Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

২৩ তম কোলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব : স্মৃতিচারণ

সঞ্জয় সিনহা

 

বিগত দশক জুড়ে চলচ্চিত্র আমাদের যে মোহিনীমায়ায় জড়িয়ে রেখেছিল, নতুন সহস্রাব্দের দ্বিতীয় দশকেও তার চটক কি আর তেমনিভাবে টানে আমাদের? ২৩তম কোলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের বৃষ্টিভেজা দিনগুলোতে নানা রঙের ছাতায় ঢেকে যাওয়া নন্দন চত্বর সেই সংশয়ের কোনও অবকাশ রাখে না। আবার সংশয় থাকেও। কারণ পপকর্ন-মোবাইল শাসিত প্রেক্ষাগৃহের অভ্যাস আর মেগাসিরিয়াল-চর্চিত চিত্ত দু’ঘণ্টার ঘনসংবদ্ধ চলচ্চিত্রকে ধারণ করার বা ন্যূনতম সম্মান জানানোর ক্ষমতা হারিয়ে অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে, এমন উদাহরণও বিস্তর। কখনও হলের ভিতর চলতে থাকে সিট দখলের যুদ্ধ, জ্বলে ওঠে মোবাইলের আলোর ছটা, পর্দার উপরের আলোছায়ার আলপনা অবান্তর হয়ে পড়ে। কখনও যান্ত্রিক গোলযোগে থমকে যায় ছবি। বাইরে তীব্র স্বরে বেজে চলে যন্ত্র(ণা)সঙ্গীত, কখনও আক্রমণ চালায় চলচ্চিত্রের অন্তর্গত নৈশঃব্দের ভিতর। দৈনিক পাশ না পাওয়া বিষণ্ণ তরুণ রেলিংয়ের ধারে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে থাকে বেঢপ এক ক্যামেরার মডেলের পাশে।

মনে হয়, এ এক অদ্ভুত প্রহেলিকা। দিনযাপনের গ্লানি মিথ্যে করে দিয়ে যখন এত মানুষ একসাথে এসে দাঁড়ান বিশ্ব চলচ্চিত্রের সামনে, তখন এক আশ্চর্য ভালোবাসার হীরকদ্যুতি ঝলসে ওঠে।

যে আঁধার আলোর অধিক

উৎসবের অন্ধকার চেয়ার উপহার দেয় আলোকিত অভিজ্ঞতা। আলো ক্রমে নিভে যায়, আমরা প্রবেশ করি অনুভূতির জগতে। আমাদের মতো অন্ধদের সামনে উন্মুক্ত হতে থাকে সংযোগের অসীম রহস্য। শুরু হয় জাপানের চলচ্চিত্রকার নাওমি কাওয়াসের ছবি Radiance।

চিত্র ১ Radiance

নায়িকা মিশাকো অন্ধদের জন্য একটি চলচ্চিত্রের ধারাভাষ্য নির্মাণের কাজে ব্যস্ত, যা পরীক্ষামূলকভাবে পেশ করা হয় কয়েকজন অন্ধ মানুষের কাছে। দৃশ্য বা অনুভূতির আক্ষরিক বর্ণনা কতদূর গ্রহণযোগ্য, নাকি নৈঃশব্দই হিরণ্ময়; এই সব দোলাচলের ভিতরে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে আরও এক সংশয় -– ব্যাখ্যাকর্তার অনুভূতিতে জারিত ব্যাখ্যা অন্য আরেকজনের কাছে কি মূল বিষয়বস্তুর আস্বাদ এনে দিতে পারে? দৃষ্টিশক্তি ক্রমশ কমে আসছে ফটোগ্রাফার নাকামোরির, মিশাকোর সাথে তার তীব্র মতান্তর হয় এইসব আলোচনায়। তারপর শুরু হয় দু’জনের দু’রকম যাত্রা। মিশাকো আলোকচিত্রের সূত্র ধরে, নিরুদ্দিষ্ট বাবার ফেলে যাওয়া মানিব্যাগের টুকিটাকির সূত্র ধরে, ছেলেবেলার বন পাহাড়ের স্মৃতির পথ ধরে, ফিরে যেতে চায় ফেলে আসা সময়ের কাছে। তার চলচ্চিত্রটির ধারাভাষ্য ক্রমাগত বদলে যেতে থাকে, অন্ধদের অনুভূতির জগতের কিছু ইশারা সে ধরতে পারে, এমনকি চলচ্চিত্রের মূল অভিনেতার সঙ্গে দেখা করে মিশাকো, তাদের কথোপকথনের সূত্রে মিশাকোর কাছে উঠে আসে সংযোগের এক নতুন সমস্যা — যখন একই দৃশ্য আলাদা আলাদা ব্যক্তির ব্যাখ্যায় ভিন্ন তাৎপর্যে ধরা দেয়, তখন কীভাবে সে তার বর্ণনাকে করে তুলবে সর্বজনীন? অন্যদিকে একদা আলোর শিল্পী নাকামোরির যাত্রা শুরু হয় চোখের আলোর বাইরের এক অন্য অনুভূতির গহীনে। একদা যে ক্যামেরা ছিল তার হৃদপিণ্ড, এক গোধূলিবেলায় তাকে সে পাহাড়ের ঢালে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। বার বার ঘুরে ফিরে আসে এই কথাগুলি, “Nothing is more beautiful than which disappears before our eyes.” সূর্যাস্তের বিপরীতে নির্মিত হয় কতগুলি মায়াবী ইমেজ, দেখা-না-দেখার ধূসর জগত ফ্রেমের পর ফ্রেমে ছড়িয়ে যায়, খুলে দেয় অন্তর্জগতের পথ। আবহ সঙ্গীতে আবেগের প্রাধান্য বড় বেশি, মিশাকো আর নাকামুরির সম্পর্কের বুননেও বড় বেশি আবেগময়তা। অভিজ্ঞদের মতে এ ছবি নাওমির সেরা কাজ নয়, তবু ছবি শেষ হবার পরেও সংযোগের রহস্যময় জোনাকির দল মাথার অন্ধকারে স্নিগ্ধ আলো জ্বেলে রাখে।

শাশ্বত রাত্রির বুকে সকলি অনন্ত সূর্যোদয়

Oblivion Verses ছবিটার বিস্তার ঘটে কোনও এক উপকথার মতো। ছবির পটভূমি এক নাম-না-জানা দেশ, প্রধান চরিত্র এক নাম-না-জানা বুড়ো। শহর থেকে দূরে এক পাহাড়ি এলাকার একটি মর্গের কেয়ারটেকার সে। দুই সহযোগী তার, এক অন্ধ কবরখননকারী, যাকে মৃত মানুষটির গল্প না শোনালে সে কাজে হাত দেয় না, অন্যজন শববাহী গাড়ির চালক।

চিত্র ২ Oblivion Verses

এ ছবিতে সমস্ত চরিত্রই নামহীন। স্বচ্ছন্দ কৌতুকচলনে গল্প এগিয়ে চলে, ছোট ছোট সংলাপ আর ডিটেলের মধ্য দিয়ে আমরা টের পাই এক স্বৈরশাসনের দমবন্ধ পরিস্থিতি আর তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভের আভাস, সংঘাত এবং একই সময়ে ‘অজ্ঞাত কারণে’ হারিয়ে যেতে থাকা তরুণ প্রজন্মের চিরকালীন ইতিহাস। মর্গের এক শীতল খোপে বৃদ্ধ আবিষ্কার করে এমনই এক বিক্ষোভে যোগ দেওয়া তরুণীর ফেলে যাওয়া মৃতদেহ। মর্গের নীচের দলিল ঘরের ভুলভুলাইয়া থেকে সে বের করে আনে নিজের মেয়ের মৃত্যুর দলিল-দস্তাবেজ, সন্তানের ফেরার অপেক্ষায় বছরের পর বছর ধরে বসে থাকা এক মহিলার কাছ থেকে সংগ্রহ করে জন্মের শংসাপত্র, চেনা জগতের ভিতরে এক অচেনা অভিযানে নেমে পড়ে বৃদ্ধ, যাতে পরিচয় ফিরিয়ে দিয়ে অচেনা মৃত মেয়েটির এক সম্মানজনক সৎকারের আয়োজন করা যেতে পারে। যে কোনওরকম দমনপীড়নের ভিতর থেকে ঠিক বেরিয়ে আসে নাম-না-জানা এই বৃদ্ধ, যেন নাম-না-জানা অসংখ্য মানুষের ইতিহাসের এগিয়ে চলার আখ্যান। অনায়াস ভঙ্গিতেই কখনও কখনও বাস্তবের গণ্ডি পেরিয়ে যান পরিচালক। ভোটের প্রতিশ্রুতিময় ইস্তাহারের উলটো পিঠে ছাপা হয় শোকবার্তা; যে সরকারি অফিসারটি কানে প্রায় শুনতেই পান না, মুহুর্মূহু তার একগাদা এলার্ম ঘড়ির একেকটা বেজে উঠতে থাকে কিন্তু কী কারণে এলার্ম তা তার মনেই পড়ে না; বৃদ্ধ তার কবরের জমি অনন্তকালের জন্য কিনে রেখেছেন শুনে এক মহিলা কেরানি, খুব স্বাভাবিকভাবেই বুঝিয়ে দেন যে আজকাল অনন্তের মাপও ছোট হয়ে গেছে, বড়জোর দশ বা পনের বছর, যার যেমন ট্যাঁকের জোর আর কি! রেডিওতে তিমি মাছের একটি দল সমুদ্রের অগভীর খাঁড়িতে আটকে পড়ার সংবাদ ভেসে আসে, যে তিমিরা কখনও একে অন্যকে ছেড়ে যায় না, এমনকি মৃত্যুতেও, তারা হঠাৎই বৃদ্ধের দৃষ্টিবিভ্রম ঘটিয়ে শহরের আকাশে ভেসে আসে। কখনও বৃষ্টি নেমে আসে পোস্ট অফিসের ভিতর। ক্যামেরা নীরব দর্শকের মতো চুপটি করে বসে থাকে গোটা ছবিটাতে, কেবলমাত্র এইরকম দু’একটি কাব্যের ইঙ্গিতে সে ক্ষণিকের জন্য নিশ্চলতা ভেঙ্গে নড়েচড়ে ওঠে। চিত্রগ্রহণ, বর্ণবিন্যাস এবং আবহ সঙ্গীত মিশে গেছে ইঙ্গিতময় উপকথার শরীরে। ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের কব্জির জোর আর প্রয়োগের সংযম, এ দু’য়ের ভারসাম্য কাব্যকে বিকশিত করেছে। পরিচালক আলিরেজা খাটামি ইরানের মানুষ, তাঁর এই প্রথম ছবির চিত্রগ্রহণ হয়েছে চিলিতে। তাই কি ইরানের ছবির সংবেদনশীলতায় এসে মিশে গেল দক্ষিণ আমেরিকার যাদু বাস্তবতা?

অদ্ভুত আঁধার এক

বিশ্ব চলচ্চিত্রকে আরেকটু নিঃস্ব করে গত বছরের ৯ই অক্টোবর চলে গেছেন আন্দ্রে ওয়াইদা। Afterimage তাঁর শেষ ছবি। বিখ্যাত পোলিশ আভাঁ-গার্দ চিত্রকর Wladyslaw Strzeminski তাঁর জীবনের শেষ কয়েকটি বছরে এঁকেছিলেন একগুচ্ছ ছবি -– Afterimage of Light, তাঁর জীবনকে ঘিরেই স্ট্যালিন জমানার নিষ্পেষণের এক মর্মভেদী দলিল হয়ে ওঠে এই ছবি। শিল্পী তাঁর বাঁ হাত ও বাঁ পা হারিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। ছবির শুরুর দিকের এক দৃশ্যে দেখা যায় সাদা ক্যানভাসের সামনে শিল্পী প্রস্তুত হচ্ছেন আঁকবার জন্য, হঠাৎ-ই সমস্ত ঘর লাল আলোয় ভরে যায়। তাঁর ঘরের জানলা ঢাকা পড়েছে স্ট্যালিনের প্রতিকৃতি আঁকা এক বিশাল ব্যানারে। ক্রাচের খোঁচায় ব্যানার ফুটো করে দেন শিল্পী। এই রূপক তারপর গোটা ছবি জুড়ে বাস্তবের মাটিতে নেমে আসে -– কেবলমাত্র রাষ্ট্রের প্রয়োজনেই শিল্পী কাজ করবেন, সমাজতান্ত্রিক বাস্তবতার ধুয়ো তোলা এ হেন দমনকারী তত্ত্বকে প্রশ্ন করে আর্ট কলেজের পদ হারান তিনি; শিল্পী সঙ্ঘের পদ থেকে বিতাড়িত হন; রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকা রঙের দোকান তাঁকে রঙ বিক্রি করে না; শেষ পর্যন্ত খাদ্য সংগ্রহের ন্যূনতম অধিকারও হারান তিনি। এই দুর্দশার মধ্যেও ছাত্রছাত্রীদের সহায়তায় তিনি গোপনে রচনা করেন Theory of Vision বইটি। যে মানুষটি তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের দেখিয়েছিলেন মুক্ত চিন্তার রাস্তা, চোখের সামনের বাস্তবকে পার করে তাঁর অন্তর্নিহিত অনুভূতির পাঠগ্রহণের গূঢ় রহস্যের দরজা খুলে দিয়েছিলেন, ইউরোপ যখন তাঁকে নতুন সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিল্পীর আসনে বসিয়ে রেখেছে, সেই মানুষটি যে কোনও একটি তুচ্ছ কাজের আশায়, জীবনধারণের জন্য ঘুরে বেড়িয়েছেন রাস্তায় রাস্তায়। যে মিউজিয়ামে তাঁর ছবি সংরক্ষিত রয়েছে, সেখানেও তাঁর কাজ জোটেনি। অবশেষে যক্ষ্মা তাঁকে এই দুর্বিষহ জীবন থেকে নিরাময় দেয়। এক বিষণ্ণ তিক্ততায় ভরে ওঠে পর্দা। তখন মনে হয়, চলচ্চিত্রটি আমাদের আরও কিছু দিতে পারত, শুধু শিল্পের তত্ত্বকথার বক্তৃতা নয়, দিতে পারত এক স্রষ্টা কিভাবে তাঁর সৃষ্টিকে জীবন্ত করে তুলেছিলেন, সেই কাহিনী, কীভাবে জন্ম নিল Neoplastic Room, Colonial Oppression, Afterimage of Light অথবা তার কোলাজগুলি, কেনই বা সময়ের ওঠাপড়া পেরিয়ে টিঁকে রইল তাঁর কাজ। Afterimage of Light সিরিজের ছবির রঙের বৈচিত্র্য চলচ্চিত্রে নেই, শিল্পীর অন্তর্জগতের সেই আলোর বদলে কেবল দমন-পীড়নের ধূসর রঙের বিষণ্ণতা, যা মাঝে মাঝে ছুপিয়ে ওঠে লাল রঙের আগ্রাসনে। তাঁর ভাস্কর স্ত্রী, কন্যা, প্রিয় ছাত্রী -– এদের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কও ছবিতে খুব গুরুত্ব পায় না। ফলে একথাও মনে হয় যে ওয়াইদা সেই দমন-পীড়নের ইতিবৃত্তের বর্ণনাকেই প্রধান গুরুত্ব দিয়েছেন, শিল্পীর অন্তর্জগতের টানাপোড়েন তাঁকে ততটা টানেনি। শিল্পীর চরিত্রে Boguslaw Linda-র অসাধারণ অভিনয় সত্ত্বেও এই অসম্পূর্ণতার অস্বস্তি সঙ্গে থেকে যায়।

যে জন্মেছে, সে জন্মানোদের সাহায্য চায়

Aurora Borialis হাঙ্গেরির প্রখ্যাত নির্দেশক Marta Meszaros-এর সাম্প্রতিক ছবি।

চিত্র ৩ Aurora Borialis

এক অশীতিপর বৃদ্ধা মারিয়া কোমায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। মারিয়ার মধ্যবয়সী কন্যা ওলগা মায়ের দেখভাল করার সময়ে খুঁজে পায় কিছু অচেনা মানুষের ছবি, মায়ের অস্ফুট উচ্চারণে কানে আসে কিছু অচেনা নাম। মারিয়া সুস্থ হয়ে ওঠার পর সে সব সম্পর্কে কোনও প্রশ্ন উঠলেই তিনি প্রসঙ্গান্তরে চলে যান। ওলগা হাল ছাড়ে না, কারণ সে আভাস পায় তার পরিবারের এক অজানা ইতিহাসের, যা কিনা তার আত্মপরিচয়ের সঙ্গেও জড়িত। চলচ্চিত্রকার প্রায় রহস্য কাহিনীর বুনটে, নানান দক্ষ মোচড়ে মেলে ধরেন অন্ধকার সময়ের ইতিবৃত্ত। হাঙ্গেরির সে সব সুখের দিন নয়, নাৎসি আক্রমণের পর লালফৌজের বিজয়, নানান চেহারার দখলদারি ক্রমাগত দেগে দিচ্ছে ক্ষতচিহ্ন। তরুণী মারিয়ার তীব্র অসহায়তা, আতঙ্ক, রাজনৈতিক টালমাটালের ভিতরে দাঁড়িয়ে সাধারণ মেয়েটির টিঁকে থাকা আর সম্পর্কের হিসেবনিকেশ ওলটপালট করে দিয়ে তার মনুষ্যত্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, যা কিনা অন্যদিকে বাকি জীবনের জন্য তাকে ভিতরে ভিতরে দীর্ণ করে দেয়, এ সমস্তই এক বিধুর বিকেলে মেয়েকে খুলে বলে মারিয়া। যন্ত্রণার ক্রুশকাঠ পিঠে নিয়ে মানুষের এই বেঁচেবত্তে থাকার আকাশ অরোরা বোরিয়ালিসের রঙের মায়ায় ধুয়ে যায়। হয়ত এই কাহিনী বা পরিবেশনভঙ্গি ইউরোপীয় চলচ্চিত্রের দর্শকের খুব চেনা, কিন্তু হাঙ্গেরি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে ভারতের এক অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে যেন মারিয়ার পাশে এসে বসেন দেশভাগের পর সীমান্ত পাড়ি দেবার দুঃসহ অভিজ্ঞতা নিয়ে মুখ খুলতে রাজি না হওয়া সারি সারি উদ্বাস্তু মহিলা, চলচ্চিত্রকার যেন তার অনুভবী হাত রাখেন বুকের ভিতরের এক বাস্তুহীন, পরিচয়হীন ক্ষতের উপর -– সেই অনুভূতি, সেই সংযোগটুকু এই চলচ্চিত্রের কাছে পরমপ্রাপ্তি। মারিয়ার চরিত্রে আশি বছরের অভিনেত্রী Mari Torocsik যে অনবদ্য অভিনয় করেছেন, তা নিশ্চয়ই আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।

সে ছিল একদিন আমাদের যৌবনে

কয়েক বছরের ব্যবধানে এবারের উৎসবে আবার পাওয়া গেল গোদারকে। একদিকে যেমন দেখানো হল তাঁর ১৯৮৫ সালে নির্মিত ছবি Grandeur and Decadance of a small film business, আর অন্যদিকে Michel Hazanavicius-এর সাম্প্রতিক চলচ্চিত্র Redoutable আমাদের সামনে হাজির করল গোদারের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যার ভিত্তি গোদারের দ্বিতীয় স্ত্রী Anne Wiazemsky রচিত আত্মজীবনীমূলক বই Roman a clef।

চিত্র ৪ Grandeur and Decadance of a small film business

১৯৬৭ সালে La Chinoise নির্মাণের সময় ঘটে যায় ছবির ১৯ বছর বয়সী নায়িকা Anne–এর সঙ্গে ৩৬ বছর বয়সী পরিচালকের উদ্দাম প্রেম এবং বিবাহ -– যা ভেঙ্গে যায় মাত্র দু’বছরের মধ্যেই। সেই সময়ের পরিসরটুকুকেই ব্যবহার করে এক প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর সঙ্কট, আত্মজিজ্ঞাসা আর অস্মিতাকে সাজিয়েছেন পরিচালক। ১৯৬৮-এর সরবোর্নের উত্তাল ছাত্র আন্দোলনের সাথে পথে নেমেছেন গদার, হাতে ক্যামেরা, পাশে স্ত্রী, চলচ্চিত্রের নতুন দর্শনের খোঁজে নস্যাৎ করে দিচ্ছেন তাঁর নিজেরই মাস্টারপিসগুলি, এমনকি Breathless-ও। তাঁর অদ্ভুত খ্যাপামি আর দ্বিচারিতার জন্য ছাত্ররাও তাঁকে ফিরিয়ে দিচ্ছে পাল্টা বিদ্রূপ। গোদার তবু ভীষণভাবে তারুণ্যের পক্ষে, বলেন, ছাত্ররাই ঠিক, এই তরুণেরা ধরে ফেলেছে যে আমি এখন আর সেই সৃষ্টিশীল মানুষটি নই, কেবল গোদার নামের এক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর ভূমিকায় অভিনয় করছি মাত্র। দ্য গল বিরোধী আন্দোলনের সমর্থনে সে বছর কান উৎসব বাতিল করার অন্যতম হোতা গোদার -– ফলে চলচ্চিত্র জগতের বন্ধুদের সঙ্গে তাঁর মতভেদ তীব্র হয়ে ওঠে। আবার অভিনেত্রী স্ত্রীর অভিনয় করাটা তাঁর পছন্দ নয়, যুক্তি -– অভিনেতা এক ক্রীতদাস, নির্দেশকের অঙ্গুলিহেলনে সে হাসে কাঁদে এমনকি হামাগুড়ি দেয়, স্বাধীনতাহীনতায় বেঁচে থাকাটা কোনও কাজের কথা নয়! একদিকে চলচ্চিত্র জগত ছেড়ে বিপ্লবের বেসামাল স্বপ্নে মশগুল হয়ে ওঠা আর অন্যদিকে পুরুষ প্রভুত্বের অহংবোধ — এইসব স্ববিরোধিতার ঘূর্ণিপাকে বিবাহবিচ্ছেদ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। ছবির আবহাওয়া একদমই গুরুগম্ভীর নয়, পরিচালক তাতে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে কখনও কখনও কৌতুকের ছোঁয়া দিয়েছেন, যেমন প্রতিটি আন্দোলনে গোদারের চশমা ভাঙ্গা এক সরস মন্তব্য হিসাবে ফিরে ফিরে আসে। গোদারীয় ছবির মেজাজে ব্যবহৃত হয়েছে গ্রাফিত্তি, টাইটেল কার্ড, নেগেটিভ, নগ্নতা। গোদারের চরিত্রে অভিনয় করেছেন Louis Garrel, বিতর্কিত মানুষটির জটিল ব্যক্তিত্ব যত্নের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। গোদারের প্রতি তাঁর স্ত্রীর ভালবাসা আর শ্রদ্ধার পাশাপাশি আত্মিক দূরত্ব আর নিঃসঙ্গতা Stacy Martin–এর অভিনয়ে ধরা পড়েছে।

চিত্র ৫ Redoutable

শুধুমাত্র গোদারের বিশেষজ্ঞ, ভক্ত বা বিরোধীদের জন্যই নয়, সমস্ত দর্শকের জন্যই এ ছবি সেই টগবগে সময়ের ইতিহাসের এক উপভোগ্য উপস্থাপনা। প্রসঙ্গত উল্লেখ থাক, তাঁর জীবৎকালেই রচিত এই জীবনীচিত্র প্রসঙ্গে গোদার তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গীতে বলেছেন, “A stupid, stupid idea!”

রক্তক্লেদ বসা থেকে রৌদ্রে ফের উড়ে যায় মাছি

Birds are singing in Kigali ছবির শুরুতেই জাতিবিদ্বেষের তীব্র ঘোষণা ভেসে আসে রেডিওতে, ‘টুটসিরা আরশোলার জাত, আমাদের ঘরে সেঁধিয়ে সাবাড় করছে আমাদেরই খাবার দাবার …’ রোয়ান্ডার নৃশংস গৃহযুদ্ধের পটভূমিকা ফুটে উঠতে থাকে, ১৯৯৪ সালের যে গণহত্যায় সংখ্যাগুরু হুটু উপজাতির মানুষের হাতে নিহত হয় অগুন্তি টুটসি উপজাতির মানুষ।

চিত্র ৬ Birds are singing in Kigali

পোল্যান্ডের পক্ষিতত্ত্ববিদ আনা তখন রোয়ান্ডায়, শকুনদের বিষয়ে তার গবেষণায় ব্যস্ত, যে শকুনেরা বার বার ছবির নানান মুহূর্তে ফিরে আসে, জীবিত ও মৃত, ক্লোজআপের বীভৎসতায় বা লঙ শটের দমবন্ধ করা অস্বস্তিতে, যুদ্ধ মৃত্যু সর্বনাশের প্রতীকের মতো। টুটসি উপজাতির সহগবেষক গণহত্যার শিকার হলে তার কন্যা ক্লডিনকে নিয়ে পোল্যান্ডে পালিয়ে যায় আনা। গণহত্যার আতঙ্ক দুজনকেই তাড়া করে বেড়ায়, নিজের দেশে ফিরেও আনা স্বভাবিক হতে পারে না, আর বিধ্বস্ত দেশছাড়া ক্লডিনকে নতুন দেশ তার আইন-কানুন আর অবজ্ঞা-উপেক্ষা দিয়ে দূরে ঠেলে রাখে। দু’বছরের ব্যবধানে হুটুদের সরিয়ে রোয়ান্ডার শাসনক্ষমতায় আসে টুটসিরা, ক্লডিন ফিরে আসে দেশে, আনাও তার সঙ্গী। কঠিন বাস্তব তাকে বলে, সে দেশ আর তার নয়, ঘরবাড়ি সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে, তার জন্য আর কোনও প্রিয়জন সেখানে অপেক্ষা করে নেই। শুধু গৃহযুদ্ধের গণকবর বহন করছে ইতিহাসের স্মৃতিচিহ্ন। জেলবন্দি এক গণহত্যার পাণ্ডাকে ক্লডিন প্রশ্ন করে, কেন? কেন এই অকারণ হত্যা? উত্তর আসে, আমাদের পালা আপাতত শেষ, এবার তোমাদের সময়… জাতিঘৃণার এই ভয়ঙ্কর দলিলটি সমাপ্তিহীন রেখে দেন নির্দেশক দম্পতি Joana Kos-Krauze এবং Krzysztof Krauze। প্রোডাকশন চলাকালীন Krzysztof মারা যান, Joana একাই শেষ করেন ছবিটি। আনার ভূমিকায় Jowita Budnik এবং ক্লডিনের ভূমিকায় Eliane Umuhire তাঁদের অন্তর্গত আতঙ্ককে আমাদের মধ্যেও পৌঁছে দেন, ঘৃণার উৎসমুখে পৌঁছে আমরা শিউরে উঠি।

যুদ্ধ শুয়ে থাকে তোমার আর তোমার সঙ্গীর মাঝখানের বিছানায়

এবারের উৎসবে রেট্রোস্পেক্টিভ বিভাগে ছিল Michael Winterbottom-এর ছবি এবং নির্দেশক নিজেও উপস্থিত ছিলেন। সাম্প্রতিক ছবি On the road ছিল উদ্বোধনী ছবি, যা দেখা হয়নি এবং শোনা কথা, অধিকাংশেরই তা পছন্দ হয়নি। বাকি ছবিগুলি বহুচর্চিত, তবু তাঁর প্রথম ছবি Welcome to Sarajevo, যা ১৯৯৭ সালে আলোড়ন তুলেছিল এবং ব্রিটিশ রক্ষণশীল ঘরানার বাইরে যা তাঁর নিজস্ব চলচ্চিত্র নির্মাণ পদ্ধতির ধাঁচা তৈরি করে দিয়েছিল, তাকে ফিরে দেখার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেওয়া যাক।

চিত্র ৭ Welcome to Sarajevo

১৯৯২ সালের বসনিয়াতে তখন তীব্র জাতিদাঙ্গা, শহরের বাড়িগুলির দেওয়াল মর্টার আর গুলির ঘায়ে ক্ষতবিক্ষত, কেউ জানে না দূর থেকে কোন স্নাইপারের গুলি এসে তাকে চিরদিনের জন্য স্তব্ধ করে দেবে। তারই ভিতর একটি বিদেশি সাংবাদিক দল কাজ করে চলেছে। সাংবাদিকতার নানা মাপকাঠিতে মাপা হতে থাকে ঘটনা, কখনও ব্রিটিশ রাজপুরুষের ডিভোর্স পিছনে ফেলে দেয় বসনিয়ার খবরকে, কেউ নম্বর দেওয়ার ভঙ্গিতে জানায় বসনিয়া বিশ্বের দুর্দশাগ্রস্ত দেশগুলির মধ্যে ত্রয়োদশ স্থানে রয়েছে, আমেরিকান নিউজ অ্যাংকর ফ্লিন সব সময় ক্যামেরার সামনে থেকে যায় কারণ সে জানে সারাজেভোকে আর কে চেনে, আমাকে চেনে সবাই! ব্রিটিশ সাংবাদিক হেন্ডারসন এই রক্তক্ষয়ী উন্মত্ততার মধ্যে কোনও অর্থবহ কাজ খুঁজে বেড়ায়, একটি অনাথ আশ্রমের শিশুদের সে নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেবার চেষ্টা করে, এমিরা নামের একটি বালিকাকে সে দত্তক নেয়। ছবিটিতে প্রকৃত তথ্যচিত্র আর কাহিনীচিত্র মিশে গিয়ে এক নতুন ভাষ্য তৈরি হয়। গোটা ছবিতে বাজতে থাকে উৎসবের সঙ্গীত, বাইরের পৃথিবীর প্রতি তীব্র বিদ্রূপে। পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক ভয়াবহতায় কখনও কখনও শরীর গুলিয়ে ওঠে, কিন্তু সংঘর্ষের ইতিহাস বা বিশ্লেষণের গভীরে যাওয়ার চেষ্টা এ ছবিতে নেই। পরিচালকের অন্য যে ছবিগুলো এবারের উৎসবে দেখানো হয়, সেগুলো হল The claim, The road to Guantanamo, Trishna, Everyday।

তুমি কি কেবলই

আমরা যারা শিল্পের অত আঁটিসুটি বুঝি না, তাদের সাথে নারায়ণ সান্যাল রোদ্যাঁ’র যে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গেছেন, তেমনটি আর পেলুম না। না, এই উৎসবের Rodin ছবিটিতেও নয়।

চিত্র ৮ Rodin

ছবিটির উপস্থাপনা ঝকঝকে, স্মার্ট। শিল্পীর নির্মাণের পদ্ধতি দেখানোতেও পরিচালক যথেষ্ট যত্নশীল। তবু রোদ্যাঁর স্টুডিওর ভিতরেই আমাদের বেশিরভাগ সময় কেটে যায়, যা চলচ্চিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে ভীষণভাবে পরিকল্পিত, চড়া আলো, বড় বেশি সাদা। সেখানে তৈরি হচ্ছে নরকের দ্বার। ঘুমন্ত ভিক্টর হুগোর মাপ নিয়ে এসে তৈরি হচ্ছে তাঁর মূর্তি। বালজাকের নগ্ন মূর্তির গায়ে আলখাল্লা চড়ানোর সেই বিশ্ববিশ্রুত উপাখ্যান। তাঁর অনন্ত নারীসঙ্গের বর্ণনা, শিক্ষার্থী কামীল, মডেলের দল, সারা জীবনের সঙ্গিনী রোজ-মেরী ব্যুরে। এত তথ্যের ভার পেরিয়ে তবু মানুষটি কেন রক্তমাংসের চেহারা নেয় না? কেন সমসময়ের মনীষীদের কেবলমাত্র নাম উল্লেখ করার জন্যই ডেকে আনা? কেন এত খণ্ড খণ্ড বিক্ষিপ্ত উপাখ্যানের আয়োজন? পরিচালক Jacques Doillon ফ্রান্সের মানুষ, বাংলা ভাষা বোঝেন না, ফলে উত্তরের আশা জলাঞ্জলি দিলুম।

আলো ক্রমে আসিতেছে

আফগানিস্থানের ছবি নিয়ে কৌতূহল ছিল — যুদ্ধ, দারিদ্র্য, অশিক্ষা আর মৌলবাদী দমন-পীড়নের মাঝখানে সে দেশে কী ধরণের ছবি নির্মিত হচ্ছে। A letter to the president ছবিতে পরিচালক Roya Sadat আফগানিস্তানের এক মহিলা সরকারি কর্মচারীর কাহিনী বলেছেন।

চিত্র ৯ A letter to the president

সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাকে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধ অবস্থান নিতে হয়। নানা রকম চাপ আসে তার উপর -– এমনকি স্বামীও তাকে ঘর থেকে বার করে দেয়। উত্তেজিত তর্কাতর্কির মধ্যে দুর্ঘটনাবশত মহিলার স্বামী মারা যায়। দুর্ঘটনার সমস্ত প্রমাণ লোপাট করে দেয় মহিলার প্রভাবশালী শ্বশুর, খুনের অভিযোগে মহিলার ফাঁসির আদেশ হয়। রাষ্ট্রপতির কাছে মহিলার চিঠি পৌঁছলে তিনি ফাঁসির হুকুম রদ করেন, কিন্তু সে নির্দেশ আসার আগেই মহিলাকে হত্যা করা হয়। ছবি হিসেবে হয়তো তত গুরুত্বপূর্ণ নয়, নির্মাণেও হলিউডি প্রভাব প্রবল, এ ছবির সূক্ষ্ম সরকারপক্ষীয় রাজনীতির পৃষ্ঠপোষণও লক্ষণীয়, তবু শুষ্ক মরুর দেশের চলচ্চিত্র বেরিয়ে পড়েছে বিশ্বের উৎসবে, এ এক উল্লেখযোগ্য সংবাদ।

আলোকের এই ঝর্ণাধারা

একটা ছোটদের ছবির কথা বলি, এন এফ ডি সির প্রযোজনায় বানানো প্রমোদ পাঠকের পিন্টি কা সাবুন।

চিত্র ১০ Pinti Ka Saboon

পাহাড়ি গ্রামের একটি ছেলে মেলার দৌড় প্রতিযোগিতায় জিতে পুরস্কার পায় একটি সাবান। যে সে সাবান নয়, তাদের বড়লোক বন্ধু সুন্দরী পিন্টি যে সাবান মাখে, একদম তাই! সাবানের দরুন বন্ধুদের মধ্যে তার দারুণ কদর, গ্রামের লোকের কাছেও, কাউকেই সে ধরতে দেয় না সে সাবান, এমন কি বাড়ির লোককেও নয়। লুকিয়ে লুকিয়ে স্নান করে সে, চারপাশের লোক গন্ধেই মাত! ক্রমে বন্ধুরা সরে যায়, একলা হয়ে যায় সে, এবং হঠাই আবিষ্কার করে ফুরিয়ে যাচ্ছে সাবান! এর মধ্যে সাবানের বিজ্ঞাপন শুট করতে এসে শুটিং পার্টি গ্রামের লোকেদের বিলিয়ে যায় পিন্টি কা সাবুন। শেষ পর্যন্ত হতাশ ছেলেটির সাথে সাবান ভাগ করে নেয় তার সমবয়সী কাকা, আবার তার জীবন ফিরে আসে স্বাভাবিক খাতে। খুবই উপভোগ্য মজার ছবি বানিয়েছেন প্রমোদ, তবে ছোটরা কীভাবে এ ছবি দেখার সুযোগ পাবে, এন এফ ডি সি তার কোনও ব্যবস্থা করেছে কিনা, তার উত্তর আমার জানা নেই।

অনির্বাণ থাক উৎসবের আলো

উৎসবের বেশিরভাগ ছবিই দেখা হয়নি। যেমন আরেকটি রেট্রোস্পেক্টিভ ছিল Pen-Ek Ratanaruang–এর ছবি নিয়ে। থাইল্যান্ডের মেন স্ট্রিম চলচ্চিত্রে তিনি এক নতুন রাস্তা তৈরি করছেন। সহজ গল্প, সহজ বিষয়, কিন্তু একদম সাধারণ মানুষের বাস্তব জীবন, অভিজ্ঞতা ও ভাষা জুড়ে জুড়ে তিনি ছবি বানাচ্ছেন। দেখার ইচ্ছে রইল যাযাবর জীবন ও সঙ্গীতের যাদুকর Tony Gatlif–এর Djam। The Square, Son of Sofia, Kupal, On body & soul, বাংলা ছবি পিউপা, পুরস্কৃত Los Peros, The Swan, এরাও রইল ইচ্ছে তালিকায়। ততটা উচ্ছাস প্রকাশ না করা গেলেও ২৩তম উৎসবে প্রাপ্তির পরিমাণও যথেষ্ট।

শেষ করার আগে কিছু প্রশ্ন আর প্রস্তাব পেশ করা থাক। প্রতিযোগিতা কি না করলেই নয়? কোলকাতার প্রতিযোগিতায় যে কান, বার্লিন বা কার্লোভি ভ্যারির মতো সেরা ছবিগুলি অংশগ্রহণ করবে না, তা তো নিশ্চিত। তার বদলে যদি আমরা সে বছরের নামজাদা উৎসবের ভালো ছবিগুলোকে নিয়ে আসি, তাতে তো আমাদেরই লাভ। ক্লাসিক ছবিগুলি বারবার দেখাতে হবে, কারণ নতুন নতুন প্রজন্মের জন্য বড় পর্দায় সেগুলো দেখার সুযোগ সব সময়েই উন্মুক্ত রাখা উচিত। আঞ্চলিক ছবির প্রদর্শনীর গুরুত্ব বাড়ানো দরকার। ছোট ছবি আর তথ্যচিত্র আরেকটু যত্নের দাবি রাখে, উৎসবের পত্রিকার Shorts & Documentaries শব্দবন্ধের আড়ালে নামহীন ছবিগুলি সুনির্দিষ্ট ব্রোশিওর দাবি করে। তবে সবচেয়ে দুঃখ পেয়েছি এবারের উৎসবের প্রারম্ভ চিত্রটি দেখে, পরেরবারের নির্মাতার কাছে এর চেয়ে খারাপ কিছু বানানোটা সত্যিই চ্যালেঞ্জের। বাকি কিছু অসুবিধার কথাও বলে ফেলি। নন্দন চত্বরে গান চলুক, তবে মৃদু স্বরে। রবীন্দ্র সদনের পর্দা এবার পালটানো হোক, ঐ মাঝখানের জোড়াটা গত কয়েক বছর ধরে মাঝে মাঝে চলচ্চিত্রের দিগন্তরেখার সাথে মিলে মিশে গিয়ে সে এক বিতিকিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটাচ্ছে। আর শিশিরেই যদি ছবি দেখানো হবে, তবে প্রোজেক্টরটা অন্তত এই কয়দিনের জন্য ওপর থেকে ঝোলানো যায় না? আর একটা সনির্বন্ধ অনুরোধ, আন্তর্জাতিক উৎসবে কোনও আন্তর্জাতিক সুরই বাজুক, খামোকা তাতে জাতীয় সঙ্গীত বাজিয়ে কান ধরে ওঠবোস করানোর ব্যাপারটা বন্ধ হোক। জাতীয় সঙ্গীতও যে কোনও জায়গায় ফস করে দশ বার বাজিয়ে ফেলার মতো সস্তা বিষয় নয়।