Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

সমর বাগচি— যাঁর খোঁজা কখনওই শেষ হবে না

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 


একটা কথা তিনি সবসময়ে বলতেন ছাত্র-শিক্ষক দুই পক্ষকেই— খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ। Quest, Quest, Quest. তাঁর বিশ্বাস ছিল গভীর অনুসন্ধিৎসা ছাড়া বিজ্ঞানচেতনা কখনওই পরিপূর্ণতা লাভ করে না

 

আরও এক নক্ষত্রপতন, আরও এক প্রিয়জনের প্রয়াণ, আরও আরও গহীন শূন্যতায় ছোট হয়ে আসে আগলে রাখার, ভালবাসার মানুষজনের পরিবৃত্ত। যে মানুষটিকে উপলক্ষ করে এই কথাগুলো বলছি তিনি, শ্রদ্ধেয় সমর বাগচি, আজ সকালে ৭টা ৪৫ মিনিটে মরলোকের কর্মব্যস্ততার পাট চুকিয়ে দূর অচিনলোকের পথে পাড়ি দিলেন। বয়স হয়েছিল ৯১ বছর। যথেষ্ট পরিণত বয়সেই তাঁর চলে যাওয়া, তবুও শূন্যতার ভার আমাদের গভীরভাবে ভারাক্রান্ত করে, বিশেষ করে আমরা যখন তাঁর বহুবিধ কর্মকাণ্ডের কথা স্মরণ করি।

সমর বাগচি মশাইয়ের জন্ম বিহারের মুঙ্গেরে। বাবা ছিলেন চিকিৎসক। তাই বাবার কর্মসূত্রেই শৈশব ও কৈশোরের দিনগুলো কেটেছে প্রবাসে। পরবর্তীকালে পড়াশোনার জন্য এলেন কলকাতায়। ভর্তি হলেন স্কটিশ চার্চ কলেজে। এখানেই যুগন্ধর সব অধ্যাপকদের নিবিড় সান্নিধ্য তাঁকে বিজ্ঞানমুখী করে তুলেছিল। হাতেকলমে বিজ্ঞান শেখার ও শেখানোর প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি হয়তো তখনই অনুভব করেছিলেন গভীরভাবে। তাই পরবর্তীকালে ‘নো কস্ট, লো কস্ট’ বিজ্ঞান অনুসন্ধানের কথা উচ্চকণ্ঠে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। এটাই যেন হয়ে উঠেছিল তাঁর সমর-যুদ্ধ। ১৯৮০ সালে সানফ্রান্সিসকো শহরে ফ্রাঙ্ক ফ্রিডম্যান ওপেনহাইমার প্রতিষ্ঠিত এক্সপ্লোরেটোরিয়াম পরিদর্শনের সূত্রে এই হাতেকলমে পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানকে এদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার এক প্রবল তাগিদ তাঁর মধ্যে জেগে ওঠে। কলকাতার বিড়লা ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল মিউজিয়ামের অধিকর্তা হিসেবে যোগদান করার পর তিনি যেন তাঁর স্বপ্নকে অনেক অনেক মানুষের কাছে, নবীন শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার সুযোগ পেলেন। বইয়ের চেনা শব্দবন্ধের মধ্যে বিজ্ঞানভাবনাকে আটকে না রেখে জীবনের প্রতি পলে তাকে কার্যকারণের আলোচনার সূত্রে আত্মস্থ করার কথা ভাবতেন তিনি। একটা কথা তিনি সবসময়ে বলতেন ছাত্র-শিক্ষক দুই পক্ষকেই— খোঁজ, খোঁজ, খোঁজ। Quest, Quest, Quest. তাঁর বিশ্বাস ছিল গভীর অনুসন্ধিৎসা ছাড়া বিজ্ঞানচেতনা কখনওই পরিপূর্ণতা লাভ করে না। তাই সাদাকালো দূরদর্শনের যুগে তাঁর উদ্যোগে সম্প্রচারিত বিজ্ঞানশিক্ষার অনুষ্ঠান ‘কোয়েস্ট’ প্রচলিত বিজ্ঞানচেতনার সমস্ত চেনা বেড়া ভেঙে শিক্ষার্থীমানসকে বিপুল জ্ঞানের অথৈ সমুদ্রে অবগাহনের অবকাশ তৈরি করে দেয়। সকলে ঋদ্ধ হয়। সমর বাগচি মশাই চাইতেন আমরা সকলে, বিশেষত নবীন শিক্ষার্থীরা যেন এভাবেই ভাবতে শিখি, ভালবাসতে শিখি। তাঁর খুব প্রিয় ছিল একটি প্রাচীন চিনা প্রবাদ:

আমি শুনি এবং আমি ভুলে যাই,
আমি দেখি এবং আমি মনে রাখি,
আমি করি এবং আমি বুঝতে পারি।

কেবল শোনা বা দেখা নয়, সমস্যাকে হাতেকলমে নেড়েঘেঁটে যাচাই করা— এটাই ছিল তাঁর একমাত্র মন্ত্র। আমৃত্যু এই সাধনার পথেই পথিক হয়ে পথ চললেন এই পরম শ্রদ্ধেয় মানুষটি। শরীর সায় দিচ্ছে না, বাড়িতে নানান সমস্যার চাপ— তিনি চললেন ওয়ার্কশপ পরিচালনার কাজে হুইলচেয়ারে সওয়ার হয়ে। কী অদম্য ইচ্ছাশক্তি, কী বিপুল তাগিদ!

সমরবাবুর জীবনে একাধিক বরণীয় মানুষের প্রভাব পড়েছিল। কলেজে পড়ার সময়েই মার্কসবাদী সমাজভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হন। সেই ভাবনায় স্থিতধী ছিলেন তিনি। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যখনই মানুষ পথে নেমেছে তখনই ‘পথের দাবি’কে কুর্নিশ জানাতে ছুটে গিয়েছেন সেই সব প্রতিবাদী মানুষের পাশে, মিশে গিয়েছেন উচ্চকণ্ঠে গর্জে ওঠা মানুষদের ভিড়ে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি ছিল তাঁর গভীর ভালবাসা। রবীন্দ্রনাথের মুক্তশিক্ষার দর্শন তাঁকে তীব্রভাবে আকর্ষণ করত। চাইতেন অমন শিক্ষাব্যবস্থার প্রচার ও প্রসার। হয়তো তাই কিশোরভারতী, খেলাঘর-এর মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ছিল তাঁর নিবিড় সংযোগ। সু এবং কার্যকর শিক্ষার প্রসারে তিনি সদা আগ্রহী ছিলেন। আর গভীর শ্রদ্ধা করতেন গান্ধিজিকে। বিশেষ করে তাঁর গ্রাম-স্বরাজের ভাবনায় সমরবাবু মজেছিলেন। একবার ঠাট্টা করে বলেছিলাম— কমিউনিস্টরা তো গান্ধির অবদানকে স্বীকার করতে চায় না। বেশ কিছু সময় নীরব থেকে শান্ত কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন— আমরা তাঁকে না বুঝে, না পড়ে এড়িয়ে যাওয়ার ভান করেছি। তাঁকে বুঝতে গেলে তাঁর লেখায় ডুবতে হবে। আমাদের সময় কোথায়?

সমরবাবু খুব ভালবাসতেন কবিতা পড়তে। একাধিক কবির কবিতা স্মৃতিতে জমা ছিল তাঁর। মনে পড়ে ১৯৮৮ সালে পুরুলিয়ায় এক শিবিরে তাঁর মুখে জীবনানন্দ দাশের ‘ঘাস’ কবিতাখানির আবৃত্তি শুনি। ভীষণভাবে প্রকৃতিসচেতন মানুষ ছিলেন আর তাই হয়তো প্রকৃতির অবক্ষয় তাঁকে গভীরভাবে নাড়া দিত। চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের সবুজ কামরায় সৌভাগ্যক্রমে তিনি ও আমি সহযাত্রী হয়েছিলাম একবার (নভেম্বর, ২০২১)। তাই নিয়ে কত কথা, কত আলোচনা। এই সময়ের চরম ভোগবাদী যাপন তাঁকে যন্ত্রণা দিত। কষ্ট পেতেন এই সময়ের মানুষদের শূন্যগর্ভ অর্থহীন আলোচনায়। তবে এসব ক্ষেত্রে কখনওই তিনি নিজের প্রজ্ঞা জাহির করার কথা ভাবেননি, নীরব থাকাকেই হয়তো শ্রেয় মনে করেছেন।

আজ তাঁর চলে যাওয়া এক গভীর শূন্যতার সৃষ্টি করল। নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকার এই অ-সময়ে তাঁর মতো মানুষের বড়ই প্রয়োজন ছিল। সমরবাবুর অত্যন্ত প্রিয় কবি ছিলেন অরুণ মিত্র। তাঁর মুখে শোনা অরুণ মিত্রর এক প্রিয় কবিতার কথা স্মরণ করে আজ তাঁকে স্মরণ করি:

ভোরগুলো সব বেমালুম হাওয়া,
নিরেট অন্ধকার থেকে জেগে

একেবারে দাউদাউ দুপুরে।

হাত বাড়িয়ে দিলেই ঝরাপাতা মরাপাতা

আর ইটভাঁটার মুঠো মুঠো ছাই।

কোথায় যে ফুটে আছে ঘুমছোঁয়া শিশিরচোখ
এলিয়ে আছে ভেজা নীলের আকাশ।

খুঁজে আনো ভোরগুলোকে, খোঁজো।

আজ সেই খোঁজেই তাঁর মহাপ্রস্থান?