Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং এবারের অন্তর্বর্তী বাজেট

জয়ন্ত ভট্টাচার্য

 


রাষ্ট্রের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড ও ইস্তেহারে স্বাস্থ্য কখনওই গুরুত্ব পায়নি। এবারে্র হেলথ বাজেটের (২০২৪-২৫) ক্ষেত্রেও একই কথা। জিডিপি-র ২ শতাংশও স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ হয় না। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিশেষজ্ঞরা সবসময়েই বলেছেন, জিডিপি-র অন্তত ৩ শতাংশ স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ করা উচিত। ভারত যেখানে বিশ্বের তৃতীয় শক্তিশালী জিডিপি-র দেশ হতে চাইছে সেখানে একটি তুলনা অনিবার্যভাবেই এসে পড়বে— আমেরিকার স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় জিডিপি-র ১৮.৫২ শতাংশ, চিনের ৫.৫৯ শতাংশ এবং জার্মানির ১২.৮১ শতাংশ

 

এবারের অন্তর্বর্তী বাজেট প্রাক-২০২৪ নির্বাচনী প্রস্তুতির বাজেট। ফলে নানা জনমোহিনী সম্ভার সাজানো থাকবে এটাই স্বাভাবিক। স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় অন্তর্বর্তী বাজেটের অন্তর্ভুক্ত, যাকে আমরা অভিহিত করছি স্বাস্থ্য বাজেট বলে। কিন্তু আগাম দু-একটি বিষয়ে কথা বলা দরকার। এমনিতে ভারতে ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে স্বাস্থ্যখাতে অন্তর্বর্তী বাজেটে কত ব্যয় হয়েছে, এবং বর্তমান সময়ে ভারতে স্বাস্থ্যের সংক্ষিপ্ত হালহকিকত আলোচিত হয়েছে ডক্টরস ডায়ালগ-এ প্রকাশিত “Indian Health Budget 2024 – Some Stocktaking” শীর্ষক আমার প্রবন্ধে।[1] যদিও সে-প্রবন্ধ ইংরেজিতে লেখা।

সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। বোঝা যাচ্ছে বাজেটে বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যের স্থান কোথায়

প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে জীবন্ত ও ক্রিয়াশীল রাখা কেন একটি দেশের জনসমষ্টির জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ সে প্রশ্নে কিছু আলোকপাত করার প্রয়োজন সমধিক। কিন্তু এ-ব্যাপারে সাধারণ পাঠকদের জন্য দৈনন্দিন সংবাদমাধ্যম এবং কাগজপত্রে আলোচনা এতই কম যে সমাজের বৌদ্ধিক বিচারে এটা ভাবনার যোগ্য কোনও বিষয় হিসেবেই বিবেচিত হয় না। ধরতাই হিসেবে কিছু প্রারম্ভিক কথা বলা দরকার জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্যের পরিস্থিতি বোঝার উদ্দেশ্যে।

১৯৮১ সালে ৩৪তম ওয়ার্ল্ড হেলথ অ্যসেম্বলি-র অধিবেশন বসেছিল জেনেভা শহরে ৪-২২ মে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার সদস্য সমস্ত দেশ তাতে অংশগ্রহণ করে। সেখানে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি। তাঁর ভাষণে তিনি বিশ্ববাসীর সামনে বলেন— আমাদের অত্যুন্নত আধুনিক হাসপাতালের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু ঊচ্চমূল্যের আরও বেশি টেকনোলজি-নির্ভর মেডিসিনের প্রলোভন সামলাতে হবে… প্রাথমিক স্বাস্থ্যসুরক্ষা, দূরত্ব এবং অর্থ উভয় দিক থেকেই, সমস্ত মানুষের নাগালের মধ্যে থাকতে হবে… আমরা চাইব, ভারতে মানুষের দরজায় স্বাস্থ্য পৌঁছক, কেন্দ্রীভূত বৃহৎ হাসপাতাল-মুখী হওয়ার পরিবর্তে। স্বাস্থ্যসেবা শুরু হবে যেখানে মানুষ আছে সেখান থেকে এবং যেখানে সমস্যার শুরু সেখান থেকে।” বলেন— “স্বাস্থ্য ক্রয় করার যোগ্য কোনও পণ্য নয়, কিংবা অর্থের মূল্যে কোনও পরিষেবা নয় এটা হল জানার, জীবনযাপনের, অংশগ্রহণের এবং মানুষ হয়ে ওঠার একটি প্রক্রিয়া।” খুবই মূল্যবান কিছু মতামত পাওয়া গেল স্বাস্থ্য, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা ইত্যাদি নিয়ে। বিশেষ করে যখন বলেন স্বাস্থ্য কোনও পণ্য বা কোনও পরিষেবা নয়, “it is a process of knowing, living, participating and being.” আজ প্রায় ৪৫ বছর পরে একবার খোঁজ নিতে হবে স্বাস্থ্যের সরণিতে কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা।

২১ মার্চ, ২০২৩-এ WHO (হু)-র তরফে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল “Commercial determinants of health”[2] শিরোনামে। এ প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হল: ১. “Commercial determinants of health are the private sector activities that affect people’s health, directly or indirectly, positively or negatively.” এবং ২. “The private sector influences the social, physical and cultural environments through business actions and societal engagements; for example, supply chains, labour conditions, product design and packaging, research funding, lobbying, preference shaping and others.”

দীর্ঘদিন ধরেই হু যে দৈতাকৃতি, বহুজাতিক কর্পোরেটদের চাপে নিজের স্বাস্থ্যনীতি[3] ক্রমাগত বদলাতে বাধ্য হচ্ছে, এ সত্য খানিকটা লঘুস্বরে, প্রকারান্তরে মেনে নেওয়া হল এ-প্রতিবেদনে। ২০১৫ সালে থার্ড ওয়ার্ল্ড নেটওয়ার্ক-এর তরফে একটি বিশেষ সংখ্যাই প্রকাশিত হয়েছিল Resurgence — World Health Organization Corporation?: Resisting Corporate Influence in WHO শিরোনামে। এ-সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলা হয়— “হু-কে ২০১৩ সালে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন ৩০১ মিলিয়ন ডলার অর্থসাহায্য করেছে, যার পরিমাণ আমেরিকার সম্মিলিত ২৯০ মিলিয়ন ডলার অর্থসাহায্যের চেয়ে বেশি।”

বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার প্রাক্তন মহাসচিব গ্রো হারলেম ব্রান্টল্যান্ড (১৯৯৮-২০০৪) এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রাক্তন মহাসচিব বান কি মুন (২০০৭-২০১৬) ২০১৮ সালে ভারতে আসেন স্বাস্থ্যের অবস্থা পরিদর্শনের জন্য। ব্রান্টল্যান্ড পরে ল্যান্সেট-এ একটি প্রবন্ধ লেখেন “India’s health reforms: the need for balance” শিরোনামে। তাঁর উপলব্ধি ছিল— “ভারতের নতুন স্বাস্থ্যসংস্কারের যে-সব প্রোগ্রাম সেক্ষেত্রে একটি ঝুঁকি রয়েছে যে, এই প্রোগ্রামগুলো যে অর্থ খরচ হবে সেটাকে টার্শিয়ারি কেয়ারমুখী করে তুলতে পারে। এবং প্রাথমিক স্বাস্থ্যের জন্য সরকারের স্বাস্থ্য বাজেটের অন্তত ২/৩ অংশ ব্যয়ের ঘোষিত নীতিকে গুরুত্বহীন করে তুলতে পারে।”[4] ব্রান্টল্যান্ড এক্ষেত্রে আমেরিকার উদাহরণ দিয়েছেন— যেখানে জিডিপির ১৮ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় হলেও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষা নেই। এখানে আরেকটি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের জন্য একটু পেছনে হাঁটতে হবে আমাদের।

 

ভুলে যাওয়ার ঐতিহাসিক অধ্যায়

ভারী কৌতূহলোদ্দীপক একটি কাহিনি বলছেন স্বয়ং একজন যাঁদের হাত ধরে আধুনিক বিশ্বের আন্তর্জাতিক দরবারে প্রথম বিশ্ব-স্বাস্থ্যনীতি জন্ম নিয়েছিল। ১৯৪৫ পর্যন্ত স্বাস্থ্য একটি “ভুলে যাওয়া” তথা “forgotten” বিষয় ছিল— “One interesting example is that health was “forgotten” when the Covenant of the League of Nations was drafted after the first World War. Only at the last moment was world health brought in, producing the Health Section of the League of the Nations, one of the forerunners of the present FAO, as well as WHO.”[5]

ইভাং-এর বয়ানে পাচ্ছি— “কে ভেবেছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে যখন রাষ্ট্রপুঞ্জের চার্টার তৈরি হচ্ছে তখন স্বাস্থ্য আবার “forgotten” হয়ে যাবে?” ঠিক এটাই ঘটেছিল যখন ১৯৪৫-এর বসন্তে সান ফ্রান্সিসকোতে “জরুরি ভিত্তিতে” বিশ্ব স্বাস্থ্য-কে আলোচ্য তালিকায় আনা হয়। তিনজন মানুষ সেদিন উদ্যোগ নিয়েছিলেন— ব্রাজিলের তরফে ডাঃ পলা সুজা, চিনের তরফে ডাঃ জেমিং জে এবং নরওয়ের তরফে ডাঃ ইভাং স্বয়ং।[6]

সে-সময়ে মাত্র কয়েকটি দেশ ছিল লিগ অব নেশনস-এ। আমেরিকা কখনও সদস্যই হয়নি, ১৯৩৩-এ জার্মানি বেরিয়ে যায়, সাত বছর সদস্য থাকার পরে জাপানও ১৯৩৩-এ বেরিয়ে যায়, ইতালি ১৯৩৭-এ, সোভিয়েত রাশিয়াকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয় ১৯৩৯-এ।

এখানে যে-কোনও জিজ্ঞাসু পাঠককে ভাবাবে, স্বাস্থ্যের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে আন্তর্জাতিক মঞ্চে বারেবারে ভুলে যাওয়া হচ্ছিল কেন? সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য উত্তর হবে সম্ভবত বাণিজ্য হিসেবে স্বাস্থ্য কতটা লাভজনক হতে পারে এবং কী পরিমাণ মুনাফা দিতে পারে তা তখনও অব্দি বহুজাতিক কোম্পানি এবং বিশ্বে প্রভুত্বকারী ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর মাথায় আসেনি, বোধ করি ভালভাবে নজরেও আসেনি।

২০০৫ সালে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর পৃথিবীতে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫০০ বিলিয়ন ডলার, ২০০৭-এ হল ৭১২ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ দু-বছরে বিক্রি বাড়ল শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি।[7] ২০১৮-তে এর পরিমাণ হওয়ার কথা ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের মতো। আরও গুরুত্বপূর্ণ হল এশিয়া এবং আফ্রিকায় ওষুধ ও চিকিৎসা সংক্রান্ত বাজার বৃদ্ধির হার ১৭ শতাংশ, পূর্ব ইউরোপে ১১ শতাংশ এবং লাতিন আমেরিকায় ১০ শতাংশ। অথচ সমগ্র বিশ্বে এ হার মাত্র ৪ শতাংশ। আরেকটা তথ্য হল ২০০৫ সালে প্রযুক্তি-নির্ভর মেডিসিনের চাপে পড়ে ব্রাজিলকে প্রায় ১.৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে।

এরকম একটি লাভজনক বিনিয়োগের চিত্র যতদিন না স্পষ্ট হয়ে ঊঠেছে, ততদিন অব্দি নিও-লিবারাল অর্থনীতির কাণ্ডারীরা স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত বিনিয়োগকর্মে সেভাবে হাত লাগায়নি। ১৯৭০-এর দশকের শুরু থেকে স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ ও বিপুল মুনাফার ধারণা নির্দিষ্টভাবে দানা বাঁধতে শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে শুরু করে ১৯৪৫ সাল অব্দি আন্তর্জাতিক জগতে “forgotten” বিষয়টির চরিত্র। এক নতুন যাত্রাপথ জন্ম নেয়— ১৯৭৮ সালের আলমা আটা সম্মেলনের “সংহত প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা”-র (comprehensive primary health care) এবং “২০০০ সালের মধ্যে সকলের জন্য স্বাস্থ্যর বোধ থেকে ২০১৫-তে এসে অতিমাত্রায় বিক্রয়যোগ্য “স্বাস্থ্যপরিষেবার পণ্য বাজারের বোধে প্রায় পূর্ণত রূপান্তরিত হয়ে গেল।

অধুনা গবেষকেরা দেখিয়েছেন, আফ্রিকার যে দেশগুলোতে এবোলা (Ebola) এরকম মারণান্তক চেহারা নিল সে দেশগুলোতে আইএমএফ এবং বিশ্বব্যাঙ্কের চাপে জনস্বাস্থ্য খাতে ক্রমশ খরচ কমিয়ে প্রযুক্তিনির্ভর (যে প্রযুক্তি, যেমন সিটি স্ক্যানার বা MRI কিনতে হয় বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে) স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়তে বাধ্য হয়েছে। ফলে এবোলা যখন মহামারির চেহারা নিয়েছে তার সঙ্গে মোকাবিলা করার মতো কোনওরকম পরিকাঠামো— সামান্য গ্লাভস বা মাস্ক পর্যন্ত— এ দেশগুলোতে ছিল না।

আমাদের এ আলোচনায় আমরা চারটে বিষয় নিয়ে ভেবে দেখব— (১) “সকলের জন্য স্বাস্থ্য”-র স্লোগান কী করে স্বাস্থ্যপরিষেবার মুক্তবাজারের অর্থনীতির আওতায় চলে এল; (২) প্রাথমিক স্বাস্থ্যপরিষেবার সংহত ধারণা কীভাবে বেছে-নেওয়া (selective) স্বাস্থ্যপরিষেবার ধারণাতে রূপান্তরিত করা হল, যার ফলে ঝাঁ চকচকে অত্যন্ত দামী (নামীও বটে) পাঁচতারা হাসপাতাল বা নার্সিংহোম “ভাল স্বাস্থ্য”-র সমার্থক হয়ে উঠল; (৩) কীভাবে ক্লিনিক্যাল হেলথ বা ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ও এর চিকিৎসা এবং পাবলিক হেলথ বা জনস্বাস্থ্যের মধ্যেকার দার্শনিক অবস্থানগত পার্থক্য মুছে গিয়ে দুটোই একাকার হয়ে গেল, এবং (৪) কীভাবে জনমানসে “ভার্টিকাল হেলথ” অর্থাৎ ব্যক্তিরোগীর রোগ ধরে চিকিৎসা প্রতিস্থাপিত করছে “হরাইজন্টাল হেলথ” অর্থাৎ জনস্বাস্থ্য বলতে যা বোঝায় সে ধারণাকে। একই সঙ্গে আমরা নজরে রাখব মেডিসিনের জগতে শিক্ষাক্রমের ক্রম-রূপান্তর এই সমগ্র প্রক্রিয়াটিকে ত্বরাণ্বিত করল এবং এ পরিবর্তনের একটি উপাদান হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিল।

ওপরের আলোচনার চতুর্থ বিষয়টি তথা মেডিক্যাল কারিকুলামের সঙ্গে চিকিৎসকদের বোধ তৈরি হওয়া, বিশ্বরাজনীতির সঙ্গে মেডিসিনের সম্পর্কের বিষয় সামান্য কথা বলা যাক। পৃথিবীতে এই মুহূর্তে চিকিৎসকমহলে বিশেষ সমাদৃত জার্নাল ‘নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অফ মেডিসিন’ (ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর: ১৭৬.০৭৯)। এ জার্নালে “Murmurs of Politics and Economics” শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। এ প্রবন্ধে বলা হয়— “যদি মেডিক্যাল স্কুলগুলো একটি ‘core component’ হিসেবে গ্রহণ করত, তাহলে ছাত্ররা স্বাস্থ্যপরিষেবার জটিলতাগুলো হৃদয়ঙ্গম করতে পারত— স্বাস্থ্য শুধুমাত্র বায়োলোজির বিষয় নয়, বরঞ্চ এর অভ্যন্তরে বিরাজমান রাজনীতি এবং অর্থনীতির আলোকে বুঝতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কীভাবে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক ও আইএমএফ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে অর্থ জোগায় এগুলো বুঝলে লাভবান হত ছাত্ররা। সে কারণগুলো বুঝতে পারত, কেন নিম্ন আয়ের দেশগুলো একপাক্ষিক সাহায্যের ওপরে নির্ভর করে নিজেদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অর্থের জোগানের জন্য।”[8]

 

ভারতের স্বাস্থ্যচিত্র নিয়ে সামান্য কথা

ন্যাশনাল হেলথ ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে (এনএফএইচএস) সরকার এবং রাষ্ট্র-স্বীকৃত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সমীক্ষা বলে ধরা হয় স্বাস্থ্য, পরিবার, অর্থনৈতিক বিভাজন কীভাবে স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটায়, ইত্যাকার বিভিন্ন বিষয়ে অপক্ষপাত আলোকপাত করে বলে। ভারত সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রক কর্তৃক প্রকাশিত এনএফএইচএস-৫ (২০১৯-২০২১) রিপোর্টে ভারতে রক্তাল্পতা (অ্যানিমিয়া) নিয়ে কিছু অস্বস্তিকর তথ্য সামনে আসে। তথ্যগুলো হল:

  1. এনএফএইচ-এস-৪-এ যেখানে ৬ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুদের ক্ষেত্রে রক্তাল্পতার হার ছিল ৫৮.৬ শতাংশ। এনএফএইচ-এস-৫-এ তা বেড়ে হয়েছে শহরাঞ্চলে ৬৪.২ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে ৬৮.৩ শতাংশ (গড়ে ৬৭.১ শতাংশ)।
  2. সবধরনের ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের রক্তাল্পতার হার এনএফএইচ-এস-৪ থেকে এনএফএইচ-এস-৫-এ ৫৪.১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছিল ৫৯.১ শতাংশ।
  3. ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে এর বৃদ্ধি ছিল ২৯.২% থেকে ৩১.১%।

অন্যান্য উদ্বেগজনক তথ্য হল—

  1. খোলা জায়গায় মলত্যাগ, সরকারের দাবি অনুযায়ী, যেখানে শূন্যে ছিল, এনএফএইচ-এস-৫-এ দেখা গেছে প্রায় ১৯ শতাংশ বাড়িতে কোনওরকম পাকা টয়লেটের ব্যবস্থাই নেই।
  2. ৪০ শতাংশ বাড়িতে পরিষ্কার রান্নার তেলের জোগান নেই। অধিকন্তু, ৫৭ শতাংশ বাড়িতে এলপিজি বা প্রাকৃতিক গ্যাসের কোনও সংযোগ নেই।

এসব তথ্য কার্যত কেন্দ্রীয় সরকারের বহুলপ্রচারিত “উজ্জ্বলা যোজনা” স্কিমকেই প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়। কিন্তু সরকার চায় “পজিটিভ ডেটা”, এবং এর কোনও ব্যত্যয় মেনে নেওয়া মুশকিল।

বিশেষ সমস্যা হয়েছিল রক্তাল্পতার ডেটা-সেট নিয়ে— আন্তর্জাতিক মহলে বেশ আলোড়ন পড়েছিল। ল্যান্সেট-এর মতো মান্য মেডিক্যাল জার্নালে এপ্রিল ১৬, ২০২১-এ একটি বৃহৎ স্টাডিতে দেখানো হয়, রক্তাল্পতা স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। যেমন নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়, শিশুদের ক্ষেত্রে উপযুক্ত বৃদ্ধির হ্রাস ঘটে, এমনকি মস্তিষ্কের বিকাশের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব আছে।[9] আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জার্নাল প্লস (PLoS)-এ ডিসেম্বর ১, ২০২২-এ প্রকাশিত স্টাডির পর্যবেক্ষণ ছিল— “প্রাপ্ত ফলাফল থেকে জনস্বাস্থ্যের একটি ইস্যু হিসেবে ছেলেদের মধ্যে রক্তাল্পতাকে বিবেচনা করা উচিত। পুরুষদের রক্তাল্পতাকেও নিয়মিত স্ক্রিনিং-এর মধ্যে রাখতে হবে জাতীয় বোঝা কমানোর জন্য।”[10] দেশের শ্রমসম্পদ বাড়াতে হলে এ-প্রসঙ্গগুলো একান্ত জরুরি। কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার “সাসটেনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল”-এ পৌঁছনোর পথে এগুলো বিশেষ প্রতিবন্ধক।

 

এবারের স্বাস্থ্যবাজেট (২০২৪-২০২৫)

আমরা নিশ্চয়ই নজরে রাখব যে, এ-সমস্যাগুলো জনস্বাস্থ্য, প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং “সোশ্যাল ডিটারমিনেন্টস অফ হেলথ”-এর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। এ-ঘাটতি পূরণ করা না গেলে মোট সামাজিক শ্রমসম্পদ তৈরিও ব্যাহত হয়। এখানে যে-তথ্যটি আমাদের গোচরে থাকা দরকার তা হল, ন্যাশনাল হেলথ ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে-র কাজ করে এবং রিপোর্ট তৈরি করে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রকের অধীন ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ পপুলেশন সায়ান্সেস (আইআইপিএস) নামের একটি স্বয়ংশাসিত সংস্থা। এর অধিকর্তা ছিলেন আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত বিজ্ঞানী কেএস জেমস। অ্যানিমিয়া-সংক্রান্ত এদের স্টাডি কেন্দ্রের বিড়ম্বনার কারণ হওয়ার দরুন কেএস জেমস-কে এক অদ্ভুত যুক্তিতে বরখাস্ত করা হয় ২০২৩ সালের জুলাই মাসে।[11]

শুধু তাই নয়, এনএফএইচ-এস-৬-এ অ্যানিমিয়াকে অন্তর্ভুক্তই করা হয়নি। আর এবারের বাজেটে একেবারে গোড়ার সমস্যা বাদ দিয়ে “সিকল সেল অ্যানিমিয়া”র গবেষণার জন্য অর্থবরাদ্দ করা হয়েছে। ঘোষণা করা হয়েছে, ২০৪৭ সালের মধ্যে এ-রোগটি নির্মূল করা হবে। ২০২১-এর তথ্যানুযায়ী সিকল সেল অ্যানিমিয়ায় ভোগা রোগীর সংখ্যা ২ কোটির আশেপাশে।[12] আর অ্যানিমিয়ায় ভোগা রোগী ভারতীয় জনসংখ্যার ৬৭.১ শতাংশ পর্যন্ত। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের সমস্যা এড়িয়ে গিয়ে এমন একটি রোগের কথা বলা হল যা তুলনায় অনেক কমসংখ্যক মানুষের আছে এবং, তদুপরি, আন্তর্জাতিকভাবে বেশ একটি সমীহ জাগানোর মতো খবর।

রাষ্ট্রের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকাণ্ড ও ইস্তেহারে স্বাস্থ্য কখনওই গুরুত্ব পায়নি। এবারে্র হেলথ বাজেটের (২০২৪-২৫) ক্ষেত্রেও একই কথা। জিডিপি-র ২ শতাংশও স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ হয় না। এবারেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিশেষজ্ঞরা সবসময়েই বলেছেন, জিডিপি-র অন্তত ৩ শতাংশ স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ করা উচিত। ভারত যেখানে বিশ্বের তৃতীয় শক্তিশালী জিডিপি-র দেশ হতে চাইছে সেখানে একটি তুলনা অনিবার্যভাবেই এসে পড়বে— আমেরিকার স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় জিডিপি-র ১৮.৫২ শতাংশ, চিনের ৫.৫৯ শতাংশ এবং জার্মানির ১২.৮১ শতাংশ। আমাদের অর্থমন্ত্রী এবারের অন্তর্বর্তী বাজেটে স্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ করেছেন ৯০,১৭১ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪-এর বাজেটের তুলনায় বরাদ্দ ২.৬% বেড়েছে।[13] কিন্তু এর মধ্যে মুদ্রাস্ফীতিকে হিসেবে রাখা হয়নি। আরেকটি কথা হল, যদি স্বাস্থ্যখাতে জিডিপি-র ২.৫ শতাংশ বরাদ্দ হত তাহলে টাকার পরিমাণ হত ৮,১৯,০০০ কোটি টাকা। বাস্তব হিসেবে, প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য সুরক্ষা যোজনায় বরাদ্দ হয়েছে ২,৪০০ কোটি টাকা। গত বাজেটে ছিল ৩,৩৬৫ কোটি টাকা— মুদ্রাস্ফীতির হিসেব ছাড়াই ৩৩ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। সরকারের একটি “ফ্ল্যাগশিপ” প্রোগ্রাম পিএম-অভিম (PM-ABHIM)-এ গতবার যেখানে ছিল ৪,২০০ কোটি টাকা, এবারে বরাদ্দ হয়েছে ৪,১০৭ কোটি টাকা।

 

উল্লেখযোগ্য ঘোষণা হল, অল্পবয়সি মেয়েদের[14] জরায়ুর ক্যান্সার রোধের টিকা দেওয়ার জন্য অর্থবরাদ্দ। কিন্তু গভীরে ভাবলে অনেকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়বে, এই ভ্যাক্সিন তৈরির জন্য দৈত্যাকৃতি বহুজাতিক কোম্পানিরা ঝাঁপিয়ে পড়বে না তো? ২২টি নতুন এইমস ধরনের মেডিক্যাল ইন্সটিটিউট তৈরির জন্য অর্থবরাদ্দ করা হয়েছে। গতবছরে এর পরিমাণ ছিল ৬,৮৩৫ কোটি টাকা, এবারে ৬,৮০০ কোটি। গোঁদের ওপরে বিষফোঁড়ার মতো ২০১৪ থেকে তৈরি হওয়া এরকম ১৬টি ইনস্টিটিউট এখনও কার্যত পুরোপুরি চালুই হয়নি। আইসিএমআর-এর গবেষণাখাতে বরাদ্দ হয়েছে ২,৪৩২ কোটি টাকা, গতবারে ছিল ২,৩৬০ কোটি। এমনকি “পোষণ.২” খাতেও মুদ্রাস্ফীতির হিসেব ধরলে বরাদ্দ কমেছে ১.৭৭ শতাংশ।

কোভিড-কালে আমরা দেখেছি, আমাদের দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা কী ভয়ঙ্কর আঘাতের মুখোমুখি হয়েছিল। কী ভঙ্গুর অবস্থায় আছে। কোভিড-উত্তর সময়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে বাঁচিয়ে তোলা-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে “Revitalizing primary care is the key to people’s health in the post‑COVID era” প্রবন্ধে।[15] এটা বোঝা খুব শক্ত নয় যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য এবং জনস্বাস্থ্যখাতে ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি করা ছাড়া দেশের স্বাস্থ্যকে সুরক্ষিত রাখা অসম্ভব। এ-প্রসঙ্গটি এবারের বাজেটে অবহেলিত রইল। এক, ব্যক্তির স্বাস্থ্য তথা “ক্লিনিকাল হেলথ” এবং জনসমষ্টির স্বাস্থ্য তথা “পাবলিক হেলথ”-এর মধ্যে ফারাক করা প্রয়োজন; দুই, “কিউরেটিভ হেলথ” এবং “প্রিভেন্টিভ হেলথ”-এর মধ্যে ভারসাম্য রাখাতে হবে; এবং তিন, “ভার্টিকাল” তথা রোগ-নির্ভর চিকিৎসা (প্রধানত আমেরিকান মডেল) এবং “হরাইজন্টাল” তথা জনস্বাস্থ্য-নির্ভর চিকিৎসার মধ্যেকার ফারাক আজ সবার বোঝা জরুরি। স্বাস্থ্য সুরক্ষিত হওয়ার চাহিদা তো সবার।

ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নাল-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে বলা হয়েছে— “The Ministry of Health source says covid-19 hindered efforts to tackle NTDs for only a few months when the programmes halted. The closure of schools also hampered efforts to reach children.”[16]

 

ওষুধের রাজনীতি এবং ইলেকটোরাল বন্ড

এ লেখা যখন লিখছি সে-সময়ের মধ্যে ভারতের ওষুধ রাজনীতি, ভারতীয় রাজনীতি এবং জনস্বাস্থ্যের দুয়েকটি ক্ষেত্রে কিছু নতুন উপাদান জমা হয়েছে। সেগুলো নিয়ে স্বল্প কথা বলা দরকার।

ইলেকটোরাল বন্ড এবং ওষুধ কোম্পানির নিবিড় যোগ নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। শিক্ষিত জনতার একটি বড় অংশই, আশা করা যায়, এ বিষয়ে অবহিত। শুধু কিছু তথ্য প্রাসঙ্গিক হওয়ার কারণে যোগ করা যায়। এবং, ভেবে দেখতে হবে, এর সঙ্গে আমাদের দেশের ওষুধনীতি, নির্বাচনী রাজনীতি ও জনস্বাস্থ্যের সংযোগ আছে।

প্রথমত, এপ্রিল ২০২২-এ হেটেরো ড্রাগস লিমিটেড এবং হেটেরো ল্যাবস লিমিটেড দুটি সংস্থাই ২০ কোটি টাকা করে মোট ৪০ কোটি টাকার ইলেকটোরাল বন্ড কিনেছিল। এর আগে অক্টোবর ৬, ২০২১-এ ৬টি রাজ্যে এদের বিভিন্ন সংস্থায় আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে কেন্দ্রীয় সরকার-পুষ্ট কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা হানা দিয়েছিল। ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট নগদে ১৪২ কোটি টাকা বাজেয়াপ্তও করেছিল। যাহোক ইলেকটোরাল বন্ড কেনার পরে (শেষ হিসেব ৫৫ কোটি টাকা) এরা স্বচ্ছ নির্মল জলে ধুয়ে যায়। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থারা আর ফিরেও তাকায়নি। প্রশ্ন উঠবে, খামোখা ৫৫ কোটি টাকা এরা দেবে কেন যদি লাভের কোনও আশা না থাকে? যদি এর পরে ওষুধের দাম বাড়ে সেরকম দামী ওষুধ কি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে? এতে দেশের জনস্বাস্থ্যের কিছু উন্নতি হবে কী? আমাদের সাধারণ বিচার-বুদ্ধি কী বলে?

প্রসঙ্গত বলে নেওয়া ভাল, ২০২৩ সালের হিসেবে বহুমূল্য চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি মানুষ ভারতে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। একটি নতুন শব্দবন্ধই তৈরি হয়ে “মেডিক্যাল পভার্টি ট্র্যাপ”। “About 55 million Indians were pushed into poverty in a single year due to patient-care costs, as per a study by the Public Health Foundation of India. The medical debt trap is a big issue in India. A significant percentage of urban as well as rural households are victims of medical debt traps … According to World Bank data, India’s private health expenditure was 72.4% of the total current health expenditure in 2018, whereas the global average was 40.2% in 2018.” (Medical Debt Trap – Pushing Indians in Poverty)

দ্বিতীয়ত, হেটেরো গ্রুপসের মতো একই পরম্পরায় ইন্টাস, লুপিন, ম্যানকাইন্ড, মাইক্রোল্যাবস, টরেন্ট ফার্মা, জাইডাস ফার্মা, গ্লেনমার্ক, সিপলা ইত্যাদি কোম্পানির অফিসে প্রথমে দুর্নীতি ও আর্থিক অনিয়মের জন্য হানা দেওয়া হয় এবং এরপরে সবাই ইলেকটোরাল বন্ড কেনে কোটি কোটি টাকার। ওষুধের দামের ওপরে এর প্রভাব সহজেই অনুময়ে। দান-খয়রাতি করার জন্য এরা টাকা খরচ করে না। ওষুধের মার্কেটিং, যার মধ্যে ডাক্তারকে দেওয়া উপঢৌকনও আছে, ইত্যাদির জন্য কোটি কোটি খরচ করে। না করলে হয়তো ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের আরেকটু নাগালের মধ্যে থাকতে পারত।

তৃতীয়ত, ১৪ মার্চ, ২০২৪-এ ইলেকশন কমিশনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ৩৫টি ফার্মা কোম্পানি প্রায় ১০০০ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে। এবং এই কোম্পানিগুলোর মধ্যে অন্তত ৭টি কোম্পানি আমাদের দেশের দুর্বল পরীক্ষাকাঠামো থাকা সত্ত্বেও নিম্নমানের ওষুধ তৈরি করার জন্য চিহ্নিত হয়েছিল। ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ মেডিক্যাল এথিক্স-এর সম্পাদক অমর জেশানি বলেছেন— “We often see a lax approach by drug regulators, both at state and central level … if pharma companies finance political parties to strike some compromise in regulatory cases at the state level.”

নিয়তির কী পরিহাস, যে অরবিন্দ ফার্মার সিইও ইলেকটোরাল বন্ড কেনার জন্য শাসকদলকে ৩৪ কোটি টাকা দিয়েছে সে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হতে সম্মত হয়েছে। এ যেন অনেকটা সূর্যমন্ত্রের মতো— “জবাকুসুম, সঙ্কাশং কাশ্যপেয়ং মহাদ্যুতিম্ ধান্তারীং সর্বপাপঘ্নং প্রণতোহস্মি দিবাকরম্।”

 

শেষ কথা

বহু স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞের মতামত হচ্ছে—

একটি শক্তিশালী প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো থাকলে স্বাস্থ্যের দীর্ঘস্থায়ী ফলাফল ভাল হয়, স্বাস্থ্যের জন্য খরচ কমে, এবং অনেক বেশি ন্যায়সঙ্গত বণ্টনের বাস্তবতা তৈরি হয়। কারণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা হল সমাজের দুর্বলতর এবং ভঙ্গুর শ্রেণির কাছে স্বাস্থ্যের সুফল পৌঁছে দেওয়ার চাবিকাঠি।[17]

সমধর্মী কথা শোনা গেছে আরেক বিশ্রুত জার্নাল ল্যান্সেট-এ। এ-জার্নালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে সমস্ত দেশে প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং স্বাস্থ্যসুরক্ষার মতো বিষয়গুলো সুরক্ষিত সেসব দেশে কোভিডের ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। এ-প্রতিবেদনের অন্যতম সিদ্ধান্ত— “বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রকের অবশ্যপালনীয় দায়িত্ব হল, স্বাস্থ্যের জন্য লগ্নি করার নীতি এবং স্বাস্থ্যের কাঠামোর সংস্কার করা যাতে একটি ব্যয়বরাদ্দের একটি জাতীয় স্বাস্থ্যলগ্নির ব্যবস্থা তৈরি করা যায়। এ-প্রক্রিয়াটি একটি ভাল সুযোগ সমস্ত ধরনের লগ্নিকারীদের ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ এবং জনগণ-কেন্দ্রিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার লক্ষ্যে পা ফেলা যায়।”[18]

আমেরিকার মতো দেশে যেখানে জিডিপির ১৮ শতাংশের বেশি স্বাস্থ্যের জন্য খরচ করা হয় সেখানে স্বাস্থ্যের বেসরকারি দৌরাত্ম্য এবং অতি বেশি ইন্সিউরেন্স ফি নিয়ে জনগণ অখুশি। স্বাস্থ্যের জন্য ব্যয় জীবনে সুখ এনে দিতে পারছে না। নিচের গ্রাফ থেকে বোঝা যাবে ডাক্তারি পড়ুয়াদের মধ্যে ও-দেশে কীভাবে প্রাইমারি হেলথ কেয়ার ফিজিশিয়ান হওয়ার ঝোঁক ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। হাহাকার পড়েছে— “Primary Care — Will It Survive?”

Percent Change between 1998 and 2006 in the Percentage of U.S. Medical School Graduates Filling Residency Positions in Various Specialties

আন্তর্জাতিক জগতের এতসব অতি গুরুত্বপূর্ণ জার্নালগুলোতে ক্রমাগত লেখালেখি এবং আমেরিকার মতো কর্পোরেট-শাসিত, মুক্ত অর্থনীতির নিও-লিবেরাল দেশের অভিজ্ঞতার পরেও এবারের বাজেটে প্রাথমিক স্বাস্থ্য নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্যই হল না। সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? “রাত কত হইল? উত্তর মেলে না।”


[1] Bhattacharya, Dr. Jayanta. Indian Health Budget 2024 — Some Stocktaking. Doctors Dialogue. Feb 19, 2024.
[2] Commercial determinants of health. WHO. Mar 21, 2023.
[3] ১৯৭৮ থেকে অনুসৃত।
[4] Brundtland, Gro Harlem. India’s health reforms: the need for balance. Lancet. Sep 25, 2018.
[5] Evang, K. “Political, national and traditional limitations to health control”, Health of Mankind [CIBA Foundation Symposium]. ed., Wolstenholme G. E. W. & O’Connor, Maeve. London: J. & A. Churchill. 1967. pp. 196-211.
[6] পূর্বোক্ত, পৃঃ ২০২-২০৩।
[7] Petryana, Adriana. When Experiments Travel. Princeton University Press. 2009.
[8] Lilic, Nikola. Murmurs of Politics and Economics. NEJM. Sep 27, 2018.
[9] Prevalence, years lived with disability, and trends in anaemia burden by severity and cause, 1990-2021: findings from the Global Burden of Disease Study 2021. Lancet. Apr, 2021.
[10] Singh, Aditya. et al. Prevalence and determinants of anaemia among men in rural India: Evidence from a nationally representative survey. PLOS. Dec 1, 2022.
[11] পরে বরখাস্তেরর অর্ডার তুলে নেওয়া হয়।
[12] তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে খানিক সন্দেহ আছে।
[13] বরাদ্দ ছিল ৮৬,১৭৫ কোটি টাকা।
[14] ৯ থেকে ১৪ বছর বয়সি।
[15] Bhattacharya, Jayanta. Revitalizing primary care is the key to people’s health in the post‑COVID era. PubMed. May 31, 2023.
[16] Kapoor, Cheena. Covid-19 sets back progress on neglected diseases in India. theBMJ. Sep 21, 2022.
[17] Woo, Beverly. Primary Care — The Best Job in Medicine? NEJM. Aug 31, 2006.
[18] Ma-Nitu, Serge Mayaka. Financing primary health care: seeing the bigger picture. Apr 4, 2022.