Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ধর্মের অধিকার এবং শূদ্রদের অবস্থা

কাঞ্চা ইলাইয়া শেফার্ড

 


কাঞ্চা ইলাইয়া শেফার্ড স্বনামধন্য রাজনৈতিক তাত্ত্বিক, সমাজকর্মী এবং লেখক। তাঁর এই নিবন্ধটি স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে গত ২০২৩-এর ১৫ আগস্ট দ্য লিফলেট পত্রিকায় ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। নিবন্ধটির গুরুত্ব অনুধাবন করে আমরা এটি বাংলা তর্জমা করে প্রকাশ করলাম

 

১৯৫০-এ একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান গ্রহণ করার আগে দেশের মানুষের কোনও ধারণাই ছিল না যে ধর্মকে আইনি ব্যবস্থার একটি অংশ হিসেবে গণ্য করা হবে।

ভারতের ইতিহাসে একটি নাগরিক সমাজ এবং একটি রাষ্ট্র গঠিত হওয়ার পর ভারতীয় সংবিধানই হল সেই দৃষ্টান্ত যেখানে ধর্মের অধিকার-এর ধারণা দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের জন্য সংজ্ঞায়িত হয়।

ধর্মের অধিকার নিয়ে কোনও ভারতীয় দার্শনিকই কখনও কোনও সার্বিক তত্ত্ব প্রণয়ন করেননি। বিভিন্ন ধর্মীয় অনুশীলন দেশে কয়েকশো বছর ধরেই চলে আসছে, কিন্তু ধর্মের অধিকার বিষয়টি কোনও ব্যক্তিবিশেষ বা কোনও সামাজিক গোষ্ঠী, কারও ক্ষেত্রেই কখনও কার্যকরী হয়নি।

উদাহরণস্বরূপ, হিন্দুত্ব এবং ইসলামকে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদী চর্চা আবর্তিত হতে শুরু করার আগে পর্যন্ত ভারতে ধর্মীয় ভাবাবেগ বস্তুটিই সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল।

সংবিধানের আর্টিকেল ২৫-এ বলা হয়েছে: “Subject to public order, morality and heath… all persons are equally entitled to freedom of conscience and the right freely to profess, practise and propagate religion.”

তারপর আর্টিকেল ২৬-এ আবার সমস্ত গোষ্ঠী (denominations)-কে ধর্মীয় অনুষঙ্গেই তাদের সমস্ত কিছু মেটানোর সুযোগ দেয়। এই আর্টিকেলে শুধু তাদের কথাই বলা হয়েছে যারা একই ঈশ্বরবিশ্বাস নিয়ে সচেতনভাবে কোনও ধর্ম-সম্প্রদায়ে সংগঠিত হয়েছে। ‘গোষ্ঠী’ (‘denomination’) বলতে সম্ভবত বৈষ্ণব, শৈব, ক্যাথলিক, প্রোটেস্টান্ট, শিয়া বা সুন্নি এই সম্প্রদায়গুলিকে বোঝানো হয়েছে।

কিন্তু এই সাংবিধানিক ভাষ্যে শূদ্রদের স্থানটা কোথায়? আম্বেদকরের আগে পর্যন্ত দলিতদের হালও এমনটাই ছিল। এখন, সামাজিকভাবে, শূদ্রদের অবস্থাটাই সবচেয়ে খারাপ।

দলিতরা মোটের ওপর বৌদ্ধদের সঙ্গে এক ধরনের একজাতীয়তা বোধ করে। আদিবাসীদের ওপর ব্রাহ্মণ্যবাদের নিয়ন্ত্রণ খুব একটা ছিল না। তারা আস্তে আস্তে খ্রিস্টধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

এই মুহূর্তে আমরা মণিপুরে খ্রিস্টান আদিবাসী এবং হিন্দু-ব্রাহ্মণ্যবাদের একটা সংঘর্ষ প্রত্যক্ষ করছি। খ্রিস্টধর্ম এবং ইসলামের অধিকারকে সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় থেকে হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি চ্যালেঞ্জ জানিয়ে আসছে। এই দুই ধর্মের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করেছিল ব্রাহ্মণ বুদ্ধিজীবীরা।

প্রথমদিকের হিন্দুত্ব-প্রচারকদের মধ্যে কেবি হেডগেওয়ার, এমএস গোলওয়ালকর এবং ভিডি সাভারকরের নাম সুপরিচিত। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মোহন ভাগবত এবং দত্তাত্রেয় হোসাবলে আজ তাঁদের উত্তরসূরি। এই তালিকায় একজনও শূদ্র বা দলিত বুদ্ধিজীবীকে পাওয়া যাবে না, অথচ যখনই কোনও সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ বেধেছে ব্রাহ্মণ্যবাদী বুদ্ধিজীবীরা এদেরই সেই সংঘর্ষের ময়দানে নামিয়েছে।

 

শূদ্রদের বিভ্রান্তিকর দুর্দশা

আর্টিকেল ২৫-এ শূদ্রদের সমস্যা সমাধানের জন্য কিছুই নেই। ব্রাহ্মণ চিন্তকরা এখন তাদের হিন্দু বলে চালাচ্ছে, কিন্তু একটা ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষরা যে-সমস্ত ধর্মীয় অধিকার পেয়ে থাকে তার কিছুই তারা শূদ্রদের দিতে নারাজ।

‘হিন্দুত্বে’র মধ্যে শূদ্রদের অবস্থানটা ঠিক কী হবে সেটা উপলব্ধি করার জন্য তাদের মধ্যে যেহেতু কোনও চিন্তক জন্ম নেয়নি, তাই হিন্দু ধর্মের নিয়ন্ত্রক ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য ‘দ্বিজ’ (যাদের নাকি দুবার জন্ম)-রা বেশ নিরাপদ বোধ করে।

শূদ্রদের ওপর দীর্ঘস্থায়ী কর্তৃত্ব কায়েম রাখার উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণরা তাদের সংস্কৃত শিখতে দেয়নি। শূদ্রদের দিয়ে তারা মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুবাদের প্রচার চালাচ্ছে আর জাহির করছে যে তাদের হাতে কী বিপুল সংখ্যক শক্তি রয়েছে।

শূদ্ররা আমাদের দেশের জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ। ফলে তারা যদি তাদের গ্রাসকারী এই ‘হিন্দুত্ব’কে একবার চ্যালেঞ্জ করে তবে হিন্দুত্ববাদের হিংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য তাদের বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করাই হোক বা তাদের ভোটের ওপর নির্ভর করে সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতা দখল করাই হোক— কিছুই আর চলবে না।

শূদ্ররা যেভাবে ব্রাহ্মণ্যবাদের অনুশাসন মেনে তাদের একটা অনুগত সামাজিক শক্তি হিসেবে কাজ করে চলেছে, তা কিছুটা বিভ্রান্তিকর। ব্রাহ্মণ বা অন্য দ্বিজ-দের সমান অধিকার তাদের নেই, তারা শুধুই ব্রাহ্মণ বুদ্ধিজীবীদের ঠিক করে দেওয়া অনুশাসন মেনে চলে।

একটা ঐতিহাসিক সম্প্রদায় হওয়া সত্ত্বেও শূদ্ররা এখনও পর্যন্ত তাদের একটা ‘স্বাধীন বিবেক’ তৈরি করে উঠতে পারেনি। তারা ব্রাহ্মণদের চাপিয়ে দেওয়া এক বিবেক-বোধ অনুসরণ করে মাত্র। এই বিবেকবোধ তাদের এই প্রশ্নটা করতেও বাধা দেয় যে হিন্দুত্ব, যা প্রকৃত প্রস্তাবে ব্রাহ্মণ্যবাদেরই নামান্তর, তা তাদের মুক্তি দিতে পারে কি না। তারা ভাবেই না এই ধর্ম আদৌ তাদের মোক্ষ হতে পারে কি না।

ভারতীয় খ্রিস্টান এবং মুসলিমদের একটা ক্ষুদ্র অংশ যথাক্রমে বাইবেল এবং কোরানের সূত্রে এটা অন্তত জানে যে ধর্ম বিষয়টা তাদের কাছে ঠিক কী। কিন্তু এই এই ধর্মবিশ্বাসী বেশিরভাগ মানুষের কাছেই যাজক এবং মোল্লাদের নির্দেশ এবং বচনই বেদবাক্য— তারা সেগুলিই অন্ধভাবে অনুসরণ করে চলে।

কিন্তু এই ধর্মগুলির সপক্ষে এটাই বলার কথা এই ধর্মগুলি অন্তত কোনও জাত বা সম্প্রদায়ের জন্য ধর্মীয় পাণ্ডিত্য অর্জনের পথ রুদ্ধ করেনি।

 

ধর্ম প্রসঙ্গে প্রথম বড় বিতর্ক

স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে মূলত দেশের ইংরেজি-শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে ধর্ম প্রসঙ্গে একটি জাতীয় স্তরের বিতর্ক হয়। মহাত্মা গান্ধি হিন্দুত্বের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ইসলামের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মহম্মদ আলি জিন্না।

হিন্দুত্ব নিয়ে নিজের মত গান্ধি লিপিবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু ইসলাম নিয়ে জিন্না বেশি কিছু লেখেননি। মনে হয় তিনি ইসলামের হয়ে মৌখিক যুক্তিবিন্যাসের ওপরেই বেশি নির্ভর করেছিলেন।

ডঃ বিআর আম্বেদকর সুলিখিত যুক্তি-সহ একটি তৃতীয় ধারণা নিয়ে আসেন। গান্ধির হিন্দুত্বের ধারণায় অস্পৃশ্য-সহ সমস্ত জাতই ছিল হিন্দু।

তিনি কখনওই সেই হিন্দু ধর্মের মধ্যে শূদ্র কৃষিজীবীদের আলাদা স্ট্যাটাসের কথা উল্লেখ করেননি। সেই সময়ে শূদ্ররা ব্রাহ্মণ্য মন্দিরগুলিতে (ওগুলিকে ‘হিন্দু মন্দির’ বলা ভুল) ঢুকতে পারত।

 

শূদ্রদের নিজস্ব কৃষিসম্পর্কিত দেবদেবীদের মন্দিরও ছিল। গান্ধি যাকে হিন্দুত্ব বলেছিলেন সেখানে তাদের আর আলাদা কোনও ধর্মীয় অধিকার ছিল না। তাদের সংস্কৃত শেখার অধিকার ছিল না, পুরোহিত হওয়ার অধিকার ছিল না, ধর্মগ্রন্থ পড়ারও কোনও অধিকার ছিল না।

কোনও ধর্মের কিন্তু এগুলিই কেন্দ্রীয় বিষয়।

মুসলিম এবং খ্রিস্টানদের শত্রু হিসেবে নির্মাণ করতে প্রচুর ব্রাহ্মণ বুদ্ধিজীবী সম্পূর্ণভাবে জড়িত ছিল। বৌদ্ধিক জগতে যে কী ঘটে চলেছে সে-সম্পর্কে শূদ্রদের কোনও ধারণাই ছিল না। তারা কেবল মন্দিরে ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের এবং সমাজে ব্রাহ্মণ বুদ্ধিজীবীদের অনুশাসন পালন করে গেছে।

 

ডঃ আম্বেদকরের দোলাচল

ডঃ আম্বেদকর সংস্কৃত পুঁথির ওপর এবং ‘বর্ণ-ধর্ম’র আদর্শের ওপর ভিত্তি করে শূদ্রদের মর্মান্তিক দুর্দশার কথা লিখেছিলেন। কিন্তু তিনিও তাঁর বই শূদ্র কারা?-তে গান্ধির মতোই শূদ্রদের হিন্দু, এমনকি ‘দ্বিজ’ বলেই বিচার করেছেন।

তিনি ধীরে ধীরে আরও গভীরে ঢুকে অস্পৃশ্যদের অধিকার নির্ধারণ করেন, এবং পরবর্তীকালে শূদ্রদের ‘বর্ণ হিন্দু’-দের একটি বৃহত্তর গোষ্ঠীতে সন্নিবিষ্ট করেন।

খ্রিস্টধর্মের মতো সমসাময়িক বিশ্বের অন্যান্য ধর্মগুলি তার অনুগামীদের সেই নির্দিষ্ট ধর্মমতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ার একটা মৌলিক অধিকার দিয়ে থাকে। কিন্তু ডঃ আম্বেদকর এই বিষয়টিকে তার অন্তর্বস্তুতে গিয়ে ভারতীয় পরিপ্রেক্ষিতে কখনওই যাচাই করে দেখেননি। হয়তো খ্রিস্টধর্মের সঙ্গে ঔপনিবেশিকতার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক থাকার কারণেই।

 

ব্রিটিশ শাসকদের খ্রিস্টান হিসেবেই গণ্য করা হত, এবং খ্রিস্টধর্মমত, হিন্দু ধর্মমতের বিপরীতে, বেশিটা অচর্চিতই রয়ে গেছে।

ততদিনে ইসলাম এ-দেশে সামন্ততান্ত্রিক এবং অভিজাততান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। শিক্ষা ও অনুশীলনের কোনও ব্যাপক সাধারণ তত্ত্বের অনুপস্থিতিতির সুযোগে আশরাফ, মুঘল এবং পাঠানরা মুসলিমদের মধ্যে প্রাধান্য বিস্তার করেছে।

বিপরীতে, ভারতীয় খ্রিস্টধর্ম সমস্ত ব্রাহ্মণ, বেনিয়া, কায়স্থ, ক্ষত্রী এবং ক্ষত্রিয় নেতাদের ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

চিকিৎসাক্ষেত্রে, খ্রিস্টান মিশনারি হাসপাতালগুলিই ‘দ্বিজ’দের কাছে একমাত্র বিকল্প ছিল। তথাকথিত ব্রাহ্মণ্য আয়ুর্বেদ দেশের ‘দ্বিজ’দের কাছেই পৌঁছতে পারত না— শূদ্র, দলিত এবং আদিবাসীদের কথা ছেড়েই দিলাম।

গান্ধি=সহ কোনও ‘দ্বিজ’ লেখকই খ্রিস্টান সেবাকেন্দ্রগুলি সম্পর্কে কোথাও কিছু লেখেননি। খ্রিস্টান মিশনারি হাসপাতালগুলির উপযোগিতা এবং ব্রাহ্মণ বুদ্ধিজীবীদের সেগুলিকে উপেক্ষা করার প্রয়াস— এই দুয়ের গুরুত্বই উপলব্ধি করেছিলেন পণ্ডিতা রমাবাই। করে তিনি ব্রাহ্মণ হওয়া সত্ত্বেও খ্রিস্টধর্মের আশ্রয় নেন, এবং এক মহান সমাজসেবক হিসেবে স্মরণীয় হন।

ডঃ আম্বেদকর, গান্ধি বা নেহেরুর স্তরের কোনও শূদ্র বুদ্ধিজীবীই স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে শূদ্রদের মধ্যে থেকে উঠে আসেননি। মহাত্মা জ্যোতিরাও ফুলে এবং সাবিত্রীবাই ফুলের পর দক্ষিণ থেকে পেরিয়ার রামস্বামী উঠে আসেন। কিন্তু তিনিও যত না তাত্ত্বিক ছিলেন তার চেয়ে বেশি ছিলেন দ্রাবিড় আন্দোলনের নেতা। তারপর যখন আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ঢেউ এসে পড়ল, পেরিয়ার নাস্তিক হয়ে গেলেন।

 

বৌদ্ধিক বিষয়ে প্যাটেলের উদাসীনতা

স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়কার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য শূদ্র নেতা সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল। কিন্তু তিনি কখনওই ‘দ্বিজ’দের বিরুদ্ধে লড়েননি।

তিনি গান্ধির একজন অনুগামী হন, এবং গুজরাতি বেনিয়া এবং ব্রাহ্মণদের মতো নিজেকেও একজন হিন্দু হিসেবে ভেবে নেন। প্যাটেল-দের কিন্তু হিন্দু ভাবা হত না।

ব্রাহ্মণ বেনিয়ারা তাদের শূদ্র কৃষক হিসেবে অপমান করত। ব্রাহ্মণদের কাছে জমি চাষ করা ছিল একটি দোষণীয় কাজ। জৈন বেনিয়ারা কৃষিকাজকে হিংসাত্মক কাজ হিসেবে গণ্য করত।

যদি সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল ‘বর্ণ-ধর্ম’ তন্ত্রের অন্যতম প্রবক্তা গান্ধিকে একবারও জিজ্ঞেস করতেন যে শূদ্ররা কি নিজেদের সন্তানদের হিন্দু ধর্মতাত্ত্বিক স্কুলে পাঠানোর অধিকার ছাড়াই, মন্দিরে পুরোহিত হওয়ার অধিকার ছাড়াই, বা ব্রাহ্মণদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ‘দক্ষিণা’ অর্থনীতির অধিকার ছাড়াই হিন্দু হিসেবে গণ্য হতে পারে? তবে নিশ্চয়ই গান্ধি তাঁর হিন্দু-সংখ্যাগুরুবাদ নিয়ে আবার চিন্তাভাবনা করতেন।

তখন শূদ্রদের ব্যবসা করার অধিকারও ছিল না। ব্যবসা বিষয়টা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করত বেনিয়ারা। গান্ধি নিজেই এসেছিলেন এরকম একটি বেনিয়া পরিবার থেকে। তিনি ঐতিহাসিকভাবে মাংসাশী শূদ্রদের ওপর জোর করে নিরামিষ-ভোজনের অভ্যাস চাপিয়ে দিয়েছিলেন। এই খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের যাত্রাতেও প্যাটেল নীরবে গান্ধিকে অনুসরণ করে গেছেন।

 

শূদ্ররা যদি বলত যে তারা হিন্দু নয়, এই হিন্দু ধর্মটা শুধু ‘দ্বিজ’দেরই ধর্ম, তবে ভারতীয় জনতা পার্টি এবং আরএসএস আজ নিজেদের দিকে যত লোক জড়ো করতে পেরেছে তা কিছুতেই পারত না।

শূদ্রদের শেখানো হয়েছে সমস্ত অ-মুসলিম এবং অ-খ্রিস্টানরাই হল হিন্দু। তারাও সেটা মেনে নিয়ে আজ হিন্দু-সংখ্যাগুরুবাদ গড়ে ওঠার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে।

মূল বিষয়টা হল, এমনকি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসও ‘দ্বিজ’দের নিয়ন্ত্রণে, এবং শূদ্রদের মধ্যে এমন কোনও সৃজনশীল, সাহসী এবং বুদ্ধিজীবী নেতা নেই যিনি হিন্দুদের মধ্যে এবং রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে তাদের অবস্থানের একটা মূল্যায়ন করবেন। শূদ্ররা তাই হাজার বছর ধরে ব্রাহ্মণ্যবাদের অত্যাচারী ধর্মীয় কর্তৃত্বের নিচে বন্দি হয়ে রয়ে গেছে।

 

একজন শূদ্র নেতা প্রয়োজন

হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস দুটোই পুরোপুরি ‘দ্বিজ’ সংগঠন। জন্মের সময় থেকেই এদের মাথায় বসে আছে ব্রাহ্মণরা এবং এদের অর্থ জোগায় হিন্দু এবং জৈন বেনিয়ারা। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে সমস্ত বড় ব্যবসাই ছিল বেনিয়া এবং পার্সিদের হাতে। এরা শূদ্র এবং দলিতদের অস্পৃশ্য মনে করত।

নিচুজাতের মানুষদের যে কীভাবে দেখা হত তার একটা বড় উদাহরণ বরোদায় ডঃ আম্বেদকরের সঙ্গে হওয়া ন্যক্কারজনক অসম্মানের ঘটনা। সেখানে তিনি একজন দলিত বলে তাঁকে এক পার্সি হোটেল থেকে বের করে দেওয়া হয়। মনে রাখতে হবে, ডঃ আম্বেদকর কিন্তু একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ।

ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য শূদ্রদের কোনও ধর্মীয় ক্ষমতা সেদিনও ছিল না এবং আজও নেই। কিছু শূদ্র সামন্তপ্রভু দেশের বিক্ষিপ্ত কিছু অঞ্চলে কিছু আঞ্চলিক দল বানিয়েছে, এবং ফলত সেসব অঞ্চলে তাদের কিছু নগণ্য রাজনৈতিক ক্ষমতা তৈরি হয়েছে। কিন্তু আজও তাদের কোনও কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই।

মন্দির-অর্থনীতি আর ব্যবসায়-অর্থনীতিতে শূদ্ররা কোথায় ছিল? কোথাও না। মন্দির-অর্থনীতি এমনকি আজও বেশিটাই ব্রাহ্মণরা নিয়ন্ত্রণ করে, আর বড় ব্যবসা সব বেনিয়াদের হাতে।

শূদ্ররা বেশিরভাগই কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত। আর ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃত সাহিত্যে ভারতের কৃষিভিত্তিক সভ্যতা প্রায় পুরোই উপেক্ষিত রয়ে গেছে। যদি তাদের মধ্যে ডঃ আম্বেদকরের মতো কেউ আসতেন, তাঁর মতো ইংরেজি-শিক্ষায় কোনও উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিত মানুষ, তবে যে ‘হিন্দুত্ববাদ’ তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে শূদ্ররা তা খণ্ডন করতে পারত।

যদি কোনও শূদ্র নেতা তাদের ব্রাহ্মণ, বেনিয়া, কায়স্থ, ক্ষত্রী এবং ক্ষত্রিয়দের— যাদের পবিত্র উপবীত ধারণের, সংস্কৃত পুঁথি পড়ার এবং ‘গুরুকুল’-এ সংস্কৃত শেখার অধিকার রয়েছে— থেকে ভিন্নতর এক পরিচিতি দিতে পারত, তবে আজকের হিন্দু সংখ্যাগুরুবাদ নির্মিত হতে পারত না।

 

সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদে কোনও শূদ্র নেই

আরএসএস সদস্যরা প্রচার করছে যে তারা প্রাচীন সংস্কৃত পুঁথিতে বর্ণিত সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের আদর্শের ভিত্তিতে দেশ গড়তে চায়।

প্রশ্ন হল, কোনও সংস্কৃত পুঁথিতে ঐতিহাসিক সম্প্রদায় হিসেবে আদিবাসী, দলিত এবং শূদ্রদের কি আদৌ কোনও অস্তিত্ব আছে? তাদের জীবন এবং সমাজে তাদের অবদান নিয়ে লেখা কোনও সংস্কৃত পুঁথি কি আদৌ রয়েছে?

সবচেয়ে বেশি পঠিত প্রাচীন সংস্কৃত বই হল রামায়ণ এবং মহাভারত। দুটি বইতেই ব্রাহ্মণ ঋষি এবং ক্ষত্রিয় রাজারাজড়াদের কথা। দুটি বইই যুদ্ধ-কেন্দ্রিক, এবং যেই যুদ্ধের প্রেক্ষিত থেকে উঠে আসা নৈতিকথার কথা বলে।

কৃষিকাজ এবং কারিগরশ্রেণির জীবন সম্পূর্ণ উপেক্ষিত।

কৃষক এবং কারিগরদের জীবন-সম্পর্কিত কোনও ভাষ্য এই সমস্ত বইগুলিতে নেই। ক্রুতা এবং দ্বাপরযুগের সাহিত্যে শূদ্র, দলিত এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের কোনও অস্তিত্বই নেই।

শূদ্র এবং দলিত শ্রমজীবীদের বাদ দিলে সাধুসন্ত এবং রাজারাজড়ারা খেত কী? তাদের দুর্গ, বাড়িঘর, যুদ্ধাস্ত্র কারা বানাত? ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের সমর-সংস্কৃতি কি কোনও একটা সভ্যতার একমাত্র প্রতিনিধি হতে পারে?

উৎপাদন, সেই উৎপাদন সম্পর্কিত সামাজিক সম্পর্কবিন্যাস, সেই উৎপাদিত দ্রব্যাদির বণ্টন— এগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ নীরব থেকে কোনও সংস্কৃতিকে কীভাবে সূত্রায়িত করা সম্ভব?

যুদ্ধক্ষেত্র সংস্কৃতি তৈরি করে না, করে উৎপাদন-ক্ষেত্র। কিন্তু সেই উৎপাদন-ক্ষেত্রের কোনও হদিশ কোনও সংস্কৃত বইয়ে পাওয়া যাবে না।

সেই সিন্ধু সভ্যতার গড়ে ওঠার দিন থেকেই দলিত এবং শূদ্র কৃষক-শ্রমিকদের কাজই সামগ্রিকভাবে ভারতীয় সভ্যতাকে গড়ে তুলেছে। ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়দের যুদ্ধবিগ্রহ নয়।

একটি দেশের অস্তিত্ব এবং অগ্রগতি পুরোটাই শূদ্র এবং দলিতদের কাজের ওপর নির্ভরশীল। তারা জঙ্গলে বসবাস করে এবং কৃষি, পশুপালন এবং কারিগরি প্রযুক্তির উন্নতি ঘটায়।

উৎপাদনের কোনও ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণ, বেনিয়া, কায়স্থ, ক্ষত্রী এবং ক্ষত্রিয়দের ভূমিকা ছিল না। তারা কেবল ব্রাহ্মণদের বর্ণ-ধর্ম ব্যবস্থার দ্বারা শূদ্র এবং দলিতদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে। ওই ধর্ম-বর্ণ ব্যবস্থারই এখন নাম হয়েছে হিন্দু ধর্ম। তারা নিজেদের ধর্মীয় গোঁড়ামি দিয়ে এখনকার ধর্মীয় যুদ্ধগুলি শুরু করেছে।

গুজরাত, দিল্লি-সহ বহু জায়গার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় শূদ্র এবং দলিতদের পেশিশক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। আজ মণিপুরে খ্রিস্টান কুকি জনজাতিদের বিরুদ্ধে হিন্দু মেইতেই জনজাতিদের পেশিশক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।

 

আরএসএসের ব্রাহ্মণ-পরিচালিত শাখাসমূহ

আরএসএস এবং হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি ব্রাহ্মণ্যবাদকে তাদের দর্শন হিসেবে স্বীকার করে না। তার পরিবর্তে তারা ‘হিন্দু’ শব্দটা ব্যবহার করে যাতে শূদ্রদের তার মধ্যে ঢুকিয়ে নেওয়া যায়। শূদ্রদের লাঠিচালনা এবং আরও নানা শারীরিক কসরৎ শেখানোর জন্য তারা বিভিন্ন ‘শাখা’ (হিন্দু ধর্মীয় স্কুল) চালায়।

যদি আরএসএস একটি হিন্দু সংগঠন হিসেবে সত্যিই একটি জাতপাত-হীন হিন্দু ধর্মীয় ব্যবস্থা চাইত, তাহলে তারা সমস্ত হিন্দু যুবকদেরই মন্দিরে পুরোহিত হওয়ার এবং অন্যান্য ধর্মীয় আচারের পাঠ দিত। কিন্তু যেসব এখানে পড়ানো হয় সেই ‘গুরুকুল’গুলি পুরোপুরি ব্রাহ্মণদের নিয়ন্ত্রণে এবং সেখানে কেবল ব্রাহ্মণ যুবকদেরই পাঠ দেওয়া হয়।

আরএসএসের তৈরি করা ব্যবস্থায় ধর্মীয়-সামাজিক সাম্য নিয়ে প্রশ্ন তোলার কোনও অধিকার শূদ্রদের নেই।

গুরুকুলগুলিতে ব্রাহ্মণ যুবকদের বাদ দিয়ে বেনিয়া, ক্ষত্রিয়, ক্ষত্রী এবং কায়স্থদেরও প্রবেশাধিকার নেই, তবে তারা ব্রাহ্মণ্য ধর্মীয় কাঠামো থেকে অন্যান্য সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকে।

আরএসএস তথা ‘দ্বিজ’দের স্বার্থ সবচেয়ে সুরক্ষিত থাকে জাতপাত-ব্যবস্থা বহাল থাকলে। এই ব্যবস্থার মূল লক্ষ্যই হল শূদ্র এবং দলিতরা। কারণ তারা শ্রম দেয়, এবং সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে তাদেরকেই লেলিয়ে দেওয়া হয়।

দলিতরা এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে, এবং অনেকেই ডঃ আম্বেদকরকে তাদের মুক্তিদাতা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে বৌদ্ধ এবং খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে। কিন্তু শূদ্ররা ‘মায়াবাদ’ নামক এক দর্শনের খপ্পরে পড়ে এখনও ব্রাহ্মণ্যবাদের জালেই আটকা পড়ে রয়েছে। এই মায়াবাদ তাদের বুঝিয়েছে যে যা দেখছ সবই মায়া।

 

মন্দির-অর্থনীতি এবং শূদ্রদের অধিকার

শূদ্ররা মন্দিরে যায় এবং পুরোহিতদের দক্ষিণা দেয়। ব্রাহ্মণ-পরিচালিত মন্দিরে তাদের পুরোহিত হওয়ার কোনও অধিকার নেই। এই মন্দিরগুলিতে কত কত অর্থ সংগৃহীত হয় এবং সেই অর্থ কী কাজে ব্যবহার হয়— এসব বিষয়েও তারা সম্পূর্ণ অনবগত।

গুরুকুলে যে সংস্কৃত শিক্ষা দেওয়া হয় এবং মন্দির-অর্থনীতি পরস্পর-সম্পর্কিত। মন্দির-নগরগুলিতে বেনিয়ারা ব্যবসা করে। ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানগুলি মূলত তাদেরই নিয়ন্ত্রণে এবং তারা ধর্মীয়, সামাজিক এবং আর্থিক মানদণ্ডে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তুল্যমূল্য। এই ব্রাহ্মণ এবং বেনিয়ারাই এখন আরএসএস-বিজেপির ক্ষমতা-কাঠামোয় নিয়ন্ত্রক।

যে-সব রাজ্যে রাজ্য সরকারের অধীনস্থ অনুদান দপ্তর মন্দিরগুলির তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে থাকে, সেখানে হয়তো মন্দির ট্রাস্টের মাথায় এমন কেউ থাকতেও পারেন যিনি শূদ্র কৃষিজীবী পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। কিন্তু তিনি সবসময়েই নিজেকে মন্দিরের প্রধান পুরোহিতের চেয়ে হীনতর বোধ করেন।

কিছু মন্দির প্রচুর সম্পদ আহরণ করে, এবং সেগুলির পুরোহিতদের উপার্জনও প্রচুর। শাসক আরএসএস-বিজেপি এই মাত্রার ক্ষমতাবান পুরোহিত পদটিকে সর্বব্যাপ্ত করে দিতে চায় না।

কংগ্রেস সরকার ধর্মনিরপেক্ষতার মুখোশ পরে কাজ করত। ফলে, জাতপাত-সংক্রান্ত যাবতীয় সাংস্কৃতিক সমস্যাকে তারা পাশ কাটিয়ে যেত।

কংগ্রেসের ওপর নেহেরু পরিবারের নিয়ন্ত্রণ ছিল বহু-সাংস্কৃতিক এবং বহু-ধর্মীয়। কিন্তু আরএসএস এবং বিজেপি পরিকল্পিতভাবে নেহেরু পরিবারের পশ্চাৎপটকে নিশানা করে আক্রমণ চালাতে থাকে। ফলে রাহুল গান্ধি এবং প্রিয়াঙ্কা গান্ধির মতো কংগ্রেসের আজকের নেতৃত্বরা হিন্দুত্বের দিকে ঢলে পড়েছেন। রাহুল গান্ধি এরকমও দাবি করেছেন যে তিনি একজন উপবীতধারী ব্রাহ্মণ।

কংগ্রেসও প্রকৃতপক্ষে দ্বিজ-পরিচালিত। শূদ্ররা সেখানেও নিজেদের আলাদা পরিচিতি নির্মাণে সক্ষম হয়নি, কারণ কংগ্রেসের নেতারা মূলত বিলেতফেরত ব্রাহ্মণ যারা বরাবরই জাত এবং ধর্মের সমস্যাগুলিকে পাশ কাটিয়ে গেছে। আরএসএস এবং বিজেপির ‘দ্বিজ’রা কংগ্রেসের শাসনকালেই বিকশিত হতে পেরেছে।

 

একটি জাতীয় শূদ্র-পরিচিতি আন্দোলন

এটা সুপ্রতিষ্ঠিত যে ব্রাহ্মণ এবং বেনিয়ারা সমস্ত ক্ষেত্রেই বিকশিত হয়েছে— বিশেষ করে শিক্ষগত, সামাজিক, ধর্মীয় এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে— এবং শূদ্রদের পরিচিতি সম্পূর্ণরূপে মুছে গেছে।

ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রাচীন চার বর্ণের— ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বেনিয়া এবং শূদ্র— মধ্যে ব্রাহ্মণরা তাদের প্রাধান্যকারী অবস্থান বরাবরই বজায় রেখে গেছে দেশে একাধিকবার রাজনৈতিক ব্যবস্থার বদল হওয়া সত্ত্বেও। সেই রাজতন্ত্রের আমলেও, ঔপনিবেশিক সময়েও, এবং ১৯৪৭-এর পর থেকে এই গণতান্ত্রিক আমলেও।

খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়ে বেনিয়ারা ক্ষমতার স্বাদ পায়। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়েও মহাত্মা গান্ধি তাদের শক্তিশালী করে তোলেন এবং তারা ক্ষমতা ভোগ করতে থাকে। ২০১৪ সাল থেকে নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহের কৌশলে কর্পোরেট বাণিজ্য পুরোটাই বেনিয়ারা নিয়ন্ত্রণ করছে।

১৯৪৭-এর পরে ক্ষত্রিয়রা কিছুটা অস্তিত্ব-সঙ্কটে পড়ে যায়। কিন্তু ইদানিংকালে যোগী আদিত্যনাথের উত্থানের কারণে এবং অযোধ্যায় নতুন রামমন্দির প্রতিষ্ঠার কারণে (রাম একজন ক্ষত্রিয় রাজা ছিল) ক্ষত্রিয়রা আবার পাদপ্রদীপের আলোয় আসার চেষ্টা করছে। তারা খুব সচেতনভাবে যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বে সংগঠিত হচ্ছে।

শূদ্ররাই বর্তমানে সবচেয়ে খণ্ডবিখণ্ড এবং সবচেয়ে প্রান্তিক সামাজিক গোষ্ঠী। পেশা অনুযায়ী তাদের বিভিন্ন জাতে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।

আঞ্চলিক ভাষা এবং বিচ্ছিন্ন জাত-নামের কারণে তাদের সামাজিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। যদিও প্রতিটি রাজ্যেই তাদের সংখ্যা বিপুল, কিন্তু তাদের একক শূদ্র-পরিচিতিটা নষ্ট হয়ে গেছে।

তাদের একটা অংশ এখন ‘অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি’ (ওবিসি) নামে একটা সাংবিধানিক পরিচিতি পেয়েছে। কিন্তু এই পরিচিতি সম্পূর্ণভাবেই চাকরি এবং শিক্ষায় সংরক্ষণের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাদের ইতিহাস, ধর্মীয় অবস্থান বা সভ্যতায় তাদের অবদান— কিছুই এই পরিচয়ে প্রতিফলিত হয় না।

বেনিয়াদের মতো ‘দ্বিজ’ জাতরাও শূদ্রদের ঐতিহাসিকতাকে পাশ কাটিয়ে এই ওবিসি সার্টিফিকেট হাসিল করেছে। শূদ্র-পরিচিতি নির্মাণে আরও সমস্যা আছে। তাদের মধ্যে সংরক্ষিত শূদ্র (ওবিসি) এবং অসংরক্ষিত শূদ্র এই দুটি ভাগ হয়ে গেছে। এই অসংরক্ষিতরা পড়ছে সাধারণ (জেনারেল) ক্যাটেগরিতে। তাদের মধ্যে জাঠ, কাম্মা, প্যাটেল, রেড্ডি, ভেলামা এবং অন্য অনেক শূদ্র-জাতও রয়েছে।

শূদ্রদের মধ্যে যারা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পেয়েছে তারাও যে-সব ‘দ্বিজ’রা ধর্মীয়, দার্শনিক এবং ঐতিহাসিক বিষয়ে কাজ করে তাদের নাকচ করেনি। মধ্যবিত্ত এবং উচ্চমধ্যবিত্ত শূদ্ররা কৃষিকাজ এবং রিয়েল এস্টেট অর্থনীতিতেই সীমাবদ্ধ।

কাম্মা, মারাঠা, প্যাটেল, রেড্ডি এবং যাদবদের কিছু নেতা অন্ধ্রপ্রদেশের মতো কিছু রাজ্যে আঞ্চলিক দল গঠন করেছেন। কিন্তু সভ্যতা, সংস্কৃতি এবং ধর্ম-সম্পর্কিত ঐতিহাসিক বিষয়গুলি নিয়ে কোনও চর্চা হয়নি।

এই আঞ্চলিক শূদ্র নেতারা জমি, সম্পদ ইত্যাদির মালিকানা এবং রাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতাও হয়তো পাচ্ছেন, কিন্তু তাঁদের ইতিহাস সংক্ষিপ্তই রয়ে যাচ্ছে। কারণ তাঁদের মধ্যে কোনও বুদ্ধিজীবী নেতা নেই।

দলিত এবং আদিবাসী সম্প্রদায় এখন ভারতজুড়েই নিজস্ব পরিচিতি লাভ করেছে। দলিতদের অস্পৃশ্যতার প্রশ্নটি বিশেষ করে ২০০১ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘের ডারবানে অনুষ্ঠিত ‘জাতিভেদ, জাতিবৈষম্য, ভিনজাত-আতঙ্ক, এবং তৎসম্পর্কিত অসহিষ্ণুতা’-বিষয়ক সম্মেলনের পর এখন একটি বৈশ্বিক চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই সম্মেলনের পরে আমেরিকার অনেক রাষ্ট্রে জাতপাতের বিরুদ্ধে আইন তৈরি হয়।[1] কিন্তু শূদ্র এবং ওবিসি-দের আন্তর্জাতিক পরিচিতি এখনও নগণ্য।

আমার মতে, আজ যাকে হিন্দুত্ব বলা হচ্ছে সেই আধুনিক ব্রাহ্মণ্যবাদের মধ্যে ধর্মীয় সাম্য অর্জনের জন্য শূদ্রদের একটা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন প্রয়োজন। সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রে সাম্য আজকের সবচেয়ে জরুরি দাবি।

পুরোহিত হওয়ার অধিকার, হিন্দু ধর্মীয় স্কুলগুলিতে শিশু এবং যুবদের পাঠ নেওয়ার অধিকার, এবং ‘হিন্দু ধর্মীয় সংস্থা’গুলিতে সমতার ভিত্তিতে নিযুক্তি— এগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।

পুরোহিত হওয়ার অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখযোগ্য শৈব পীঠগুলির প্রধান হওয়ার অধিকারও দাবি করতে হবে। বিশেষ করে যে-ধরনের পীঠ এবং মঠগুলি অষ্টম শতকের ব্রাহ্মণ পুনর্জীবনের কাণ্ডারি শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

যদি তাদের ধর্মীয় অধিকার এখনকার মতোই আধাখেঁচড়া থাকে তবে শূদ্রদের অবশ্যই ‘হিন্দুত্ব’ পরিত্যাগ করে নিজেদের নতুন ধর্মীয় ব্যবস্থা তৈরি করা উচিত।


[1] Chakrabarty, Ria. Significance of caste discrimination ban in Seattle. The Leaflet. Mar 6, 2023.