Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

গর্বাচেভ-এর মৃত্যু ও কিছু অপ্রিয় প্রসঙ্গ

মিখাইল গর্বাচেভ | রাজনীতিক

শুভাশিস মুখোপাধ্যায়

 



প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, পরিবেশবিদ

 

 

 

বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা, ক্ষমতাচ্যুত রাষ্ট্রপ্রধান, মিখাইল গর্বাচেভ ৩০ আগস্ট ২০২২-এ মস্কোর প্রায় এক অনামা হাসপাতালে ৯১ বছর বয়েসে প্রয়াত হলেন। তিনি অনেকদিন ধরেই কিডনির সমস্যায় পীড়িত ছিলেন। আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক পরিসর থেকে তিনি অনেক দিন আগেই বিদায় নিয়েছিলেন; কিছুদিন তাঁর প্রতিষ্ঠিত “গর্বাচেভ ফাউন্ডেশন” নানা বিষয়ে মতামত দিয়ে প্রাসঙ্গিক থাকার চেষ্টা করেও কার্যত আর পাদপ্রদীপের আলোতে আসতে পারেনি। পুতিন-এর রাষ্ট্রনীতির বেশ কিছু সঙ্গত সমালোচনা ছাড়া তাঁর কাছ থেকে পশ্চিমি দুনিয়ার আর কিছু পাওয়ার ছিল না। কমিউনিস্ট পার্টিতে তিনি যোগ দেন ১৯৫০ সালে, স্তালিন তখনও সোভিয়েত রাশিয়া তথা সারা বিশ্বে মধ্যগগনে বিরাজ করছেন। ধীর কিন্তু নিশ্চিতভাবেই তাঁর উত্থান ঘটেছে, এক পদ থেকে আর এক পদে, শেষ পর্যন্ত তিনি বিতাড়িত হওয়ার আগে সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছিলেন।

নভেম্বর বিপ্লবের ৭০ বছর (১৯৮৭) পূর্তি উপলক্ষে ভাষণে মিখাইল গর্বাচেভ বলেন, “আজকে দেশে সেইসব ব্যক্তি কৃষক নেই যাঁদের সঙ্গে ঐক্য গড়তে হবে, যেটা ছিল বিশের দশকের আর্থিক নীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। কিন্তু নয়া আর্থিক নীতির একটি দূরবর্তী লক্ষ্যও ছিল। নতুন সমাজ গড়ার জন্য কাজ হিসেবে ঠিক করা হয়েছিল, যেমনটি লেনিন বলেছিলেন, যে তা “সরাসরি ব্যক্তির উৎসাহের ওপর নির্ভর না করে” বরং “মহান বিপ্লব যার জন্ম দিয়েছে, তার ওপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগত স্বার্থ, ব্যক্তিগত উৎসাহপ্রদান এবং ব্যবসায়িক নীতিভিত্তিক করতে হবে… এটাই বিপ্লবের বস্তুগত গতি প্রকৃতি ও অভিজ্ঞতা আমাদের শিক্ষা দিয়েছে।“

এই একই বক্তৃতায় তিনি বিভিন্ন তথ্য তুলে এনে এবং সেই তথ্যের ব্যাখ্যা দিয়ে দেখানোর চেষ্টা করেন যে তাঁর আমলে প্রস্তাবিত ও পরে গৃহীত “পেরেস্ত্রৈকা” ও “গ্লাসনস্ত” আসলে নিকিতা ক্রুশ্চেভের আমলে বিংশতি ও দ্বাবিংশতি কংগ্রেসে গৃহীত প্রস্তাবাবলির ফলিত রূপ। কোনও কোনও ক্ষেত্রে গর্বাচেভ-এর এই দাবির ভিত্তি থাকলেও, অনেক ক্ষেত্রেই তথাকথিত “মুক্ত দুনিয়া”-র পক্ষ থেকে সোভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ তোলা হয়, অতীত জমানার সোভিয়েত রাশিয়ার নেতাদের মত একই যুক্তি গর্বাচেভ তাঁর বক্তৃতায় বলেছিলেন।

গর্বাচেভ তাঁর ভাষণে স্পষ্ট করে বলেছিলেন, তিনি যাকে “পেরেস্ত্রৈকা” ও “গ্লাসনস্ত” বলছেন তার সূত্রপাত ঘটেছিল যথাক্রমে রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির ১৯৫৩ সালের সেপ্টেম্বর এবং ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসের অনুষ্ঠিত পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির প্লেনামে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে শ্রমিকদের কর্মোদ্যমের পেছনে ব্যক্তিগত স্বার্থকে স্বীকৃতি দিয়ে তাদের আর্থিক সহ অন্যান্য বাস্তব উৎসাহ-দান পদ্ধতি চালু করা হবে, যা কিনা গর্বাচেভ-নির্দেশিত যুগ্ম সংস্কারের একটি মূল বিষয়। এই কাজটি করার একটি সামাজিক ও কাঠামোগত পূর্বশর্ত হতে হবে সংস্থা ও সমিতিগুলিকে স্বশাসিত করা, তাদের স্বাতন্ত্র্য প্রদান করা, সামাজিক ক্ষেত্র থেকে তাদের মুনাফা অর্জনের এবং নিজেদের খরচ সমাজ থেকে না নিয়ে তাদের ব্যবসা, বাণিজ্য ও মুনাফা থেকে মেটানোর পথে হাঁটা, শ্রমিক সমবায়গুলিতে যে সামাজিক সম্পদ এতদিনে সৃষ্টি হয়েছে সেগুলিকে মুনাফার উদ্দেশ্যে নতুন নতুন ব্যক্তিমালিকানার ক্ষেত্রে লগ্নি করা। এই কারণে প্রশাসন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে হবে, তার জন্য রয়েছে প্রস্তাবিত “পেরেস্ত্রৈকা”। ক্রুশ্চেভ ও ব্রেজনেভ-এর আমলে যথেষ্ট দ্রুততায় এই সব মূল নীতিগুলি রূপায়িত না হলেও, সেগুলি কার্যকর করা শুরু হয়ে গিয়েছিল, প্রয়োজনীয় “সুফল”, গর্বাচেভ-এর মতে, দৃশ্যমান হচ্ছিল। তাই এই সব নীতিগুলিকে কেবল তাত্ত্বিক কচকচি হিসেবে না ধরে সেগুলি রূপায়ণের স্তরে উন্নীত হয়েছিল বলে ধরে নেওয়াই সঙ্গত। ১৯৮৭ সালে এসে গর্বাচেভ বলেন যে, বর্তমানে বহুল পরিমাণে সংস্থা ও সমিতিগুলি, যেমন নির্মাণ, পরিবহন, কৃষিক্ষেত্র এইসব নীতির ভিত্তিতে আত্ম-নির্ভর, মুনাফা অর্জনকারী এবং লগ্নিকারী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে।

১৯৮৮-৮৯ সালে দেখা যায় সোভিয়েত রাশিয়ার শিল্প উৎপাদনের ৬০ শতাংশ এই মুনাফাভিত্তিক স্বতন্ত্র (রাষ্ট্রের পরিচালনার বাইরে, ব্যক্তি বা সমষ্টি উদ্যোগের ফসল হিসেবে) পথে চলছে। “পেরেস্ত্রৈকা” তার আরব্ধ কাজ সম্পন্ন করেছে।

গর্বাচেভ আগাগোড়াই বলে এসেছেন যে তিনি লেনিন-অনুসৃত ১৯২০ সালের নয়া আর্থিক নীতি বর্তমান অবস্থায় প্রয়োগ করছেন। এই নীতি স্তালিনের আমলে আচমকা বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আর্থিক ক্ষেত্রে বন্ধ্যাভাব আসে, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে গণতন্ত্রের অভাব, বিরুদ্ধ মতের প্রতি অসহিষ্ণুতা, ন্যায় বিচারে অবহেলা এবং সমাজতন্ত্রের ধারণার বিপরীত অনুশীলন শুরু হয়, যা ক্রুশ্চেভের আমলে শোধরানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। এই বিষয়টি আসলে “গ্লাসনস্ত”। গর্বাচেভ যে আর্থিক বিষয়ে তাঁর পূর্বসূরিদের অনুসারী, তিনি তাঁর অনেক উদাহরণ তুলে ধরেছিলেন।

কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাঁর এই দাবি ধোপে টেকে না। যে যে বিষয়ে গর্বাচেভ ক্রুশ্চেভ-পূর্ব ধারণা মেনে নিয়েছিলেন, তার সামান্য কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি নিকিতা ক্রুশ্চেভ-কে যাবতীয় পদ থেকে সরিয়ে দেয়। এই সরিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি ন্যায্য প্রক্রিয়া মেনে বা সোভিয়েত পার্টির আইন মেনে করা হয়নি। এই বিষয়ে গর্বাচেভ পরে মন্তব্য করেছেন যে, পদ্ধতি যা-ই হোক, সোভিয়েত রাষ্ট্রকে সুস্থির করার জন্য এই কাজ করার দরকার ছিল, ক্রুশ্চেভের খামখেয়ালি ব্যবস্থাপনা দেশকে গোল্লায় পাঠাচ্ছিল। অর্থাৎ, ক্ষেত্র-বিশেষে “গ্লাসনস্ত”-কে দরজার বাইরে রাখা যেতে পারে।

১৯৬৫ সালের মার্চ এবং সেপ্টেম্বর মাসে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির দুটি প্লেনারি সভা হয়, যেখানে কৃষি এবং শিল্প ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় ম্যানেজারদের হাতে পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান করার সিদ্ধান্ত হয়। অনেক বিরোধিতা এলেও সেই কাজ শুরু হয়ে যায়। কিন্তু ব্রেজনেভের আমলে ঢিলেঢালা প্রশাসন এইদিকে দ্রুত পদক্ষেপ করতে পারেনি। গর্বাচেভ পরে মন্তব্য করেন, এই পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারলে সোভিয়েত রাশিয়া টিঁকে যেত।

আর্থিক এবং রাজনৈতিক-সামাজিক সংস্কার শুরু করে সেগুলি শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে না যাওয়ার ঘটনায় তিনি এমনকি লেনিনকেও ছাড় দেননি। ১৯২১ সালে লেনিন যে নয়া আর্থিক নীতি নিয়েছিলেন, সেখানে কৃষিতে ব্যক্তিগত বাণিজ্য (উদ্বৃত্ত কৃষিপণ্য বাজারে বেচা-কেনা করার সুযোগ সৃষ্টি করা) করার অনুমতি দেওয়ার পাশাপাশি লঘু ও মধ্যম মাপের শিল্প উৎপাদনে ব্যক্তি-উদ্যোগ মেনে নেওয়া হয়। লেনিনের মতে এসবই ছিল আপতকালীন ব্যবস্থা, অল্প কিছুদিনের জন্য, অস্থায়ী, যা ক্রমশ বাড়ার পরিবর্তে কমে আসবে। স্তালিনের হাত ধরে এই নয়া আর্থিক নীতি, পাশাপাশি এই নীতির ফলে যারা সুবিধাভোগী, তাদেরকে সমাজ থেকে দূর করে দেওয়া হয়। গর্বাচেভের মতে লেনিনের এই নীতিমালা বর্তমান, অর্থাৎ তাঁর আমলে ব্যক্তি-উদ্যোগ ও তার ফলে ব্যক্তিকে আর্থিক সহ অন্যান্য উৎসাহপ্রদানের ভিত্তিতে নির্মিত ব্যবসায়িক নীতিগুলি গঠিত হয়েছে; যা লেনিনের কাছে ছিল এক অস্থায়ী ব্যবস্থা, গর্বাচেভের কাছে সেটিই বিকাশ ও প্রবৃদ্ধির স্থায়ী পথ। সোভিয়েত পার্টির বিংশতি কংগ্রেসে ক্রুশ্চেভ দ্বারা স্তালিনের নিন্দা এবং দ্বাবিংশতি কংগ্রেসে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুসারে মুসোলিয়াম থেকে স্তালিনের মৃতদেহ সরিয়ে ফেলাকে গর্বাচেভ সোভিয়েত সমাজের ইতিবাচক দিকে অগ্রগমনের সঙ্কেত বলে বর্ণনা করেছেন।

যেখানে পশ্চিমি দুনিয়া এবং সোভিয়েত রাশিয়ার অনেক মানুষ ১৯৩০ সালে কৃষির সমবায়িকীকরণকে বলপূর্বক করা বলে বর্ণনা করে থাকেন, সেখানে গর্বাচেভের মতে এই কাজ আসলে “of fundamental importance”। একইরকমভাবে যে দ্রুততায় সোভিয়েত রাষ্ট্র তার শিল্পায়ন সম্পন্ন করেছে, তা নিয়ে সোভিয়েত-বিরোধী এবং সোভিয়েতের সমর্থক, উভয় দলের মানুষদের কাছে প্রচুর প্রশ্ন আছে। কিন্তু গর্বাচেভের মতে এই দ্রুততায় করা শিল্পায়ন আসলে ”raised the country to a fundamentally new level in one heave.”

গর্বাচেভের এই স্ববিরোধী অবস্থান তাঁকে তাঁর নিজের দেশের মানুষদের পাশাপাশি “মুক্ত দুনিয়া”-র যে সব মানুষ সোভিয়েতের যাবতীয় সামাজিক-রাজনৈতিক-আর্থিক নিরীক্ষাগুলি “ইতিহাসের আবর্জনা” বলে মনে করেন এবং করেন না, এই সব দলের মানুষদের কাছেই যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য করে তোলেনি।

গর্বাচেভ সোভিয়েত রাশিয়ার নেতা হিসেবে সেই দেশ পরিচালনা করেছিলেন ১৯৮৫ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত। এই সময়কালে মার্কিন দেশের যে দুজন রাষ্ট্রপতি, রোনাল্ড রেগান ও জর্জ বুশ (বাবা বুশ) পৃথিবীর ভূ-রাজনীতিকে যেভাবে সাজাতে চাইছিলেন, যে কাজটি তাঁর আগের অনেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি করতে সমর্থ হননি কেবলমাত্র সামরিক দিক থেকে সুগঠিত সোভিয়েত রাষ্ট্রের উপস্থিতির কারণে, মিখাইল গর্বাচেভ তাঁর নিজের দেশে লেনিনের মতাদর্শ এবং পশ্চিমি দুনিয়ার “মুক্ত সমাজ”-এর ধারণাকে মেলাতে গিয়ে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে সোভিয়েত রাশিয়া দেশটিকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার অনুষ্ঠানের সভাপতির ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন, মার্কিন রাষ্ট্রপতিদের হয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করলেন।

বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত রাশিয়ার তিনিই একমাত্র রাষ্ট্রীয় কর্ণধার যিনি ভূরাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এককভাবে পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চল থেকে সোভিয়েত সামরিক শক্তি কমিয়ে এনেছেন, সোভিয়েত উপস্থিতি হ্রাস করেছেন উল্লেখযোগ্যভাবে। পূর্ব ইউরোপ সহ পৃথিবীর যে সমস্ত দেশ এবং অঞ্চল সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের অধীনে ছিল, সেই সব দেশ ও অঞ্চলে তিনি সোভিয়েত সামরিক সাহায্য (অস্ত্র ও অন্যান্য) কমিয়ে এনেছেন, সামরিক ও অন্যান্য পরামর্শদাতাদের প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। ব্রেজনেভের আমলে সোভিয়েত রাশিয়া তার নিজের স্বার্থ বজায় রাখার জন্য ঠিক মার্কিন দেশের মতো পরদেশে পুতুল সরকার বসানো থেকে শুরু করে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান সংগঠিত করার চেষ্টা চালিয়ে গেছে। গর্বাচেভ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমঝোতা করে আফগানিস্তান, নিকারাগুয়া, আফ্রিকার অ্যাঙ্গোলা, কাম্বোডিয়া বা পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে উদ্ভূত সঙ্কটের সমাধান করেছেন পিছু হটে এসে।

গর্বাচেভ তৎকালীন পূর্ব জার্মানি থেকে সোভিয়েত ফৌজ সরিয়ে নেওয়া শুরু করেন এবং এক সময়ে বার্লিনের পাঁচিল ভেঙে দুই জার্মানি সংযুক্ত হয়। ১৯৯০ সালে গর্বাচেভ জার্মানির ন্যাটো-ভুক্তিও মেনে নেন, যে কারণে আজকে ইউক্রেন সঙ্কটের মুখে পুতিন গর্বাচেভের নীতিকে দায়ী করছেন। যে লেনিনকে তিনি প্রকাশ্যে গুরু মানতেন, সাম্রাজ্যবাদীদের সঙ্গে আলোচনা টেবিলে তিনি লেনিনের আলোচনার সেই দক্ষতা দেখাতে পারেননি। ফলত তিনি “নেগোশিয়েটর” হিসেবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। ১৯৮৯-৯১ সময়কালে যখন সোভিয়েত রাশিয়ায় মুদ্রাব্যবস্থা ভেঙে পড়তে বসেছে, তখন তিনি ভিক্ষাপাত্র নিয়ে সংযুক্ত জার্মানি ও পরে খোদ মার্কিন মুলুকে কাঁচা টাকার সন্ধানে পাড়ি জমান। সময়টা রাশিয়ার পক্ষে মোটেই অনুকূলে ছিল না। ন্যাটো নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে, অন্যদিকে রাশিয়ার জোরের জায়গা, ওয়ারশ চুক্তিভুক্ত দেশগুলি হীনবল, কার্যত তার আর ন্যাটোর বিপরীত শক্তি হিসেবে কোনও অস্তিত্ব নেই। যে সামরিক শক্তির বলে বলীয়ান হয়ে রাশিয়া অন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পশ্চিমি দেশগুলির সমীহ আদায় করত, গর্বাচেভের নিজের হাতেই তার অন্তর্জলীযাত্রা ঘটেছে। শক্তির ভারসাম্যের পাঞ্জা লড়াইতে মার্কিন দেশ ও তার তাঁবেদারবৃন্দ তখন “ওয়াক-ওভার” পাওয়ার খোঁয়ারে বিভোর। তাঁর ভাগ্যে পশ্চিমি দুনিয়ার লগ্নি জোটেনি। পশ্চিমি আগ্রাসন রাজনীতির ধারক ও বাহক হিসেবে তাঁর নিজের দেশে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী বরিস ইয়েলতসিনের কাছেও তিনি যার-পর-নাই হেনস্থার সম্মুখীন হয়েছেন। গর্বাচেভের হাতে ক্ষমতা ধরে রাখার যে কটি রাস্তা ছিল, তার মধ্যে সবচেয়ে নিশ্চিত রাস্তাটি ছিল সৈন্যবাহিনির সহায়তা নেওয়া, যা ক্রুশ্চেভ গ্রহণ করে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের পরাজিত করেছিলেন, ব্রেজনেভ সরিয়েছিলেন ক্রুশ্চেভকে। কিন্তু গর্বাচেভ সেই পথে হাঁটেননি, যদিও পরবর্তী ঘটনা দেখিয়েছে যে সৈন্যবাহিনি তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল!

অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে গর্বাচেভের “সংস্কার”-এর ফল হয়েছিল আক্ষরিক অর্থেই বিষময়। আর্থিক সংস্কার সারা দেশ জুড়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অবাধ লুণ্ঠনের জন্ম দেয়। জারের সময়কাল থেকে যে সুপুষ্ট আমলাতন্ত্র রাশিয়ার বুকে জাঁকিয়ে বসেছিল, দুর্ভাগ্যক্রমে সেই আমলাতন্ত্রের মূল স্তম্ভগুলি সোভিয়েত আমলে আরও দৃঢ়, আরও মজবুত এবং আরও সর্বত্রগামী হয়ে পড়ে। এই এলিটবৃন্দের সন্তানসন্ততিরা গর্বাচেভ-নির্দেশিত “সংস্কার”-এর যাবতীয় ফল কুক্ষিগত করে নেয়, কেননা পার্টির যুব সংগঠন, কমসোমল, তার উচ্চকোটির নেতা ও কর্মীরা ব্যবসা ফেঁদে বসে। তারা সোভিয়েতের সম্পদ আইনত বিক্রি করা শুরু করে। প্রথমে দেশের মধ্যে, তারপর দেশের বাইরে। এইভাবে একটি দ্বিতীয় এবং প্রায় সমান্তরাল ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। যাদের হাতে বিভিন্ন সংস্থার অর্থ ও সম্পত্তির খাতাপত্র ছিল, তারা ঋণ দেওয়ার বা স্রেফ সুদ-বন্দকি কারবার ফেঁদে বসে। আর কে না জানে, যেখানেই সঙ্কট, সেখানেই মহাজনী-সুদখোরী ব্যবসার রমরমা!

রাশিয়ার বস্তুত তাই-ই ঘটেছে। ১৯৮৯ সালে দেখা যাচ্ছে যে সেদেশের ৪ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষের মাসিক আয় দাঁড়িয়েছিল ৭৫ রুবল-এ, যেখানে সরকারি মতে দারিদ্র্যসীমা ছিল মাসে ২০০ রুবল খরচের অক্ষমতা! পশ্চিমি গবেষক জন এলিয়ট লিখেছিলেন যে গর্বাচেভ-জমানার বৈশিষ্ট্য ছিল, “deteriorating quality and unavailability of goods, proliferation of special distribution channels, longer and more time-consuming lines, extended rationing, higher prices … virtual stagnation in the provision of health and education, and the growth of barter, regional autarky, and local protectionism.”

সরকারি মতে ১৯৯০ সালে নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যা ছিল ৪০ লক্ষ, আদতে সংখ্যাটা নিশ্চিতভাবেই আরও অনেক বেশি হওয়ার কথা। অর্থনীতিবিদদের মতে সংখ্যাটি ২ কোটির আশপাশে। এই সব তথ্য ঘেঁটে এলিয়টের মন্তব্য, “With masses of people shipwrecked, alcoholism, drug use and deaths of despair all exploded during the years to come.”

১৯৮৯ সালে অর্থনীতিবিদ আর্নস্ট মেন্ডেল, তাঁর গ্রন্থ “বিয়ন্ড পেরেস্ত্রৈকা”-তে লিখেছিলেন, “From the viewpoint of the Soviet working people and the world proletariat, Gorbachev would today be the best solution for the USSR. Just that year alone, according to official data, the USSR lost 7.3 million working days to strike action, largely driven by mass unrest in the mines. During just the first nine months of the following year, that number rose to 13.7 million.”

আজকের রাশিয়ার পুতিন হলেন গর্বাচেভের পেরেস্ত্রৈকা-র ফসল। গর্বাচেভ ছিলেন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিতে ইউরি আন্দ্রোপভ-এর গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত, যে ইউরি আবার ছিলেন কেজিবি-র প্রাক্তন প্রধান। অন্যদিকে ভ্লাদিমির পুতিন এই সেদিন পর্যন্ত ছিলেন কেজিবি-র প্রধান। আমলাতন্ত্রের যে ঊর্ণজালের কথা কতদিন আগে ম্যাক্সিম গোর্কি তাঁর পৃথিবীর পাঠশালায় লিখে গিয়েছিলেন, বিপ্লবোত্তর রাশিয়ায় অনেক ইতিবাচক অর্জনের পরও সেই আমলাতন্ত্র, জারের আমলের গুপ্ত পুলিশ ও তাদের সন্ত্রাস, পাশাপাশি সমাজে তাদের উচ্চ থেকে উচ্চতর কোটিতে আরোহণ, তা প্রায় পুরোমাত্রায় অব্যাহত ছিল। গর্বাচেভ কী করতে চেয়েছিলেন তা জানাবোঝার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল তিনি কী করে গিয়েছেন। তিনি যা করেছেন, তার মূল্য চোকাচ্ছেন অনেক শ্রম, রক্ত, ঘামের বিনিময়ে যে বিপ্লবের সন্তানেরা দুনিয়ার বুকে যে বাস্তবে সমাজতন্ত্রের দিকে যাত্রা করা সম্ভব, তার উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন, তাঁরা।

শেষ পর্যন্ত, ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর, সারা পৃথিবীর খৃশ্চান দুনিয়া যখন যিশুর প্রেমের বাণী বিতরণ করছে এবং পৃথিবীর এক-পঞ্চমাংশ অংশে বিভিন্ন মাত্রার যুদ্ধে লিপ্ত, তখন মিখাইল গর্বাচেভ টেলিভিশনে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘোষণা করেন। গর্বাচেভের মৃত্যুর পর যে নিষ্ঠুর সত্যটি ইতিহাসের বুকে লেখা হয়ে থাকল তা মোটেই তাঁর “সংস্কার”, “গ্লাসনস্ত”, “পেরেস্ত্রৈকা” বা নিউক্লিয়ার অস্ত্র কমানোর আকুল প্রচেষ্টা নয়, পড়ে থাকল রক্ত-লাঞ্ছিত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের রিপাবলিকগুলো— চেচনিয়া, আর্মেনিয়া, আজারবাইজান আর আজকের যুদ্ধ-বিধ্বস্ত ইউক্রেন। যে পশ্চিমি কূটনীতিকবৃন্দ সোভিয়েত রাশিয়ায় “মুক্ত দুনিয়া”-র “সুবাস” ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য গর্বাচেভকে বাহবা দিচ্ছেন, তাঁরাই আজ এই সোভিয়েত-“মুক্ত” রাশিয়ায় আগ্রাসন চালানোর যাবতীয় কলাকৌশল নিচ্ছেন, সেই হিটলারের কায়দায় ন্যাটো-র মাধ্যমে এক নতুন “লেবেনস্রাম”-এর খোঁজে উদ্বেল হয়ে উঠেছেন। এটাই ইতিহাসের বিরাট ট্র্যাজেডি।