Site icon ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

ঝামেলার নীতিমালা

শিক্ষক

পরিতোষ হেনরি আলম

 

আমার শিক্ষকতার বয়েস প্রায় বিশ বছর হয়ে গেল, এর আগে নিজেদের শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের দেখেছি, মার খেয়েছি বিস্তর, আদরও পেয়েছি অনেক, শিক্ষাক্ষেত্রে এতটা নৈরাশ্য ও নৈরাজ্য আগে দেখিনি আমি। রাস্তায় ঘাটে ট্রেনে বাসে শিক্ষক সম্প্রদায় ‘সফট টার্গেট’, কেমন যেন মনে হয় এর পিছনে একটা বুদ্ধিমান ডিজাইন কাজ করে চলেছে। যে রাষ্ট্রে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক শক্তিশালী, সেখানে রাষ্ট্রের মাথায় বসে থাকা অপোগণ্ডগুলো নিজের ইচ্ছেমত কাজ একটু বুঝেশুনে করে। কথাটা ক্লিশে হলেও সত্যি, কারণ ওরা যত বেশি জানে, তত কম মানে.. এ তো আমরা ছোট থেকেই জানি। শিক্ষিকা শিক্ষকদের মধ্যে দুর্নীতি নেই, স্যাডিজম নেই এমন দাবি করছি না, কিন্তু শিক্ষক শিক্ষিকাদের অংশগ্রহণ সমাজ থেকে সুনিপুণভাবে দূরে সরাতে পারলে রাষ্ট্রযন্ত্রের রাসভকুল উপকৃত হবে, এ আজকের কথা নয়।

কার্লসবাড ডিক্রী মনে পড়ে? প্রিন্স ক্লেমেন্স ভন মেটারনিক ছিলেন অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর, ১৮১৫ থেকে ৪৮-এর মধ্যে বিস্তীর্ণ ইউরোপে তার ক্ষমতা বিস্তৃত ছিল। মেটারনিক খুব ভালোই বুঝেছিলেন, ফরাসী বিপ্লবের গণতান্ত্রিক আদর্শের আঁচ যদি পরাধীন প্রদেশগুলির মননে থাবা বসাতে পারে তবে সহজে অস্ট্রিয়ার সাম্রাজ্যের স্বার্থরক্ষা অসম্ভব হবে। স্বভাবতই শিক্ষা ও গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরার জন্য প্রবর্তিত হল মেটারনিক ব্যবস্থা, কার্লসবাড ডিক্রীর নামে ইতিহাসে কুখ্যাত পিরিয়ড শুরু হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ছাত্রদের মুক্তচিন্তার পরিসর কেড়ে নেওয়ার জন্য একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি হল, অধ্যাপকদের স্বাধীন মুক্ত চিন্তার স্রোতে বসিয়ে দেওয়া হল কোড অফ কনডাক্টস-এর নিপুণ চাপাতি। বলা বাহুল্য, সাফল্যও এসেছিল, মুক্তচিন্তার গলা টিপে ধরা শাসকদের পুরোনো স্ট্র্যাটেজি, আজও এর সাকসেস রেট কম নয়।

ছাত্রশিক্ষকের মুক্তচিন্তায় থাবা বসানো ফ্যাসিজম-এরও একটা পুরোনো টেকনিক। ফ্যাসিবাদ – খুব ওজনদার একটা শব্দ; অবশ্য যেকোনও শাসকগোষ্ঠীকে দুম করে ‘ফ্যাসিবাদী’ বলে দেগে দেওয়া একটা দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয়, সেটাই যখন করতে যাচ্ছি তখন ফ্যাসিজম নিয়ে বলে ফেলা যাক দু-এক কথা। বাঙালির জ্ঞানের পরিধি একসময় নির্ভর করত তার কাছে থাকা জেরক্সের সংখ্যার উপর, এখন তা নির্ভর করে উইকিপেডিয়া পেজের আয়তনের উপর। তো ফ্যাসিবাদ সম্পর্কে উইকি বলছে “Fascism is a form of authoritarian nationalism, characterized by dictatorial power, forcible suppression of opposition”।

আরও বলছে, “liberal democracy is obsolete and they regard the complete mobilization of society under a totalitarian one party state”।

চেনা চেনা লাগছে? এখানে অথোরিটারিয়ান বা কর্তৃত্বমূলক বলতে কী বলা হয়েছে? অথোরিটারিয়ান স্টেট এর দু’টি বৈশিষ্ট্য আছে, প্রথমটি পার্টিসেন্ট্রিক গভর্নমেন্ট যারা পার্টি ভিন্ন অন্যের কোনও ভূমিকা স্বীকারই করে না, দ্বিতীয়টি হল লিমিটেড অর নো পলিটিকাল ফ্রিডম।

তবে সাধারণভাবে বললে টেনট্যাটিভলি আমার কাছে ফ্যাসিবাদের মৌলিক ও অপরিহার্য বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

১। চরম/অনমনীয় পরমত অসহিষ্ণুতা;
২। যে কোনও দ্বিমত বা দ্বিপথের ক্ষেত্রে জবরদস্তির প্রয়াস;
৩। দ্বিমতাবলম্বী বা দ্বিপথাবলম্বীদের বিমানবিকীকরণ – demonisation, dehumanisation, degradation – এক্সপ্লিসিটলি বা ইমপ্লিসিটলি, যেভাবেই হোক না কেন;
৪। সার্বিক রেজিমেন্টেশন ও ইউনিফর্মিটির জবরদস্তিমূলক প্রয়াস – বাস্তব বা/এবং মতাদর্শিক;
৫। ব্যক্তির প্রাইভেট স্পেস বা জগৎকে নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রবণতা।

উপরোক্ত এই ৪ ও ৫ নম্বর নীতির প্রবল ইম্পলিমেন্টেশন শিক্ষাক্ষেত্রে ঢেলে দেওয়া যে কোনও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসকের মাস্টার স্ট্র‍্যাটেজি। এতদিন এই রাজ্যে এই ফ্যাসিজম দেখা বাকি ছিল। এবার তাও শুরু হল বলে।

কলকাতার রাস্তায় এখন নকল বিগবেনের আলোকস্তম্ভ সময় দেখায়, শহরের দক্ষিণে একাধিক রুফটপ আড্ডা ডেস্টিনেশন, সময় বদলেছে, আমরাও। আমি নিজেও ডিজিটালাইজড হয়েছি, স্কুলে যাই ল্যাপটপ নিয়ে, ফোনে ইউটিউব চালিয়ে পড়াই, কিন্তু কোথাও একটা কোণে মনের ভিতর ঊনবিংশ শতাব্দীর রাগী পণ্ডিত মশাই বাস করে, প্রফেশনটা এখনও ডিভাইন, সম্ভবত মোস্ট ইম্পরট্যান্ট, এখনও। মুক্তচিন্তা, স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা, কারিকুলামের বাইরের পৃথিবী চেনানো, এখনও ওরা আমাদের মুখে তাকিয়ে থাকে। এখনও একজন প্রকৃত শিক্ষিকা বা শিক্ষক ছাত্রী বা ছাত্রের মনে আগুন জ্বালানোর ক্ষমতা রেখে দিয়েছেন, আর সম্ভবত সেজন্যেই রাষ্ট্র এখনও শিক্ষকে অশনি সংকেত দেখে চলেছে। তাই এবার আমাদের রাজ্যে শিক্ষিকা শিক্ষকদের উপর ফ্যাসিজম-এর এই খাঁড়া।

স্কুল এডুকেশনের ওয়েব-এ আর কলকাতা গেজেট-এ গত দশই নভেম্বর ২০১৭ প্রকাশিত হল চারটি নোটিফিকেশন, মেমো নং, যথাক্রমে 982-SE/S/1A-10/2017, 984, 985 আর 986, যা একগুচ্ছ কোড অফ কনডাক্ট-এ বেঁধে ফেলল সমস্ত সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত বিদ্যালয়গুলিতে কর্মরত সমস্ত শিক্ষাকর্মীকে। তা রাজ্য সরকার বের করতেই পারেন অসুবিধা নেই, অসুবিধা তখনই, যখন এই সরকারি নিষেধাজ্ঞাকে কার্লসবাড ডিক্রির সাথে তুলনীয় বলে মনে হয়, অথবা সোজাসুজি রাজ্য সরকারের ফ্যাসিবাদী মনোবৃত্তির পরিচয়জ্ঞাপন করে। চারটি নোটিফিকেশন এর একটিতে সরাসরি শিক্ষিকা ও শিক্ষকদের কোড ওফ কনডাক্টের নির্দেশিকা আছে, মূলত সেটিই আলোচ্য। অন্য তিনটি, যথাক্রমে সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলের প্রধান ও সহকারী প্রধান শিক্ষক আর পরিচালন সমিতির কার্যক্রম, বেসরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলিরই নিয়মগুচ্ছ, কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত, আর তৃতীয়টিতে নিউলি অ্যাপোয়েন্টেড টিচারের মেডিক্যাল এক্সামিনেশনের ফরম্যাট।

আলোচ্য শিক্ষাকর্মীদের কোড অফ কনডাক্ট সম্বলিত নোটিফিকেশনটিতে (984-SE/S/1A-10/2017) সর্বমোট ১১ টি পয়েন্ট আছে। Short title হিসেবে বলা আছে “West Bengal Board of Secondary Education (Appointment, Confirmation, Conduct and Discipline of Teachers and Non Teaching staffs) Rules 2017.”

শুরু করার আগে নোটিফিকেশন-এ বলা আছে, প্রকাশের ত্রিশ দিন পর থেকে এই নিয়মাবলী বৈধ, এবং এই নির্দিষ্ট দিনসংখ্যার মধ্যে আপত্তিকর কিছু নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা দয়া করে বিচার করা হবে।

আলোচনার আগে, ১১ টি পয়েন্ট একটু বলে দিই – যথাক্রমে  1. short title, 2. definitions, 3. powers and duty of the board, 4. code of conduct and Discipline of teacher or non teaching staff of recognized institutions, 5. disciplinary proceedings, 6. suspension, 7. substance allowance during suspension, 8. reinstatement and court of period of suspension against service and fixation off pay, 9. penalties 10. appeal, 11. interpretation and relaxation.

এর মধ্যেই বিভিন্ন গণমাধ্যম আর সোস্যাল মিডিয়া অনেক হইচই করে ফেলেছে, তাতে কনফিউশন বেড়েছে শুধু, কাজের কাজ কিছু হয়নি। বিভিন্ন সংবাদপত্র যে খবর প্রকাশ করেছে তাতে অনেক ধোঁয়াশা, তারা নিজেরা নোটিশটি কতবার ও কীভাবে পড়েছেন তা সন্দেহ জাগাচ্ছে। শিক্ষার মত এত জরুরি বিষয়ে রিপোর্ট করতে হলে বোধহয় আর একটু বেশি যত্নবান হওয়া প্রয়োজন।

3 নং পয়েন্ট এ, সংসদের ক্ষমতা বা পাওয়ার অফ দ্য বোর্ড ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলা হয়েছে এখন থেকে নিউ অ্যাপয়েন্টমেন্ট এর একমাত্র অথোরিটি বোর্ড, আগে পরিচালন সমিতির হাতে কিছুটা ক্ষমতা দেওয়া ছিল, পরিচালন সমিতির প্রেসিডেন্ট এর লেটারহেডে বিদ্যালয়ের নিয়োগপত্র আসত, সেটা বদলের এই নীতি নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ ও গুরুত্ববহ। কিন্তু এই ঘোষণার পরেই আসছে ধোঁয়াশা,
আমি উদ্ধৃত করছি,

“… provided that before confirmation of the post of a teacher or non teaching employee, the appointing authority shall verify the character and antecedents of the concerned teacher or non teaching employee through the superintendent of police or commissioner of police on case of a district and through the joint commissioner of police, special Branch Kolkata on case of Kolkata.”

পুলিশের রিপোর্ট-এ জোর দেওয়ার মানে প্রশাসন সরাসরি শিক্ষক শিক্ষিকা নিয়োগের প্রক্রিয়ায় নাক গলিয়ে দিল, দুর্নীতি হবার সুযোগ আকাশ ছুঁয়ে ফেলল। ছাত্রজীবন ও তার পরবর্তীতেও এখন দৈনিক জীবনপ্রবাহ সাবধানে, বিনা বিতর্কে, বিনা প্রতিবাদে ও বিনা রাজনৈতিক মতাদর্শে অতিবাহিত করতে হবে যদি শিক্ষাক্ষেত্রে চাকরি পেতে হয়। সোস্যাল মিডিয়াতে নির্দোষ কার্টুন দিয়েও যে রাজ্যে জেলে যেতে হয় সেখানে হবু শিক্ষকদের উপর এই নিষেধাজ্ঞা খুব আশ্চর্য নয় বোধ হয়, ফ্যাসিজমের একটা বড় লক্ষ্য কিন্তু বিপক্ষের রাজনৈতিক ও নৈতিক বিকাশের পথ বন্ধ করে দেওয়া। আর এই কাজ শিক্ষকদের ক্ষেত্রে হলে তো ফল আরও সুদূরপরাহত হতে বাধ্য।

এই পয়েন্ট-এরই ২ নম্বর নির্দেশিকায় নিউলি অ্যাপয়েন্টেড ক্যান্ডিডেটদের মেডিক্যাল চেক আপ এর কথা বলা আছে, আর পরিষ্কার বলা আছে যদি চেক আপ এর ফলাফল “not satisfactory ” হয়, তবে, “the service of the concerned teacher or non teaching staff shall be terminated without any further references.” লক্ষ্য করুন, টারমিনেটেড উইদাউট এনি ফার্দার রেফারেন্সেস??? অর্থাৎ আমি যদি অসুস্থ হই, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রেও আমায় কনসিডার তো করা হবেই না বরং আমাকে বিনা নোটিশে বরখাস্ত করা হতে পারে? এই নোটিশ তো কর্পোরেট অফিসও দেয়না! একে ফ্যাসিবাদ বলাও ভুল, এ তো নিছক পাগলামি!

এই ৩ নং পয়েন্ট হেডেই আর একটা ছোট তথ্য আছে, স্কুলের ভ্যাকান্সি লিস্ট ও রিসার্ভেশন রোস্টার লিস্ট ও এখন পুলিশ কমিশনার অফিসের মাধ্যমে মেইনটেইন হবে, যারা স্কুলের ভ্যাকান্ট পোস্টের পি পি বের করার জন্য ডি আই আর এ ডি আই এ ছোটাছুটি করেছেন, তারা ভাবলেই বুঝবেন এর মধ্যে কমিশনারের অফিস নাক গলালে এই ছোটাছুটির ঝামেলা কোথায় গিয়ে পৌঁছতে পারে।

এবার আসি মূল চার নম্বর পয়েন্ট হেডে, অর্থাৎ শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের কোড অফ কনডাক্টস। সর্বমোট ২৪ দফা নিয়ম আছে যা শিক্ষিকা ও শিক্ষকদের দ্বারা পালনীয়। সাদা চোখে দেখতে গেলে বেশিরভাগ নীতিগুলিই তথাকথিত শিক্ষক শিক্ষিকার কর্তব্য ও আদর্শ শিক্ষা দিচ্ছে, বা বলা ভালো মরাল ডিউটির পাঠ পড়াচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হল, রাষ্ট্র (রাজ্য সরকার) কি জোর করে মরালিটিও ইমপোস করতে পারে? সেটাও কি ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর হল না?

প্রথম দফা নীতিতে (রুল ১) বলা হচ্ছে এমন কোনও আচরণ করা যাবে না যা শিক্ষক শিক্ষিকা সুলভ নয়.. “Which is improper and unbecoming of a teacher, and derogatory to the prestige of the institution”.. কোন আচরণ শিক্ষকসুলভ তা কে বলে দেবে? রাষ্ট্র না পরিচালন সমিতি, যে যুগে যে রাজ্যে আমরা বাস করি, সেখানে দিদিমণিরা শাড়ির বদলে সালোয়ারে স্বচ্ছন্দ হলে সেটাকেও ডেরোগেটরি আখ্যা দেওয়া হয়.. তাহলে কে ঠিক করে দেবে কোনটা কোট আনকোট আনবিকামিং অফ আ টিচার। শিক্ষক শিক্ষিকাদের বিরুদ্ধে জনমানসে ইন্ধন দেবার আর একটি পথ প্রশস্ত করা হল।

দ্বিতীয় দফা (রুল ২) শুনতে খুব ভালো, শিক্ষিকা বা শিক্ষকরা নেশা করতে পারবেন না, জুয়া খেলতে পারবেন না বা মদ বা অন্যান্য ড্রাগ স্কুল প্রেমিসেস বা অন্যান্য কোনও পাবলিক প্লেসে নিতে পারবেন না। কিন্তু এর পরেই আসছে দারুন মজা, পাবলিক প্লেসের সংজ্ঞা বলে দেওয়া আছে..
Public place = which the public have, or are permitted to have access, whether on payment of otherwise.
এর মানে কি? ডিউটি আওয়ারস-এ আমি অলিপাবে গিয়ে মদ্যপান করব না, করি না, কেউ করে না.. কিন্তু ডিউটি আওয়ারস-এর বাইরে আমি যদি জুয়াও খেলি, (শিক্ষক শিক্ষিকাদের পক্ষে আনবিকামিং, মেনে নিচ্ছি) রাষ্ট্রের বাবার কি? এটা পরিষ্কার ব্যক্তিস্বাধীনতার গলায় পা দিয়ে মাড়ানো হল।

এরপরেই চলে যাচ্ছি নীতিমালার পাঁচ নম্বর দফায়, পরিষ্কার লেখা আছে শিক্ষক শিক্ষিকারা বোর্ডের অনুমতি ব্যতীত বই লিখতে পারবেন না। শুধু সহায়িকা বা নোটবই নয়, যেকোনও বই!! এর মানে কী? এটাও তো ব্যক্তি স্বাধীনতায় হাত দেওয়া হল, আমি শাসক পার্টির ইতিহাস লিখতে গেলে আমায় অনুমতি দেওয়া হবে, কিন্তু ডেঙ্গু, দ্য নিউ এম্পারার অফ ক্যালক্যাটান ম্যালাডিস, লিখতে চাইলে অনুমতি দেওয়া হবে না, বাহ! এরপরও প্রতিবাদ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে??

ছয় নম্বর পয়েন্টে প্রাইভেট টিউশন সম্পূর্ণ নিষেধ করে দেওয়া হয়েছে, ভালো পদক্ষেপ, নিঃসন্দেহে.. কিন্তু নন প্রাকটিসিং ফি এর মত নন টিউটরিং ফি চালু করলে হয় না?? জেনগেন গর্জে উঠবেন, লজ্জা করে না!! আপনি না শিক্ষক? ঠিক, কিন্তু দুইখান কথা আসে.. এক, প্রচুর শিক্ষক শিক্ষিকাকে চিনি যাঁরা নিখরচায় একের পর এক ছাত্র পড়য়ে যাচ্ছেন, নিজের গরজে, তাঁদের কথা কেউ তো বলে না।
আর দুই, পড়ানোটাও শিখতে হয়, প্র‍্যাক্টিস করতে হয়, ওটা ফ্যালনা নয়, পড়ানোতেও প্রফেশনালিজম আছে। সবাই সব কিছু পারে না। এবার এটা মেনে নিন।

পনেরো সংখ্যক নিয়মটি নিয়ে ভীষণ ধোঁয়াশা আছে, পয়েন্ট টা তুলে দিচ্ছি..
“Every teacher or non teaching staff may participate in any programme, if permitted by the Board and of upon instruction of Government.”

গুগুল বলছে..“Program” is US English. It is used for every meaning of the word, both as a noun and a verb. “Programme” is UK English. It is used for every meaning of the word, both as a noun and a verb, EXCEPT in relation to computer programs, where the American spelling is used for both the noun and verb.

অর্থাৎ এই প্রোগ্রাম বলতে সরকার নির্দেশিত ট্রেনিং প্রোগ্রাম হতে পারে, আবার বেসরকারি রক্তদান শিবিরও হতে পারে, কেবল দ্বিতীয়টির ক্ষেত্রে অনুমতি নিতে হবে, আর তাতে অনুমতি দেওয়াটা কিসের উপর নির্ভর করবে তা আর বলব না, তবে সেই যে কী একটা ব্রীজ ভেঙে পরার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই যে একটা রক্তদান শিবির হয়েছিল, যা আবার ভণ্ডুল করে দেওয়া হল.. ওইরকম প্রোগ্রাম-এ অনুমতি পাওয়া যাবে কি?

সবচেয়ে বিতর্কিত দু’টি পয়েন্ট এ আসছি এবার.. ২১ নম্বর আর ২২ নম্বর। প্রথমটিতে প্রতি বছর ৩০শে এপ্রিলের মধ্যে সম্পত্তির পুরো হিসেব দাখিল করতে হবে বোর্ডে, প্রধান শিক্ষিকা বা শিক্ষক তা ডিস্ট্রিক্ট ইন্সপেক্টরের মাধ্যমে বোর্ডে পাঠাবেন। দরিদ্র স্কুল শিক্ষক, কটা টাকাই বা পাই, তার উপর ডি এ দেওয়া হয় না!! ট্যাক্স দেবার সময় তো আয়ের হিসেব করাই হয়, তার পর আবার এই গোদের উপর বিষ ফোঁড়া?  বেশিরভাগ নতুন শিক্ষক শিক্ষিকাদেরই তো বাড়ি থেকে তিরানব্বুই কিলোমিটার যাতায়াত করতে হয়, তাঁরা টিউশনটাই বা করবেন কখন আর ঘুষটাই বা খাবেন কীভাবে? এই নিয়মটা পরিচালন সমিতির উপর আরোপ করলে হত না?? মিড ডে মিলে চাল কেনার নামে….. যাক গে!

২২ নম্বর তুলে দিচ্ছি পুরোটাই, না হলে ধোঁয়াশা কাটবে না..

“No teacher or non teaching staff shall move against the government or the commissioner of school education or the board or the district inspector of schools (secondary education) or the additional district inspector of schools (secondary education) of the concerned sub division as the case may be, to any court of law, without service of any written representation upon the concerned authority and affording such authority a reasonable opportunity to dispose of the same except when there is imminent threat to the life or liberty of the teacher or the non teaching staff.”

সোজা কথা, বোর্ড বা বোর্ডের কোনওরকম যন্ত্রাংশের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না, (এক্রামুল বারির পসার গেল আর কি!) যদি না শিক্ষাকর্মীর জীবন ও স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ না হয়। মানে? কী করে বুঝব কখন জীবন ও স্বাধীনতায় “ইমিমেন্ট থ্রেট” আসতে চলেছে? পরিচালন সমিতির প্রেসিডেন্ট চাপাতি নিয়ে তেড়ে এলে? মোদ্দা কথা, একের পর এক ব্যক্তিগত ও জনস্বার্থ মামলায় হেরে গিয়ে কোর্ট অফ ল তে গিয়ে জাস্টিস চাওয়ার স্বাভাবিক অধিকারটাতেও এবার থাবা বসানোর চেষ্টা চলছে। ব্যক্তিস্বাধীনতা নয় ব্যক্তিগত জীবনেও হাত পড়ছে এবার।

২৩তম দফাতে বলা আছে যেকোনও অন্য পেশায় যাবার পরীক্ষাতে যাবার আগে ডি আই-এর মাধ্যমে বোর্ডের অনুমতি নিতে হবে। আপাত দৃষ্টিতে এই নিয়মে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই একটি জনস্বার্থ মামলার সাপেক্ষে হাইকোর্টের একটি নির্দেশিকায়। স্টেট ভার্সাস কবিতা ঘোষের এই মামলাটি বিখ্যাত, যথারীতি কবিতা ঘোষের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন স্বনামধন্য এক্রামুল বারি। কবিতা দেবী অসুস্থতা ও দূরত্বজনিত কারণে ট্রান্সফার পেয়ে যাবার পরেও তার স্কুল তাকে রিলিজ দিতে অস্বীকার করে, তিনি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন। কোর্ট রায় দেয়, যেকোনও পেশাগত উন্নতিকল্পে কোনও সরকারি সংস্থা তার কর্মীদের বাধাদান করতে পারে না আর এক্ষেত্রে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট-এরও প্রয়োজন নেই।
মানে ২৩ নম্বর নিয়মে রাজ্য সরকার হাইকোর্টকে আরও একবার অমান্য করল। এর কিছুদিন আগেই হাইকোর্ট ঘোষণা করল যে অসুস্থতাজনিত কারণে যে সব স্পেসাল গ্রাউন্ডে ট্রান্সফার আটকে আছে সেগুলিকে ছেড়ে দিতে হবে। পরের দিনই বিদ্যালয় শিক্ষা বিভাগ অর্ডার জারি করল সমস্ত রকম ট্রান্সফার অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ। সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে।

আর একটা বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষন করে শেষ করব, ডিসিপ্লিনারি প্রসিডিংস নিয়মের ৭ নং পয়েন্টে বলা আছে,

“The teaching or non teaching staff against whom disciplinary proceedings have been instituted may take the assistance of any other teaching or non teaching staff to present the case on his behalf, but may not be allowed to engage a legal practitioner.. unless…”

আনলেস ডিসিপ্লিনারি অথোরিটি বা বোর্ড অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করে। শিক্ষক বা শিক্ষিকা যদি অন্যায় করেনও, তার কপালে একজন আইনজ্ঞ জুটবে না!?

ও হ্যাঁ সম্পুর্ণ নোটিফিকেশন এ he him his এর একচ্ছত্র ব্যবহার, আমি সত্যিই জানি না এটাই আইনি পরিভাষা কিনা, সেটা আমার অক্ষমতা, কিন্তু যদি তাই হয়, তবে সেই পুরুষতান্ত্রিক আইনি পরিভাষার তীব্র নিন্দা করি।

আর পুরো নোটিশে বিশাখা গাইডলাইন (গুগুল করুন, কর্মক্ষেত্রে সেক্সুয়াল আর ভার্বাল হ্যারাসমেন্ট এড়াতে ব্যবস্থা) এর কোনওরকম উল্লেখ পেলাম না, শিক্ষিকাদের বা মহিলা শিক্ষাকর্মীদের কথা একটু ভাবা বোধ হয় উচিৎ ছিল।

তবে শেষ পর্যন্ত উদ্দেশ্য কিন্তু খুব পরিষ্কার, ডাক্তারবাবুদের শায়েস্তা করা হয়েছে, এবার শিক্ষক শিক্ষিকাদের শায়েস্তা করতে পারলে আয়োজন সম্পন্ন হয়, কারিকুলামের মিডিওকারাইজেশন তো কেন্দ্র রাজ্য প্রতিযোগিতা করে করেই দিয়েছে, এবার শিক্ষিকা শিক্ষকদের একরাশ ঘৃণার পাত্র করে তুলতে পারলেই ষোলকলা পূর্ণ, বাহবা……!