Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ভিকাস, বিকাশ, উন্নয়ন: রাষ্ট্রের দাবি, দেশের বাস্তব— সপ্তম বর্ষ, নবম যাত্রা

স্টেশনমাস্টারের কলম

 

…সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই আমরা এই সংখ্যায় দেশের প্রকৃত অবস্থাটা জানাতে চেয়েছি আমাদের পাঠকদের কাছে। এই ভোটবাজারে সবচেয়ে সুলভ বস্তু হল বাগাড়ম্বর। এবং সেই বাগাড়ম্বরের ঢক্কানিনাদে বিভিন্ন বুনিয়াদি ক্ষেত্রগুলিতে দেশের বাস্তব অবস্থা গুলিয়ে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। সেই বিপদের কথা মাথায় রেখেই আমাদের এবারের রিজার্ভড বগি ‘ভিকাস, বিকাশ এবং উন্নয়ন: রাষ্ট্রের দাবি, দেশের বাস্তব’-এর পরিকল্পনা। আমরা বেছে নিয়েছি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞানচর্চা, ইতিহাসচর্চা, দুর্নীতি এবং পরিবেশ-এর মতো ক্ষেত্রগুলিকে।…

 

গত ফেব্রুয়ারি মাসে পিউ রিসার্চ সেন্টার-এর একটি সমীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে। সমীক্ষার বিষয় ছিল ‘গণতন্ত্র’ নিয়ে মানুষের মনোভাব। বিশ্বজুড়ে চালানো সমীক্ষা। এককথায় এই সমীক্ষার ফলাফল হিসেবে পিউ জানাচ্ছে— গণতন্ত্রের প্রতি এখনও বেশিরভাগ মানুষই আস্থাশীল, তবে যেভাবে তা চলছে সেটা যথেষ্ট অসন্তোষজনক। অর্থাৎ, সোজা কথায়, যাদের আমরা ভোট দিয়ে গদিতে বসিয়েছি তারা গণতান্ত্রিক আদর্শ ঠিকঠাক মেনে চলছে না বলেই বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষ মনে করছেন।

এই পর্যন্ত অসুবিধা নেই। আমাদের অভিজ্ঞতা ভিন্নতর কিছু নয়। কিন্তু এবার যদি দেশের দিকে তাকাই? ওই যে বললাম, ‘গণতন্ত্রের প্রতি এখনও বেশিরভাগ মানুষই আস্থাশীল’— না, প্রিয় পাঠক! পিউ-এর ওই একই সমীক্ষাতেই জানা যাচ্ছে এই কথাটা আমাদের ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে সত্য নয়। সেখানে আমাদের দেশের মানুষের যে মনোভাবগুলি উঠে এসেছে সেগুলি একবার দেখে নেওয়া যাক। আমাদের দেশের মাত্র ৩৬ শতাংশ মানুষ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রই যে সর্বোত্তম শাসনপদ্ধতি, তা মনে করছেন। ২০১৭ সালে এই সংখ্যাটা ৪৪ শতাংশ ছিল। একজন শক্তিশালী নেতার অধীনে শাসিত হওয়াকে ভাল বলছেন ৬৭ শতাংশ দেশবাসী, ৩০ শতাংশ বলছেন খারাপ। আর প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের বদলে বিশেষজ্ঞ লোকজনের দ্বারা শাসিত হওয়া পছন্দ করছেন দেশের ৮২ শতাংশ মানুষ, অপছন্দ ১৫ শতাংশের।

ধাক্কা হয়তো লাগে, বিশেষ করে আমাদের মতো না-হোমে-না-যজ্ঞে লাগা মধ্যবিত্ত কলমজীবীদের, কিন্তু একটু গভীরে গিয়ে ভেবে দেখুন তো, সত্যিই কি দেশবাসীর এই মনোভাব চমক জাগানোর মতো? নয় কিন্তু। প্রথমেই যে-বিষয়টা পরিষ্কার করে দেওয়া দরকার— গণতন্ত্রের প্রতি দেশবাসীর এই অনাস্থার জন্য কোনওভাবেই তাঁদের দায়ী করা যায় না। গণতন্ত্র কী অর্থ বহন করে তাঁদের কাছে? কী অর্থ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে এই প্রায় পঁচাত্তর বছর ধরে? লিঙ্কনসাহেবের সেই বহুলপ্রচলিত উক্তিটির একমাত্র শেষাংশটুকু ছাড়া বাকি দুটি সত্যিই কি কোনও অর্থ বহন করে এই ‘বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রে’? আর ওই শেষাংশটুকুর প্রয়োগই বা কীরকম? পাঁচ বছর (কখনও কম) পর পর গিয়ে একটু আঙুলে কালি লাগিয়ে আসা? দেশের প্রান্তিক, বুনিয়াদি জনসাধারণের কাছে গণতন্ত্রের অর্থ কি স্রেফ এটুকুই নয়? শুধু তাঁদের কথাই বা বলি কেন? শহরাঞ্চলের তথাকথিত শিক্ষিত মানুষও ভোট দিতে যেতে যথেষ্ট অনীহা যে পোষণ করেন পরিসংখ্যানই তার প্রমাণ। বস্তুত, গণতন্ত্র অনুশীলনের পঁচাত্তর বছর পরেও মানুষকে ভোট দিতে যাওয়ার জন্য রীতিমতো আবেদন করতে হয়, প্রচার করতে হয়— এ-ই কি স্বয়ং গণতন্ত্রের জন্য এক পরম লজ্জা নয়? তাও যদি আবেদন-প্রচারেই সীমাবদ্ধ থাকা যেত! আধাসামরিক বাহিনি বন্দুক দেখিয়ে মানুষকে ভোট দিতে নিয়ে যাচ্ছে— এমন নজিরও তো স্থাপন করতে পেরেছে আমাদের গণতান্ত্রিক ভারত রাষ্ট্র!

তবু, গণতন্ত্রের এমন খর্বিত-খণ্ডিত অনুশীলনের পরেও, অন্য যা-সব বিকল্প এই মুহূর্তে হাতের কাছে, এটিই যে সর্বোৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা— সেটাও স্পষ্ট বলা যাক। আর এইজন্যই গণতন্ত্র নিয়ে এতগুলি শিবের গীত গাওয়া গেল। দেশে অষ্টাদশ সাধারণ নির্বাচন সমাসন্ন। এরকম একটা ব্রাহ্মমুহূর্তে একটা চিন্তা থেকে-থেকেই উত্যক্ত করে চলেছে। গণতান্ত্রিক ভারতবর্ষে দেশবাসী কি এই শেষবার তাঁদের মত-দান করতে যাচ্ছেন?

এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত সময়ের গর্ভে এবং সেখানেই থাক। আমরা কেবল আমাদের শ্রদ্ধেয় পাঠকবন্ধুদের কাছে ভাসিয়ে রাখলাম প্রশ্নটা। বস্তুত, এই যে নির্বাচন সমাসন্ন, এ-নিয়ে আমাদের দায়বদ্ধতা কেবল তাঁদেরই কাছে। নইলে, চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম তো ভোটেও লড়ে না, আর চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম সেই অর্থে নিউজ পোর্টালও নয় যে এই ভোটরঙ্গের নিত্যদিনের খবরাখবর করার জন্য তাদের ব্যস্ততা থাকবে। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম শ্রদ্ধাবনত চিত্তে তার পাঠিকাপাঠকদের কাছে দায়বদ্ধতা স্বীকার করে, যাঁদের অপরিসীম প্রশ্রয়ে তারা তাদের যাত্রার সপ্তম বর্ষ পূরণ করতে চলেছে। হ্যাঁ, বন্ধুরা, এটাই আমাদের সপ্তম বর্ষের শেষ মেল ট্রেন।

আর সেই দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই আমরা এই সংখ্যায় দেশের প্রকৃত অবস্থাটা জানাতে চেয়েছি আমাদের পাঠকদের কাছে। এই ভোটবাজারে সবচেয়ে সুলভ বস্তু হল বাগাড়ম্বর। এবং সেই বাগাড়ম্বরের ঢক্কানিনাদে বিভিন্ন বুনিয়াদি ক্ষেত্রগুলিতে দেশের বাস্তব অবস্থা গুলিয়ে যাওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা। সেই বিপদের কথা মাথায় রেখেই আমাদের এবারের রিজার্ভড বগি ‘ভিকাস, বিকাশ এবং উন্নয়ন: রাষ্ট্রের দাবি, দেশের বাস্তব’-এর পরিকল্পনা। আমরা বেছে নিয়েছি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, বিজ্ঞানচর্চা, ইতিহাসচর্চা, দুর্নীতি এবং পরিবেশ-এর মতো ক্ষেত্রগুলিকে। জয়তী ঘোষ, শুভোদয় দাশগুপ্ত, জয়ন্ত ভট্টাচার্য, নন্দন রায়, মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমন কল্যাণ মৌলিক, দেবাশিস ভট্টাচার্য এবং অনির্বাণ ভট্টাচার্য তাঁদের মূল্যবান লেখাগুলি দিয়ে আমাদের ঋণী করেছেন। এগুলির সঙ্গে আমরা অনুবাদ করে প্রকাশ করছি আনন্দ তেলতুম্বড়ে-র একটি সাক্ষাৎকার। আসন্ন নির্বাচনের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি বুঝতে সাক্ষাৎকারটি অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। অনুবাদ করেছেন অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ।

রিজার্ভড বগির সঙ্গে আরও দুটি বিভাগের কথা উল্লেখ করা জরুরি। এই সংখ্যায় আমরা স্মরণ করেছি সদ্যোপ্রয়াত চিত্রপরিচালক কুমার সাহনি-কে। লিখেছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, চণ্ডী মুখোপাধ্যায়, এবং মানস ঘোষ। সঙ্গে রয়েছে সত্যব্রত ঘোষ-এর অনুবাদে উদয়ন বাজপেয়ির একটি শ্রদ্ধার্ঘ্য।

আর বিশেষ নিবন্ধ বিভাগে আমরা এবার দুটি রচনা অনুবাদ করে প্রকাশ করছি। গোয়া কলা ও সাহিত্য উৎসবে প্রদত্ত কবি রঞ্জিত হসকোটে-র মূল ভাষণটি আমাদের জন্য অনুবাদ করে দিয়েছেন শৌভিক দে সরকার। আমরা কৃতজ্ঞ। সঙ্গে কাঞ্চা ইলাইয়া শেফার্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিবন্ধও অনুবাদ করে প্রকাশ করা হল।

সঙ্গে অন্য সব নিয়মিত বিভাগ থাকল যথারীতি।

ভাল থাকবেন, সঙ্গে থাকবেন, মতামত জানাবেন…