Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

নতুন ইহুদী: এক লুপ্ত মানচিত্রের সন্ধান

অংশুমান ভৌমিক

 



প্রাবন্ধিক, নাট্য-সমালোচক ও সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার

 

 

 

 

১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে দেশভাগ ও দেশত্যাগের সঙ্কট যে ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের একটি মর্মান্তিক অধ্যায়— এ নিয়ে দ্বিমত নেই আর। তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের পঁচাত্তর বছর পূর্তিকে মাথায় রেখে দিল্লিশাহির দৌলতে ‘আজাদি কি অমৃত মহোৎসব’ চলেছে বছর খানেক ধরে। জমকালো এই জশনে বাঙালি যে উদ্বাহু হয়ে নৃত্য করতে পারল না তার প্রধান কারণ দেশভাগ ও দেশত্যাগের সঙ্কট বাঙালিকে যত নাড়া দিয়েছে, এক পঞ্জাবি ছাড়া ভারতের আর কোনও ভাষিক গোষ্ঠীকে দেয়নি। বস্তুত ১৯৪৭ থেকে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের (আগেকার পূর্ব পাকিস্তান) মধ্যে যে গণ-প্রচরণ শুরু হয়েছিল, আজও তার পালা শেষ হয়নি। কথিত-অকথিত অজস্র রক্তক্ষয়ী সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের দায়ভাগ আজও আমাদের রক্তধারায় বয়ে চলেছে। এতই প্রবল তার অভিঘাত যে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ সাহিত্য সম্ভার এর অতলান্তিক গভীরতাকে ছুঁতে পারেনি। বা ছুঁতে চাইলেও সেভাবে তল পায়নি।

প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক অশ্রুকুমার সিকদার অনেকদিন আগে লিখেছিলেন—

দেশভাগ-দেশত্যাগ নিয়ে লিখলে পাছে সাম্প্রদায়িকতা প্রশ্রয় পেয়ে যায়, সেই ভয়ে বাংলা সাহিত্য যেন শিটিয়ে ছিল। অথবা সব কথা বলা যায় না বলেই সঙ্কুচিত ছিল। কিন্তু দেশভাগ-দেশত্যাগের ফলে এই যে ইতিবাচক সামাজিক পরিবর্তন; মুক্তির পথে, আত্মবিকাশের পথে, মানুষ হিসেবে আত্মপরিচয়ের পথে মেয়েদের এই-যে পদক্ষেপ, সেই সম্বন্ধে বাংলা সাহিত্য কেন বোবা হয়ে থাকল? সাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়াচ লাগতে পারে, এই ভয়ে এত বড় বড় ঐতিহাসিক অগ্রগতির দিকেও কি লেখকেরা নজর দিতে ভুলে গেলেন? এইভাবে, ভাঙা বাংলার বাংলা সাহিত্যের কিছু-কিছু কথা বলা হয়, অনেক কথাই অকথিত থেকে যায়।

অশ্রুকুমার যথার্থ বলেছেন। তবে যে বাংলা রঙ্গমঞ্চ স্বাধীনত আন্দোলনের উপপ্লবী দিনে হাজারো ঝড়-তুফান সত্ত্বেও বুক চিতিয়ে লড়েছিল, জায়মান জাতীয়তাবাদের বারুদের স্তূপে ফুলকি ছড়ানোর ঝুঁকি নিতে পিছপা হয়নি, সেই বাংলা রঙ্গমঞ্চ বা কলকাতা-কেন্দ্রিক প্রসেনিয়াম থিয়েটার আমাদের দেশভাগ ও দেশত্যাগের সঙ্কট নিয়ে একেবারে হাত গুটিয়ে ছিল এমন নয়। খুঁজেপেতে দেখলে দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাস্তুভিটা (১৯৪৭), রবীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তর এই স্বাধীনতা (১৯৪৮), ঋত্বিক কুমার ঘটকের দলিল (১৯৫০), বিজন ভট্টাচার্যের গোত্রান্তরে-র (১৯৬০) মতো কিছু নাটকের নাম আসবে। নাটকগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে, নান্দনিক গুরুত্বও আছে। মুশকিল হল যে প্রযোজনা হিসেবে এর কোনওটিই সফল নয়। কোনও-কোনওটি রঙ্গমঞ্চে আসার সুযোগও পায়নি। তুলসী লাহিড়ীর ছেঁড়া তারে-র কথা কেউ কেউ বলতে চান। সেটি আর যাই হোক, দেশভাগ ও দেশত্যাগের কথা সরাসরি বলেনি।

এর বাইরেও কোনও কোনও নাট্য-উদ্যোগ সে আমলে হয়েছে। সে আমলে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের দায়িত্বে থাকা সরকারি আধিকারিক হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথা উদ্বাস্তু থেকে জানা যাচ্ছে যে ১৯৫০-এর এপ্রিল মাস নাগাদ শরণার্থী সঙ্কট যখন তুঙ্গে উঠেছে, রাজ্য সরকারের তরফে ‘নাট্যকার শ্রীমন্মথ রায়কে তখন অনুরোধ করা হল এমন একটি নাটক রচনা করতে যাতে উদ্বাস্তুদের মনের বল বর্ধিত হয়।’ মন্মথ যে নাটকটি লিখে দিয়েছিলেন সেটির নাম ভাঙাগড়া। এর সঙ্গে যুক্তবঙ্গের ভাঙাগড়ার কোনও প্রত্যক্ষ সংযোগ ছিল না। ‘বাস্তুত্যাগী উদ্বাস্তুদের কাহিনি অবলম্বন করেই’ লেখা হলেও এটি আদতে পৌরাণিক নাটক। মন্মথ-রচিত বহুল প্রচারিত কারাগারে-র অনুবর্তন। হিরণ্ময়ের ভাষায়— ‘এই প্রসঙ্গে মহাভারতের কাল-যবনের কথা স্বভাবতই মনে পড়ে যায়। তার দ্বারা মথুরা হতে বিতাড়িত হয়ে যাদবেরা শ্রীকৃষ্ণের নেতৃত্বে দ্বারকায় নূতন রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল। তাদেরও শ্রীকৃষ্ণের স্থাপিত দৃষ্টান্তের অনুসরণ করতে হবে— এই হল নাটকের বাণী।’ কোনও পেশাদার বা অপেশাদার নাটকের দল নয়, অকল্যান্ড রোডের মহাকরণের কর্মীদের উদ্যোগে ভাঙাগড়া-র মঞ্চায়ন হত নানান শরণার্থী শিবিরে। কখনও আশ্রয় শিবিরের উদ্বাস্তু শিল্পীরাও এর মঞ্চায়ন করতেন। হিরণ্ময়ের বয়ানে আছে— ‘এভাবে অনেকগুলি আশ্রয় শিবিরে এই নাটকটির অভিনয়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়েছিল এবং তা দেখে ডাঃ রায় বিশেষ তৃপ্তি বোধ করেছিলেন।’

‘ডাঃ রায়’, বলাই বাহুল্য— পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়। তবে উত্তপ্ত সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতিতে সরকার-পোষিত এ ধরনের প্রযোজনা কতটা তৃপ্তিদায়ক ছিল এ নিয়ে আমাদের সংশয় আছে। বরং মৈমনসিং গীতিকার মহুয়া পালাকে দরকারমাফিক ছেঁটেকেটে নিয়ে ক্রান্তি শিল্পী সঙ্ঘ যে গণমুখী প্রযোজনা করেছিলেন, যা ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার সুভাষ ইনস্টিটিউটে প্রথম মঞ্চস্থ হবার পর পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে মঞ্চস্থ হয়, মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বাধীন ইস্টবেঙ্গল রিলিফ সোসাইটির আনুকূল্য পায়, তা বহু শ্রান্ত প্রাণে শুশ্রূষা জোগান দিয়ে থাকবে।

ঠিক এই সময় নতুন ইহুদী নামে একটি নাটক সাড়া ফেলেছিল। উত্তর সারথী নামে একটি নাট্যদলের উদ্যোগে সলিল সেনের লেখা, মনোজ ভট্টাচার্য পরিচালিত এই নাটকটি ১৯৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দে বছর খানেকের বেশি সময় ধরে কলকাতায় তো বটেই, কলকাতার বাইরেও মঞ্চস্থ হয়। নতুন ইহুদী নামকরণ সম্পর্কে সলিল লিখেছিলেন— ‘ছিন্নমূল উদ্বাস্তুদের সমস্যা বেদনা নিয়ে এই নাটক। নামটা ইচ্ছা করে ‘নতুন ইহুদী’ রেখেছিলাম। কিছুটা প্রতীকী। হিটলারের অত্যাচারে যেমন জার্মানি থেকে ইহুদীদের উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল, ঠিক সেইরকমই অত্যাচারের মুখোমুখি হতে হয় পূর্ব পাকিস্তানে অত্যাচারিত মানুষদের। তাই নাটকের নাম ‘নতুন ইহুদী’।’

প্রখ্যাত চলচ্চিত্র-সাংবাদিক রবি বসুর জবানিতে পাচ্ছি— ‘সেই পঞ্চাশের দশকে উদ্বাস্তুজীবনের ওপর গঠিত এই নাটকটি সারা বাংলাদেশে হুলস্থূল ফেলে দিয়েছিল। ঠিক বিজন ভট্টাচার্যদের ‘নবান্ন’-র মতো।’ নবান্ন-র অন্যতম প্রধান অভিনেত্রী শোভা সেনের আত্মজীবনীতে নতুন ইহুদী-র কথা নেই। তবে অন্য এক জায়গায় তিনিও বলেছেন— ‘বাস্তুহারাদের নিয়ে নাটক। খুব জমেছিল সেই নাটক।’ অহীন্দ্র চৌধুরীর স্মৃতিকথা নিজেরে হারায়ে খুঁজি-র দ্বিতীয় পর্বে আছে— ‘এই সময়ের আর একটি সফল নাটক ‘নতুন ইহুদী’— যেটি বহুরূপী সম্প্রদায় প্রায়ই অভিনয় করত। রঙমহলেও ঐ সময়ে ‘নতুন ইহুদী’র নিয়মিত অভিনয় চলছিল।’ বলাই বাহুল্য, অহীন্দ্র উত্তর সারথীর বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন না, ভুল করে বহুরূপীর গলায় প্রযোজনার কৃতিত্ব তুলে দিয়েছিলেন। তুলসী লাহিড়ীর লেখা, শম্ভু মিত্র নির্দেশিত বহুরূপীর প্রযোজনা ছেঁড়া তার তখন রংমহলে মঞ্চস্থ হয়েছে। দুটি নাটকের প্রয়োগভাবনায় তো বটেই, বিষয়গত দিক থেকেই কিছু মিল ছিল। অহীন্দ্র তখন পার্শ্ববর্তী স্টার থিয়েটারে পাঞ্জাবকেশরী রঞ্জিৎ সিং নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। ১৯৫২-র ১১ জুলাই পাঞ্জাবকেশরী রঞ্জিৎ সিং-এর প্রথম মঞ্চায়ন হয়। এর বারো দিন বাদে রংমহলে নতুন ইহুদী-র মঞ্চায়ন শুরু হয়। অহীন্দ্রের কানে খবর ঠিকই এসেছিল। তবে নতুন ইহুদী তাঁর দেখা হয়ে ওঠেনি। তৎসত্ত্বেও এই স্মৃতিকথাগুলি আমাদের কাছে মূল্যবান, কারণ বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস গতের যে সব পৃথুল বইপত্র এখন বাজারে চালু আছে, তাতে নতুন ইহুদী-র নামগন্ধ নেই বললেই চলে!

ব্যতিক্রম আশুতোষ ভট্টাচার্যের বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাস। বইটি এখন আর পাওয়া যায় না। তবে আশুতোষের বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ডের শেষে ‘নবনাট্য আন্দোলন: নাটক ও নাট্যকার’ অধ্যায়ে নতুন ইহুদী-র সপ্রশংস উল্লেখ আছে। তিনি লিখেছিলেন— ‘সলিল সেনের প্রথম নাটক ‘নতুন ইহুদি’ ১৯৫৩ সনে প্রথম প্রকাশিত হয়। ইহার পূর্ববর্তী বৎসর হইতেই কলিকাতার ব্যবসায়ী সাধারণ রঙ্গমঞ্চে ইহা অভিনীত হইতে থাকে। তুলসী লাহিড়ীর পরই এই যুগের নাট্যকারদিগের মধ্যে তাঁহার নাটক সাধারণ রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হইবার গৌরব লাভ করে।’ আশুতোষ সম্ভবত নতুন ইহুদী-র কালিকা থিয়েটার পর্যায় সম্পর্কে জানতেন না। নাটকটির মুদ্রিত পাঠই তাঁর আলোচনার বস্তু ছিল।

নতুন ইহুদী বই হয়ে ছেপে বেরোয় ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের পয়লা মে, ২/১ শ্যামাচরণ দে স্ট্রিটের ইন্ডিয়ানা থেকে। ১৩৬ পৃষ্ঠার সেই বইয়ের শুরুতে ‘পরিচয়’ শীর্ষক একটি মুখবন্ধ লিখেছিলেন সলিল সেন। তাতে অন্য কথার পাশাপাশি মঞ্চে নতুন ইহুদী-র প্রযোজনা ইতিবৃত্ত সম্পর্কে যা যা লিখেছিলেন নাটককার, সেটি আমাদের মাথায় রাখতে হবে।

‘উত্তর সারথী’র প্রচেষ্টায় পরীক্ষামূলকভাবে ‘নতুন ইহুদী’ নাটকটী ১৯৫১ সালের ২১শে জুন ‘কালিকা’ রঙ্গমঞ্চে প্রথম অভিনীত হইয়াছিল। রক্ষণশীল মনোভাবের সমস্ত দ্বিধা ও সঙ্কোচকে অতিক্রম করিয়া, ইহা নবনাট্য আন্দোলনের দিকে সুধীজনের সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে সমর্থ হয়।

‘রঙ্‌মহল’ কর্ত্তৃপক্ষের অনুরোধে ২৩শে জুলাই, ১৯৫২ হইতে পেশাদারী রঙ্গমঞ্চে ইহার অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়। ‘উত্তর সারথী’ শিল্পী গোষ্ঠীই উহার প্রদর্শন দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

ইহা ব্যতীত বিভিন্ন স্থানে নাটকটীর অভিনয় ব্যবস্থা করিয়া দেন, পূর্ব-পরিষদ, লোকশিক্ষা পরিষদ, শ্রীযুক্তা সুনন্দা বন্দ্যোপাধ্যায়, ডোভার লেন বিজয়া-সম্মিলনী, জে, ওয়াই, এম, এ, ব্রতীসঙ্ঘ এবং ক্রান্তি শিল্পী সঙ্ঘের কলিকাতা, বহরমপুর ও জামসেদপুর শাখা।

বন্ধুগণের চেষ্টায় পুস্তক আকারে নাটকটীর প্রকাশ সম্ভব হইল। এই সুযোগে নাট্যানুরাগী দর্শক সমাজকে ও প্রদর্শন, প্রচার, সংগঠন, সমালোচনা প্রভৃতি করিয়া যাঁহারা সাহায্য করিয়াছেন তাঁহাদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাইতেছি— এবং ‘উত্তর সারথী’র সহমর্ম্মী সভ্যদের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাইতেছি।

এই ‘পরিচয়’ প্রসঙ্গে কটি টীকাটিপ্পনীর প্রয়োজন আছে। অধুনালুপ্ত কালিকা থিয়েটারের (পরবর্তীকালের কালিকা সিনেমা) অবস্থান ছিল কালীঘাট মহল্লায়, আজকের বসুশ্রী সিনেমার ঠিক পেছনে। কালিকার প্রতিষ্ঠাতা ও স্বত্বাধিকারী ছিলেন রাম চৌধুরী। ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হাত দিয়ে দোর খুলবার পর একের পর এক জনপ্রিয় প্রযোজনার সাক্ষী থেকেছে কালিকা থিয়েটার। কলিকাতা পৌর সংস্থার আইনের গেরোয় পড়ে ১৯৫১-র শেষাশেষি ঝাঁপ ফেলতে বাধ্য হয় এই প্রেক্ষাগৃহ। সম্ভবত এ জন্যই নতুন ইহুদী-কে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে আসতে হয় হাতিবাগান পাড়ায়, রংমহল থিয়েটারে। ১৯৫১-র ২১ জুনের পর ১৫ আগস্ট নতুন ইহুদী-র দ্বিতীয় মঞ্চায়ন হচ্ছে, এ খবর আমাদের হাতে আছে। তারপরের অনুপুঙ্খ আমাদের হাতে আসেনি। ১৯৫২-র ২৩ জুলাই থেকে কতদিন ধরে রংমহলে নতুন ইহুদী চলেছিল, এ ব্যাপারে কোনও পাকা খবর আমাদের হাতে নেই। রংমহলে তখন মালিকানা নিয়ে ঝুটঝামেলা চলছে। সম্ভবত পুজোর আগেই নতুন ইহুদী বন্ধ হয়ে যায়। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন— ‘পরের দিকে, সেই নাটক যখন কলকাতা মাতিয়ে তুলেছে, দিনের পর দিন হাউসফুল গেছে।’ মনে হয় রংমহল পর্যায়ের কথা মাথায় রেখেই কথাটি বলেছিলেন সাবিত্রী। তবে কালিকা থিয়েটার বা রংমহলের বাইরেও মঞ্চস্থ হয়েছে নতুন ইহুদী। যেমন— নিউ এম্পায়ারে, শ্রীরঙ্গমে, সুন্দরমে (করিন্থিয়াম থিয়েটারে)।

সাবিত্রী আরও বলেছিলেন— ‘অত বড় দাঙ্গার পর, হানাহানির পর সর্বস্ব খুইয়ে জীবন হাতে নিয়ে যে মানুষগুলি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে বুকে ভাসতে সেদিন বাধ্য হয়েছিল, তাদের একটা ডকুমেন্ট বলা যায় এই নাটককে। নাটকটি যখন প্রথম মঞ্চস্থ হয় তখন থেকেই ভূমিকম্পের মতো একটা ত্রস্ত সাড়া ও নাড়া পড়ে গিয়েছিল জনমানসে।’

সাবিত্রী-কথিত ‘ত্রস্ত সাড়া ও নাড়া’র কথা মনে রাখলে ‘রক্ষণশীল মনোভাবের সমস্ত দ্বিধা ও সঙ্কোচ’ বলতে সলিল ঠিক কী ইঙ্গিত করেছেন তা আজ আর আমাদের বুঝে নিতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। এই রক্ষণশীলতা নাটকের বিষয়বস্তু সংক্রান্ত। একেবারে ঘটমান বর্তমানের কথা রঙ্গমঞ্চে তুলে এনেছিল নতুন ইহুদী। বিষয়টি সেই সময়ের সাপেক্ষে অত্যন্ত স্পর্শকাতর ছিল। ১৯৫০-এ পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর পশ্চিমবঙ্গ তথা কলকাতার বুকে শরণার্থী মানুষের যে বিপুল স্রোত নেমে এসেছিল, তার দরুন কলকাতা ও তার উপকণ্ঠে, বিশেষ করে চটকল মহল্লায় যে অস্থিরতা ডেকে আনে, তার জলজ্যান্ত প্রতিচ্ছবি নতুন ইহুদী। শরণার্থী সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধান তখনও অধরা বলে সামাজিক ক্ষেত্রে যে নৈরাজ্য দেখা দিয়েছিল, তা কলকাতার স্থিতাবস্থাকে বিপন্ন করেছিল। কলকাতার বাসিন্দাদের সিংহভাগ এই সঙ্কট থেকে মুখ ফিরিয়ে ছিলেন। এই উদাসীনতা, যা কার্যত ঘৃণার সমতুল, নতুন ইহুদী-তে চাপা থাকেনি। তা সত্ত্বেও নবনাট্য আন্দোলনের যে ধারা ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ বাহিত হয়ে বহুরূপীর মধ্যে উত্তরসাধক খুঁজে পেয়েছিল, সেই ধারাতে মিশে যেতে পেরেছিল নতুন ইহুদী। পেরেছিল ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের সহযোগিতা ছাড়াই। মনে রাখতে হবে যে সলিল সেনের জন্ম কলকাতায় হলেও তিনি বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে লেখাপড়া করেছেন। এখানেই রেভোলিউশনারি সোশ্যালিস্ট পার্টির (আরএসপি) নেতা ত্রিদিব চৌধুরীর সান্নিধ্যে রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছে সলিলের। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে আরএসপি-র সাংস্কৃতিক শাখা হিসেবে ক্রান্তি শিল্পী সঙ্ঘ আত্মপ্রকাশ করলে তার প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ছিলেন সলিল। উত্তর সারথীর কাজকর্ম শুরু হয়েছিল বহরমপুরেই, সলিল সেন ও অরুণ দাশগুপ্তের নেতৃত্বে। দ্রুত তা কলকাতায় চলে আসে। নতুন ইহুদী দিয়েই আত্মপ্রকাশ ঘটে দলটির। এই প্রযোজনার সহযোগী হিসেবে ক্রান্তি শিল্পী সঙ্ঘের কলকাতা, বহরমপুর, জামশেদপুর শাখার নাম করেছেন সলিল। আমাদের আন্দাজ, এই সব প্রযোজনার অন্তত তিনটি আমন্ত্রণমূলক মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেছিলেন ক্রান্তি শিল্পী সঙ্ঘ। শরণার্থী সঙ্কট নিয়ে কলকাতার পুরনো বাসিন্দাদের আপাত উন্নাসিকতা সত্ত্বেও বালিগঞ্জ অঞ্চলের দুটি সক্রিয় সংগঠন— ফার্ন রোডের ব্রতী সঙ্ঘ ও ডোভার লেনের দুর্গোৎসব আয়োজকরাও নতুন ইহুদী-র পিঠ চাপড়ে দিয়েছেন, সম্ভবত ম্যাড়াপ বেঁধে মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেছেন। একটি আপাত অপেশাদার নাট্যদলের কাছে এহেন প্রাপ্তি সেকালে অনেক।

এই ঘটনার অনেক পরে, ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ জানুয়ারির সাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকায় সলিল সেনের একটি সাক্ষাৎকার বেরোয়। তাতে সলিল বলেছিলেন— ‘‘নতুন ইহুদী’ মঞ্চস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সাড়া পড়ে গিয়েছিল। বিষয়বস্তুর জন্যেই কিছু মানুষ আকর্ষণ অনুভব করেন। খুব সমালোচনাও হয়। এ ধরনের বিতর্কিত বিষয়বস্তু নিয়ে নাটক লিখলে যে প্রশংসা সমালোচনা পাশাপাশি চলবে এ আমি অবশ্য জানতাম।’

সমালোচনার সূত্রে উল্লেখ করতে হয় ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের কোনও এক সময় দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত পাক্ষিক পত্র নাট্যলোকে-র পাতায় বেরোনো নতুন ইহুদী-র সমালোচনা। এটি লিখেছিলেন স্বনামধন্য নাটককার ও নাট্যব্যক্তিত্ব শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত। দুষ্প্রাপ্য এই রচনাটি সঙ্কলিত হয় সুনীল দত্তের লেখা নাট্য আন্দোলনের তিরিশ বছর বইয়ে। উত্তর সারথীকে ‘প্রগতিশীল নাট্য আন্দোলনের অংশীদার’ বলে গণ্য করে এই সমালোচনার একটি খণ্ডিত পাঠ উদ্ধার করেছিলেন সুনীল। পড়ে দেখা যাচ্ছে যে নতুন ইহুদী-র আখ্যানভাগের খুঁটিনাটি আলোচনা করে তার কিছু দুর্বলতার দিক, বাহুল্যের দিক চিহ্নিত করেছেন শচীন্দ্রনাথ। তাঁর মনে হয়েছে— ‘নাটকের গোড়ার দিকে নাট্যকার যে প্রশংসনীয় সংযমের পরিচয় দিয়েছেন, শেষের দিকটাতেও যদি তার ব্যতিক্রম না দেখতাম তাহলে আরো খুশী হতাম।’ তিনি এও লিখেছেন— ‘টিম গঠন যেমন সুন্দর হয়েছে, তেমনই সুন্দর হয়েছে টিম-ওয়ার্ক। অতি-অভিনয়ের অভ্যাস অনেকেরই ছিল, কিন্তু পরিচালক কাউকে তা করতে দেননি। তাই দর্শকরা কোথাও শক্‌ না পেয়ে নাটকের বেদনা উপলব্ধি করতে পেরে বিষয়টির গুরুত্ব হৃদয়ঙ্গম করতে পেরেছেন বলেই মনে হলো। সেই জন্যই বলি নাটক ও অভিনয় সার্থক হয়েছে।’

যে পরিচালকের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন শচীন্দ্রনাথ, তিনি মনোজ ভট্টাচার্য। সত্যজিৎ রায় নতুন ইহুদী দেখেছিলেন কিনা আমাদের জানা নেই, তবে পথের পাঁচালী-র হরিহরের ভূমিকার সঙ্গে এই নাটকের কানু বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত চরিত্র মনমোহন ভট্টাচার্যের মিল চোখে পড়ার মতো। তাঁর সমালোচনায় কুশীলব ধরে ধরে এ প্রযোজনার অভিনয় নিয়ে বিশ্লেষণ করেছিলেন শচীন্দ্রনাথ।

কানু বন্দ্যোপাধ্যায়

তবে এহ বাহ্য। নতুন ইহুদী নিয়ে নাট্য-ঐতিহাসিকদের অধিকাংশের নীরবতা সত্ত্বেও এই প্রযোজনার অনেক কথাই যে ছাপার অক্ষরে থেকে গেল তার প্রধান কারণ এই প্রযোজনায় পরীর ভূমিকায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের আবির্ভাব। নায়িকাপ্রধান নাটক না হলেও, পরীই এই নাটকের প্রধান স্ত্রী-চরিত্র। এই চরিত্রে অভিনয় করেই থিয়েটার তো বটেই, সিনেমার রথীমহারথীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন বছর তেরো-চোদ্দোর সাবিত্রী। এ নাটকে তাঁর অভিনয় দেখে ১৯৫১র ১৭ আগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছিল— ‘পরীর ভূমিকায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় নবাগতা, কিন্তু অভিনয় কৃতিত্বে তিনি এই প্রথম অবতরণেই যেকোন বড়ো শিল্পীর পাশে দাঁড়াতে পারবেন। বাপ মা ভায়ের দুঃখে নিজের অক্ষমতার মর্মবেদনাকে তিনি যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা সমাজের চোখ খুলে দেওয়ার মতো যথেষ্ট।’

পরবর্তীকালে অসংখ্য সাক্ষাৎকারে, এমনকি সম্প্রতি বেরোনো আত্মজীবনীতেও নতুন ইহুদী-র প্রস্তুতিপর্ব থেকে প্রযোজনার সাতকাহন নিয়ে কথা বলেছেন সাবিত্রী। রবি বসুকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনও বলেছেন—

‘নবান্ন’ নাটক নিয়ে আজও যে পরিমাণ হইচই হয়, ‘নতুন ইহুদী’ নাটক নিয়ে সেটা হয় না কেন? ওটাও যেমন দুর্ভিক্ষের ওপর একটা ডকুমেন্ট, চাষীদের সংগ্রাম, এটাও তো তেমনি দাঙ্গা আর দেশবিভাগের ওপর একটা ডকুমেন্ট। এটাও তো ছিন্নমূল মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রামের নাটক। তাহলে?

এর জবাবে রবি বসু গণনাট্য সঙ্ঘের সাংগঠনিক গুরুত্বের কথা বলেছিলেন। নবান্নে-র জন্য কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়ার পৃষ্ঠপোষণার কথা বলেছিলেন। এর কোনওটাই নতুন ইহুদী-র বরাতে জোটেনি। কলকাতার সাধারণ রঙ্গালয়ের ইতিহাসে অনেক ধূসর পাণ্ডুলিপির আনাগোনা আছে। রংমহলে নতুন ইহুদী-র মঞ্চায়নের কোনও নির্ভরযোগ্য খতিয়ান আমাদের হাতে নেই। তার ওপর গ্রুপ থিয়েটারের কুলীন কুলে উত্তর সারথী গোষ্ঠীর জায়গা হয়নি। আরএসপি-প্রভাবিত ক্রান্তি শিল্পী সঙ্ঘের সক্রিয়তা অনেক আগেই ইতিহাস। অতঃপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা কোনও কোনও মহাফেজখানায় তত্ত্বতালাশ চালিয়েও এই প্রযোজনা সংক্রান্ত কোনও প্রামাণ্য নথিপত্র আমাদের নাগালে আসেনি। ছবিছাবা দূরে থাক, টিকিট-হ্যান্ডবিলও নয়। এতদসত্ত্বেও নতুন ইহুদী-র নান্দনিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব কিছুমাত্র খাটো করা যাচ্ছে না। দাঙ্গাবিধ্বস্ত কলকাতার বুকে যে নাটক দেশত্যাগী এক শরণার্থী পরিবারের মর্মন্তুদ পরিণতির কথা শোনাল, তাকে উপেক্ষা করা অপরাধই হয়েছে এতকাল।

অগতির গতি সাবিত্রীর স্মৃতিকথা থেকে যে প্রেক্ষাপট নির্মাণ করা যায় তা কতক এইরকম।

 

নতুন ইহুদী-র হয়ে ওঠা

সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম কুমিল্লার কনকসার গ্রামে, ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ২১ ফেব্রুয়ারি। বাবা শশধর চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ইংরেজ আমলের ট্রেন কোম্পানির স্টেশনমাস্টার। মা ইচ্ছাময়ী চট্টোপাধ্যায়। সাবিত্রী ছিলেন বামা-মায়ের দশম সন্তান, আরও স্পষ্ট করে বললে দশম কন্যাসন্তান। বাবা শশধর পরের দিকে ঢাকার কমলাপুরে বড় বাড়ি তৈরি করেছিলেন। বাড়িতে গানবাজনার আবহাওয়া ছিল। উৎসবে অনুষ্ঠানে আসর বসত। মঞ্চ বেঁধে যাত্রা, থিয়েটার হত। শশধর বাড়ির মেয়েদের দিয়ে ‘নিমাই সন্ন্যাস’ যাত্রা করিয়েছিলেন, দেশের বাড়িতে, কনকসারে। অভিশাপ হয়ে নেমে এল দেশভাগ। কলকাতায় পঞ্চম দিদির বাড়িতে চলে আসতে হল সাবিত্রীকে। রাসবিহারী মোড়ের কাছে ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউটে ভর্তি করানো হল তাঁকে।

দেশভাগের কিছুকালের মধ্যে ঢাকার সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হল। প্রাণ হাতে করে কলকাতায় চলে আসতে হল বাবা শশধরকেও। কমলাপুরের সাধের বাড়ির বদলে, কলকাতার উপকণ্ঠে অনুন্নত মহল্লা টালিগঞ্জের বাবুরাম ঘোষ রোডে একটি দুই ঘরের বাড়ি পেলেন। ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য ভবানীপুরে পূর্ণ সিনেমার পাশে পান-বিড়ি-সিগারেটের দোকান দিলেন ঢাকা কমলাপুরের অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাবু শশধর চট্টোপাধ্যায়।

এই সময়ই একদিন স্কুল থেকে বেরিয়ে রাসবিহারী মোড়ের একটি দোকানে বরফের ওপর সাজানো রাংতা-মোড়া পান চিবুতে চিবুতে বন্ধুদের সঙ্গে গুলতানি করতে করতে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নজরে পড়েন সাবিত্রী। কদিনের মাথায় ভানু এগিয়ে এসে সাবিত্রীর সঙ্গে আলাপ করাতে দুজনের আত্মীয়তার সূত্র বেরিয়ে যায়। উত্তর সারথীর নতুন ইহুদী নাটকে পরীর ভূমিকার জন্য অভিনেত্রীর খোঁজ চলছিল। ভানু নাকি সাবিত্রীকে বলেছিলেন, ‘ক’দিন ধইরা তোমার চলন-বলন সব লক্ষ করে দ্যাখলাম তুমিই পারবে। তুমি আমাদের থিয়েটারে পার্ট করবে? বাঙ্গাল ভাষার নাটক। আগাগোড়া দ্যাশের ভাষা।’ সাবিত্রী যেমন ‘কটকট’ করে কথা বলেন, ভানুর মতে সেটি নাকি পরীর চরিত্রের পক্ষে মানানসই ছিল। এ ব্যাপারে সাবিত্রীর বাবার অনুমতির প্রয়োজন ছিল। ভানুর মুখে নাটকের নাম শুনে বাবা শশধর নাকি যারপরনাই উত্তেজিত হন। বলতে থাকেন, ‘ঠিকই তো! আমরা তো এখন নতুন ইহুদিই বটে!’

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়

উত্তর সারথীর মহড়া হত চেতলায়, উত্তর সারথীর সদস্য বলীন সোমের সাতমহলা বাড়িতে। ফ্রক পরে, ভানুর কিনে দেওয়া নতুন জুতো পরে প্রথম মহড়ায় গেছিলেন কিশোরী সাবিত্রী। ‘পুরোপুরি রিফিউজি রিফিউজি চেহারা’র সাবিত্রীকে প্রথম দেখে কানু বন্দ্যোপাধ্যায় নাকি সংশয়ের সুরে বলেছিলেন, ‘তা হ্যাঁ গো মেয়ে, তুমি বাঙাল ভাষায় কথা বলতে পারবে তো? না কি কলকাতায় এসে দেশের ভাষা ভুলে গেছ?’ সাবিত্রী নাকি সপাটে জবাব দেন, ‘পারুম না ক্যান! আমি বাঙ্গাল দ্যাশের মাইয়া।’ সাবিত্রীর জায়গা পাকা হয়েছিল। সাবিত্রীর সংশয় ছিল তাঁর সহ-অভিনেতৃদের নিয়ে। কানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সুশীল মজুমদার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, রসরাজ চক্রবর্তী, বিনু বর্ধন, বলীন সোম, বাণী গাঙ্গুলি— সবাই কলকাতাই জবানে কথা বলেন। বাঙাল বুলি তাঁদের মুখে ফুটবে কী করে? অচিরেই সেই সংশয় নিরসন হয়েছিল।

মঞ্চ-অভিনয়ে সড়গড় হতে সাবিত্রীর সময় লাগছিল। সাবিত্রীকে হাতে করে গড়েপিটে মঞ্চ-অভিনয়ের ব্যাকরণ শিখিয়েছিলেন কানু বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে বলেছিলেন, ‘ধর তুই যে চরিত্রটা করছিস সেটা খুব দুঃখের। তুই যদি স্টেজের ওপর কান্নাকাটি করে চোখের জলে বুক ভিজিয়েও ফেলিস তাহলেও দেখবি দর্শকদের চোখে তোর জন্যে এক ফোঁটাও জল আসছে না। তোকে করতে হবে কী, বুকের মধ্যে দুঃখের তীব্র অনুভূতিটা রেখে সেই অদৃশ্য কান্নাটা অভিব্যক্তির মধ্যে দিয়ে দর্শকদের মনে পৌঁছে দিতে হবে। দেখবি তোর দুঃখে দর্শকরা কেঁদে ভাসাচ্ছে। ঠিক তেমনি ভেতরের আনন্দটাকেও নিজে না হেসে দর্শকের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এই যে হাসি কিংবা কান্না নিয়ন্ত্রণ করার টেকনিক, সেটাই অনুশীলনের মধ্যে দিয়ে শিখতে হবে।’

নতুন ইহুদী-র বোর্ড রিহার্সালের দিন যাঁদের বিশেষভাবে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছিল তাঁদের মনে একজন ছিলেন অরুণকুমার চট্টোপাধ্যায় ওরফে উত্তমকুমার। সাম্প্রতিকতম স্মৃতিকথায় সাবিত্রী জানিয়েছেন যে উত্তমকুমার তাঁর সেদিনের অভিনয়ে শুধু তুষ্ট হননি, তাঁকে নিজেদের পাড়া ভবানীপুরের নাটকের দল কৃষ্টি ও সৃষ্টির প্রযোজনা আজকালে অভিনয় করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। টালিগঞ্জের বাড়িতে এসে শশধর চট্টোপাধ্যায়ের অনুমতি চেয়েছিলেন। শশধরের এক কথায় নগদ ৫০ টাকা আগাম দিয়ে তাঁকে কৃষ্টি ও সৃষ্টির মহড়ায় যাওয়ার অনুমোদন আদায় করেছিলেন।

এ প্রসঙ্গ আলাদা। তবে এটুকুও লেখা থাক যে সাবিত্রী নানান জায়গায় বলেছেন যে নতুন ইহুদী-তে অভিনয় তিনি কোনও অর্থ উপার্জন করেননি। অথচ কৃষ্টি ও সৃষ্টির প্রযোজনায় ভানু চট্টোপাধ্যায়ের লেখা আজকাল যখন মঞ্চস্থ হয়েছে রংমহলে, তখন পারিশ্রমিক নিয়েছেন। এর পরপরই স্টার থিয়েটারে শ্যামলী নাটকের পালা পড়েছিল। তবু মনে রাখতে হবে যে টানাটানির সংসারের মেয়ে হয়েও গ্রুপ থিয়েটারের মৌল আদর্শে থিতু ছিলেন বছর তেরো-চোদ্দোর সাবিত্রী।

সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়

 

কেন নতুন ইহুদী?

পটভূমি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রস্তুতিপর্ব নিয়েও খানিক আলোকপাত হল। এবারে আমরা খতিয়ে দেখব সলিল সেনের নতুন ইহুদী-র বিষয়বস্তু ও তার অন্যান্য বৈশিষ্ট্য।

প্রথমেই বলতে হয়, এ নাটকের ভাষার কথা। পূর্ববঙ্গের ঢাকা জেলা থেকে শরণার্থী হয়ে কলকাতায় চলে আসা একটি পরিবার ও তাদের অনুগ্রহভাজন আরেকটি পরিবারের জীবনসংগ্রাম নিয়ে নাটক। মুখ্য চরিত্রগুলির মুখে ঢাকাই উপভাষার প্রয়োগ তাতে অনিবার্য। সলিল সেনের মুন্সিয়ানা ভাষার মিশেলে। কলকাতার মানুষের মুখে তিনি শান্তিপুরী বুলি তুলে দিয়েছেন। দরকারমাফিক ইংরেজিতেও বাতচিত করেছেন কলকাতার লোকজন। আবার হুগলি শিল্পাঞ্চলের টিটাগড়ের শ্রমিক মহল্লায় চালু দেহাতি হিন্দি ভাষারও প্রয়োগ ঘটেছে নতুন ইহুদী-তে। কোথাও তেলে জলে হয়নি। গণনাট্য সঙ্ঘের প্রযোজনার সূত্র ধরে বাস্তববাদী অভিনয়ের যে ধারা ক্রমে মান্যতা পাচ্ছিল সেকালের কলকাতায়, এই পাঁচমিশেলি ভাষাপ্রয়োগ তার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল।

তবে অঙ্ক ও দৃশ্যের যে ভাগাভাগি তখনও অবধি আমাদের রঙ্গমঞ্চে কায়েম ছিল— নবান্নে-ও যার ব্যতিক্রম ঘটেনি— সেটিকে মানেননি সলিল। নতুন ইহুদী লেখা হয়েছে ১৭টি দৃশ্যে। সময়ের ধারাবাহিকতা মেনে বিন্যস্ত এই দৃশ্যগুলির সূচনা পূর্ববঙ্গের গ্রামে, সমাপ্তি কলকাতার বস্তিতে।

নতুন ইহুদী-র সূত্রপাত ‘পূর্ব্ব-পাকিস্তানের অন্তর্গত একটি মধ্যবিত্ত হিন্দু ব্রাহ্মণ পরিবারের কুটীর প্রাঙ্গণ’-এ। এই পরিবারের প্রধান মনমোহন ভট্টাচার্য— ‘মাধ্যমিক স্কুলের ভি এম পাশ পণ্ডিত’। মনমোহনের চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়েছে, কারণ বাংলার জায়গায় উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আগে থেকেই সংস্কৃতকে কোণঠাসা করার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। নিচু ক্লাসে সংস্কৃত পড়ানোর দরকার নেই বলে মনমোহনের চাকরি গেছে। গ্র্যাচুইটি বাবদ ২৫০ টাকা তাঁর প্রাপ্য। সেটি হাতে পাওয়ার আগেই পৈতৃক সূত্রে পাওয়া জমিজিরেত জলের দামে বেচে দিয়ে কলকাতায় চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মনমোহন। চোখের সামনে দেখছেন যে একের পর এক বর্ণহিন্দু পরিবার গ্রাম ছেড়ে যাচ্ছে। মুসলমানদের প্রতাপ প্রতিপত্তি বাড়ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলা দায় হয়েছে। এ যাত্রায় তাঁর সঙ্গী হয়েছেন স্ত্রী অন্নপূর্ণা। দুই ছেলে দুইখ্যা আর মোহন। এক মেয়ে পরী। মনমোহনের সঙ্গে আরও দুজন আছেন— দুইখ্যার ভাষায় ‘আমাগো পেরজা’— গ্রামের নমঃশূদ্র চাষি কেষ্টদাস আর তাঁর স্ত্রী আশালতা।

ট্রেনে চড়ে তাঁরা এসে পড়েছেন শিয়ালদহ স্টেশনে। কোনওরকমে আব্রু রক্ষা করে রিলিফের চাল-ডালে ক্ষুন্নিবৃত্তি করছেন। কাশী বিশ্বনাথ সেবা সমিতি, ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ, রামকৃষ্ণ মিশন, শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠের দেওয়া ত্রাণসামগ্রী নিয়েছেন। এভাবে কয়েক সপ্তাহ কেটে গেছে। এবারে প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে রিফিউজি ক্যাম্পে উঠে যাওয়ার জন্য তাঁদের ওপর চাপ দিতে শুরু করেছেন স্বেচ্ছাসেবকরা। কতক বাধ্য হয়েই ৯ নং নীলু ঘোষাল স্ট্রিটের ১৮ নং বস্তিতে মাথা গুঁজবার বন্দোবস্ত করতে হয়েছে মনমোহনকে। কোনওরকমে দিন-আনি-দিন-খাই অবস্থায় সংসার চলছে। মনমোহন কোনও চাকরি জোটাতে পারেননি। গঙ্গার ঘাটে পুরুতের কাজ করতে গিয়ে অসম্মানের গ্লানি সয়েছেন। শেষটায় এক টাকা বারো আনা রোজে এই হালুইকরের জোগাড়ের কাজ করতে গিয়ে চূড়ান্ত অমর্যাদার মুখে পড়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। মেজ ছেলে দুইখ্যা ক্রমে এলাকার সমাজবিরোধীদের দলে নাম লিখিয়েছে। চুরি ছিনতাই পকেটমারি করে দিন কাটাচ্ছে। ছোট ছেলে মোহনের লেখাপড়ায় ইতি পড়েছে। মোট বইবার কাজ, ফিরিওয়ালার কাজ— কোনওটাতেই সুবিধে করতে পারেননি মোহন। কতক বাধ্য হয়ে টিটাগড়ে কাজের সন্ধান করেছেন। তাঁর মুখ দিয়ে ‘এতবড় পৃথিবীতে আমাগো মাথা গোজনের স্থানটুকুও নাই’ এমন মর্মান্তিক সংলাপ বলিয়ে নিয়েছেন নাটককার। দেশভাগ-দেশত্যাগের জোড়া ধাক্কায় জাতপাতের বালাই যে ঘুচে গেছে তারও স্বীকৃতি আছে কেষ্টদাসের হাতে জল খাবার সময় মোহনের বলে ওঠা ‘ওই সব ছাড়ান দাও কিষ্ট— ভিখারীর কোন জাত নাই’ এমন সংলাপে। মনমোহনের সংসারের হাত ধরে আছেন স্ত্রী অন্নপূর্ণা। তাঁকে সবরকম সাহায্য করছেন পরী। দুই দাদার অনুপস্থিতিতে অসুস্থ বাবার জন্য পথ্য কিনতে গিয়ে দেহব্যবসায়ীদের আড়কাঠি যতীনের খপ্পরে পড়েছেন পরী। কতক অজান্তেই। পরে বুঝতে পেরেও পিছিয়ে আসতে পারেননি।

অন্যদিকে শিয়ালদহে থাকতে থাকতেই ঠগের পাল্লায় পড়ে কেষ্টদাস সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এক দেহাতি কুলি ভিখুয়ার যোগসাজশে সস্ত্রীক চলে এসেছেন টিটাগড়ে। ‘আমি হালায় জাত-চাষা— জমি না পাইলে আমি মইরা যামু। চাষবাস ছাইড়া কুলীর কাম আমি করুম না’ বলে জেদ ধরেছিলেন কেষ্টদাস। রাখতে পারেননি। কারখানায় কাজ নিয়েছেন। আশালতা ঠিকে ঝি-র কাজ নিয়েছেন আশপাশে কোথাও।

এত করেও শেষরক্ষা হয়নি। পূর্ব পাকিস্তান থেকে গ্র্যাচুইটির টাকা আসার কিছুক্ষণ আগে বস্তির ঘরে বেঘোরে মরেছেন মনমোহন। পথ দুর্ঘটনায় প্রাণ গেছে দুইখ্যার। পরিবারের মুখে দু মুঠো তুলে দেবার জন্য সম্ভ্রম বেচতে হয়েছে পরীকে। অসহায় হয়ে সব সইতে হয়েছে অন্নপূর্ণাকে। শোকাতুর মোহনকে সান্ত্বনা দিয়েছেন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা মহেন্দ্র। তাঁকে শিখিয়েছেন— ‘মনে মনে সমস্ত প্রপীড়িতদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে শপথ নাও যে স্বার্থলোভী, অর্থলোলুপ যারা তোমাদের ভাগ্যকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে, তাদের শাস্তি দেবে। হৃদয়হীন শোষকদের অত্যাচার তুমি খতম করবেই, ভাগ্যের গোলামী তুমি আর বরদাস্ত করবে না কিছুতেই।’

নাটক শুরু হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা চন্দ্রগুপ্ত নাটকে ব্যবহৃত ‘ধনধান্যপুষ্পভরা’ দিয়ে। শেষ হয়েছে ওই গানেরই ‘ওমা তোমার চরণদুটি বক্ষে আমার ধরি/ আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতেই মরি’ দিয়ে।

১৭টি দৃশ্যের পরিসরে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীদের নিদারুণ পরিণতির ছবি আঁকার পাশাপাশি তৎকালীন কলকাতার নানান রকমের মানুষের নানান রকমের প্রতিক্রিয়াকেও নথিভুক্ত করেছেন সলিল সেন। শিয়ালদহ স্টেশনে আপাত সহানুভূতিশীল স্বেচ্ছাসেবকের মুখেও ‘ও, মিনিমাগনার চাল খেয়ে বুঝি তেল বেড়েছে’-র মতো বক্রোক্তি শোনা গেছে। ৩০০ টাকায় দু বিঘা জমি কিনে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কেষ্টদাসকে পথে বসিয়েছে কলকাতারই কোনও ঠগ। এই কলকাতারই বুকে সৎভাবে রোজগারের কোনও উপায় না পেয়ে চুরি-চামারিতে ভিড়ে গেছে দুইখ্যা, মদ খেয়ে ‘চরিত্র’ খুইয়েছে। বড়বাবুর দালাল যতীন নানান লোভের ফাঁদে ফেলে পরীকে ঘরছাড়া করেছেন। হাতের লোহা বিক্রি করার সিদ্ধান্ত নিয়েও পরিবারের পরিত্রাণে কাজে লাগতে পারেননি অন্নপূর্ণা। আর চক্রব্যূহে ঢুকে পড়ে মোহন বলে উঠেছেন— ‘আমরা সব্বাই ভাইস্যা যামু— যতই চেষ্টা করি না কেন, দুর্ভাগ্য আমরা ঠেকামু কি দিয়া’।

কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ প্রতিরোধের ডাক দিয়ে নতুন ইহুদী শেষ হলেও তার বিয়োগান্ত সুরটিই আমাদের মনে নাড়া দিয়েছে। ১৯৫১-৫২ খ্রিস্টাব্দে সব খুইয়ে আসা মানুষের কাছে এই বিয়োগান্ত সুর কত মর্মান্তিক ছিল তা আজ আমরা কল্পনাতেও আনতে পারব না। ১৯৫১-র ২৪ আগস্ট ‘গণবার্তা’র পাতায় এই প্রযোজনার সমালোচনা লিখতে গিয়ে প্রখ্যাত নাট্য ঐতিহাসিক হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত নতুন ইহুদী-র সঙ্গে নবান্নছেঁড়া তারে-র তুলনামূলক আলোচনা করে বলেছিলেন— ‘তবে সব দিক দেখিয়া প্রতীতি হয় যে উত্তর সারথীর ‘নতুন ইহুদী’ই সময়োপযোগী অদ্ভুত অবদান। মস্কো আর্ট থিয়েটারে রুষিয়ার প্রধান অভিনেতা ক্যানলড্‌ যখন দেশবাসীর দুর্দ্দশার অবস্থা মঞ্চের মাধ্যমে প্রকট করিতেন, প্রত্যেক দর্শক একেবারে অভিভূত হইয়া সমস্যার প্রতিকারে বদ্ধপরিকর হইত। একথা কেবল কাগজেই পড়িয়াছি, প্রত্যক্ষ করি নাই। কিন্তু সেদিন কালিকা থিয়েটারে ‘নতুন ইহুদী’র অভিনয় দেখিয়া লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারা পরিবারের দুর্দ্দশা যেন দুই তিন ঘণ্টার মধ্যে জাজ্জ্বল প্রত্যক্ষ করিলাম।’ ১৯৫২-র ৪ এপ্রিল তারিখে যুগান্তর লিখেছিল— ‘প্রকৃতপক্ষে বহুরূপীর ‘ছেঁড়া তার’-এর পর বাস্তুহারাদের বিড়ম্বিত জীবনের এমন বাস্তব নাট্যরূপ আর দেখা যায়নি।’ আমাদের আক্ষেপ যে নাট্য ইতিহাসের পাতায় ছেঁড়া তারে-র মর্যাদা আজও অক্ষুণ্ণ থাকলেও নতুন ইহুদী তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে।

অনেক খুঁজেপেতেও নতুন ইহুদী-র কলাকুশলীর কোনও পূর্ণাঙ্গ তালিকা আমাদের হাতে আসেনি। নাট্যশোধ সংস্থানে সংরক্ষিত নানান সমালোচনা থেকে খানিক আভাস পাওয়া যায়।

মনমোহন: কানু বন্দ্যোপাধ্যায়
অন্নপূর্ণা: বাণী গাঙ্গুলী
দুইখ্যা: ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়
মোহন: সুনীল দাশগুপ্ত
পরী: সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়
মীর্জা: সুশীল মজুমদার
গুপী: শ্যাম লাহা
কেষ্টদাস: দেবী নিয়োগী
আশালতা: কমলা চট্টোপাধ্যায়
ভিখুয়া: রসরাজ চক্রবর্তী
মহেন্দ্র: গৌতম মুখোপাধ্যায়”

এই লেখা শেষ করার আগে তারেক মাসুদের ছায়াছবি অন্তর্যাত্রা-র (২০০৬ খ্রি) একটি দৃশ্যের কথা মনে পড়ছে। ঢাকার পুরনো মহল্লায় দেশভাগের সময় হাতবদল হওয়া একটি বাড়িতে ফাইফরমাশ খাটেন ‘লক্ষ্মণদা’ নামে এক বৃদ্ধ। মনে হয় পুরুষানুক্রমে এই বাড়ির দেখভাল করছেন লক্ষ্মণ ও তাঁর পূর্বপুরুষরা। জন্মসূত্রে হিন্দু হলেও মুসলমান ঘরে কাজ করার মানসিকতা তাঁর আছে। তিনি ‘দেশ’ ছাড়েননি। এই সিদ্ধান্ত কতখানি স্বতঃপ্রণোদিত আর কতখানি বাধ্যতামূলক এ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেয় বাড়ির অতিথি-অভ্যাগতদের উপস্থিতিতেই লক্ষ্মণের মুখে উঠে আসা একটি মেঠো ছড়া। ‘গান্ধি মরল গুলি খাইয়া/ জিন্নায় আধমরা/ বর্ণহিন্দু পলায়ে গেল/ এই চাঁড়াল পড়লাম ধরা’। এই উচ্চারণ ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের নয়, ১৯৪৮-এর মাঝামাঝি সময়কার। সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতার আঁচ পেতেই ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছিলেন সম্পন্ন হিন্দু সম্প্রদায়। হয় শশধর চট্টোপাধ্যায়ের মতো কলকাতার কোনও মুসলমান পরিবারের সঙ্গে সম্পত্তি বিনিময় করে, নয় যে কোনও মূল্যে সম্পত্তি বিক্রি করে। এই পলাতক জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই ছিল বর্ণহিন্দু এবং ধনাঢ্য-মধ্যবিত্ত। যাঁরা হিন্দু হয়েও ভারতে গেলেন না, তাঁদের অধিকাংশ বর্ণাশ্রম প্রথার শোষণের সাক্ষী। তাঁদের কারও কারও মনে পাকিস্তানের মাটিতে মাথা উঁচু করে থাকার খোয়াব ছিল। বরিশালের যোগেন মণ্ডল তাঁদের কারও কারও কাছে অনুপ্রেরণা ছিলেন। নমঃশূদ্র বা হরিজন বা দলিত বা বা নিম্নবর্গীয় বা মতুয়া বা অন্য যে-নামেই ডাকি না কেন, বর্তমানে নানান তফসিলভুক্ত এইসব মানুষের কথাও বলতে শুরু করেছিল নতুন ইহুদী। শিয়ালদহ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে বা টিটাগড়ের কুলি লাইনের ঘরে এক সঙ্গে থাকতে থাকতে এতকালের লালিত ‘ছোঁয়াছুঁয়ির ছোট্ট ঢিল’ যে হারিয়ে গিয়েছিল, সেই সূত্রও দিয়েছিল।

নতুন ইহুদী সম্পর্কে ১৯৫১-র ২৫ আগস্টের দেশ লিখেছিল—

বছর কতক ধরেই পশ্চিমবঙ্গের পথেঘাটে, পল্লীতে পল্লীতে বাস্তুহারাদের চোখে পড়ে আসছে; তাঁদের অসীম দুর্দশা ও দুর্গতিও চোখের সামনেই ঘটতে দেখা যাচ্ছে; কিন্তু সাধারণ লোকের কাছে সেসব একটা অপসৃয়মান সাময়িক পরিস্থিতির চেয়ে ঘোরতর কিছু মনে হয় না। নাটকখানিতে বাস্তুহারাদের দুর্গতির বাস্তব চেহারাটা খোলাখুলিভাবে তো দেখানো হয়েছেই, কিন্তু তার চেয়ে বড়ো কথা হচ্ছে, বাস্তুহারা আসার ফলে বা বাস্তুহারাদের দুর্দশার জেরটা বাঙালীর সমগ্র মধ্যবিত্ত সমাজে যে আলোড়ন তুলেছে, সমাজের কাঠামোটাই যেভাবে ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করেছে, সেইদিকটাই প্রকট করে তোলা হয়েছে; এই জন্যেই নাটকখানির প্রয়োজন ছিল। নাটকখানি বাস্তুহারাদের প্রকৃত সমস্যা সম্পর্কে দেশকে সচেতন করে তুলবে এবং সমস্যার সমাধানের জন্যেও উদ্বুদ্ধ করে তোলার সহায়তা করবে। এইখানেই নাটকখানি সার্থক সৃষ্টি হয়ে উঠেছে। সমগ্র নাটকখানি এতোটা সাবলীল ও স্বাভাবিকভাবে ফুটে উঠেছে যে, শেখানো-সাজানো কতকগুলো দৃশ্যের সমষ্টি বলে একবারও মনে হয় না। অন্তরে বিঁধিয়ে দেবার মতো তীব্র আবেগসম্পন্ন কতকগুলো ঘটনা চোখের সামনে ঘটে যেতে থাকে; বাস্তুহারা জীবনের একেবারে অন্তস্থলটিকে উদ্ঘাটিত করে দেয়।

এতৎসত্ত্বেও এমন একটি নাটককে আমরা প্রাপ্য মর্যাদা দিতে পারিনি। এবারে যেন পারি।

 

তথ্যসূত্র: