণত হবে। ওই যে তোমাদের ব্যাকরণ বইতে বিশিষ্টার্থক শব্দ প্রয়োগের অধ্যায়ে আছে না— খাল কেটে কুমির আনার কথা, এ তো বিলকুল তাই! তোমাদের দৌরাত্ম্যে ধরিত্রীর কোনও কিছুই আর অমলিন, অপরিবর্তিত নেই। সর্বত্রই সভ্যতার কলুষচিহ্ন প্রত্যক্ষ করছি আমরা। হায় মানুষ! তোমাদের নাকি মান আর হুঁশ রয়েছে সবকিছুকে আগলে রাখার জন্য। অথচ প্রহসন দেখো— হুঁশ তো উড়েছে অনেকদিনই, এবার তোমাদের মান হারানোর পালা।

তোমাদের উত্তর-প্রজন্মের জন্য দুঃখ হয়। কী রেখে যাচ্ছ তোমরা তাদের জন্য? ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স-অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট, বাড়ি-হালফ্যাশনের গাড়ি-শেয়ারবাজারের বিপুল বিনিয়োগ? এ-সবে তারা ভালো থাকবে বলে মনে হয় তো? কাদের নিয়ে, কী নিয়ে বাঁচবে তারা? পৃথিবীর এই শূন্যতা তাদের ভালো থাকতে দেবে? গ্লোবাল ওয়ার্মিং-ওজোন লেয়ার ডিমলিশন-ইমব্যালেন্স ইন হিট বাজেট-গ্লেসিয়াল রিট্রিট-এয়ার পলিউশন-ডেজার্টিফিকেশন-অ্যাসিড রেন-গারবেজ ডিজপোজাল-ই ওয়েস্ট… এই সমস্ত অচেনা শব্দবন্ধের সঙ্গে মিথোজীবী হয়ে থাকতে পারবে তারা? তাদের জীবনে আকাশের রং আজ ঘোর কালো, দিনেই নেমে আসে অন্ধকার, নদীর জল দুর্গন্ধে ভরা, কালো আবর্জনা ঠেলে সে আর বইতে পারে না— এ কোন পৃথিবী রেখে যাচ্ছ তোমরা? যেখানে সম্মিলনের বদলে আছে সংঘাত, সমতার বদলে মাত্রাহীন বৈষম্য, সখ্যতার পরিবর্তে আস্তিন গোটানো শত্রুতা, যৌথ যাপনের বদলে সঙ্গহীন বিচ্ছিন্ন যাপন…! ধিক তোমাদের!

তবে সবটাই কি এমন হতাশায় ভরা? আজ যখন ৫ জুন এসে তোমাদের দুয়ারে কড়া নাড়ছে, তোমাদের আহ্বান জানাচ্ছে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য, যখন তোমাদের এই বাসভূমিকে আবার প্রাণময় করে তোলার আহ্বান জানাচ্ছে বসুধা আবাসনের সমস্ত সদস্যরা এই বলে যে— আমাদের একটাই পৃথিবী, ওনলি ওয়ান আর্থ— এসো, তখন সেই আহ্বানে তোমরাও সমস্বরে সাড়া দাও, সকলের সঙ্গে হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নতুন করে সব গড়েপিটে নেওয়ার অঙ্গীকার করো। তোমাদের এক কবি বলেছিলেন না— মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। আমি এক বহিষ্কৃত সৌরসদস্য হয়েও সেই কথা কায়মনোবাক্যে বিশ্বাস করি। ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস— নিজেদের একান্ত বাসভূমিকে বিমল, পরিচ্ছন্ন করার শপথ গ্রহণের দিন। এই আহ্বান নিয়েই সেই ১৯৭২ সাল থেকে নতুন করে পথ চলছে ধরিত্রী আবাসনের ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা আবাসিকরা। ১৯৭৪ সালেও ‘একটি মাত্র পৃথিবী’কে সামনে রেখে সঙ্কল্প গ্রহণ করেছিলে তোমরা, আজও সেই মন্ত্রের ডাক এসেছে উদযাপনের সুবর্ণ জয়ন্তী বর্ষে।

মনে রেখো, আগামী দিনে এই সুন্দর বাসভূমিকে, ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র বাসভূমিকে সুরক্ষিত রাখার দায়িত্ব তোমাদের। তোমাদের প্রত্যেকেই এই কর্মযজ্ঞের অগ্নিহোত্রী। ধরিত্রীরক্ষার ব্রতসাধনের ব্রতী। নিজেদের একান্ত পরিসর থেকেই আজ কাজ শুরু করতে হবে। পাল্টাতে হবে তোমাদের চলতি জীবনধারা। প্রকৃতির তন্ত্রের সঙ্গে সুর মিলিয়ে আগামীদিনের জীবনের সুর বাঁধতে হবে। আজকের অভ্যস্ত জীবন টেঁকসই নয়, ভঙ্গুর। প্রাকৃতিক সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার নয়, চাই সুষ্ঠু ও পরিমিত ব্যবহার। এই মন্ত্রে তোমাদের দীক্ষা নিতে হবে। ভোগবাদের হাতছানি তোমাদের এক চরম পরিণতির সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। যে বিপুল পরিমাণে পার্থিব সম্পদ নিত্যদিনের যাপনে অবচয় হচ্ছে, তাকে পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুনর্ব্যবহারোপযোগী করে তোলা ভীষণ জরুরি। এই পরিকল্পনার বাস্তবায়নে চাই নিরলস প্রয়াস, আন্তরিক নজরদারি। এই কাজগুলি করতে হবে নীরবে সঙ্গোপনে এই ধরার প্রতিটি আবাসিককে। বিন্দু থেকে যেমন সিন্ধু হয় তেমনই ব্যক্তি-এককের প্রচেষ্টা থেকেই জন্ম হবে নতুন পৃথিবী গড়ার স্বপ্নের। অতুলনীয় এক বৈশ্বিক কর্মপ্রয়াসের।

ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলে চলবে না। নিজেদের বদলাতে হবে বলে কান্না জুড়লে চলবে না। তোমরা সকলে ধরিত্রীর কাছে ঋণী। মনে করো আজ সেই ঋণ স্বীকার করার সময় এসেছে। ওই দেখো বিনম্র যাপনের আহ্বান নিয়ে আজ পথে নেমেছেন লিসিপ্রিয়া কানজুজাম, গ্রেটা থুনবার্গ, যাদব পায়েং, সালুমারাদা থিম্মাক্কা, তুলসী গৌড়া, সাইমন ওঁরাও, ক্যাথরিন হ্যাহো, মালাইকা ভাজ, মেধা পাটেকর, বন্দনা শিব, সুভাষ দত্ত, সুনীতা নারায়ণ, সমর বাগচির মতো মানুষেরা। ব্রহ্মাণ্ডের এই একমাত্র বাসভূমিকে প্রাণময় রাখার দায়িত্ব তোমার, তোমাদের। এই সত্য বিস্মৃত হোয়ো না।

তোমরা ভালো থেকো। তোমাদের জন্য রইল ৫ জুনের শুভেচ্ছা।