Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ডেঙ্গু তরজা

ডেঙ্গু

রেজাউল করীম

 

কবি সেই কতকাল আগে লিখে গেছেন– বন্যায় আমরা মরি না কখনও, মারী নিয়ে ঘর করি। আমরা, বাঙালিরা জাতি হিসেবে অনন্য। যখন আমাদের বৈভব ছিল, যখন মসলিনের প্রেমে মাতোয়ারা বিশ্বের তাবৎ বণিকেরা সোনার চুপড়ি উজাড় করে দিত আর বাঙালির ঘরে ঘরে অপরিমিত ঐশ্বর্য জমা হত, তখনও খুব সম্ভবত মারী আমাদের সঙ্গী ছিল। জলবসন্ত অর্থাৎ মায়ের দয়া, হাম বা মাসিপিসি– এছাড়া আর কোনও মারীকে বাঙালি আপন করেনি, তা জানা নেই। অথচ, মাসিপিসির ছদ্মবেশী হাম শিশুদের অপুষ্টি ও যক্ষার অন্যতম প্রধান কারণ। বৈশ্য বাঙালির মধ্যে নামকরা বৈদ্যরাজের উল্লেখ বেশি পাওয়া যায় না। লখিন্দর বড়লোক বাপের একমাত্র সন্তান কিন্তু যখন সে সাপের কামড়ে মারা গেল, কোনও বৈদ্যের দেখা পাওয়া গেল না। বৌদ্ধ যুগে ভেষজ বিজ্ঞান ও শল্য চিকিৎসার বেশ উন্নতি হয়েছিল, তার পর্যাপ্ত প্রমাণ পাওয়া যায়। আর্য আয়ুর্বিজ্ঞান বাঙালি কতটা আপন করে নিয়েছিল তার প্রমাণ অবশ্য গবেষণার বিষয়। বাঙালি উপকথায় ‘ধাই’-এর উল্লেখ পাওয়া যায় কিন্তু অন্য কোনও বৈদ্যের উল্লেখ সাধারণের দৃষ্টিগোচর হয় না। Goergicus-এর লেখায় বাঙালি বীরের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তা থেকে মনে হয়, বর্তমান বাঙালি অতীতের ছায়ামাত্র। এমনকি ১৮০৭ সালে লর্ড মিন্টো লিখছেন– “I never saw so handsome a race, these (Bengalees) are tall, masculine athletic figures, perfectly shaped and with finest possible cast of countenance and features” Minto’s letter to Mr A M Elliot, 20/9/1807. এ থেকে অনুমান করা যায় যে বাঙালি নিশ্চয়ই ভেষজ বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে ছিল যা তাঁকে নীরোগ ও সুস্থসবল রাখতে সাহায্য করেছিল। খুব সম্ভবত, সভ্য ব্রিটিশরা আমাদের বর্তমান হাল-হকিকতের জন্য অনেকাংশে দায়ি।

স্বাধীনতার ৭০ বছর পর এই বঙ্গদেশ সারা ভারতে আর তার পরিশীলিত ও ক্ষুরধার মেধা বা অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য আর তেমন পরিচিত নয়, যতটা সে অন্য কারণে বিখ্যাত। রাজনীতি ও সমাজের অন্য ক্ষেত্রের কথা না বলে যদি স্বাস্থ্যের সূচকের কথা আলোচনা করি তাহলে দেখব প্রায় সমস্ত সূচকেই আমরা ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছি। হাম রোগে সংক্রমণের হিসাবে দেখি সেখানে আমাদের অংশীদারত্ব প্রায় ১৫%, যদিও  জনসংখ্যার হিসেবে আমরা দেশের মাত্র ৮%। টীকাকরণ কর্মসূচীতে আমরা বেশ পিছিয়ে আছি, শিশুদের প্রায় শতকরা ৩১-৩৩% অপুষ্টিতে ভুগছে, ৫৭% মহিলা রক্তাল্পতার শিকার ও জনস্বাস্থ্যের অন্য অনেক সূচকেও (যথা, শৌচাগার, সুপেয় পানীয় জল, প্রসবকালে চিকিৎসাকর্মীর উপস্থিতি ইত্যাদি) আমরা বেশ খানিকটা পিছিয়ে আছি। তাই খুব স্বাভাবিক যে প্রতিরোধযোগ্য অসুখ-বিসুখ এই রাজ্যে একটা বড় সমস্যা। এইসব অসুখের প্রতিরোধের জন্য কোনও একক ব্যবস্থা খুব বেশি কার্যকরী হয় না মূলত দু’টি মৌলিক কারণে। আমরা সরকারকে জনবিচ্ছিন্ন একধরনের মহাশক্তিধর সংস্থা হিসেবে দেখি, যে আমাদের সব ভালমন্দের জন্য দায়ি। তাই সরকারের ভুলত্রুটি দেখিয়েই আমরা আমাদের দায়িত্ব শেষ করতে চাই। বিরোধী দল ও সরকার পক্ষ স্বাস্থ্যের মতো অবিতর্কিত বিষয়েও একমত হতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি নাগরিক হিসেবে আমরা আমাদের ন্যূনতম দায়িত্ব পালনেও পরাঙ্মুখ। তাই রাজ্যে জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম অনন্তকাল ধরে চললেও আমরা তাতে বিশেষ সাফল্য লাভ করতে পারিনি। চীন সিসটোসমিয়াসিস মাত্র ৬ বছরে নির্মূল করতে পেরেছে অথচ ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পে আমরা ডাহা ফেল।

আমাদের আরেকটি বড় সমস্যা হল মহামারী শুরু হওয়ার পর আমরা তা নিয়ন্ত্রণ শুরু করি। ধরা যাক, ডেঙ্গুর কথা। ডেঙ্গুর মশা খুব বেশি ওড়াউড়ি করতে পারে না। পরিষ্কার জমা জলে এই মশার চাষ হয়। পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে পারলে ও যত্রতত্র ভাঙা ঘটিবাটি, কাপ, নারকেলের খোলা, বোতল, ভাঙা বালতি না ফেলে রাখলে মশা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন নয়। শহরে অনিয়ন্ত্রিত বাড়িঘর বানানো ও অসমাপ্ত অবস্থায় ফেলে রাখলে সেখানে জল জমে মশার বংশবৃদ্ধি হবে। কোনও সরকার বা কোনও একক ব্যক্তির পক্ষে এই নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব। কাজেই সরকারের দোষারোপ করে সমস্যা সমাধান হবে না। কিন্তু প্রশ্ন হল, সরকারকে কেউ দোষারোপ করার আগেই তারা ডেঙ্গু হয়নি ডেঙ্গু হয়নি বলে চিৎকার শুরু করলেন কেন? আমার মনে হয় সমস্যাটা মনস্তাত্ত্বিক, অবৈজ্ঞানিক ও অপরিশীলিত বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত। প্রথমে মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায় আলোকপাত করতে হলে একটু বিস্তৃত ব্যাখার দরকার আছে।

এদেশে যা কিছু অস্বস্তিকর, তা ঘটেনি বলে ঘোষণা করাকেই সবচেয়ে বীরত্বব্যঞ্জক বলে সরকার মনে করেন। ‘পাব্লিক প্রবিটি’ যে শব্দটি শোনা যায়, তা এদেশে ডিকশনারির বাইরে এসে জনজীবনে কোনও ছাপ ফেলবে সে দুরাশা না করাই ভালো। আমরা কীরকম, যিনি আমাদের সব কিছুর খোলনলচে বদলে পোঁ ধরিয়ে দিয়েছেন তাঁর কথাতেই বলা ভালো– “আমাদের জাতি যেমন সত্যকে অবহেলা করে এমন আর কোনো জাতি করে কিনা জানি না। আমরা মিথ্যাকে মিথ্যা বলিয়া অনুভব করি না। মিথ্যা আমাদের পক্ষে অতিশয় সহজ স্বাভাবিক হইয়া গিয়াছে। আমরা অতি গুরুতর এবং অতি সামান্য বিষয়েও অকাতরে মিথ্যা বলি। অনেক কাগজ বঙ্গদেশে অত্যন্ত প্রচলিত হইয়াছে তাহারা মিথ্যা কথা বিক্রয় করিয়া জীবিকা নির্বাহ করে, পাঠকদের ঘৃণা বোধ হয় না। আমরা ছেলেদের সযত্নে ক খ শেখাই, কিন্তু সত্যপ্রিয়তা শেখাই না– তাহাদের একটি ইংরাজি শব্দের বানান ভুল দেখিলে আমাদের মাথায় বজ্রাঘাত হয়, কিন্তু তাহাদের প্রতি দিবসের সহস্র ক্ষুদ্র মিথ্যাচরণ দেখিয়া বিশেষ আশ্চর্য বোধ করি না। এমনকি, আমরা নিজে তাহাদিগকে ও তাহাদের সাক্ষাতে মিথ্যা কথা বলি ও স্পষ্টত তাহাদিগকে মিথ্যা কথা বলিতে শিক্ষা দিই। আমরা মিথ্যাবাদী বলিয়াই তো এত ভীরু! এবং ভীরু বলিয়াই এমন মিথ্যাবাদী। আমরা ঘুষি মারিতে লড়াই করিতে পারি না বলিয়া যে আমরা হীন তাহা নহে– স্পষ্ট করিয়া সত্য বলিতে পারি না বলিয়া আমরা এত হীন।” ইংরেজ একসময় এই দেশ শোষণ ও শাসন করেছে। দেশের সম্পদ অকাতরে নিজের দেশে নিয়ে গিয়ে লন্ডন শহরের জৌলুস বাড়িয়েছে। তবু ইংরেজ সম্পর্কে আমাদের শাসকশ্রেণির মনোভাব অন্তত মোগল-পাঠান সম্পর্কিত ধারণার চেয়ে উচ্চ। অথচ, ইংরেজের বীরত্ব এই যে তাঁরা সত্যকে স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করে না কিন্তু আমরা তাঁদের ভালো গুণের কণামাত্রও রপ্ত করিনি, অথচ তাঁদের সব মন্দ গুণ অনায়াসে জীবনশৈলীতে গ্রন্থিত করে ফেলেছি। সম্প্রতি বিলেতে একজন উচ্চমার্গের রাজনীতিক নৈতিক বিচ্যুতির কথা স্বীকার করে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। বিরোধী দলকে দোষারোপ করেননি বা দোষ প্রমাণ না করতে পারলে পদত্যাগ করব না বলে গোঁ ধরেননি। আমরা তাঁদের মতো সৎ নই, তাই আমাদের রাজ্যে এই মৃত্যুমিছিল অব্যাহত থাকলেও মারণজ্বরকে অম্লানবদনে অস্বীকার করে আমরা শ্লাঘা লাভ করি। গর্ব করে বলতে পারি, অন্যরাজ্যের তুলনায় আমরা কম মরেছি!! অথচ, অস্বীকার করা যাবে না যে, কলকাতা শহরে ডেঙ্গু কয়েক শতাব্দী ধরে বিদ্যমান। রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন– “একবার কলিকাতায় ডেঙ্গুজ্বরের তাড়ায় আমাদের বৃহৎ পরিবারের কিয়দংশ পেনেটিতে ছাতুবাবুদের (আশুতোষ দেব) বাগানে আশ্রয় লইল। আমরা তাহার মধ্যে ছিলাম।” ১৯৮৭-৮৮ সালেও আমরা শিশুবিভাগে সমানে ডেঙ্গু পেতাম। ডাঃ নিশীথরঞ্জন পান মহাশয়ের তত্ত্বাবধানে বেশ কিছু শিশুর রক্ত পরীক্ষা করে আমরা ডেঙ্গু ও জাপানিজ এনকেফেলাইটিসের পুরনো সংক্রমণের প্রমাণ পেয়েছিলাম। রাজ্য সরকার সমানে সেই ডেঙ্গু জ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকার করে চলেছেন, যদিও কেউ বলেনি যে সরকারের ত্রুটির জন্য ডেঙ্গু হয়েছে। এই দুঃসময়ে সরকারি কর্তাব্যক্তিরা যদি অন্তহীন নিষ্ফল বিতর্ক না করে ডেঙ্গু নির্মূলে যথাযথ নেতৃত্ব দিতেন, তাতে সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হত। মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দলকে এখনও ভালবাসে, বিশ্বাস করে– তাঁরা যদি সামাজিক ব্যাধি উৎখাত করতে চান তাহলে তা সহজেই সফল হতে পারে। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে এইসব ঘটনার টানাপোড়েনে সরকার একটু পিছিয়ে পড়ে ও যেহেতু উন্নয়ন নিয়ে মানুষের মোহ ভেঙে গেলে ভোটের বাক্সে তার প্রতিফলন হতে পারে বলে মনে করা হয় তাই অনুন্নয়নের কথা মানুষের স্মৃতি থেকেই বলপূর্বক বিলুপ্ত করার চেষ্টা করতে থাকে।

দ্বিতীয় আরেকটি কারণের কথাও আমি বলেছি। জনস্বাস্থ্য কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সারা বিশ্বব্যাপী নানানরকম প্রটোকল চালু আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণের জন্য জনস্বাস্থ্য কর্মীদের জন্য সহজ, সর্বজনগ্রাহ্য সংজ্ঞা চালু করেন। জ্বরঘটিত সমস্যাগুলিকে তারা Acute febrile illness বলে চিহ্নিত করেছেন। এই রোগ ডেঙ্গু হতে পারে কিম্বা অন্য কোনও রোগেরও উপসর্গ হতে পারে। মূল উদ্দেশ্য হল কতকগুলি “খারাপ লক্ষণ” চিহ্নিত করে কোন রোগীকে বিশেষ চিকিৎসা করতে হবে ও কোন রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা করতে হবে তা স্থির করা। ডেঙ্গু প্রকৃতপক্ষে একটি সাধারণ সমস্যা যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাড়িতেই চিকিৎসা করা সম্ভব। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল খারাপ লক্ষণগুলিকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করা। ডেঙ্গুতে রক্তের ঘনত্ব বেড়ে যায় ও রক্তপাতের আশঙ্কা থাকে। সারা পৃথিবী জুড়ে বছরে ১০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন তাদের শতকরা প্রায় ৫ ভাগ খারাপ ধরনের ডেঙ্গু। এদের মধ্যে মৃত্যু হার ৮.৭% (এই পরিসংখ্যান আমাদের দেশে, বিদেশে তা মাত্র ১-৫%)। সরকারের সঙ্গে চিকিৎসকদের মতামতের যে ফারাক দেখা যাচ্ছে তা মূলত রোগী চিহ্নিতকরণে। সরকার বলছে শুধু NS1 রিয়াকটিভ হলে তাঁরা ডেঙ্গু বলে মানেন না। তাদের বদ্ধমূল ধারণা তাঁরাই ঠিক বলছেন। একটু আলোচনা করলেই বোঝা যাবে কারা ঠিক বলছেন। ডেঙ্গু হয়েছে কিনা কেন জানা দরকার? কারণ আমরা খারাপ লক্ষণ চিহ্নিত করতে চাই। তাহলে যদি NS1 রিয়াকটিভ রোগীদের প্রথমেই চিহ্নিত করতে পারি তাহলে সরকারের অসুবিধা কোথায়? খুব বেশি হলে পাঁচ-দিনে IgM পরীক্ষা নেগেটিভ হবে, মানুষটিকে আমরা সুস্থ অবস্থায় বাড়ী পাঠাতে পারব। জনস্বাস্থ্য কার্য়ক্রমে False Positive খারাপ নয়, বরং তা রোগীর পক্ষে ভাল। হতে পারে সরকারের পক্ষে খারাপ কিন্তু চিকিৎসকের দৃষ্টিভঙ্গিতে তার উপযোগিতা অস্বীকার করা যায় না। পঞ্চম বা ষষ্ঠ দিনে রোগীর শরীরে আ্যন্টিবডির মাত্রা দেখে ডেঙ্গুর সঠিক চিহ্নিতকরণ হবে। তখন চিকিৎসকদের মূল বিবেচ্য হবে রক্তের ঘনত্ব ও রক্ত তঞ্চণজনিত সমস্যার সমাধান। সরকার যদি কোনও ফরমান দেন যে ডেঙ্গু লেখা যাবে না সেটা ভুল ও গা-জোয়ারি কারণ রোগীর ডিসচার্জ বা ডেথ যাই হোক সার্টিফিকেট দিতে হবে ICD 10 অনুসারে সেখানে Reactive Acute Febrile Illness with thrombocytopenia and haemorrhage বলে কোনও অসুখ নেই ও অজানা জ্বরের যে সংজ্ঞা তার জন্য ও রোগীকে কমপক্ষে তিন সপ্তাহ জ্বরে ভুগতে হবে ও তার গ্রহণযোগ্য কোনও কারণ থাকা চলবে না। বর্তমান জ্বরটিকে সমস্ত অর্থেই ডেঙ্গু বলে চিহ্নিত করাই শ্রেয়। অথচ, সরকারি প্রচারে তার উল্টোটাই হচ্ছে। চিকিৎসক রোগীর অসুখের জন্য দায়ী নয়, সরকার হলেও হতে পারে, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সরকারের কাছে চিকিৎসকরাই শত্রুশিবিরের লোক বলে চিহ্নিত হচ্ছেন।

ডেঙ্গু নিয়ে সর্বত্র ভয়ের আবহ, বিশেষত প্লেটলেট নিয়ে। কিন্তু খুব কম লোকের প্লেটলেট দিতে হয় (৫০০০০/ মিলির কম ও রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিম্বা ১০০০০/মিলির কম এমন রোগী)। প্লেটলেট দেওয়ারও নানারকম ঝুঁকি আছে। ডেঙ্গু রোগের কোনও নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই এবং প্লেটলেট ট্রান্সফিউশন ডেঙ্গুর চিকিৎসা নয়। কাকে কখন প্লেটলেট দিতে হবে তা একমাত্র বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই বলতে পারেন। এ প্রসঙ্গে সরকারের ভূমিকা ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা অতীব নিন্দাজনক। কাগজের কাণ্ড দেখে কে বলবে যে তাঁরা সারা বছর স্বাস্থ্য নিয়ে সুস্থ আলোচনায় কোনও আগ্রহ দেখান না। তাঁরা হঠাৎ যেন যোগনিদ্রা থেকে জেগে উঠে ডেঙ্গু নিয়ে বিস্তর চেঁচামেচি শুরু করেছেন। ডেঙ্গু ও প্লেটলেট চর্চায় খবরের কাগজের মহার্ঘ নিউজপ্রন্ট খরচ হচ্ছে– কাগজের বিক্রি ও জনগণের প্যানিক পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, মধ্যবিত্ত ঘটিবাটি বন্ধক রেখে বড় বড় হাসপাতালে গিয়ে ভর্তি হচ্ছে। যে রাজ্যে বছরে এককোটি মানুষকে চিকিৎসার জন্য চিকিৎসকের কাছে যেতে হয় সেখানে কিছু ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহার, চিকিৎসাঘটিত অভিযোগ যে থাকবেই তা বলা বাহুল্য। সেগুলো সংবাদমাধ্যমে গালগল্পসহ ছাপা হলে আখেরে কারও কোনও লাভ হয় না। এসবের জন্য আইন-আদালত, ক্রেতা সুরক্ষা ইত্যাদি আছে। অথচ, অভিযোগের পর অভিযোগের ফিরিস্তি দেওয়াকেই যারা সংবাদপত্রের দায়িত্ব বলে মনে করেন তারাই যখন ‘স্বাস্থ্য’ নিয়ে সিরিয়াস কথা বলতে চান তখন এই অতিভক্তি দেখে সংশয় হয়। জনচেতনা প্রসারে সংবাদপত্র বা বৈদ্যুতিন মাধ্যম যদি সত্যিই আগ্রহী হত তাহলে মহামারীর সময় মড়াকান্নার প্রয়োজন হয় না। আমাদের দুঃখের মূল কারণ স্বাস্থ্য এখনও আমাদের মৌলিক অধিকার নয়, স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ কম, রাজনৈতিক সদিচ্ছা আরও কম। এছাড়া স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য বরাদ্দের ৬%-এরও কম খরচ করা হয়। সংবাদপত্র কখনও কি এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছে কিম্বা সরকার বা জনগণের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করেছে? প্লেটলেট নিয়ে প্রতিদিন যা তাঁরা লিখছেন তা নির্লজ্জতা ও অসততার চূড়ান্ত উদাহরণ। সম্প্রতি প্লেটলেটের সংখ্যা নিয়েও তাঁরা নানারকম রূপকথার গল্প শোনাচ্ছেন। চিকিৎসার সব তাঁরা বোঝেন। তাঁরা চিকিৎসকের ত্রুটি ধরতে পারদর্শী, তারা প্লেটলেট ট্রান্সফিউশন বোঝেন, ভেন্টিলেশন বোঝেন– এককথায় জটিল চিকিৎসার সবকিছু বোঝেন। শুধুমাত্র সংবাদপত্রের এথিকস, তাঁদের দায়িত্ব ও কর্তব্য নিয়ে তাঁরা ওয়াকিবহাল নন। চিকিৎসককে অর্থগৃধ্নু, রক্তচোষা বলে চিহ্নিত করতে তাঁদের বাধে না। একজন অসাধু বা অপটু চিকিৎসকের দোষে পুরো চিকিৎসক সমাজকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ক্যাঙ্গারু কোর্ট বসিয়ে তাঁদের অর্জন ও সামাজিক মানসম্মানকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া হয়। একেকজন চিকিৎসক যখন নিগৃহীত হন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের নির্লজ্জ ঘটনা ঘটে, সংবাদপত্র তখন কিছুই দেখতে পান না, পালিত মেষশাবকের মতো পুচ্ছ দুলিয়ে শাসকের পক্ষপুটে আশ্রয় লাভ করেই সংবাদপত্রের মহান কর্তব্য পালন করেন। সংবাদমাধ্যম চিকিৎসকের মানহানির গপ্পো দেদার ছাপিয়ে চলেন কিন্তু চিকিৎসকের ভাষ্য সেখানে ছাপা হয় না। সংবাদপত্র যতটা ব্যবসা বোঝে তার কানাকড়ি যদি চিকিৎসকরা বুঝতেন, তাহলে বোধহয় কখনও জনগণের হাতে কখনও নেতাদের হাতে তাঁদের এতটা হেনস্থা হতে হত না।

স্বাস্থ্য নিয়ে খুব মৌলিক কাজ যাঁরা করেন তাঁরা একবাক্যে বলছেন যে আমাদের দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিস্তর গলদ আছে। সব গলদ একসঙ্গে শোধরানো যাবে না কিন্তু স্বাস্থ্য জনগণের দাবি হিসেবে উঠে না এলে এর ভবিষ্যত ভালো নয়। প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলি স্বাস্থ্যের যে অপূর্ণ চাহিদা সেগুলিকে তাঁদের দাবির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করলে অবস্থার হেরফের হবে না। এই রাজ্যে স্বাস্থ্যের যে পরিকাঠামো আছে তা দশ কোটি মানুষের তুলনায় কম। রোগীপিছু শয্যাসংখ্যার নিরিখে আমরা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির তুলনায়ও পিছিয়ে আছি। চিকিৎসকের সংখ্যা ও সেবিকার সংখ্যাও অপ্রতুল। আরেকটি বড় সমস্যা হল দারিদ্র। যেহেতু সরকার স্বাস্থ্য খাতে যা ব্যয় করেন তা খুব কম, তাই বেশিরভাগ টাকাপয়সা মানুষকে তাঁর পকেট থেকে ব্যয় করতে হয়। প্রতীচি ট্রাস্টের একটি রিপোর্টে দেখতে পাচ্ছি রোগপিছু খরচ স্বাক্ষর ও প্রাগসরদের তুলনায় নিরক্ষর ও পিছিয়ে পড়া মানুষের বেশি। খুব স্বাভাবিক কারণে মানুষ ক্ষুব্ধ। ক্ষোভের নায্য বহিঃপ্রকাশ হওয়া উচিত যাঁরা রাষ্ট্র চালান তাঁদের বিরুদ্ধে, কিন্তু তাঁরা সুপরিকল্পিতভাবে ক্ষোভের বর্ষামুখ চিকিৎসকদের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। মুষ্টিমেয় কিছু চিকিৎসকের অন্যায্য আচরণও তার জন্য খানিকটা দায়ী। তাই চিকিৎসাকর্মীরা আজ সীমাহীন আতঙ্ক নিয়ে কাজ করছেন ও নিরাপত্তার অভাব অনুভব করছেন।

ডেঙ্গুর বিদায় নেবার সময় আসন্ন, সংবাদপত্রের পাতাজোড়া নাট্যরঙ্গেরও যবনিকাপাত হবে অচিরে। কিন্তু জনগণের স্বাস্থ্যের অধিকার নিয়ে শাসকের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন না হলে জনস্বাস্থ্য যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই থাকবে। চিকিৎসকদের শুধু চিকিৎসা করলেই হবে না জনগণ ও রাজনীতিকদের শিক্ষকের ভূমিকা পালন করতে হবে। ক্লিনিকের ক্ষুদ্র পরিসরে রোগ সারিয়ে দেওয়া যেতে পারে কিন্তু তাতে স্বাস্থ্যের অধিকার অর্জিত হবে না। জনগণই চিকিৎসকের ভালমন্দের দায়িত্ব নিতে পারে। তাই, তাঁকে নূতন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। আর চিকিৎসককে ঠিক করতে হবে তাঁরা তাঁদের সুরক্ষা বাউন্সার ব্যবহার করে অর্জন করবেন, না মানুষের পাশে দাঁডিয়ে তাঁদের সুখদুঃখের সমান ভাগীদার হয়ে নিজেদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করবেন।