Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

‘মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার’

‘মানুষ গুরু নিষ্ঠা যার’ | অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

সহজেই অনুমেয়, বাজারে যখন বিক্রেতারা গিজগিজ করে তখন পণ্যের দাম হয় পড়তে থাকে, নয়তো বা, বিক্রেতারা একে অপরের সঙ্গে ঝগড়া অথবা মারামারি করে। স্কুল-কলেজবেলা হস্টেল থেকে লালগোলা প্যাসেঞ্জারে যখন বহরমপুরে বাড়ি ফিরতাম, রানাঘাট স্টেশন ছাড়ালে এক প্যারাওয়ালা উঠে ‘টাকায় চারটে প্যারা’ বলে হাঁক পাড়ত। তার দু-চারটে হাঁক তখনও ঠিকঠাক শোনা গেছে কি যায়নি, আরেক প্যারাওয়ালা কোথা থেকে লাফিয়ে এসে পড়ে ডাক দিত, ‘টাকায় ছটা’। তারপর প্রথমজন দ্বিতীয়জনের সঙ্গে ঝগড়া জুড়ত এই অভিযোগে যে সে এসে তার নির্দিষ্ট ফেরি-এলাকায় ‘অযাচিত’ভাবে ঢুকে পড়েছে। এইরকম কিছু তর্কাতর্কির পর যখন দুজনে কেউ কারও কথা মানছে না, হাতাহাতি প্রায় শুরু হয় হয়, তখন প্রথমজন রেগেমেগে চিল্লিয়ে বলত, ‘তুই টাকায় ছটা দিবি? আমি দেব আটটা। এই যে দাদারা, টাকায় আটটা।’ প্রতিদ্বন্দ্বী হাঁকে, ‘টাকায় দশ’। এইভাবে দুইয়ের ‘আকচাআকচি’তে শেষমেশ দর গিয়ে দাঁড়ায় টাকায় বাইশ কি চব্বিশ। একজন রণে ভঙ্গ দেয়।

এই একই ঘটনা প্রায় প্রতিবারই পুনরাবৃত্ত হয়। প্রথমবার মনে বেশ দুঃখ পেয়েছিলাম, দুই গরিব মানুষ পরস্পরের মধ্যে এইভাবে ঝগড়া করে নিজেদের কী ভয়ঙ্কর লোকসান করছে। পরে বুঝেছিলাম, সহযাত্রীদের থেকেও জেনেছিলাম, এই সবটাই আসলে একটা পরিকল্পিত নাটক। একবার এর, পরেরবার ওর— সেলস প্রমোশনের এই হল কৌশল। কিন্তু প্রায় সকলেই যখন এই ফাঁকিটা ধরে ফেলেছে, তখনও কিন্তু সে নাটক বন্ধ হয়নি। কারণ, টাকায় বাইশ না চব্বিশ নাকি ছাব্বিশ— কোথায় গিয়ে শেষে দাঁড়ায়, এটা দেখা যেমন একটা কৌতূহলের বিষয় ছিল, তদুপরি, ধিকিরি ধিকির অলস ট্রেনযাত্রায় এ ছিল এক বিনোদনও বটে।

এই ঘটনাটা মনে পড়ল, যখন আজকাল প্রায়শই দেখি, বাঙালি ও বাঙালিয়ানা নিয়ে নানাবিধ মন্তব্য-টিপ্পনি, বিষোদগার, মশকরা, এমনকি বিতর্কসভাও কেমন অবলীলায় বহমান। ইউটিউব ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ার দৌলতে, না চাইলেও, চোখের সামনে সে সব অহরহ ভেসে ওঠে। ফলে, সে সম্পর্কিত দু-একটি শিরোনাম, আলগা বাক্যাংশ, খিস্তি-খেউড়— মনের কোণে মাঝে মধ্যে জায়গা খোঁজার চেষ্টা করে বৈকি! ভাবতেও বোধকরি ভালো লাগে, আমিও তো বাঙালি, নাকি! অতএব, মনে মনে না চাইলেও, দুই প্যারাওয়ালার নাট্যাংশের মতোই এইসব খেউড় বা ‘সিরিয়াস’ চর্চাগুলিও আসলে কারও না কারও বিক্রির (নিজেকে অথবা নিজের পণ্যটিকে) কৌশল বলেই মালুম হয়। আর এতে কিঞ্চিৎ বিনোদনও আছে; এটা জানা সত্ত্বেও যে ঝগড়াটি আসলে ‘ডিম আগে না মুরগি আগে’ গোছের। কীরকম?

এই যে শুনি কেউ কেউ বলে, এফএম রেডিওয় বাংলা গান আর শোনাই যাচ্ছে না, বাংলা ছবি (দু-একটি ব্যতিরেকে) কেউ আর দেখতেই চাইছে না, বাংলা নাটক হলে দর্শক পাচ্ছে না, বাংলা পত্র-পত্রিকা পড়া প্রায় সকলে ছেড়েই দিচ্ছে— এইসব নানাবিধ হা-হুতাশ, দুঃখ-সুখ, চারপাশে কান পাতলেই বেশ প্রকট। আর এর কারণ হেতু নানারকম ব্যাধি-উপসর্গের কথাও বেশ উচ্চনাদে চর্চিত। কিন্তু সবচেয়ে বড় কারণটি নাকি হিন্দি ভাষা ও সংস্কৃতির আধিপত্য। অনেকটা রামপদর হাঁড়ি আর পাগলা দাশুর পটকার মতো। কারণ, এটা বোঝা বেশ দুষ্কর, আমার বই, ছবি বা গান যদি না বিকোয়, তাহলে তার জন্য অপর একটি ভাষা কীভাবে দায়ী হতে পারে! এমন তো নয় যে, সমস্ত সিনেমা হলে জোরজবরদস্তি হিন্দি ছবি চালানো হচ্ছে, অথবা, কলেজ স্ট্রিটের কোনও দোকানে বাংলা বই আর রাখা হচ্ছে না, শুধু হিন্দি বই পাওয়া যাচ্ছে! সবচেয়ে বড় কথা, উঠতি মা-বাবাদের পিঠে বন্দুক ঠেকিয়েও কেউ বলছে না যে, উঁহু, বাংলা মাধ্যমে নয়, ছেলেমেয়েদের ভর্তি করো ইংরেজি অথবা হিন্দি মাধ্যমে। যা ঘটছে আপন নিয়মেই ঘটছে, যা চলছে নিজের খেয়ালেই চলছে। তাহলে কার দায় চাপাই কার ঘাড়ে? অবশ্য কেউ বলতেই পারেন, এইসব হল প্রচারের ঢক্কানিনাদ, বুঝলেন, মগজ ধোলাই। তৎক্ষণাৎ মনে পড়বে মগনলালকে দেওয়া ফেলুদার সেই মোক্ষম উত্তরটি, ‘মাইন্ডটা যখন আমার, তখন তা চেঞ্জ করতে অসুবিধা কোথায়?’ মগজ বুঝি অত ঠুনকো?

তাহলে এই যে স্বঘোষিত বাঙালি, যারা কথায় কথায়, বাঙালি এই ছিল এই হইয়াছে (মূলত ‘পতন’ অর্থে) বলে থেকে থেকে চোঁয়াঢেকুর তোলে, তারা কারা? যাদের গায়ে অল্পেই ফোস্কা পড়ে, ‘আমায় খেলায় নিচ্ছে না’ বলে নালিশ জানায়, বড় বড় কাগজে অথবা পাঁচতারা শোভিত আলোচনাসভায় বাঙালির ‘মধ্যমেধা’ নিয়ে খিল্লি করে, অর্থ ও ক্ষমতার জোরে কে লেখক, কে পাঠক, কেই বা চিত্র-পরিচালক তার ঘোষণা দেয়— তারাই বা কারা! সেই সব সেলিব্রিটি, সেই সব জ্ঞানী-গুণী, পার্টি অফিসে বসে চাকুরিপ্রাপ্ত শিক্ষক-শিক্ষিকার নামের তালিকা তৈরিতে পটিয়সী, কাটমানি আদায়ে সিদ্ধহস্ত, ধর্মের নামে গরিবে গরিবে লড়িয়ে দিতে উদারহস্ত- সেই সব বঙ্গ শিরোমণিকুলই বা কারা? তারা সকলেই স্বঘোষিত বাঙালি। তারা ডিজে বাজিয়ে গলা চড়িয়ে বলে, ‘আমরা বাঙালি’। এই বাঙালির কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। তারা বড়জোর দু দলে বিভক্ত প্যারাওয়ালা— নিজেদের মালটুকুন বিক্রি করার জন্যই যত সব ছিরিছাদ্ধ।

তবে এটুকুন জানি, আমরা যারা ট্রেনের প্যাসেঞ্জার, চলতে চলতে টুকটাক কিনে যাদের জীবন চলমান, তারা ‘বাঙালি’ নই! আমরা গান লিখি, গাই, জীবনকথা বলি, শুনি, নন্দীগ্রাম অথবা দেউচা-পাচামিতে জমি বাঁচাতে রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি, নেতা ও নেতাদের কথা শুনি অথবা শুনি না, ভান করি, খেউড়ে আছি আবার স্মার্ট ফোনেও থাকি, নিম্নমেধায় নিমজ্জিত— আমরা কেউ বাঙালি নই। আমরাই লেবার অথবা দক্ষ-অদক্ষ কারিগর, কাজের তল্লাশে কেরল কিংবা গুজরাত অথবা আরব মুলুক নয়তো আমেরিকাতেও পৌঁছে যাই, আমাদেরই চলনে বলনে বারবার রামপ্রসাদ গেয়ে ওঠেন, ‘মন রে কৃষিকাজ জানো না’, সেই চাষাভুষোর দল আমরা, মাছ ধরি, তাঁত বুনি, দোকান দিই, ফেরি করি, নৌকা বাই, আমরা কেউ ‘বাঙালি’ নই; কিন্তু কথা বলি বাংলায় (আরও অনেক ভাষায়, হিন্দিতেও), হয়তো আছি, থেকে যাই অথবা আবার ফিরে আসি বাংলায়ই— আমাদের গল্পগাথা বোনা অন্য তারে যা শুধু নিজেরাই শুনতে পাই অথবা আমাদের গল্প বলেই কিছু নেই। বলা ভালো, আমাদের কোনও ‘তালজ্ঞান’ বা অস্তিত্বই নেই: ‘ওরে, দে খুলে দে পাল তুলে দে/ যা হয় হবে বাঁচি মরি’।

এক সময়ে উচ্চে আসীন বাঙালিজনেরা নিম্নজনেদের অনায়াসে চামার, ছোটলোক, খোট্টা, মেরো যা কিছু বলে দেগে দিতেন। এখন ওইভাবে হয়তো বলেন না। কিন্তু জ্ঞানের বড়াই ষোলআনা। ফলে হয়েছে কী, আরও বিঁধে বিঁধে দগ্ধ করো। উন্মুক্ত ময়দানে। সোশ্যাল মিডিয়া সে সুযোগ দিয়েছে। যারে দেখতে নারি, তার চরণই শুধু বাঁকা নয়, সে পাষণ্ড, বর্বর, কুৎসিত, তাকে তিলে তিলে মারো। গণপ্রহারে ‘চোর’ মারো, আর গণখিস্তিতে ‘অপছন্দের জনকে’, ‘ঈর্ষার জনকে’।

তবুও খানিকটা রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, তাই আমরা হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাংলা-অভিধান গবেষণাকে ফেলে দিতে পারিনি, লালন সাঁই-এর গানের চরণকে না বুঝেও মেনে নিয়েছি। ক্ষেত্রির মহারাজা ছিলেন বলে স্বামী বিবেকানন্দকে অনাহারে মরতে হয়নি। মহাশ্বেতা দেবী লেখেন, ‘অগ্নিগর্ভ’। লালন বলেন, ‘মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপা রে তুই মূল হারাবি’। আমাদের ভরসাও সেখানে। ন্যাংটার আবার বাটপাড়ের ভয়!