Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

তিনটি অণুগল্প

প্রদীপ ঘটক

 

ওহে গল্পকার

…অবশেষে বাধ্য হয়ে বিবাহের সিদ্ধান্ত নিলাম।

এভাবেই গল্পটা শেষ হয়েছিল।

ফেসবুক জুড়ে হইচই চঞ্চল মুখার্জি বিয়ে করছেন। যেন চঞ্চল মুখার্জি বিয়ে করেননি বলে তাঁদের বিয়ে বা অন্যান্য কাজ থমকে ছিল।

কয়েক মাস পর একটা সাহিত্যসভা। অগ্রজ এক সাহিত্যিক গলা বাড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে শুধালেন— শুনলুম তোর বিয়ে! অবশেষে করলি? করলিই যখন যৌবনটা…।

আরেকজন বললেন— বুড়ো বয়সের সন্তান শক্তিশালী হয়।

আরেকজন— আহা! এতদিন একা একা কাটিয়েছে, বউয়ের খুব আদর হবে।

সাহিত্যসভা যেন চঞ্চলবাবুর বাসরঘর হয়ে উঠল।

হাসি ছাড়া কী আর উপায়! এরপর চঞ্চল মুখার্জি যাই-ই পোস্ট করেন উঠে আসে তাঁর বিয়ে প্রসঙ্গ, আর ফুটেজ আলাস্কা ছোঁয়।

ইনবক্স মেসেজে ভর্তি। নারীকণ্ঠের হতাশা “আমি তো অনেক আগেই বলেছিলাম তোমাকে… উপেক্ষিতা রয়ে গেলাম” বা “যাঁকে সহধর্মিনী করতে যাচ্ছেন, আমি কি তাঁর চেয়ে কোনও অংশ কম ছিলাম?” ইত্যাদি ইত্যাদি। প্রতিটি মেসেজের বুকে দীর্ঘশ্বাসের শব্দ চঞ্চলকুমার যেন অনুভব করেন।

সব কিছুর সীমা আছে। হাসি-মজাও একসময় তেতো হয়ে ওঠে।

একদিন বাড়িতে হাজির স্কুলজীবনের সহপাঠিনী, চঞ্চলকুমারের একসময়ের ভালবাসা, শ্রীময়ী। সময় গড়িয়েছে, বিবাহ করেছেন, ভরা সংসার, দুই সন্তানের জননী, নাতনির ঠাকুমাও। কিন্তু চঞ্চলের প্রতি একটা দুর্বলতা রয়েই গেছে।

অভিমানী কণ্ঠে বলেন— তাহলে দুর্ঘটনায় তুই কিছুই হারাসনি? আমাকে মিথ্যা বলেছিলি?

তারপর সপাটে গালে একটা চড়।

 

বন্ধু

–আমাকে নেবে না?

ইনবক্সে আসা মেসেজটার মধ্যে একটা অন্যরকম আকুতি ছিল।

–তুমি ছেলে না মেয়ে? তোমার আসল নাম কী? তোমার পিপি না পেলে নয়।
–নামে কী আসে যায় কবি? আমার ছবি যে দেখাবার মতো নয়।
–কেন, তুমি কি দেখতে কুৎসিত? মানুষ কখনও কুৎসিত হয় বলে আমি বিশ্বাস করি না। তুমি প্রোফাইলে তোমার ছবি দিলে তবেই নেব।

জবাব দিয়ে মোবাইল অফ করি।

পরদিন সকালে মেসেজবক্সে দেখি তার মেসেজ— কিন্তু কবি, আমি যে তোমার কবিতার প্রেমে পড়েছি?

পাঠক/পাঠিকায় বড় লোভ কবির। তাই লিখলাম— ফলো করো।

–তাই তো এতদিন করেছি। কিন্তু আমার ভাললাগা তোমার কাছে পৌঁছাবে কী করে? তোমার অডিয়েন্স যে ফ্রেন্ডদের জন্য শুধু। আমি তাই কিছুই বলতে পারি না কবি! অডিয়েন্সটা পাবলিক করবে?

এমন পাঠক/পাঠিকাকে কি দূরে রাখা যায়?

টাইমলাইন ঘুরে এলাম। বেশ ভাল লেখে সে-ও। কিন্তু সবই বিষাদের কবিতা।

জিজ্ঞাসা করেছিলাম, শুধু হেসেছিল।

হাসিটা কেমন যেন ম্লান ছিল, তা তার পাঠানো মেসেজের অক্ষরেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম।

প্রতিদিন গুড মর্নিং আর গুড নাইট পাঠাতে ক্লান্তি গ্রাস করত না তাকে। আমার প্রতিটা কবিতায় তার কমেন্ট থাকত। গঠনমূলক সমালোচনা করত। আমিও শিখতাম তার কাছে।

রাতের নিস্তব্ধতায় একদিন চেয়ে বসলাম সেলফি।

সে বলল— আমাকে দেখলে তোমার কষ্ট হবে।

আমি বললাম— তবু দেখতে চাই।

সে সেলফি দিল, আমি চমকে উঠলাম।

জিজ্ঞাসা করলাম— কেন এমন?

সে শুধু হাসল।

প্রতিদিনের গুড মর্নিং আর গুড নাইট-এর মেসেজ আমার বিরক্তি আনত মাঝেমাঝেই। নামটা ইগনোর করলাম।

অনেকদিন কমেন্ট নেই, মেসেজবক্স খুলিনি। হঠাৎই একদিন মনে কুচিন্তা এল।

নিউ মেসেজ রিকুয়েস্ট খুলতেই একগাদা গুড মর্নিং আর গুড নাইট-এর মাঝে দুটো মেসেজ—

“যেদিন সবুজ আলো জ্বলবে না সেদিন জানবে আমি নেই”

আর

“আসি বন্ধু।”

চোখে ভেসে উঠল সেলফিটা, ন্যাড়া মাথা, যন্ত্রণাক্লিষ্ট একটা মুখ।

 

সেলফি

সন্দেহটা শুরু হয়েছিল বাড়ি থেকে বেরোনোর পর।

বাড়ি-গলিপথ-বড় রাস্তা, একই অনুভূতি।

ভিড়ে ঠাসা বাজারে অনুভূতিটা মনে আসেনি। ওভারব্রিজে ওঠার আগের মুহূর্তে শরীরের সমস্ত জোর এক করে ইন্দ্র ঘুরে তাকাল।

কেউ নেই, অচেনা মুখের আনাগোনা। দৌড়চ্ছে সব, এখনই এসে পড়বে বর্ধমান-হাওড়া ডাউন লোক্যাল।

ইন্দ্র পা পাড়ায়। ওদের গ্যাংটা পাঁচ নম্বরে ওঠে। ট্রেন ঢুকতেই পরমদা জানালা দিয়ে হাঁক দিল— ইন্দ্র ও ও ও।

ভিড় ট্রেনে সেও পা দিল কি? ইন্দ্র সহচরদের কাছে এগিয়ে যায়। তাসের আসর বসেছে। দু-তিনটে স্টেশন, তাই ইন্দ্র আর বসে না, তাসে উঁকি মেরেই কাটিয়ে দেয়।

হাওড়া স্টেশন জনসমুদ্র। তবু তার উপস্থিতি টের পায় ইন্দ্র। সাবওয়েতেও সে।

এগারো নম্বর গেট দিয়ে বেরিয়ে সামনের বিহারি ছেলেটার কাছে একটা সিগারেট কেনে। নটা পঞ্চাশ এখনও বাজেনি। বেহালার স্টেট গাড়িটা আরেকটু দেরিতে ছাড়বে। পিছনে কি খসখসে আওয়াজ? ইন্দ্র আবার পিছন ফেরে। না তো, কেউ তো নেই।

অফিসে আনমনা থাকার জন্য কয়েকটা তির্যক উড়ে এল। “ইন্দ্রদা, কী ব্যাপার, রাতটা কি বৌদির সঙ্গে জেগেই কাটিয়েছ নাকি?” “না রে, ফেসবুকে বান্ধবী জুটেছে”… ইত্যাদি।

ইন্দ্রের হঠাৎ মনে পড়ে যায় গত রাতে মেসেঞ্জারের সেই বান্ধবীর কথা। টিফিনটাইমে মেসেঞ্জার খোলে। বান্ধবীর অভিমানী মেসেজ একের পর এক। ইন্দ্র অভিমান দূর করে একটা প্রমিস করে।

বাড়ি ফেরার সময়ও মনে হয়েছে, পিছনে কেউ আছে। উত্তরপাড়া স্টেশনে নেমে সে যেন স্পষ্ট দেখতে পায় সেই কুৎসিতদর্শন রূপটা।

একটা খিচখিচানি মনের  ভিতর। তবু সব উপেক্ষা করে বাড়ি ফেরে। স্নান-টিফিন করে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে। বান্ধবীর দাবি মত তার লোমশ দেহের সেলফি তুলতে হবে।

টাইম সেটিং করে মোবাইলটা টেবিলে রাখে। মোবাইলে নিজের দেহটাকে সেট করে।

‘ক্যাঁওচ’ শব্দ করে সেলফি ওঠে নির্দিষ্ট সময়ের পর।

কিন্তু একি! সেলফিতে তো তার ছবি, সারাদিন ইন্দ্রকে ফলো করেছে যে।