Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

মুল্লান পায়াল ও এক আগ্রাসনের আখ্যান

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 

ওই বাজিল ঘন্টা

মাথার কাছে রাখা মুঠোফোনের অ্যালার্ম বেজে উঠতেই তড়াক করে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে মাধবন। সকালে ওঠাটা তার বহুদিনের অভ্যাস। ট্রান্সপোর্ট কোম্পানিতে চাকরি নেওয়ার পর পুরনো অভ্যাসেই আরও যেন বেশি করে ধাতস্থ হয়ে পড়েছে সে। ভোরের আকাশ, বাতাস, হালকা আলো-আঁধারির রহস্যময় আভাস, রাতঘুম ভেঙে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে জেগে ওঠা পাখপাখালির কিচিরমিচির— এ-সবই ভীষণভাবে টানে মাধবনকে। আর এখন তো ডিউটির তাড়া। ব্যস্ত শরীরে স্বামীকে উঠতে দেখে পাশে শোয়া প্রিয়াম্মাও উঠে পড়ে। মাত্র মাস কয়েক বয়স হল প্রিয়াম্মার সংসারের। কিন্তু এই ক-মাসেই একটা অলিখিত রুটিনে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে। এখন তাকে উঠে দু কাপ কফি বানাতে হবে। এক পেয়ালা মাধবনের জন্য, আর অন্য পেয়ালা নিজের জন্য। সঙ্গে থাকে মুরুক্কু। আজও সেই বাঁধা রুটিনের পাট চুকিয়ে মাধবন বেরিয়ে পড়ে।

 

চলো, বেরিয়ে পড়ি…

বাড়ি থেকে সামান্য তফাতেই শাখতান থাম্বুরাই বাস ডিপো। এইটি শুধুমাত্র ত্রিচুরের সবচেয়ে বড় বেসরকারি বাসের ডিপো নয়, গোটা রাজ্যের মধ্যেই বৃহত্তম। সারাদিনরাত কত বাস যে এখানে আসছে-যাচ্ছে তার খবর মাধবনের জানা নেই। এমন কাকভোরেও অগণিত মানুষের আনাগোনায় গমগম করছে থাম্বুরাইয়ের বাস-আড্ডা। আজ তাকে কোঝিকোড়ে যেতে হবে। সেখানে নাকি কীসব আজব ঘটনা ঘটেছে ওখানকার এক অনামা অখ্যাত নদীতে। আর তা দেখতেই ভিড় জমাচ্ছে হাজার হাজার পর্যটক। মাধবন জানে তার রাজ্যে সারা বছর ধরেই দেশবিদেশের পর্যটকদের আনাগোনা লেগেই আছে— ঈশ্বরের আপন দেশ বলে কথা! ইলাইয়া রাজার একটা গানের সুর গুনগুন করে ভাজতে ভাজতে মাধবন বাসস্ট্যান্ডের প্রভাতী ভিড়ে মিশে যায়। সম্ভাব্য আমদানির খবরে মন ভরে ওঠে।

 

মুল্লান পায়াল— একটি ফুল

মাধবনের রাজ্যের লোকেরা ফুলটিকে ডাকে মুল্লান পায়াল নামে। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় গোলাপী রঙের এই ফুলটির নাম Cabomba furcata। দ্রুত বংশবিস্তারের মাধ্যমে এলাকা দখলকারী এই জলজ উদ্ভিদটিকে ফর্কড ফ্যানওয়ার্ড নামেই সাধারণত ডাকা হয়। Cabombaceae গোত্রের এই জলজ উদ্ভিদটির আদি নিবাস সুদূর মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায়। প্রধানত অ্যাকোয়ারিয়াম সজ্জায় এই জলজ উদ্ভিদটিকে ব্যবহার করা হয়, এবং সম্ভবত সেই সূত্রেই এটি ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে, নানা দেশে। হয়তো এইভাবেই মুল্লান পায়াল এসে পৌঁছয় ভারতের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তসীমায় অবস্থিত আরব সাগরের তীরবর্তী কেরলে। প্রায় ৩০-৮০ সেমি উচ্চতাবিশিষ্ট এই উদ্ভিদটি বেশ ঝোপালো চেহারার পাতাযুক্ত হয়ে থাকে। অভিবাসন ক্ষেত্র হিসেবে ফর্কড ফ্যানওয়ার্ডের প্রথম পছন্দের বাসভূমি হল পুকুর, হ্রদ, প্লাবনক্ষেত্র সহ ধীর-প্রবাহী নদী। আর এমনই অবস্থার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে মুল্লান পায়াল তার গোলাপী সাম্রাজ্য দ্রুত বিস্তার করেছে ঈশ্বরের আপন দেশ কেরলে।

মাধবনের গাড়ি পেরামব্রা পৌঁছতেই বাসযাত্রীরা সকলে ব্যস্ত পায়ে হইহই করে নেমে যায়। রাস্তায় বিপুল মানুষের জমজমাট ভিড়ে শ্লথ হয়ে আসে গাড়ির গতি। এই সময়ে খুব সতর্ক হয়ে গাড়ি চালাতে হয়। সে-কথা মাধবন বিলক্ষণ জানে। প্রায় খালি হয়ে যাওয়া গাড়িতে বেশ কিছু শহরগামী নতুন যাত্রী উঠিয়ে নিয়ে কোঝিকোড়ের দিকে ছোটে মাধবনের গাড়ি। লোকজনের এমন ভিড় দেখে প্রিয়াম্মার কথা মনে পড়ে তার।

 

গাঁয়ের নামটি আভালাপান্ডি

গাঁয়ের নাম আভালাপান্ডি। কেরলের কোঝিকোড় জেলার এক শান্ত, সবুজ কৃষিগ্রাম। এই গ্রামই আজ আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কারণ? মুল্লান পায়াল, ফর্কড ফ্যানওয়ার্ড। গ্রামের মধ্যে দিয়ে তির তির করে বয়ে যাওয়া আভালাপান্ডি নদীর যতদূর পর্যন্ত নজর যায় ততদূর গোলাপি, মখমলি ফুলেল কার্পেটে ঢাকা। এক অনির্বচনীয় দৃশ্যপট। অতিমারিকালে এই তল্লাটে তেমনভাবে লোকজনের পা পড়েনি। আর সেই নিভৃত ব্যস্ততাহীন সময়কালে ধীরে ধীরে নিজের সাম্রাজ্য বাড়িয়ে গেছে এই আগ্রাসী জলজ উদ্ভিদেরা। আর আজ, পরিণতির কাল পূর্ণ হতেই গোলাপী ফুলের পুষ্পকেতন উড়িয়ে যেন সদম্ভে ঘোষণা করছে— এসো, দেখো, কেমন আশ্চর্য রঙে ভরিয়ে তুলেছি অচেনা অজানা আভালাপান্ডির ক্ষীণপ্রবাহী স্রোতস্বিনীকে!

এমন একটা বিষয় এবার আর লোকজনের নজর এড়ায়নি। হাতে ধরা মুঠোফোনের ক্যামেরা বারংবার ঝলসে উঠেছে মুল্লান পায়ালের এই অপরূপ দৃশ্যপট ক্যামেরাবন্দি করে দূরদূরান্তের উন্মুখ দর্শকদের কাছে পৌঁছে দিতে। যেমন ভাবা তেমনই কাজ। নেটপথে এই বার্তা রটি গেল ক্রমে— কেরলের নদী এখন গোলাপী।

 

একটি টুইট— এ নদী আশানদী

গোলাপী রঙের নদীর ছবি আন্তর্জালের মাধ্যমে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়তেই লাইক, কমেন্ট আর শেয়ারের বন্যায় ভেসে যায় সোশাল মিডিয়া। প্রখ্যাত উদ্যোগপতি মাহিন্দ্রা গ্রুপের চেয়ারম্যান আনন্দ মাহিন্দ্রা উচ্ছ্বসিত হয়ে টুইট করেন—

“বিপুল সংখ্যাক পর্যটক কোঝিকোড়ের আভালাপান্ডিতে ভিড় করেছেন— এমন খবর শুনে আমি বিন্দুমাত্র অবাক হইনি। আভালাপান্ডির অপরূপ দৃশ্যপট আমার উৎসাহ ও আশাবাদকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন থেকে এই আশ্চর্য রঙিন ফুলেল ছবিটাকে আমি আমার স্ক্রিনে সংরক্ষণ করে রাখব ‘রিভার অফ হোপ’ বা ‘আশানদী’ শিরোনাম দিয়ে।”

এমন উচ্ছ্বাসভরা টুইট এই প্রথম তেমন কিন্তু মোটেই নয়। বহু মানুষ অগণিত মুল্লান পায়ালে ঢাকা নদীর ছবি পাঠিয়ে ভরিয়ে তুলেছে সামাজিক সংযোগমাধ্যমের ক্ষেত্রগুলিকে। কেরলের নানা প্রান্ত নানা সময়ে এই আশ্চর্য জলজ উদ্ভিদের আগ্রাসনে আক্রান্ত হয়েছে। তবে সেইসব আক্রমণের খবর নিয়ে দেশ জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আমজনতার আগ্রহ ছিল অনেক কম। কিন্তু এবার যেন সব হিসেব ওলটপালট হয়ে গেছে। আনন্দ মাহিন্দ্রা যে দৃশ্য দেখে এমন আবেগঘন টুইট করেছেন সেই দৃশ্যটি সত্যিসত্যিই কতটা আনন্দদায়ক সে বিতর্কে যাওয়ার আগে আমরা ঈশ্বরের আপন দেশের আর এক আশ্চর্য ফুলকথা এই অবসরে শুনে নিই।

 

আমি বনফুল গো…

আমার নাম…। বিজ্ঞানীরা আমাকে আদর করে ডাকেন Strobilanthes kunthianus বলেন। ঈশ্বরের আপন দেশেই আমার অধিষ্ঠান। আজ যেমন কোঝিকোড়ের আভালাপান্ডিতে বহু মানুষের ভিড় ভেঙে পড়েছে, ঠিক একইরকমভাবে চার বছর আগে ২০১৮ সালে আমাদের দেখার জন্য সারা পৃথিবীর মানুষ এসে ভিড় করেছিল দক্ষিণের এই ছোট্ট রাজ্যে। আর তোমরা আসবে শুনে মুন্নারের বুক জুড়ে থাকা এরাভিকুলাম জাতীয় উদ্যানের পাহাড়ি ঢালের বুকে খিলখিলিয়ে হেসে উঠেছিলাম আমরা। তোমরা যেমন উৎসবের সময় নতুন নতুন জামাকাপড়ের বর্ণিল শোভায় নিজেদের সাজিয়ে তোলো, ঠিক তেমনি যে আমরা প্রতি বারো বছর অন্তর নীলগিরি পাহাড়ের হরিৎ অঙ্গবাস বদলে নীল পোশাক পরিয়ে দিই। গোটা উপত্যকা জুড়ে তখন আশ্চর্য নীল রঙের মায়াবি সমারোহ। সমগ্র নীলগিরি পর্বত এই নীলোৎসবে মেতে ওঠে আশ্চর্য আনন্দে। সারা পৃথিবীতে আমাদের প্রায় ২৫০ প্রজাতির দেখা মেলে, তবে তার মধ্যে ৪৬টি প্রজাতির দেখা পাওয়া যায় দক্ষিণের রাজ্য কেরল ও কর্নাটকে। এই পৃথিবীতে আমাদের আয়ুষ্কাল মাত্র কয়েকটি মাস। তারপর আমরা অন্তরালে চলে যাই বারো বছরের জন্য। তাই আমাদের এই খুশিভরা উছল মুখগুলোকে দেখতে হলে তোমাদের দীর্ঘ বারো বছর অপেক্ষা করতে হবে। তার মানে আবার আমরা ফিরে আসব ২০৩০ সালে। অনেকটা লম্বা সময়, তাই না? কী করব বলো? ভাল কিছুর জন্য তো একটু অপেক্ষা করতেই হবে। আজ চলি। এই দেখো! আমার খুব চেনা নামটাই যে তোমাদের বলা হয়নি! এই নাও আমার ভিজিটিং কার্ড। এখানে আমার নাম, ধাম, দেখা করার সময় সব দেওয়া আছে—

নীলাকুরুঞ্জি ওরফে গার্গী
নীলগিরি পর্বত, কেরল
২০৩০ সাল, জুলাই-আগস্ট মাস

সায়ানারা। পৃথিবীকে ভাল রেখো…

 

রূপে তোমার ভুলছি না গো…

আসুন, নীলগিরি পাহাড়ের ঢাল বেয়ে সন্তর্পণে নেমে এসে মুন্নারের এই কাফেটেরিয়ায় বসে আমরা বরং কিছু গুরুগম্ভীর আলোচনা করে নিই। কলকাতায় থাকলে অবশ্য চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের ভিড়ে ঠাসা বেঞ্চে বসে চায়ের পেয়ালায় দুরন্ত তুফান তুলে তর্ক করা যেত। তবে এখানে কফিই হল প্রথম পছন্দ, তাই কফির পেয়ালাই আমাদের ভরসা।

আনন্দ মাহিন্দ্রা গোলাপী নদীর অপরূপ দৃশ্যশোভায় বিমোহিত হয়ে কবুল করেছেন— তোমায় হৃদমাঝারে রাখব, ভুলে যাব না। যে কোনও সুন্দরতার এমনতর প্রশংসাই কাম্য। আভালাপান্ডির নদীশোভা যে কোনও মানুষের মনকে ছুঁয়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু এর পাশাপাশি কতগুলো প্রশ্নও উঠে আসছে মুল্লান পায়ালকে ঘিরে। যা চকচক করে তা-ই যেমন সোনা নয়, তেমনই গোলাপী ফুলের এই অপরূপতার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কিছু অনিবার্য আশঙ্কাও। আর এই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন আমার-আপনার মতো কোনও আমআদমি নয়, প্রশ্ন উঠেছে নিবিড় নিমগ্ন গবেষণায় যুক্ত বিজ্ঞানীদের পক্ষ থেকে। কী বলছেন তাঁরা মুল্লান পায়াল বা ফর্কড ফ্যানওয়ার্ড সম্পর্কে? কই, নীলাকুরুঞ্জির দিকে তো কেউ এভাবে আঙুল তোলেনি!

আসলে গলদটা তো বিসমিল্লাতেই! কেন বলছি এ-কথা? মনে রাখতে হবে এই প্রাথমিক সত্যটাকে যে, মুল্লান পায়াল বা ফর্কড ফ্যানওয়ার্ড আমাদের দেশে সম্পূর্ণভাবে বহিরাগত। সুদূর দক্ষিণ আমেরিকার একটি উদ্ভিদ, ঠিক যেন উড়ে এসে জুড়ে বসেছে আমাদের ভুঁইতে… থুড়ি, জলেতে। এদেশের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে যেটুকু সময়ের অপেক্ষা, আর তারপরই ‘পোহালে শবরী, মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে’! এইবেলা ‘কেরল ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট’-এর বিজ্ঞানীরা এ-প্রসঙ্গে কী বলছেন তা একটু শুনে নেওয়া যাক—

“কোনও জৈব প্রজাতিকে তার একান্ত নিজস্ব প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে তুলে এনে যদি নতুন কোনও পরিবেশে পুনঃসংস্থাপন করা হয়, তাহলে তা অভিবাসন-ক্ষেত্রের জীববৈচিত্র, বাস্তুতান্ত্রিক ক্রিয়াশীলতা, স্বাস্থ্য এবং মানবীয় ব্যবস্থাপনার ওপর এক গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে এই নতুন প্রজাতির উপকরণটিকে ‘ইনভেসিভ অ্যালিয়েন’ প্রজাতি হিসেবে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ এই নতুন প্রজাতির জৈবনিক কার্যকলাপের ফলে অভিবাসনক্ষেত্রের পরিবেশের বাস্তুগত ভারসাম্যের বড় রকমের বিপর্যয় ঘটে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, এই বহিরাগত প্রজাতির প্রাণী বা উদ্ভিদেরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিজেদের বংশবিস্তার করে ফলে টান পড়ে স্থানীয় প্রজাতিদের খাদ্য, পানীয় এবং বাসস্থানের পর্যাপ্ত জোগানে। এভাবে অচিরেই স্থানীয়রা আত্মসমর্পণ করে আক্রমণাত্মক বহিরাগতদের কাছে। পরিণতিতে বাস্তুসংস্থানের বৈশ্বিক ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বলা বাহুল্য এই ক্ষতি এক কথায় অপূরণীয়।”

এই নিবন্ধের শিরোনামে থাকা মুল্লান পায়াল এই দোষে দোষী। আমরা মুল্লান পায়ালের রূপে মুগ্ধ হয়েছি, কিন্তু আমাদের অলক্ষ্যে এই বহিরাগত অ্যালিয়েন ইনভেসিভ প্রজাতির উদ্ভিদটি দেশীয় জলজ বাস্তু-ভারসাম্যে বড় বিপর্যয় আনতে চলেছে। এমনই আশঙ্কা প্রকাশ পেয়েছে কেএফআরআই-এর বিজ্ঞানীদের কথায়।

 

তো প্রথম নয়… নয় গো…

মুল্লান পায়ালের গোলাপী শোভার সঙ্গে কেরলবাসীর সখ্যতা অনেকদিনের। এই রাজ্যের দখিনদুয়ার দিয়ে বহু বহিরাগতর অনুপ্রবেশ ঘটেছে অতীতে (সার্স কোভিড-১৯ ভাইরাস এর নবতম সংযোজন)। ১৯৫২ সালে সর্বপ্রথম ক্যাবোম্বার উপস্থিতির কথা নথিভুক্ত করা হয়। পরবর্তীকালে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৫ ও ১৯৬৬ সালে এই উদ্ভিদের ভ্রূণ-সংক্রান্ত গবেষণা করা হয় বিস্তারিতভাবে। এর ঠিক এক দশক পরে ১৯৭৭ সালে এই আগ্রাসী উদ্ভিদের খোঁজ মেলে রাজ্যের কোচি অঞ্চলে।

পরবর্তীকালে ২০০৩ সালে কেরলের আলুভা অঞ্চলের এল্লুর এবং থট্টুমুগাম শিল্পশহরের প্রায় ১৩ কিলোমিটার অঞ্চল জুড়ে এই আগ্রাসী জলজ উদ্ভিদের সন্ধান পাওয়া যায়। এখানেই শেষ নয়, মুল্লান পায়ালের জলাভূমি জবরদখলের খবর পাওয়া যায় এর্নাকুলাম, কোট্টায়াম, আলাপুঝা এবং পাথানামথিট্টা জেলার নানা অংশ থেকে। নয়নাভিরাম ফুলেল শোভায় মানুষজনকে বিভ্রান্ত করে এই জলজ উদ্ভিদটি তার সাম্রাজ্য বিস্তার করতে থাকে অপ্রতিহত গতিতে। ২০০৩-১৩-র মধ্যবর্তী দশকে কোল জলাভূমি সহ ত্রিচুর জেলার পুঝাক্কাল নদীর বুক জুড়ে গোলাপী আগ্রাসন জারি থাকে। এর ফলে স্থানীয় বাস্তুভারসাম্যের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

কেরলে বিভিন্ন জৈব প্রজাতির আগ্রাসনের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। উনিশ শতক থেকেই নানা সূত্রে বিজাতীয় উদ্ভিদ ও প্রাণী এই রাজ্যে অনুপ্রবেশ করছে। বলা বাহুল্য এই বহিরাগত অনুপ্রবেশের ঘটনা আজও সমানভাবে চলছে— সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে।

আক্ষেপ করেছেন কেএফআরআই-এর বিজ্ঞানী সজীব। তাঁর মতে কেবল জলভাগেই এমন অনুপ্রবেশের ঘটনা সীমায়িত রয়েছে তেমন নয়। স্থলভাগের বাস্তুপরিবেশের ওপরেও বারংবার বহিরাগত উদ্ভিদ ও প্রাণীরা আক্রমণ শানিয়েছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বন মটমটিয়া (Chromoleanaodorata, আদি নিবাস উত্তর আমেরিকা), পুটুস (Lantena Camara, আদি নিবাস ক্রান্তীয় আমেরিকা), জাপানি লতা (Mikaniamicrantha, আদি নিবাস আমেরিকা), তেইরাকাটা (Mimosa Diplotricha, আদি নিবাস মেক্সিকো), ভৃঙ্গরাজ (Sphagenticolatrilobata, আদি নিবাস মেক্সিকো), ইত্যাদি উদ্ভিদের কথা উল্লেখ করেন। কেরলের মাটি ছেড়ে এই সব বুনো উদ্ভিদেরা অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করেছে ভারতের প্রায় সমস্ত রাজ্যে। এই সমস্ত ভিনদেশি, ভিন-পরিবেশে বেড়ে ওঠা উদ্ভিদেরা আমাদের বাস্তুসংস্থান ও জীববৈচিত্রকে কতখানি বিশৃঙ্খল, কতখানি রিক্ত করেছে তা নিবিড় গবেষণার অপেক্ষা রাখে। এই সমস্ত উদ্ভিদের নিরন্তর আগ্রাসন আজ গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বাস্তুবিজ্ঞানীদের কাছে। হারিয়ে যাওয়া দেশীয় প্রজাতিগুলির খোঁজ কীভাবে মিলবে তাও আজ বিজ্ঞানীদের মাথাব্যথার বিষয়।

বিজ্ঞানী সজীবের মতে:

বিশ্ব-উষ্ণায়নের ফলে এই সমস্ত আগ্রাসী বুনো উদ্ভিদের দাপট অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। বর্ধিত উষ্ণতার আনুকূল্যকে কাজে লাগিয়ে এই সমস্ত বহিরাগত উদ্ভিদেরা নতুন নতুন ক্ষেত্রে তাদের আধিপত্য বিস্তারের খেলায় মেতে উঠেছে। এদের সঙ্গে সম্মুখ-সংগ্রামে পরাভূত হয়ে দেশীয় প্রজাতির উদ্ভিদেরা ঠাঁই নিচ্ছে অতীতের পাতায়— কালগহ্বরে।

এ এক নিঃশব্দ আগ্রাসনের কাহিনি।

এই আগ্রাসনের ফলে জলাভূমির বাস্তুতন্ত্র বিপর্যস্ত হওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপরে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। নদী থেকে মাছ ধরে যাঁরা রুটিরুজির সংস্থান করতেন, তাঁদের জীবনে নেমে এসেছে গভীর হতাশা। মুল্লান পায়ালের দ্রুত বৃদ্ধির কারণে নদীতে বসবাসকারী মাছেদের অস্তিত্ব আজ সঙ্কটে। এখনই উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আগামী দিনে সমস্যা যে আরও ঘনীভূত হবে তা বলাই বাহুল্য।

 

এখনও কথা আছে…

মুল্লান পায়াল সম্পর্কে এত নিন্দেমন্দ করার পরও কিছু ইতিবাচক সম্ভাবনার কথা শুনিয়েছেন ভেষজ বিজ্ঞানীরা। মুল্লান পায়ালকে নিয়ে বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষার পর তাঁরা এই আগ্রাসী উদ্ভিদের মধ্যে কতগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জৈব-রাসায়নিক যৌগের উপস্থিতির কথা জানিয়েছেন, যাদের ব্যবহার করে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কতগুলো ভেষজ দ্রব্য উৎপাদন করা যেতে পারে। এই উপাদানগুলির মধ্যে রয়েছে ভিটামিন-ই (যা অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট গুণসম্পন্ন), অ্যাজিলাইক অ্যাসিড, হেক্সা-ডেকানোয়িক অ্যাসিড ইত্যাদি। মুল্লান পায়াল এখন আলোচনার কেন্দ্রে। লোহা গরম থাকতে থাকতেই তাকে পেটাতে হয়। আমরা কী করব? সেই সিদ্ধান্ত কিন্তু আমাদেরই নিতে হবে।