Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

বেলা দত্ত প্রসঙ্গে

বেলা দত্ত | রাজনৈতিক কর্মী

মানব চক্রবর্তী

 

 

মানব চক্রবর্তীজলার্কপত্রিকার সম্পাদকঋতাক্ষর প্রকাশন‘-এর কর্ণধার স্বেচ্ছাবসর নিয়েছেন ব্যাঙ্কের চাকরি থেকে তেরো বছর আগে

 

 

 

সরোজকুমার দত্ত বা সরোজ দত্ত নামটির সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৬৯ সালে। আরও একটি নামে লিখে রক্তে আগুন ধরিয়ে দিতেন তিনি; সে-নামটি ‘শশাঙ্ক’, ছদ্মনাম। ‘দেশব্রতী’ পত্রিকায় তাঁর নিয়মিত ফিচার ছিল ‘পত্রিকার দুনিয়ায়’।

সরোজকুমার দত্ত-র অনুবাদ-করা বই ‘শিল্পীর নবজন্ম’। মূল বই রম্যাঁ রলাঁর লেখা, ইংরেজিতে যার নাম ‘I shall not rest’। এই বই আর ‘দেশব্রতী’-র ফিচারগুলো পড়ে সরোজ দত্ত সম্পর্কে ধারণা হয়েছিল যে সত্যি-সত্যি নির্ভীক আদর্শনিষ্ঠ এক বুদ্ধিজীবীই তখনকার বিপ্লবী কর্মপ্রচেষ্টার সাংস্কৃতিক বিষয়গুলোকে পরিচালনা করছেন।

নানান কথা তাঁর সম্বন্ধে শুনতাম বন্ধু আর দাদাদের কাছ থেকে। কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ লেখেন, বিতর্কে পটু, আলোচনায় সরস ও সফল, এই সব। আর একটা কথাও শুনতাম। বিয়ের রাতেই নাকি ভোর থাকতে থাকতে তরুণী বধূকে শয্যায় রেখে সরোজ দত্ত বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন তাঁর কর্মক্ষেত্রে– অমৃতবাজার পত্রিকায় চলতে থাকা ধর্মঘটে যোগ দিতে।

মনে হত, কেমন সেই বউ রে বাবা! বিয়ের মধ্যেও যার বর আন্দোলন করতে বেরিয়ে পড়ে? সরোজ দত্তকে দেখতে ইচ্ছে করত, আর কৌতূহল হত তাঁর স্ত্রীকেও দেখতে।

১৯৭১-এর ৫ আগস্ট সরোজ দত্তকে খুন করা হয় কলকাতার খোলা ময়দানে, এমনিতে এক শান্ত ভোরবেলায়। অতএব, তাঁকে দেখা আর আমার হয়ে ওঠেনি। তাঁর মৃত্যুর খবরটা যে-বাড়িতে বসে অমৃতবাজার পত্রিকাতেই পড়েছিলাম, সেই বাড়িতেই বছর চার-পাঁচ পরে সরোজ দত্তের স্ত্রীকে প্রথম দেখি।

এই চার-পাঁচ বছরে সে-বাড়ির মাসিমা-মেসোমশাইয়ের দু-দু’টি সন্তান প্রদীপ ও প্রবীর পুলিশি নৃশংসতায় মারা যায়। স্বামীহারা বেলা দত্ত দেখা করতে আসেন সন্তানহারা মায়া রায়চৌধুরী ও সদানন্দ রায়চৌধুরীর সঙ্গে। সেদিন সে-বাড়িতে উপস্থিত থাকায় বেলা দত্তের সঙ্গে পরিচয় হয় এবং অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি ‘বেলাদি’ হিসাবে সম্বোধিত হতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন।

বেলাদি এসেছিলেন পুত্রকন্যা-হারা মাসিমা-মেসোমশাইয়ের পাশে দাঁড়াতে, শান্তি জোগাতে। তাঁর স্বামীকে কিন্তু ‘মৃত’ বলে ঘোষণাই করা হয়নি, ময়দানের সেই পুলিশি হত্যার পর থেকেই ‘নিখোঁজ’ বলেই দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

মাসিমা-বেলাদির কথোপকথন থেকে জানতে পারি, একসময় নাকি বেলাদি মাসিমার স্কুলে শিক্ষিকা ছিলেন। যশোরের গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে। কেমন শিক্ষিকা? মাসিমার মুখে শুনেছি, শিক্ষিকা বেলাদি টিফিন-টাইমে ছাত্রীদের সঙ্গে কিত-কিত খেলতেন। দু’জনের সস্মিত কথাবার্তায় উঠে আসে হারানো স্নেহ-সম্বন্ধের কথা। আমি ভাবি নতুন সম্বন্ধ স্থাপনের পিছনকার স্বামী-সন্তান হারানোর হাহাকার।

এই যে ছাত্রীদের সঙ্গে কিত-কিত খেলার মন, এই যে সহজ-উদার-নিরহং স্ফূর্তি বেলাদির মধ্যে লক্ষ করেছিলাম, তা-ই আবার অনেকদিন পরে ফিরে পেয়েছিলাম ওঁর সঙ্গে ডুয়ার্সে বেড়ানোর দিনগুলোতে। মধ্যবর্তী নানান সময়ে টুকরো কথা আর হাসির বিনিময়ে প্রতিটি সাক্ষাৎকারই আমার কাছে হয়ে উঠত বিশেষ আনন্দের ঘটনা।

ডুয়ার্সে গিয়েছিলাম ২০০৫ সালে। ছ-জন। চার ছেলে-বন্ধু আমরা, বেলাদি-সরোজদার ছোট ছেলে যে-দলে একজন। তখন– পঁয়ষট্টির মমতাদি আর বিরাশি বছরের বেলাদি। বেলাদির জিভের খানিকটা তখন ডাক্তাররা কেটে দিয়েছেন ক্যান্সার ঠেকাতে।

সারাক্ষণ হাসিখুশি বেলাদি আমাদের সেই ভ্রমণ জমিয়ে দিয়েছিলেন। বিরাশি বছর বয়সেও শরীর নিয়ে তাঁর কোনও প্যানপ্যানানি নেই, মানিয়ে নিচ্ছেন সবকিছুর সঙ্গে। অসুবিধে-টসুবিধে গ্রাহ্যই করছেন না।

একদিন মনে আছে, গরুমারা এলিফ্যান্ট ক্যাম্পে থাকাকালীন ভোরবেলা বেলাদিকে পাওয়া যাচ্ছে না। আগের দিন রাতেই দলছুট একটা পাগলা হাতি ওই বন-আবাসের সীমানার তারকাঁটার পাশ দিয়ে উদভ্রান্ত দৌড় শুরু করেছিল। কোথাও ঘাপটি মেরে আছে নাকি কে জানে! খোঁজ-টোজ করে পাওয়া গেল যখন, দেখা গেল হাওদা-হীন একটা হাতির পিঠে উঠে বসে আছেন তিনি আর বলছেন, ‘তোমরা যারা যেতে চাও উঠে এসো, মাহুত রাজি হয়েছেন, বন থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবেন।’ রাতের ম্যাক্সিটাই পরে প্রাতঃভ্রমণ করতে বেরিয়ে অফিসের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা করেছেন।

আর একদিনের কথা বলি। বক্সায় গিয়ে ওপরে আর যাব না ঠিক করেছি। ওখানে গিয়ে পৌঁছতেই দেরি হয়ে গেছে, খিদে পেয়েছে যথেষ্ট। পথে কোনও ধাবায় দুপুরের খাওয়া খেয়ে নিতে হবে। একজন নীচের একটা দোকান থেকে ছ’টা আলুভাজার প্যাকেট কিনে বলল, ‘আপাতত এই এক-একটা খেয়ে খিদে মেটাই, ধাবা পেতে কতক্ষণ লাগবে কে জানে।’ বেলাদি গাড়িতে উঠতে উঠতে বললেন, ‘আমি বাবা এখন খাব না এটা। একটু পরেই তো লাঞ্চ হবে। সন্ধেবেলা যখন আমাদের আসর বসবে, তখন ওই দ্রব্যের সঙ্গে যা লাগবে না এই চিপস্!’ সবাই হেসে উঠলাম আমরা বছর বিরাশির ওই তরুণীর কথায়।

তো এই ছিলেন বেলাদি। তেভাগার লড়াকু, সারা জীবনের সংগ্রামী, সরোজ দত্তের জীবনসঙ্গিনী। সমস্তরকম কুসংস্কারমুক্ত, রসিক, স্নেহশীলা এবং দৃঢ়চেতা। বেলাদির বিদায়ে স্নেহ পাওয়ার মতো আরও একজনকে হারালাম।