Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

দুই হাংরি বন্ধু ও এক অসমবয়সীর স্মৃতি-সাক্ষ্য

তন্ময় ভট্টাচার্য

 


আমাদের প্রজন্ম মলয় রায়চৌধুরীকে পেয়েছে মূলত ফেসবুকেই। হাংরি আন্দোলনের ইতিহাসের অতিমানবীয় চরিত্রের বাইরে, তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড আমাদের ঠাট্টার উপকরণ হয়েছে, কখনও-কখনও বিরক্তিরও। এ-ও মনে হয়েছে, হাংরি আন্দোলনের সমস্ত আলো, প্রচার ও লেখালেখির মাধ্যমে, নিজের দিকেই টেনে নিতে চেয়েছেন মলয়। এই মনে হওয়া অংশত সত্য হলেও, বন্ধুদের নিয়ে তাঁর লেখালেখি ও দিলখোলা পদক্ষেপে কমতি দেখিনি কোনওদিন। আজ, প্রথম-যৌবনের সমালোচনামূলক নজর ঘুচিয়ে মনে হয়, মলয়ের মধ্যে যে সংরক্ষণের মানসিকতা ছিল, ভবিষ্যতের জন্য অনলাইন আর্কাইভ তৈরির গুরুত্ব তিনি যেভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, তেমনটি সাহিত্যিকদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। এ-দিক দিয়ে, সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন তিনি। সেইসঙ্গে অদম্য জেদ। সত্তর বছর বয়সে কম্পিউটার শিখেছেন। শেষ অনেকগুলো বছর কি-বোর্ডে একটিমাত্র আঙুল দিয়ে টাইপ করতে পারতেন। আর এই সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েই লিখে গেছেন দীর্ঘ সব লেখা

 

ইচ্ছে করেই বেছে নিয়েছিলাম শেষ-সন্ধ্যাকে। বিজয়ার প্রণাম করতে যাওয়া, সেইসঙ্গে খানিক সঙ্গ ও সান্ত্বনাও দেওয়া। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ফোন-মারফত জেনে গিয়েছেন কারও-না-কারও থেকে! অথচ তিনি, সুবিমল বসাক, আমাকে যখন হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন, ‘খবর পেয়েছেন?’— প্রশ্নের উত্তরে বিস্মিত হয়েই ‘কী খবর’ জানতে চাইলেন, আমার অপ্রস্তুতির সেই শুরু। ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধুত্ব তাঁদের; সেই বন্ধু— মলয় রায়চৌধুরী প্রয়াত হয়েছেন সকালে— এ-কথা শুনলেন আমার মুখেই। মাথা নামিয়ে চুপ করে বসে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। তারপরই সামলে নিলেন নিজেকে। এমন এক বয়সে পৌঁছেছেন, যখন এ-জাতীয় খবরই এক ও একমাত্র সত্য হয় উঠে আসে। জানতেন না দিনকয়েক আগে আরেক বন্ধু দেবী রায়ের চলে যাওয়ার খবরও।

 

হাংরি আন্দোলনের ইতিহাসে আমার প্রবেশ মূলত সুবিমল বসাকের সূত্রেই। প্রতিবেশী তিনি; দেখছি শৈশব থেকেই। শেষ-কৈশোরে, যখন নিজেও লেখালেখি শুরু করেছি, ঘনিষ্ঠতার শুরু। তিনি তখন চুয়াত্তর, আমি কুড়ি। চুয়ান্ন বছরের ফারাক সত্ত্বেও ‘বন্ধু’ দুজন। তারপরও কেটে গেল একদশক। চুরাশি বছর বয়সে দাঁড়িয়ে, বন্ধুমৃত্যুর খবরে তাঁর চোখের চকিত-ছায়া বিষণ্ণ করল আমাকে। বন্ধুত্ব বুঝি এমনই হয়…

সুবিমল, হাংরি আন্দোলনের অন্যতম গদ্যকার। ১৯৬৫ সালে ঢাকাইয়া কুট্টি ভাষায় লেখা তাঁর উপন্যাস ‘ছাতামাথা’ প্রকাশিত হয়। সে-বইয়ের প্রচ্ছদ করেছিলেন মলয় রায়চৌধুরী। অবশ্য বর্তমান লেখাটি সুবিমল বসাক বা মলয় রায়চৌধুরীর সাহিত্যকীর্তি নিয়ে আলোচনার নয়। বরং, অজস্রবার আলাপ-আলোচনার সূত্রে আমার স্মৃতিতে তাঁদের বন্ধুত্বের যে টুকরো-টুকরো গল্প গেঁথে রয়েছে, তাই লিখে রাখার চেষ্টা। এ-ও একপ্রকার ইতিহাসের উদযাপন বইকি!

সুবিমল বসাকের ‘ছাতামাথা’ (১৯৬৫) উপন্যাসের প্রচ্ছদ, প্রচ্ছদশিল্পী – মলয় রায়চৌধুরী

সুবিমল বসাকের সঙ্গ পেয়েছি অজস্রবার, সম্পাদনা করেছি তাঁর রচনা সংগ্রহেরও। মলয় রায়চৌধুরীও আমায় চিনতেন সুবিমলের স্নেহাস্পদ হিসেবেই। ২০১৩ থেকে মলয়ের সঙ্গে কথা শুরু; সামনাসামনি আলাপের দীর্ঘ প্রতীক্ষা মিটেছিল গতবছর, মুম্বাই-এ। মলয়ের সঙ্গে এক দশকের কথোপকথনের প্রায় পুরোটাই হাংরি আন্দোলন ও সুবিমল-কেন্দ্রিক। আমার নেওয়া সুবিমলের একাধিক সাক্ষাৎকার ও তাঁকে নিয়ে লেখা গদ্য ইন্টারনেটের বিভিন্ন গলিঘুঁজিতে আর্কাইভ করে রেখেছিলেন মলয়, নিজের উদ্যোগেই। বন্ধুর সাহিত্যকীর্তির প্রতি তাঁর এই সম্মান আমাকে বিস্মিত করেছে বারবার।

আমাদের প্রজন্ম মলয় রায়চৌধুরীকে পেয়েছে মূলত ফেসবুকেই। হাংরি আন্দোলনের ইতিহাসের অতিমানবীয় চরিত্রের বাইরে, তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ড আমাদের ঠাট্টার উপকরণ হয়েছে, কখনও-কখনও বিরক্তিরও। নিজের বইয়ের যত্রতত্র উত্তুঙ্গ প্রচারকে বাঁকা চোখে দেখেছি কমবয়সে। মলয়ের এইসব পদক্ষেপ আরও দৃষ্টিকটু ঠেকত, যখন তাঁরই সমবয়সি আরেক হাংরিকে (সুবিমল বসাক) দেখতাম নিত্যদিন, নীরব, প্রায়-একটেরে, আত্মপ্রচারের আন্তর্জাল-দুনিয়া থেকে কিঞ্চিৎ দূরে। এমনকী এ-ও মনে হয়েছে, হাংরি আন্দোলনের সমস্ত আলো, প্রচার ও লেখালেখির মাধ্যমে, নিজের দিকেই টেনে নিতে চেয়েছেন মলয়। এই মনে হওয়া অংশত সত্য হলেও, বন্ধুদের নিয়ে তাঁর লেখালেখি ও দিলখোলা পদক্ষেপে কমতি দেখিনি কোনওদিন। আজ, প্রথম-যৌবনের সমালোচনামূলক নজর ঘুচিয়ে মনে হয়, মলয়ের মধ্যে যে সংরক্ষণের মানসিকতা ছিল, ভবিষ্যতের জন্য অনলাইন আর্কাইভ তৈরির গুরুত্ব তিনি যেভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, তেমনটি সাহিত্যিকদের মধ্যে সচরাচর দেখা যায় না। এ-দিক দিয়ে, সময়ের থেকে এগিয়ে ছিলেন তিনি। সেইসঙ্গে অদম্য জেদ। সত্তর বছর বয়সে কম্পিউটার শিখেছেন। শেষ অনেকগুলো বছর কি-বোর্ডে একটিমাত্র আঙুল দিয়ে টাইপ করতে পারতেন। আর এই সীমাবদ্ধতাকে মেনে নিয়েই লিখে গেছেন দীর্ঘ সব লেখা।

 

সুবিমল প্রযুক্তিকে আয়ত্ত করতে পারেননি সেভাবে। ফলে সময়ের দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছেন। অথচ দুজনে প্রায় সমবয়সীই। ৪৮ দিনের ফারাক। মলয় রায়চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৯-এর ২৮ অক্টোবর, সুবিমলের ওই বছরেরই ১৫ ডিসেম্বর। উভয়েরই জন্ম ও বেড়ে ওঠা পাটনায়। সেখানে সামান্য আলাপ থাকলেও, তা বন্ধুত্বে পরিণত হয় ১৯৬৩-তে, যখন চাকরি নিয়ে কলকাতায় আসেন সুবিমল। মলয় ততদিনে হাংরি আন্দোলন শুরু করে দিয়েছেন। ’৬৩-র এক বিকেলে, কফিহাউসে মলয়ের সঙ্গে প্রথম উল্লেখযোগ্য মোলাকাত তাঁর। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে জানার পর, ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়া। ততদিনে নাইট্রিক অ্যাসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন সুবিমলের বাবা। ‘বিক্ষুব্ধ’ হওয়ার বোধকরি সেই শুরু…

স্মৃতিতে ভেসে আসছে টুকরো-টুকরো ঘটনাক্রম। মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায় ও সুবিমল বসাক— তিন যুবক তখন দৌরাত্ম্য শুরু করেছেন কলকাতায়। লেখালেখির পাশাপাশি, চলছে প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণের বিভিন্ন ‘ন্যক্কারজনক’ কার্যকলাপও। দেশ পত্রিকার দপ্তরে সাদা পৃষ্ঠা পাঠিয়ে ছোটগল্প হিসেবে দাবি করা, ছাদ থেকে ছেলে পড়ে গেছে বলে বিমল কর-কে ভয় দেখানো, কার্ডে ‘গাঙশালিখ কাব্যস্কুলের জারজদের ধর্ষণ করো’ লিখে কবি-সাহিত্যিকদের পাঠানো, টপলেস প্রদর্শনী দেখতে আসার আহ্বান, পথেঘাটে বিমল কর-কে হেনস্থা। মলয় যখন চাকরির জন্য ফিরে যাচ্ছেন পাটনায়, কলকাতা সামলাচ্ছেন সুবিমল। বুলেটিন ছাপা থেকে লিফলেট বিলি— সমস্তকিছুই। সঙ্গী বন্ধুরা— দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, ত্রিদিব মিত্র, সুবো আচার্য, বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রমুখ। ’৬৪ সালে হাংরি জেনারেশন পত্রিকার অষ্টম সংখ্যা প্রকাশের সূত্রে ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি। গ্রেফতার করা হয় ৬ জনকে। বাকিরা অব্যাহতি পেলেও মলয়ের বিরুদ্ধে মামলা চলতে থাকে। চাকরি হারান কেউ-কেউ। মলয়ের বিরুদ্ধে হাংরিদের একাংশের ক্ষোভ। ’৬৫-তে নিম্ন আদালতের রায়, মলয় দোষী সাব্যস্ত। অবশেষে ’৬৭-তে হাইকোর্টে বেকসুর খালাস।

মলয়ের মামলার সম্পূর্ণ নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত একমাত্র সুবিমলই যে নিয়মিত তদারকি করতেন— এ-কথা লিখেছেন মলয় নিজেই। তারপরেও, ১৯৬৭ সালে হাংরিদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছেদ করে মলয়ের বাইরে চলে যাওয়াকে সুবিমল ভাল চোখে দেখেননি। পরবর্তীকালে লিখেছিলেন সে-কথা— ‘…মলয় তখন ঘোর সংসারী, সন্তানের পিতা, সফল স্বামী, দায়িত্বশীল অফিসার— পরিপূর্ণ জমাটি। জীবনের ভিন্ন আশ্রয় বলে তখন আর কিছু নেই, দেখে মন খুব দুঃখিত হয়ে পড়ে আমার। আমিও মলয় সম্পর্কে ক্রমশঃ আগ্রহ হারিয়ে ফেলি।’

বন্ধুত্ব কিন্তু ফুরোয়নি। ১৯৮৪ সালে মলয় আবার লেখালিখিতে ফিরে আসার পর, যোগাযোগ গড়ে ওঠে দুজনের, যা বজায় ছিল শেষ অবধি। মলয় যখন কলকাতায় থাকতেন, পরস্পরের বাড়িতে যাতায়াত ছিল তাঁদের। এমনকী, গত দশ বছরে একাধিকবার ফোনে তাঁদের যোগাযোগের খবর পেয়েছি, নিজেও যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি কখনও-কখনও। মলয় ‘শত্রু’ হয়ে উঠেছিলেন অনেক হাংরিরই। সুবিমল ব্যতিক্রম। এ-জন্য সুবিমলকে বিদ্ধও করেছেন অনেকে, কিন্তু, টলাতে পারেননি শেষ পর্যন্ত।

সুবিমল বসাক ও মলয় রায়চৌধুরী, কাঠমান্ডু, ১৯৬৭

সুবিমল বসাক ডাইরি লিখতেন। পঞ্চাশের দশক থেকে শুরু করে, বিগত দশক অবধি নিয়মিত-অনিয়মিত চলেছে তাঁর ডাইরিচর্চা। সেই বিপুল ভাণ্ডার থেকে ১৯৬৩-৬৫ কালপর্বকে নির্বাচিত করে, গত কয়েক বছর ধরে সম্পাদনার কাজ চালাচ্ছি আমি। বই আকারে হয়তো প্রকাশিত হবে ভবিষ্যতে। সেই ডাইরির পাতার পর পাতায় লুকিয়ে রয়েছে মলয়-সুবিমলের বন্ধুত্ব সহ হাংরি আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোর কাহিনি। হাংরিদের মধ্যে একমাত্র সুবিমলেরই ডাইরি লেখার অভ্যাস থাকায়, সেই সময়ের দৈনন্দিন ধারাবিবরণী হিসেবে এই নথিগুলির গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এত ‘অথেন্টিক’ আর-কোনও হাংরি-বিবরণী নেই বলেই আমার অভিমত।

এই ডাইরির ভূমিকা লেখার অনুরোধ জানিয়েছিলাম মলয় রায়চৌধুরীর কাছে। দীর্ঘ এক ভূমিকা লিখে আমায় পাঠান তিনি গতবছর, যার শিরোনাম— ‘সুবিমল বসাক, ওর ডাইরি, আর আমার যা মনে পড়ছে’। যথাসময়ে গ্রন্থিত হবে সেটিও। কিন্তু তার আগে, ঝাঁকিদর্শন দিয়ে দেখা যাক মলয়ের লেখার অংশ—

সুবিমল কলকাতায় হাংরি আন্দোলনের দায়িত্ব নেয়ায় আমার সুবিধা হল। সেই সময়ে আমি তিনমাসের জন্য অফিসের কাজে কলকাতায় ছিলুম। যে বুলেটিনটার জন্য মামলা হয়েছিল সেটার লেখা সংগ্রহ করে দেবীকে দিয়ে পাটনা চলে এলুম। কোনো প্রেস ছাপতে চাইছিল না। শেষ পর্যন্ত প্রদীপ চৌধুরী একটা প্রেসে ছাপায়।… যখন মামলাটা শুধু আমার বিরুদ্ধে আরম্ভ হলো তখন সবাই পালালো, একমাত্র সুবিমল বসাক ছাড়া। ত্রিদিব মিত্রও ছিল কিন্তু ওকে সবাই উপেক্ষা করার ফলে ও আন্দোলন ছেড়ে দিল। শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য নিজেদের উদ্বাস্তু গোষ্ঠির হাংরি ঘোষণা করে ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করল। আশ্চর্য যে সুবিমল বসাক ‘ছাতামাথা’ লিখেছিল উদ্বাস্তুর ভাষায় অথচ ওকেই ওরা বাদ দিয়ে দিল। ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকার কোনো সংখ্যায় সুবিমল বসাকের লেখা নিল না শৈলেশ্বর-সুভাষ। সম্ভবত এই জন্যে যে আমার মামলায় আদালতের ব্যাপারে সুবিমল আমাকে নানা ভাবে সাহায্য করছিল। প্রতিটি বহসের আদালতের সার্টিফাইড কপি নিতে হত, সেগুলো সংগ্রহ করা, যারা সাক্ষ্য দিচ্ছে তাদের জেরা রেকর্ড করা, সবই করত সুবিমল। অন্য সবায়ের মতন দেবী রায়ও কেটে পড়েছিল।…

এই দোস্তির বিভিন্ন সাক্ষ্য পাই পুরনো চিঠিপত্রেও। একটি দুর্লভ চিঠি, ১৯৬৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর, সুবিমল লিখছেন মলয়কে। তার শুরুর অংশ এরকম—

মলয়, তুমি কোলকাতা এসে অনেকের সঙ্গে দেখা করোনি। নানা প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে সেই ৬৪-৬৫র মতো খেয়োখেয়ি শুরু হয়েছে। সুভাষের আস্তানা আমি গত বৃহস্পতিবার ছেড়ে দিয়েছি। এখন জীবন একেবারে অনিশ্চিত, অত্যন্ত দুঃখময় ও বন্ধুবান্ধবহীন, একা। এইকটা দিন এর-ওর বাসায়, শিয়ালদা-হাওড়া স্টেশনে রাত কাটিয়ে শরীরের শেকড় দেখে নিয়েছি, পায়ের নিচে জমিতে চাপ দিয়ে দেখছি কতখানি স্যাতস্যাতে। প্রতিদিন সন্ধে হলেই ভাবা আরম্ভ করি কোন পরিচিতের বাড়ি হাজির হওয়া যায় রাত্তির নটার পর।

এসব পড়ে মনে হয়, ব্যক্তিগত কথাবার্তা ভাগ করে নেওয়ার পরিসরও ছিল যথেষ্টই। এককালে কলকাতায় সুবিমলের জ্যাঠার স্যাঁকরার দোকানে রাতে ঠাঁই নিতেন দুজন। সেইসব দিন অন্তরঙ্গতা বাড়িয়েছে আরও। ডাইরিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আরও অজস্র ঘটনা-টুকরো। এ-লেখায় সেসবের উল্লেখ সম্ভব নয়। বরং চোখ রাখি মলয় সম্পর্কে লেখা সুবিমলের একটি স্মৃতিচারণার অংশে—

১৯৬৫ সালে মলয়ের একটি কাব্যগ্রন্থের ব্লার্বে মলয় নিজেকে আত্মহাজির করেছে: ‘লোভী আত্মপ্রচারখ্যাপা অশান্ত প্রতিহিংসুটে স্নেহাকাক্ষী আত্মলোলুপ উত্তরাধিকারহীন ছন্নছাড়া সত্যবাদী দাম্ভিক টালমাটাল প্রিয় দ্বন্দ্ববিলাসী কুলাঙ্গার মেধাবী আমিষাশী জেদি বেহিসাবি অধ্যবসায়ী আসবাববিলাসী সাহসী আত্মম্ভর খুঁতখুঁতে বেখাপ্পা এটসেটরা এটসেটরা’।

বিশেষণ-অপবিশেষণ, গুণ-অগুণ, এগুলো মলয় নিজেই জানিয়েছে নিজের সম্পর্কে। এর আগে অমন আত্মনিন্দার সঙ্গে আমরা পরিচিত ছিলাম না। আত্মপ্রচার খ্যাপা তো বটেই, আত্মাভিমানীও প্রচণ্ড। সাবর্ণ চৌধুরী বংশের রাঢ়ী শ্রেণীর ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে কোনওদিন পৈতে ধারণ করেনি। ছাত্র বয়সে যৌনকেশ গজাবার সময় উপনয়ন এবং গঙ্গার জল দণ্ডীসহ পৈতেও ভাসিয়ে দিয়েছিল। তার ঠাকুমা সখেদে বলেছিলেন— কুলাঙ্গার, বেমনো। পরবর্তীকালে আটের দশকে মলয় নিজেকে ‘সাংস্কৃতিক-জারজ’ বলে অভিহিত করেছে। বাঙালি সংস্কৃতির জারজ ফসল।

 

আমার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল, মলয় ও সুবিমলকে একসঙ্গে বসিয়ে তাঁদের কথোপকথন রেকর্ড করার। সে-সুযোগ হয়ে ওঠেনি। ২০১৫ সালে কাঁচা হাতে একটা ডকুমেন্টরি বানিয়েছিলাম, হাংরি আন্দোলন নিয়ে দুজনের ভিডিও-বক্তব্য জুড়ে-জুড়ে। শুরু হচ্ছে মলয়েরই বক্তব্য দিয়ে—

হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করেছিলাম আমরা চারজন— আমি, আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়— আমার বন্ধু, আর শক্তি চট্টোপাধ্যায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় সেসময় থাকতেন চাইবাসায়, দাদার সঙ্গে। দাদা চাইবাসায় পোস্টেড ছিলেন। শক্তি সেখানে প্রায় তিন বছর ছিলেন। তিনি সেসময় ‘কুয়োতলা’ লিখছিলেন আর ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’-র কবিতাগুলি লিখছিলেন। আমি, দাদা— আমরা এই আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমাদের পাটনার বাড়িতে আসতেন। তখনই ঠিক হল, একটা আন্দোলন আরম্ভ করা যাক।…

সুবিমল বসাকও জানাচ্ছেন, মলয়ই হাংরি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। এ-নিয়ে যাবতীয় বিতর্কের বিপরীতে, প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা যেতে পারে এই ডকুমেন্টরিটি।

এছাড়াও, বিভিন্ন সময়ে পড়েছি উভয়ের লেখা অজস্র স্মৃতিচারণামূলক টেক্সট, মলয়ের নেওয়া সুবিমলের একটি অতিদীর্ঘ সাক্ষাৎকার। সেইসঙ্গে, মুখোমুখি বসে শোনা বিভিন্ন গল্প। এসব মিলিয়েই দুজনের বন্ধুত্ব ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে চিনেছি একটু-একটু করে— চুয়ান্ন বছর বয়সের দূরত্বে দাঁড়িয়ে। বক্তব্যের পরস্পর-বিরোধিতা, হাংরিদের কিছু-কিছু কার্যকলাপের প্রতি অসমর্থন ইত্যাদি পেরিয়ে, ছুঁতে চেয়েছি ফেলে-আসা একটা দশককে। যে-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন মহলে এত বিতর্ক ও অসূয়া, সেই আন্দোলনেরই দুই সদস্যের ছয় দশকের টিকে-থাকা বন্ধুত্বকে অস্বীকার করতে পারিনি কোনওদিনই।

 

মলয় চলে গেলেন। তাঁর অনুপস্থিতিতে, তাঁর যাবতীয় লেখালেখিকে নতুন দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা উচিত, মনে হয়। হাংরি আন্দোলন চলাকালীন কুড়ির কোঠায় বয়স ছিল তাঁর; ষাটের দশকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় একাত্ম হয়ে গেলেও, তা-ই একমাত্র নয়। পরবর্তী অর্ধশতক জুড়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিচরণ করেছে লেখালেখি, ভিন্ন এক মলয়কে পেয়েছি আমরা— কবিতায়, গল্প-উপন্যাসে, প্রবন্ধে ও অনুবাদে। হাংরি-পরিচয়ের খোপ ছাড়িয়ে এগিয়ে গেছেন অনেকখানি। অতি-চর্চিত হাংরি আন্দোলনের বাইরে যে ‘অপর মলয়’, তার প্রভাবও নিতান্ত কম নয়। একজন লেখকের সবচেয়ে বড় শক্তি, আমার মতে, জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বাঁক নেওয়া, নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করা। সে-কাজে তিনি সফল।

আবার একই সঙ্গে মনে হয়, ‘বিগ্রহপ্রতিম’ ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে হাংরি আন্দোলনকে সারাজীবন ‘ব্যবহার’-ও করেছেন তিনি। মলয় যদি কবিতা লেখার দায়ে গ্রেফতার না-হতেন, খ্যাতি এই উচ্চতায় পৌঁছত কি? কবিতা-বহির্ভূত বিষয়, যা জনগণের মুখরোচক, সেসবও তাঁকে ‘সাহায্য’ করেছে অনেকখানি। ঠিক যেমন সুবিমল বসাকের ক্ষেত্রে আলোচিত হয় কফিহাউসের নিচে শক্তি চট্টোপাধ্যায়-কর্তৃক প্রহার। তবে বিপরীত যুক্তিও হাজির করা যায়। লেখালেখি, বিভিন্ন কার্যকলাপ, প্রতিক্রিয়া ও অভিঘাত— সব মিলিয়েই একটি সময়ের প্রতিভূ হাংরি আন্দোলন। ফলে, শুধুমাত্র লেখাকে বিচ্ছিন্ন করে দেখাও অর্থহীন। এই দ্বন্দ্ব ও সীমাবদ্ধতাকে সঙ্গে নিয়েই এগোনো উচিত আমাদের; ব্যক্তি-পরিচয়ের পাশাপাশি ডুব দেওয়া উচিত তাঁদের সাহিত্যকীর্তির বিস্তীর্ণ পরিসরেও।

মলয় রায়চৌধুরীর মৃত্যু একটি সাম্প্রতিক ঘটনা। ফলে, নির্মোহ আলোচনার জন্য আরও খানিক দূরত্বের প্রয়োজন। এই মুহূর্তে অধিক জ্যান্ত, অন্তত আমার কাছে, বন্ধুত্বের সেই জার্নিই। একজন চলে গেলেন। আরেক বন্ধু তীব্র অসুস্থ। স্মৃতিতেও থাবা বসিয়েছে বয়স। তারপরও, বন্ধুবিয়োগের খবরে কয়েক মুহূর্তের যে-বিহ্বলতা, সময়ের দান বোধকরি সেটুকুই। স্বাভাবিক শ্বাসের আড়ালে লুকিয়ে-ফেলা একটি তীব্র দীর্ঘশ্বাস…


*সবকটি ছবিই তন্ময় ভট্টাচার্যের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে